বিদূষক কারে কয়

শুধু রসিকজন নন, তাঁদের কেউ ছিলেন যোদ্ধা, কেউ বিচারকও। ঈর্ষার কারণে তাঁদের হত্যারও চক্রান্ত চলে। ইতিহাস ঘাঁটলেন বিনোদ ঘোষাল মঙ্গোলিয়ান বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে বাগদাদের খলিফা পাঠিয়েছিলেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে? আকবরের সভার ঐতিহাসিক বদায়ুনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন বীরবলকে! বীরবলের প্রাণ যায় কোনও এক ঈর্ষার কারণে? ষোড়শ শতকে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের দরবারের গ্যাব্রিয়েল ভ্যান্ডারবিল্টই কি এ দেশের গোপাল ভাঁড়?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

মঙ্গোলিয়ান বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে বাগদাদের খলিফা পাঠিয়েছিলেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে?

Advertisement

আকবরের সভার ঐতিহাসিক বদায়ুনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন বীরবলকে! বীরবলের প্রাণ যায় কোনও এক ঈর্ষার কারণে?

Advertisement

ষোড়শ শতকে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের দরবারের গ্যাব্রিয়েল ভ্যান্ডারবিল্টই কি এ দেশের গোপাল ভাঁড়?

‘বিদূষক’ বা ‘ভাঁড়’-এর ইতিহাস, এমনকী লোককথার অন্দরে কতই যে রহস্য! তাঁদের জনপ্রিয় হাস্যরসইগুলি ঠিক কতটা তাঁদের তৈরি, সন্দেহ সে সব ঘিরেও।

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটি গল্প দিয়েই না হয় শুরু করা যাক।

যে-গল্প প্রায় সবারই জানা। যার গড়নটা আবার অদ্ভুত ভাবে মিলে যায় সুকুমার রায়ের বিখ্যাত একটি ছড়ার সঙ্গে।

মোল্লার গল্পে আছে—

নৌকোর মাঝি হয়ে এক পণ্ডিতকে নদী পার করে দিচ্ছেন নাসিরুদ্দিন। এমন সময়ে পন্ডিত শাস্ত্র নিয়ে কী যেন এক প্রশ্ন করলেন নাসিরুদ্দিনকে।

উত্তর দিলেন নাসির। কিন্তু সে উত্তরে কিছু ব্যাকরণগত ভুল থাকায় পণ্ডিত বলে উঠলেন, ‘‘শুধু দাঁড় টানলে হবে? পড়াশুনো কিছুই তো করোনি। জীবনের অর্ধেকটাই তোমার মাটি দেখছি।’’

এর খানিক পরে নদীতে প্রবল ঝড়। নৌকো ডুবি ডুবি। মাঝি নাসিরুদ্দিন এ বার পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনি সাঁতার জানেন তো?’’

‘‘না, তো।’’

‘‘তাহলে তো দেখছি আপনার জীবনের পুরোটাই মাটি।’’

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের এমন অসংখ্য গল্প পুঁথিতে, লোকের মুখে মুখে নানা রূপে আজও ঘোরেফরে। আর তার জেরে নাসিরুদ্দিনের একমাত্র পরিচয়টি হয়ে গেছে এক কিংবদন্তি ব্যঙ্গরসিকের!

কিন্তু সত্যিই কি তিনি তাই?

সে এক রহস্য।

আসুন ঢুকে পড়া যাক সেই রহস্যের ইতিহাসে।

নাসিরুদ্দিন নাকি তুর্কিস্থানের

নাসিরুদ্দিনের জনপ্রিয়তা এতটাই যে, অন্তত সাত থেকে আটটি দেশ দাবি করে হোজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ অল খোয়াই বা মোল্লা নাসিরুদ্দিন তাদের দেশের মানুষ।

তবে তুর্কিস্থানেই যেহেতু মোল্লার কবরস্থান, তাই অনেকেই ধরে নেন, নাসিরুদ্দিন বুঝি ওই দেশেরই মানুষ।

এতটাই তাঁর খ্যাতি যে, আজও প্রতি বছর জুলাই মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে সে-দেশের আকশেহির শহরে ধুমধাম করে নাসিরুদ্দিন হোজা উৎসব পালিত হয়।

তাতে কে না থাকেন! লেখক, শিল্পী, গায়ক, নাট্যকার, অভিনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।

আর তুর্কিস্থানের মানুষ কিন্তু নাসিরুদ্দিনকে ‘মোল্লা’ ডাকেন না, বলেন হোজা—মানে শিক্ষক বা পণ্ডিত।

সেই পণ্ডিত নাসিরুদ্দিনের সমাধিস্থল তুর্কিস্থানের অতি পবিত্র তীর্থস্থান। ১৯৯৬ সালটিকে ইউনেস্কো নাসিরুদ্দিন হোজা বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিল।

পৃথিবীতে আর কোনও বিদূষক এমন সম্মান পেয়েছেন কি না, জানা নেই।

নাসিরুদ্দিন তুর্কিস্থান ও গ্রিসে যেমন হোজা, কাজাকিস্থানে তিনিই আবার কোজা নাসিরুদ্দিন, আরবে জুহা নাসিরুদ্দিন, তাজিকিস্তানে মাস্ফিকি নাসিরুদ্দিন।

শুধু মধ্য এশিয়া বা পূর্ব ইয়োরোপেই নয়, উত্তর আফ্রিকা, ইতালি, ফ্রান্স, চিন, ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও নাসিরুদ্দিন সমান জনপ্রিয়।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে মানুষটা আজ প্রায় আটশো বছর পরেও গোটা পৃথিবীতে সমান জনপ্রিয়, তিনি কি সত্যি সত্যিই নিছক ভাঁড় ছিলেন?

