ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছিল। তাই গাড়িতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সফরশেষে যখন পৌঁছলাম শ্রীরামপুরের ওই বাড়িতে, সাতসকালে লেপের ওম ছেড়ে বেরোনোর অনিচ্ছেগুলো এক মুহূর্তে উধাও। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে প্রাসাদোপম এক অট্টালিকা! আমাদের স্বাগত জানাতে দরজায় দাঁড়িয়ে বর্তমান গৃহকর্তা প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। সেখানে তাঁকে সঙ্গত দিচ্ছে ধবধবে সাদা পাথরের তৈরি দুই সিংহও।
বর্ধমানের দেবীপুরের এই ভট্টাচার্য-পরিবার দেশভাগের আগেই যশোরে চলে যান। ১৮৬০ সালের মধ্যভাগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আদেশে সংস্কৃতের পণ্ডিত কালীনাথ ভট্টাচার্য চলে আসেন শ্রীরামপুরে। সেখানকার জমিদারবাড়ির ‘দে’ পরিবারের বাচ্চাদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন কালীনাথ। সেই শুরু দে স্ট্রিটে এই পরিবারের বাস।
কালীনাথের ছেলে দুর্গাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য চিকিৎসক হওয়ার চেষ্টা করলেও পরে পেশা হিসেবে বেছে নেন বাড়ি তৈরির কাজ। উনিশ শতকের শুরুর দিকে দ্য ক্যালকাটা কেনেল ক্লাবের ডগ শোয়ে প্রথম ব্রিটিশদের নজরে আসেন দুর্গাপ্রসন্ন। তার পর ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে তৈরি করতে থাকেন একের পর এক জুট মিল, সরকারি-বেসরকারি বাড়ি। তখনই শ্রীরামপুরে গড়ে তোলেন ‘ইউনিক লজ’। দুর্গাপ্রসন্নের মৃত্যুর পর বাড়ির খেয়াল রাখতে শুরু করেন তাঁর ছেলে নিখিলেশ ভট্টাচার্য। তাঁর বিয়ে হয় চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের বড় নাতনি পদ্মিনীর সঙ্গে। নিখিলেশের অবর্তমানে এখন মা পদ্মিনী ও ছেলে প্রদীপ্তই বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন ওই পুরনো বাড়ি।
সিংহদের পিছনে ফেলে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই ডান হাতে তিন খিলানের ঠাকুরদালান। এক সময় এখানেই জাঁকজমক করে বছরভর হত পুজো। কয়েক পা এগোতেই চোখ জুড়িয়ে দেওয়া শ্বেত পাথরের ফোয়ারা। দীপাবলি হোক বা বিশেষ অনুষ্ঠান... রঙিন ফুল, ভাসমান বাতিতে সেজে ওঠে ফোয়ারা। তার চার পাশে রাখা কাস্ট-আয়রনের চেয়ারের গায়ে রং মিলিয়ে সাদা প্রলেপ। ইতিউতি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ গাছের ডালপালা। ফোয়ারার ধারে যদি চেয়ারে এসে বসা যায়, পেতে পারেন মার্বেলের তৈরি ম্যুরাল রমণীদের সঙ্গও। আর এক লহমায় উবে যাবে যত সান্ধ্যকালীন মনখারাপ!