ইতিহাস কিন্তু তা বলছে না। বরং বলছে, ১২০৮ সালে তুর্কিস্থানের হর্তুগ্রামে জন্ম নেওয়া নাসিরুদ্দিন ছিলেন আহি সংঘের একজন নামকরা নেতা। যেমন ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য তেমনই যুদ্ধবিদ্যায় পটুত্ব।

এমনই পরাক্রমী যোদ্ধা ছিলেন তিনি যে, বাগদাদের খলিফা মঙ্গোলিয়ান বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে পাঠিয়েছিলেন এই মোল্লা নাসিরুদ্দিনকেই।

মঙ্গোলিয়ান হানাদারদের আটকানোর জন্য নাসিরুদ্দিনের ভূমিকা নাকি সত্যিই খুব জোরদার ছিল। তাই কি তুর্কিস্থান থেকে আরব, রাশিয়া থেকে চিন এই দেশগুলোতে নাসিরুদ্দিনের এত জনপ্রিয়তা! ওই দেশগুলোতেই তো মঙ্গোলিয়ানদের আক্রমণ সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।

আবার এই প্রবল পরাক্রমী যোদ্ধা মোল্লাই কায়সেরিতে কখনও বিচারকের পদে, আবার কখনও কেনিয়ার রাজা কেকাউস দ্বিতীয়-র সভায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে কাজ করেছেন।

অথচ তিনি কবে কখন কার কাছে বিদূষক বা ভাঁড় ছিলেন তারই কোনও প্রমাণ নেই।

কিন্তু সাধারণের কাছে আজও তিনি বেঁচে বিদূষক হয়েই।

মহেশদাসই তবে বীরবল

তুর্কিস্থানের হোজা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে দিল্লির মহেশদাসের, যাকে আমরা বীরবল নামে চিনি, জীবনের অনেক মিল।

সম্রাট আকবরের দেওয়া বীরবল নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সেই মিল।

কেমন? বলা যাক।

নাসিরুদ্দিন মারা যাওয়ার প্রায় আড়াইশো বছর পর জন্মেছিলেন মহেশদাস।

সংস্কৃতিমনস্ক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই যেমন কবিতা, গান লেখা, গান গাওয়ার ক্ষমতা তেমনই পড়াশুনোতেও মেধাবী।

খুব অল্প বয়েসেই গান-বাজনার পাশাপাশি হিন্দি, সংস্কৃত, পার্সিয়ান ভাষায় পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন তরুণ মহেশ।

একদিন তিনি ডাক পেলেন জয়পুরের মহারাজের রাজদরবারে। রাজামশাই মহেশের স্বরচিত এবং নিজেরই সুর দেওয়া গান শুনে এমন মুগ্ধ হলেন যে মহেশের নাম দিলেন ব্রহ্মকবি। সেই থেকে মহেশ নামটি গেল ঢাকা পড়ে।

দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ব্রহ্মকবির নাম, তাঁর যশ।

ডাক এল রাজা রামচন্দ্রের কাছে থেকেও।

গেলেন ব্রহ্মকবি।

সেখানেও জয়জয়কার।

ওই সময়েরই গুণী মানুষ জগৎবিখ্যাত গায়ক মিঞা তানসেন। শেষে এই দু’জনকেই নিজের সভায় ডেকে নিলেন দিল্লির শাহেনশা আকবর।

ব্রহ্মকবির কাব্যগুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কবিরাজ উপাধি দিলেন বাদশা। শুধু তাই নয়, গান-কবিতার পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যাতেও অমিত ক্ষমতাধর ছিলেন কবিরাজ। আকবর যখন নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করছেন তখন পঞ্জাব ও গুজরাট অভিযানের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে সেই সব যুদ্ধ জিতে ফিরেছিলেন ব্রহ্মকবি।

১৫৭২ সালে আকবর তাঁর এই যোদ্ধা-কবিকেই বিশাল সৈন্যবাহিনী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন শের আফগান কোয়ালিকে তার ভাই হাকিম মির্জার হাত থেকে বাঁচাতে।

সেই যুদ্ধেও জয়ী হয়ে ফিরেছিলেন কবি। আর তার পরেই কবিরাজকে বীরবর উপাধি দিয়েছিলেন আকবর, যা পরে হয়ে যায় বীরবল।

তাহলে কী দাঁড়াল?

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মতো বীরবলও ছিলেন আসলে এক শক্তিশালী যোদ্ধা।

এবং দু’জনেই প্রখর বুদ্ধিমান।

আর বিচক্ষণ মানুষ যে স্বভাবরসিক হবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে সরাসরি ভাঁড়?

কেউ কেউ বলেন, এর পিছনে নাকি আছে অন্য গভীর উদ্দেশ্য! যার মূলে ছিল ঈর্ষা।

সে কেমন? শোনানো যাক।

আকবরের সভার ঐতিহাসিক বদায়ুনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন বীরবলকে। কেন সম্রাট নিজে মুসলমান হয়ে একজন হিন্দুকে এত খাতির করেন, কেন ওই লোকটি সম্রাটের এত কাছের বন্ধু, কেন শাহেনশা সব বিষয়ে ওই বীরবলেরই পরামর্শ নেন।— এই এত শত ‘কেন’ সহ্য হয়নি বদায়ুনির।

সুযোগ পেলেই বদায়ুনি নিন্দা করতেন বীরবলের। বদায়ুনিই বীরবলকে বদফ্রোস বা বিদূষক নামে চিহ্নিত করেন। একজন যোদ্ধা বা মহারাজের বন্ধু, পরামর্শদাতার থেকে একজন ভাঁড় বা বিদূষকের মান যে বেশ কিছুটা নীচে। ঈর্ষান্বিত বদায়ুনির উদ্দেশ্য ছিল, এ ভাবেই বীরবলকে ‘নীচে’ নামানো।

বীরবলের প্রাণ যায় সেই ঈর্ষার কারণেই। সম্রাট আকবরের আরেক সভাসদ জৈন খান চক্রান্ত করে এক যুদ্ধে বীরবলকে আফগান সৈন্যদের দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করান।

শোনা যায়, এর পর মিত্রশোকে কাতর সম্রাট আকবর কয়েক দিন অন্নস্পর্শ করেননি।

এ হেন বীরবলের সঙ্গে জনশ্রুতিতে জুড়ে আছে শ’য়ে শ’য়ে কাহিনি।

তারই একটি যেমন—

পরমপ্রিয় বন্ধু বীরবলকে চোখে হারাতেন আকবর। তাই নিজের প্রাসাদের চৌহদ্দির মধেই বীরবলের জন্য তিনি একটি আগাগোড়া লাল পাথরে মোড়া দোতলা প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। মাঝেমাঝেই আকবর ঢুঁ মারতেন সেখানে বীরবলের সঙ্গে গল্প করতে।

এই রকমই একবার প্রায় মধ্য রাতে সম্রাট কোনও খবর না দিয়েই হাজির বীরবলের প্রাসাদে।

রাতের স্বল্পবাসে বীরবল দরজা খুলে দেখেন সামনে স্বয়ং সম্রাট।

বীরবলকে দেখে আকবর উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠে খানিক ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ‘‘এ কী বীরবল, তোমার এমন ভিখিরির দশা কবে হল!’’

বীরবলের মুখে জবাব সব সময়েই তৈরি। হেসে বললেন, ‘‘আজ্ঞে মহারাজ, নিজের সম্পর্কে আমার কিছুই লুকনোর নেই। যে অবস্থায় আমাকে দেখছেন সেটাই আমার আসল রূপ।’’

রাজপ্রাসাদে রাজার প্রিয় পারিষদের যদি ভিখিরিদশা হয় তাহলে সেই ব্যর্থতা যে আসলে রাজারই, তা ওই কথাতেই বোঝাতে চেয়েছিলেন বীরবল। আর তাঁর কথার প্যাঁচে পড়ে আকবর এ বারও চুপ।

এ ধরনের গল্প বীরবলকে ঘিরে অসংখ্য। তবে সত্যি করেই যে সে সব গল্প বীরবলেরই, তা যাচাই করা কিন্তু মুশকিল।

আসা যাক আরও এক বিদূষকের কথায়। তেনালি রমন।

খুন হয়ে যেতেন তেনালিও

তেনালি রমন। ভারতের আরও এক জনপ্রিয় বিদূষক।

বীরবলের মতোই প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ ভারতের গড়লাপতি রামকৃষ্ণাচার্যালুর সঙ্গেও। যাঁর জনপ্রিয় নামটি হল তেনালি রমন।

বীরবলের মতোই তেনালিও শত্রুর ঈর্ষায় একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। শুধু ফারাকটি এই যে, অন্যের ঈর্ষায় বীরবলের প্রাণ গিয়েছে, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তেনালি পার পেয়েছেন প্রতিবার।

কী ঘটত তেনালির বেলায়? বলার আগে একটু তেনালিকে নিয়ে প্রচলিত গল্পে ঢুকে পড়া যাক।

একদিন তেনালি প্রায় জোর করেই প্রধান পুরোহিতের ঘাড়ে চেপে রাজসভায় ঢুকে পড়েছেন।

তাই দেখে ভীষণ চটলেন রাজামশাই, ‘‘এত সাহস তোমার, রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের ঘাড়ে উঠে পড়া! এই কে আছিস, এক্ষুনি এই পিঠে চেপে বসে থাকা বেয়াদপকে দশ ঘা চাবুক লাগা।’’

তাই শুনে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতের পিঠ থেকে নেমে পড়লেন তেনালি।

বললেন, ‘‘মহারাজ বড্ড ভুল করে ফেলেছি। প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি এখুনি পুরোহিতমশাইকে আমার কাঁধে নিচ্ছি,’’ বলে পুরোহিতকে নিজের পিঠে তুলে নিলেন।

একটু পরেই পেয়াদারা এসে দেখল পুরোহিত তেনালির পিঠে চেপে। তাদের কাছে হুকুম গেছে, যে পিঠে চেপে তাকে চাবকানোর। সুতরাং বেচারা পুরোহিতকেই বেদম মার দিতে শুরু করল তারা।

আরেকটি গল্প যেমন—

একবার শত্রুরা মিলে তেনালিকে জ্যান্ত পুঁতে দিয়ে শুধু মুখটুকু বার করে রাখল হাতি দিয়ে পিষে মারবে বলে।

তেনালি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর শত্রুরা গেছে হাতি আনতে। এমন সময় এক কুঁজওয়ালা লোক তেনালির পাশ দিয়ে যাচ্ছে।

তেনালিকে দেখে সেই কুঁজো জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আরে তুমি এই ভাবে মাটির ভেতর শরীর ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?’’

সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল তেনালির। বলল, ‘‘আর বোলো না, সাধে কি রয়েছি! আমার পিঠে রয়েছে এক মস্ত কুঁজ। তো শুনলাম এখানকার এই মাটি নাকি এত ভাল যে কুঁজ ঢুকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ থাকলে পুরোপুরি কুঁজ কমে যায়। আমাকে ভাই একবার টেনে তুলে দাও তো, দেখি এতক্ষণে কিছুটা কমল কি না।’’

সেই কুঁজো তো তেনালিকে মাটি থেকে টেনে বার করে অবাক। সত্যিই তেনালির একটুও কুঁজ নেই!