এ বাড়ির ড্রয়িং বলতে দুটো। একটা তুলনায় ছোট, ঘরের মাঝখানে বড় গোল টেব্ল। ইতালীয় মার্বেলের উপর আগ্রার কারুকাজে চোখ আটকে যাবেই। কারণ টেব্লের মধ্যমণি যে উজ্জ্বল এমারেল্ড! সেই ঘরেই গ্রামোফোন। এ বাড়িতে সপ্তাহান্তের সন্ধেয় কলের গানে বেজে ওঠে পুরনো শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত। ছোট ড্রয়িং রুম থেকে বেরোলে ডাইনিং স্পেস। পুরনো কালচে ভারী আসবাবে এখানে থমকে রয়েছে সময়। ঘরের দু’দিকে আয়না, তিন দিকে দরজা। দেওয়ালে ঝুলছে পরিবারের নানা প্রজন্মের আঁকা পেন্টিং। সামঞ্জস্য বজায় রেখে রয়েছে ভারী কাঠের ডাইনিং টেব্ল, চেয়ার। হলদেটে আলোয় ডাইনিং রুমের দেওয়ালের রং যেন আরও খোলতাই। ডাইনিং রুম থেকে বেরোলেই হেঁশেল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রান্নাঘরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সাবেকিয়ানাও সেখানে বাস করছে বহাল তবিয়তে। হেঁশেলের ঠিক পাশেই পুরনো দিনের ভাঁড়ার ঘর। দেওয়ালের সঙ্গে গাঁথনি দিয়ে তৈরি হয়েছে সিমেন্টের তাক। পুরনো বা়ড়ির নিয়ম মেনে তোলা রয়েছে শিকে।
ছোট-বড় মিলিয়ে এ বাড়িতে প্রচুর ঘর। তবে মাস্টার বেডরুমে হলুদের খেলা। কাঠের কারুকাজ করা বিছানায় গুজরাতি কাজের চাদর। সারা ঘর জুড়েই কাঠের দেরাজ, আয়না, আলনা, সিন্দুক। সঙ্গে রয়েছে হলদেটে আলো। এ বাড়ির দালান, করিডোর... সব কিছু জুড়ে দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে রয়েছে পেন্টিং, বাহারি আয়না। বেশির ভাগ পেন্টিংয়ের উপরে জড়ানো পোশাক তৈরি করেছে ত্রিমাত্রিক ছোঁয়া। ইতিউতি সযত্ন রাখা পুরনো রেডিয়ো, বাতিদান, রুপোর গাছ।
দোতলায় সবচেয়ে নজর কাড়বে যা, তা হল ‘নতুন সদর’। অর্থাৎ এ বাড়ির মাস্টার ড্রয়িং রুম। এক সময়ে এখানেই বসত বিশেষ অতিথি সম্মানের আসর। সুবিশাল ড্রয়িং রুমের সিলিংয়ে হলদে ও গাঢ় মেরুনের ছোঁয়া। ঝুলছে মানানসই ঝাড়বাতি। মেঝেয় পুরু গালচেয় পা ডুবে যাবে আপনার। সোফাসেটের উপর রুচিশীল ভাবে সাজানো সুতোর কাজ করা কুশন। দেওয়ালে বাড়ির পূর্বপুরুষদের ছবি। ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়ানো কাচের শো-পিস, পুরনো দিনের গাড়ির খেলনা মডেল, কুকুরের ছবি, দেশ-বিদেশ সেঁচে আনা মণিমুক্তোসম হাজারো জিনিস। কোথাও ঘাঁটি গেড়েছে বিদেশি পুতুলের পশরা, আবার কোথাও বহাল তবিয়তে জাঁকিয়ে বসেছে নাগ়রাই পরা বিদেশি গন্ডার! পুরনো দিনের বড় ঘড়ি ঘণ্টা বাজিয়ে রাজকীয় ভাবে জানান দিয়ে যায় সময়ের। ঘরের একপাশে রাখা বিরাট পিয়ানো।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ‘নতুন সদর’-এর পিছনের গুপ্ত ঘর! ঠিক যেমনটা আমরা দেখে এসেছি সিনেমার পরদায়। ঠিক যেমনটা থাকত পুরনো দিনের বড় বাড়িগুলোতে। ড্রয়িংয়ের একটি দেওয়ালের এক কোনায় রাখা রয়েছে বেশ বড় একটা আয়না। কাঠের ফ্রেমে সূক্ষ্ম নকশা। কিন্তু ভাল করে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেই আয়নারই নীচে ছোট্ট ছিটকিনি। যা খুললে আয়না সোজাসুজি রূপান্তরিত হয় দরজায়। প্রকাশ্যে আসে বাহারি আয়নার পিছনে লুকিয়ে থাকা ঘর। এখন অবশ্য সেখানে রাখা আছে শুধুই আসবাব!
বাড়ি থেকে যখন বেরোই, তখন রোদ পড়ে এসেছে। নরম আলোয় ভিজে যাচ্ছে ফেলে আসা বাড়িটার চৌকাঠ, ঠাকুরদালান, সিঁড়ির রেলিং, ম্যুরাল। আর মনের এক টুকরো পড়ে রয়েছে পুরনো সময়ে মোড়া সেই বাড়ির অন্দরমহলে।
ছবি: দেবর্ষি সরকার