কুঁজো এ বার আবদার করল, ‘‘ভায়া এ বার তাহলে আমাকে একটু ভেতরে ঢুকিয়ে দাও দেখি, আমার কুঁজটাও কমিয়ে নিই।’’

‘‘বেশ। দিচ্ছি, তবে একটাই নিয়ম, তুমি কিন্তু চোখ বন্ধ করে আর মাথা হেঁট করে থাকবে। কোনও কথা বলা চলবে না।’’

‘‘আচ্ছা তাই হবে।’’

তেনালি এ বার সেই কুঁজোকে আকণ্ঠ মাটি চাপা দিয়েই চম্পট।

তো, এই হল তেনালির গল্প। এর গল্পের সংখ্যাও কম নয়।

কিন্তু কেন শত্রু হয়ে পড়েছিলেন এই তেনালি রমন? সে প্রসঙ্গে আসতে হলে ওঁর জীবনের খানিকটা অন্তত বলতে লাগে।

বাবা রামাইয়া আর মা লক্ষমাম্মার একমাত্র ছেলে তেনালি। খুব অল্প বয়েসেই বাবাকে হারানোর পর মায়ের হাত ধরে তেনালি চলে আসে মামাবাড়ি।

মায়ের খুব ইচ্ছে ছেলে পণ্ডিত হোক। কিন্তু সেই সময়ের বৈষ্ণব পণ্ডিতরা শৈব তেনালিকে শিক্ষা দিতে রাজি ছিলেন না।

ফলে পড়াশোনা শিকেয়।

সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে, এর ওর বাগানের ফল চুরি করে সময় কাটে ছোট্ট তেনালির। চূড়ান্ত দুষ্টুও সে।

একটু বড় হতে একসময় নিজেই তেনালি বুঝতে পারলেন, লেখা পড়া না শিখলে চিরকাল গরিব হয়েই কাটাতে হবে। অন্তত বেদ-ভাগবৎটা শেখা দরকার।

গ্রামে কয়েকজন শৈব পণ্ডিত ছিলেন। তাঁদের কাছেই গেলেন তেনালি।

তাঁরাও ‘দূর দূর’ করে তাড়ালেন তেনালিকে।— ‘‘শাস্ত্র শিখবি কি রে, যা যাহ্, ভিক্ষে কর, পেটে ভাত জুটবে।’’

তত দিনে জেদ চেপে গেছে তেনালির, পড়াশোনা যে করে হোক শিখতেই হবে। অতএব গাঁয়ের টোলের দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পণ্ডিতদের পড়ানো শুনে শুনে শেখার চেষ্টা শুরু হল। দিনের পর দিন। রোজ যা শোনেন, বাড়ি এসে মাকে তাই শোনান।

এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলেন তেনালি। কপালে জুটল চোর-বদনাম। সঙ্গে বেধড়ক মার।

বাচ্চা ছেলেটির এমন অবস্থা দেখে দয়া হল এক পণ্ডিতের।

তেনালিকে ডেকে তিনি বললেন, ‘‘আমিও তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না, সমাজের নিয়ম আমাকেও বেঁধে রেখেছে। তবে তোমাকে আশীর্বাদ করছি একদিন অনেক বড় হবে তুমি।’’

ফলে আবার রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘোরা শুরু হল তেনালির। কী করবেন জানা নেই। এমনই একদিন মনের দুঃখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে তেনালি হাঁটছেন। এক সন্ন্যাসী দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন তাকে।

‘‘কী হয়েছে বেটা?’’

সব খুলে বললেন তেনালি।

সন্ন্যাসী শুনে বললেন, ‘‘এই বয়েসে স্বরবর্ণ থেকে শুরু করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি এক কাজ করো, ওই কালীমন্দিরে গিয়ে দশ লক্ষ বার মায়ের নাম নাও। তোমার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।’’

শোনা যায়, সন্ন্যাসীর কথা শুনে তেনালি কালীনাম জপ করতে শুরু করেন। এক সময় সত্যি সত্যিই তাঁর কাছে আবির্ভূতা হন দশ মাথাওলা বিকটদর্শনা কালী।

তার রূপ দেখে হো হো করে হাসতে শুরু করে দেন তেনালি।

মা-কালী নাকি তখন তাঁকে হাসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তেনালি বলেছিলেন, ‘‘হাসব না তো কী করব, আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না তোমার যখন সর্দি হয় তখন এই মাত্র দুই হাত দিয়ে দশ মাথার নাক মোছো কী করে!’’

তেনালির বেপরোয়া এমন উত্তর শুনেই নাকি মা-কালী বেজায় খুশি হয়ে তাঁকে বরদান করেন, ‘‘তুই খুব সাহসী আর রসিক। বিজয়নগর রাজার কাছে গিয়ে দেখা কর। রাজা তোকে বিদূষক করে নেবেন।’’

মা-কালীর নির্দেশেই তেনালি রওনা হলেন বিজয়নগরের দিকে।

রাজার সঙ্গে দেখা করার কারণ হিসেবে এই অংশটুকু হয়তো মিথ। সেখানেও দেখা যায়, রাজবাড়িতে ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই তেনালি বাধা পাচ্ছেন রাজপ্রহরীদের কাছে। কিছুতেই তাঁকে সভায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। বুদ্ধিমান তেনালিও ছাড়ার পাত্র নয়। রাজসভায় অংশগ্রহণকারী একটি যাত্রাপালার শিল্পী সেজে ঠিক ঢুকে পড়লেন রাজসভায়। শুধু ঢোকার আগে রাজদ্বারীদের সঙ্গে শর্ত হল, রাজা যদি কোনও পুরস্কার দেন তার অর্ধেক ওই প্রহরীদের দিতে হবে।

এর পর রাজসভায় ঢুকে তেনালি রাজার সামনে এমন সব মজার কাণ্ড করতে থাকলেন যে সবাই হেসে খুন। তার সঙ্গে সত্যিটাও গেল ধরা পড়ে।

তেনালি যে ওই যাত্রাপালার কেউ নয়, তা জানার পর রাজা বললেন, ‘‘তোমার শাস্তি একশো ঘা চাবুক।’’

তেনালি বললেন, ‘‘আপনার হুকুম শিরোধার্য। তবে আমি আপনার দ্বারীদের কাছে চুক্তিবদ্ধ মহারাজ। এই রাজসভায় আমি যা পাব, তার অর্ধেক ওদের দেব বলে কথা দিয়েছি। সুতরাং পঞ্চাশ আমার আর বাকি পঞ্চাশ ওদের প্রাপ্য।’’

উত্তর শুনে অভিভূত রাজা কৃষ্ণদেব রায়া। বললেন, ‘‘তুমি যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই রসিক। আজ থেকে আমার সভায় তুমি বিদূষক হিসাবে নিযুক্ত হলে।’’

স্বপ্ন তো পূরণ হল। আর এর পরেই শুরু হল আসল গল্পটা।

বীরবলের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল ঠিক তাই-ই ঘটতে থাকল তেনালির ক্ষেত্রেও। স্বভাব-কবি, বুদ্ধিমান, রসিক তেনালি খুব দ্রুত জনপ্রিয় আর রাজামশাইয়ের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে লাগলেন। রাজসভার সুকবি তেনালি অক্ষরজ্ঞানহীন হয়েও মুখে মুখে কবিতা রচনায় মুগ্ধ করতেন। কিন্তু শত্রুও বাড়তে থাকল দিনে দিনে।

একে ঠোঁটকাটা, তার ওপর আবার কট্টর ব্রাহ্মণ্য-সংস্কার বিরোধী। গ্রাম্য-অশিক্ষিত বলে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ার রাজত্বের পণ্ডিতরা তার ওপর মহা খাপ্পা।

সব মিলিয়ে শত্রু আকাশছোঁয়া।

বহু বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও বর্শায় গেঁথে, কখনও হাতির পায়ের তলায় পিষে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতিবারই তেনালি বেঁচে গিয়েছেন।

আর কী অদ্ভুত, দীর্ঘ এগারো বছর ধরে রাজার বিদূষক হিসেবে কাজ করার পর তেনালি মারা গেলেন শেষে শত্রুর কামড়ে নয়, সর্পদংশনে!

নাসিরুদ্দিন। বীরবল। তেনালি। —এই যে তিন জগৎবিখ্যাত বিদূষক, একমাত্র বীরবল ছাড়া বাকি দু’জনের জীবনের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণই প্রায় নেই।

পুরোটাই লোকশ্রুতি।

আর লোকশ্রুতিতে যা ঘটে। কল্পনার মিশেল হতে হতে একসময় আসল নকল বোঝা দায় হয়ে যায়, এঁদের ক্ষেত্রেও তাই। এইসব বিদূষকদের নিয়ে যেসব মজার কাহিনি গ্রন্থিত, সে সব কাহিনি সেই ধাঁচেরই।

যে ঘটনা মোল্লার গল্পে থাকে, সেই একই কাণ্ড আবার বীরবল বা তেনালির গল্পেও।

আসা যাক গোপাল ভাঁড়-এ।

কে এই গোপাল ভাঁড়

ইতিহাস যে বিদূষকদের জীবনের ব্যাপারে খুবই উদাসীন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বাংলার গোপাল ভাঁড়।

তাঁর গল্প নিয়ে অসংখ্য বই।

সে সব গল্পে গোপাল কখনও রঙ্গেব্যঙ্গে রাজামশাইকেও লোকশিক্ষা দিচ্ছেন।

এমনই একটি প্রচলিত গল্প যেমন—

একবার রাজসভায় গোপাল মহারাজকে বললেন, ‘‘মহারাজ আমাদের রাজ্যে কিছু বৌদ্ধভিক্ষুক এসেছেন। এদেঁর পোশাক শতচ্ছিন্ন এবং ভিক্ষা না জুটলে কিছুই খান না। আপনি অনুগ্রহ করে এঁদের জন্য এক হাজার চাদর দান করুন।’’

মহারাজের তখন খরচের নেশা পেয়ে বসেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে দিলেন, ‘‘তাই হবে, আমি এখনই নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি।’’

রাজসভায় উপস্থিত তখন এক বিদেশি পর্যটক। তিনি খুব অবাক হয়ে মহারাজের অনুমতি নিয়ে গোপালকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘‘ভিক্ষু তো এসেছে মাত্র কয়েক জন, তাহলে হাজার চাদর কেন?’’

গোপাল বললেন, ‘‘এই রাজ্যে কয়েক জন, কিন্তু এঁদের বাকি সঙ্গীরা এসেছেন নবদ্বীপ, মায়াপুর, শান্তিপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আর সকলেরই এক পরিস্থিতি।’’

‘‘আচ্ছা বেশ, কিন্তু তারা সে পুরনো পোশাকগুলো ছেড়ে এই নতুনগুলো পরবেন, তাহলে পুরনোগুলোর কী হবে?’’

‘‘পুরনোগুলোর ভাল অংশটুকু কেটে নিয়ে তাঁরা বসার আসন বানাবেন।’’

‘‘খুব ভাল, আর থলের পুরনো বসার আসনগুলোর কী হবে?’’

‘‘সেগুলো দিয়ে বালিশের ওয়াড় তৈরি হবে।’’

পর্যটক পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘‘তাহলে পুরনো বালিশের ওয়াড়গুলো নিয়ে তারা কী করেন?’’

‘‘সেগুলো যেহেতু একেবারেই নষ্ট হয়ে যায় তাই ওগুলোকে কুচি কুচি করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তারা ঘরের দেওয়ালে প্রলেপ দেন।’’

‘‘তাহলে দেখছি কোনও কিছুই নষ্ট করেন না তারা!’’ বিস্মিত হয়ে বললেন পর্যটক।

গোপাল তখন মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘মহারাজ এই বৌদ্ধভিক্ষুরা কোনও জিনিসেরই অপচয়কে প্রবলভাবে ঘৃণা করেন। কারণ অপচয় মানে হল গরিব মানুষকে ঠকানো।’’

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বুঝতে পারলেন গোপাল আসলে এই কথাগুলো তাঁকেই উদ্দেশ্য করে বলছেন। এবং পরদিন থেকেই তিনি নিজের আচরণ সংযত করলেন।

তবে জীবনরসিক গোপাল ভাঁড় শুধু যে রাজাকে লোকশিক্ষা দিতেন এমন নয়, অনেক সময় সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতেনও।

এমনই একটি গল্প যেমন—

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল দু’জনে ছদ্মবেশ বেরিয়েছেন রাজ্যের হালচাল দেখতে।

বাজারে এক বৃদ্ধা বসে আছেন সামনে কিছু মাছ রেখে। আর তার মাথার ওপর টিনের ওপর খড়ি দিয়ে লেখা ‘এখানে টাটকা মাছ পাওয়া যায়’।

গোপাল আর রাজামশাই জায়গাটি ছেড়ে এগোতে যেতে হঠাৎই দেখলেন, সেই বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে টিনের লেখাটা নিজেই খুব মন দিয়ে পড়লেন। তারপর প্রথমে ‘টাটকা’ শব্দটা মুছে দিলেন।

তারও একটু পরে ‘এখানে’ শব্দটা আর তারপর ‘মাছ পাওয়া যায়’ কথাটাও মুছলেন।

তাঁর কাণ্ড দেখে রাজা আর গোপাল বেশ কৌতূহলী হয়ে বৃদ্ধার কাছে গেলেন।

গোপাল বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘লেখাটা তো ঠিকই ছিল, মুছে দিলেন কেন? আর মুছলেনই যদি পুরোটা একবারে মুছলেন না কেন?’’

বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, ‘‘আমি প্রথমে ‘টাটকা’ শব্দটা মুছে দিলাম। কারণ এখানে কে আর পচা মাছ বেচে? তারপর মুছলাম ‘এখানে’ শব্দটি। কারণ আমি তো এখানেই বসে রয়েছি মাছ নিয়ে, সকলেই দেখতে পাচ্ছে, তাহলে আর লেখার দরকার কী? আর তারপর মনে হল খদ্দেররা এলেই দেখতে পাবে আমি শুধু মাছই বিক্রি করছি, অন্য কিছু নয়। সুতরাং মাছ পাওয়া যায় কথাটারও কোনও মানে হয় না। তাই শেষে সেটাও মুছে দিলাম।’’

গোপাল আর মহারাজ বুঝলেন অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কথা শুধু বোকামি নয়, অনেকটা বাড়তি খরচের নামান্তর।

এ তো গেল জনশ্রুতির গোপাল ভাঁড়, যাকে প্রায় সকলেই চেনেন। কিন্তু এই গোপাল ভাঁড় বলে সত্যিই কি কেউ ছিলেন?

আসা যাক সেই প্রশ্নে।

এই অংশে এসে দেখা যায়, গোপাল ভাঁড়ের বংশধর বলে দাবিদার নগেন্দ্রনাথ দাসের ‘নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ বইটিকেই এক অর্থে, একমাত্র প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে ধরা ছাড়া আর গতি নেই।

অনেক প্রশ্ন ওঠে গোপালকে নিয়ে—

গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে, কোথাও লেখা নেই।

গোপালের জন্মস্থান? নথি নেই তারও।

কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে তার জমি জায়গার হিসেবনিকেশ? ঘুণাক্ষরে তারও উল্লেখ নেই কোত্থাও।

এমনকী গোপালের কোনও ছবি কেউ কখনও দেখেনি।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গোপালের যে অয়েলপেন্টিংটি রয়েছে, তা যে আদৌ গোপাল ভাঁড়, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরও লক্ষ করার মতো বিষয় হল, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নসভার রাজকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর মহারাজ, তাঁর রাজত্ব এবং সভাসদদের সম্পর্কে কাব্যগ্রন্থ লিখে গেলেও কোথাও গোপালের নামোল্লেখ করেননি।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহাফেজখানায় গোপালের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনও দলিল-দস্তাবেজও নেই।

সমসাময়িক অন্য কোনও রচনাতেই গোপালের নাম পাওয়া যায় না। এমনকী গোপালের নিজেরও কোনও লেখাপত্রও পাওয়া যায় না কোথাওই।

সব থেকে আশ্চর্যের কথা, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নসভার যে অন্যতম সদস্য ছিলেন কবি ভারতচন্দ্র, তিনি তাঁর রচনায় রাজসভার দুই কৌতুকী পারিষদের নাম নিয়েছেন তার রচনায়। তার মধ্যে একজন হলেন শঙ্কর তরঙ্গ, অপর জন বলরাম।

ভারতচন্দ্র লিখেছেন—

অতিপ্রিয় পারিষদ শঙ্কর তরঙ্গ

হরষিতে বলরাম সদা রঙ্গভঙ্গ।

এই রঙ্গ-ব্যঙ্গকারীর তালিকায় গোপাল কই! ভারতরত্ন কি তাহলে ইচ্ছে করেই তাঁর কোনও রচনায় উল্লেখ করেননি গোপালের নাম। নাকি গোপাল বলে আদৌ কেউ ছিলেন না? সন্দেহ এখানেও।

এমনকী ওই পঞ্চরত্নের আরেক রত্ন রামপ্রসাদও তার কোনও লেখাতেই গোপালের নাম করেননি একবারের জন্যও।

অথচ শোনা যায় এঁরা দু’জন নাকি খুব ভাল বন্ধু ছিলেন।

তাহলে? রহস্যটা কী?

গোপাল গেলেন কই?

চলেছে গবেষণা।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এত কাছের এত প্রিয় একজন মানুষ সে কি না মাত্র আড়াইশো বছরের মধ্যেই বেমালুম বেপাত্তা! এ তো হতে পারে না।

গবেষকদের মধ্যে অধ্যপক সুকুমার সেন তো বলেই দিয়েছেন গোপাল ভাঁড়ের কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

এ দিকে লেখক পরিমল গোস্বামী বলেছেন বেশ চমকদার একটি কথা। ‘নদীয়া মুকুর’ নামে একটি পত্রিকা-র গোপাল ভাঁড় সংখ্যায় পরিমল লিখছেন, অষ্টাদশ শতকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড় নামে কোনও বিদূষক ছিলেন বলে পণ্ডিতরা অন্তত স্বীকার করেন না।

অথচ জনশ্রুতিতে গোপাল সব থেকে বেশি বিখ্যাত। পরিমল লন্ডনে থাকার সময় গোপাল ভাঁড়ের ওপর অনেক গবেষণা করে শেষে বলছেন ‘‘ষোড়শ শতকে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের দরবারে গ্যাব্রিয়েল ভ্যান্ডারবিল্ট নামে একজন বিদূষক ছিলেন। খুব কাজের চাপের মধ্যে মাঝে মাঝে নিজের মন হাল্কা করার জন্য রানি এই বিদূষককে মাইনা দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন। এই গ্যাব্রিয়েলকে এলিজাবেথ ডাকতেন ‘গেবল ভ্যান্ড’ বলে। এই গ্যাবলের নামই এই দেশে ঘুরতে ঘুরতে একসময় গোপাল ভাঁড় হয়ে গেছে।’’

কিন্তু পরিমল গোস্বামীর এই যুক্তি আবার অনেকের না-পসন্দ।

তাঁদের কথা, একজন বিদেশিকে খামোখা এই গ্রামবাংলার মানুষ নিজেদের এত আপন করে নেবেনই বা কেন?

আর ইতিহাস বলছে, রানির গ্যাবল ভান্ড ছাড়া আরও অনেক বিদূষক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে হঠাৎ গ্যাবল ভান্ডই বা গোপাল ভাঁড় হয়ে উঠবেন কেন?

আর গোপালের জীবনের ইতিহাসে বেশ কিছুটা রহস্যজনক হলেও যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু একেবারেই অলীক কল্পনা হয়তো নয়।

যেমন, গোপালের বাবা দুলালচন্দ্র নাই ছিলেন নবাব আলিবর্দী খানের চিকিৎসক। জাতে নাপিত হলেও তিনি কোনও কালেই ক্ষৌরকর্মের অতি প্রয়োজনীয় দুটি উপকরণ, খুর কিংবা জলের ভাণ্ড বা ভাঁড় ধরেননি।

শোনা যায়, ছোটবেলায় রাজপুত্র সিরাজ একবার দুরারোগ্য ব্যাধিতে প্রায় মৃত্যুশয্যায় চলে গিয়েছিলেন। তখন এই দুলালচাঁদই চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তোলেন সিরাজকে।

দুলালচাঁদের ছিল দুই ছেলে। বড় ছেলে কল্যাণ আর ছোটজন হলেন গোপাল।

ওই সময়ে রাজা রামমোহন রায়ের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন নবাবের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি কল্যাণকে খুব ভালবাসতেন। তিনিই একসময় কল্যাণ এবং তাঁর ভাইকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসেন।

অল্প বয়স থেকেই গোপাল ছিলেন খুব বুদ্ধিমান আর তেমনই সুপুরুষ। তাঁর বুদ্ধির কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যে।

গোপালের কথা কানে যায় নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের কানেও। গোপালকে তিনি ডেকে পাঠান সভায়। ধর্মশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য, রসবোধ এবং বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নিজের পঞ্চরত্নে ঠাঁই দেন গোপালচন্দ্র নাইকে।

তাহলে ভাঁড় হলেন কী করে গোপাল?

সেও এক কাহিনি।

কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে এতটাই ভালবাসতেন যে নিজের পাকশালা বা ভান্ডারার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁকে। বোধ হয় সেই থেকেই তিনি হয়ে যান ‘গোপাল ভান্ডারী’। এই ভান্ডারী-ই ক্রমে ‘ভাঁড়’ হয়ে যায়। এর সঙ্গে ভাঁড়ামোর কোনও সম্পর্ক নেই।

শেষ জীবন পর্যন্ত মহারাজের সব থেকে প্রিয়পাত্র, বন্ধু ও পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন গোপাল।

সব বিদূষকের মতো গোপালেরও সত্যি কথাটা বলতে কোনও দিনই মুখে আটকায়নি।

এমনকী এও শোনা যায়, পলাশির যুদ্ধের আগে কৃষ্ণচন্দ্র যখন জগৎশেঠ, মিরজাফরদের সঙ্গে চক্রান্ত করছেন সিরাজকে গদিচ্যুত করার, তখন এই গোপালই বার বার মহারাজকে বারণ করেছিলেন এই ভুল না করার জন্য।

ইংরেজ ক্ষমতায় এলে মহারাজও যে পার পাবেন না, সে কথা একাধিকবার পরম বন্ধুর মতোই মহারাজকে বলেছিলেন তিনি।

তাঁর কথায় কান দেননি কৃষ্ণচন্দ্র। তার ফলও শেষমেশ ভুগতে হয়েছিল নদিয়াধিপতিকে।

সে-ইতিহাস সকলের জানা।

ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন বার বার জাগে, এত ঘটনার পরেও তাহলে ইতিহাসে গোপালের নাম কই? নাম নেই। সন্দেহ, সেই ঈর্ষাই গোপালকে ‘ভাঁড়’ করে তোলে।

কারও কারও মতে, জনপ্রিয়তার দিকে গোপালই যে সব থেকে এগিয়েছিলেন তা বুঝতে বাকি ছিল না রাজসভার গুণিজনদের। তাই খুব সচেতনভাবেই নিজেদের রচনায় প্রায় সকলের নাম রাখলেও গোপালের নামটি এড়িয়ে গেছেন তাঁরা।

আরও অনেকে মিলে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন এই বিপুল প্রতিভাবান মানুষটিকে।

ফলে জনশ্রুতিতে সুদর্শন গোপাল হয়েছেন টাকমাথা, বেঁটে ভুঁড়িওয়ালা এক ভাঁড়। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে মোটা দাগের আজগুবি গল্প। বছর বছর ধরে শুধু কল্পনাতে বেঁচে বাংলার সেরা বিদূষক? আসল মানুষটাকে আজও খুঁজে পাওয়া গেল না!

বিদূষকদের কেউ ছিলেন যোদ্ধা, কেউ কবি, কেউ গায়ক, আবার কেউ বিচারক। আর এসবের সঙ্গে ছিল তীক্ষ্ণ রসবোধ আর স্পষ্টবাদিতা— আর সেই কারণেই হয়তো এঁদের বাকি সব পরিচয় মুছে দিয়ে শুধু ভাঁড় বা বিদূষক বলে আজও চিহ্নিত করার আপ্রাণ চেষ্টা।

তবু ইতিহাস থেকে একেবারে মুছে দেওয়া যায়নি বিদূষকদের।

বরং হারিয়ে গেছেন বহু মোসায়েব।

ঋণ: নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়, বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা, গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে, নদীয়া মুকুর (গোপাল ভাঁড় সংখ্যা), Raja Birbal- Life and Times, South Indian clowns,

Tales of jestors, The secret life of corporate jestor

মহিলা বিদূষক

বিদূষক মানে কি শুধুই পুরুষ? মহিলারা বিদূষক কি কোন ওকালেই ছিলেন না?

হ্যাঁ ছিলেন।

এই মহিলা বিদূষকদের নিয়োগ করতেন রানিরা। স্তাবকতা আর নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগলে তখন ‘রানি’ ডাক দিতেন তাঁর বিদূষিকাকে।

রোজের তোয়াজ আর খোশামোদের বদলে তখন তার বিদূষিকার ব্যঙ্গে ভরা অপ্রিয় সত্যিকথাগুলো শুনতেই ভাল লাগত বেশি। সোজা কথা, মুখ বদল আর কী!

তবে এমন মহিলা বিদূষকের এশিয়ায় তেমন কোনও খোঁজ না পাওয়া গেলেও ইউরোপে বেশ কয়েকজন অতি জনপ্রিয় বিদূষিকা ছিলেন বলে জানা যায়।

তাঁদের মধ্যে স্কটিশ সম্রাজ্ঞী মেরি স্টুয়ার্টের বিদূষিকা লা জার্ডিনার ছিলেন খুবই জনপ্রিয়।

আবার ফরাসি রাজদরবারে ম্যাথুরিন লাফোল নামের এক বিদূষিকাও ১৬০০ সালে খুব নাম করেছিলেন।

শুধু মারিয়া বা ম্যাথুরিন নয়, স্প্যানিশ সম্রাজ্ঞী ইসাবেনের বিখ্যাত মহিলা বিদূষক ছিলেন মারিয়া বারবারা অ্যাস্কুইন।

পাঁচ-দশ বছর নয়, পুরো পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি রানির একান্ত অনুগত পরামর্শদাতা এবং মনোরঞ্জক হিসেবে কাজ করেছিলেন।

বিদূষকরা কি আজ আর নেই?

নাকি আধুনিক পৃথিবীতে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে?

না, তা কিন্তু নয়, আজও তাঁরা আছেন। শুধু আগে যেমন রাজদরবারে থাকতেন রাজার অনুচর হয়ে, এখন তাঁরা থাকেন কোনও ধনকুবের শিল্পপতি কিংবা কিছু কর্পোরেট সেক্টরেও।

সৌদি আরবের অন্যতম ধনী প্রিন্স আওয়ালিদ বিন তালালের কথাই বলা যাক। বিশ্বের তেরোতম ধনী হিসেবে ধরা হয় তাঁকে।

২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক বিন তালাল কাজের চাপে পাগল। তাই মন হাল্কা রাখার জন্য নিয়োগ করেছেন বেশ কয়েকজন বিদূষককে। তিনি এঁদের নাম দিয়েছেন কর্পোরেট জেস্টর।

কী কাজ তাঁদের?

তালাল যখন তাঁর নিজের বিমানে চেপে এ দেশ থেকে অন্য দেশে যান তখন তাঁর ব্যক্তিগত বিদূষকরা ওই সময়ে তাঁকে নানা হাসি মজার গল্প আর কান্ড করে হাসাতে থাকে। যে বেশি হাসাতে পারবে সঙ্গে সঙ্গে মিলবে ইনাম।

আমাদের দেশে এই কর্পোরেট জেস্টর ব্যাপারটি খুব জনপ্রিয় না হলেও আধুনিক বিশ্বে প্রথম কর্পোরেট জেস্টর নিয়োগ করে এক বিখ্যাত এয়ারওয়েজ সংস্থা।

আধুনিক পৃথিবীতে প্রথম কর্পোরেট জেস্টরের নাম হল পল বার্চ। এই পলই মোটা মাইনের বিনিময়ে ওই এয়ারওয়েজে কর্পোরেট জেস্টর হিসেবে কাজ করেন।

কী কাজ করতেন সেখানে?

চিরকাল একজন বিদূষকের আসল যা কাজ, তিনি তাই-ই করতেন। অর্থাৎ, হাসি মজার ছলে রাজাকে বা কোম্পানির সর্বোচ্চ পরিচালকদের কোম্পানির আসল সমস্যা ও তার সমাধানের পথ বাতলে দিতেন। যেটা কেউ ভাবেনি সেটা ভাবা, যেটা কেউ বলতে পারেনি, সেটাকেই মুখের ওপর বলে দেওয়া।

এই কাজ করতে গিয়ে একসময় বিপদও ঘটে যায় তাঁর জীবনে। কোম্পানির একটি বিষয়ে ‘অযথা নাক গলানো’র অভিযোগে তাঁকে চাকরিটি ছাড়তে হয়, কিন্তু এয়ারওয়েজে থাকাকালীন তিনি যা কাজ করে গেছেন, তা সত্যিই অভিনব।

চাকরি ছাড়ার পর অবশ্য পলকে বসে থাকতে হয়নি। তখন নাসিরুদ্দিন বা বীরবলের মতোই তাঁর নাম।

নিজেই খুলে ফেলেন একটি নিজস্ব কনসালটেন্সি। তাঁর ক্লায়েন্ট লিস্টে যোগ হল দুনিয়ার নামী কর্পোরেট হাউজের কয়েকটি।

শুধু পল নয়, ডেভিড রাইভনেস নামে আরেক ব্রিটিশ নাগরিকও ‘কর্পোরেট জেস্টর’ নামে একটি সংস্থা খুলে ফেলেছেন।

ডেভিড নিজেই সেই সংস্থার সিইও। উদ্দেশ্য কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে কৌশল ঠিক করতে সাহায্য করা।

আজ ডেভিডের কনসালটেন্সিদের মধ্যেও রয়েছে পৃথিবীর তাবড় নামকরা কোম্পানি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement