অপ্রকাশিত জীবনানন্দ দাশ

উজ্জ্বল উদ্ধার

চেয়েছিলেন বাংলা ছায়াছবির জন্য গান লিখতে! অসংখ্য রচনা রেখেছিলেন বাক্সবন্দি। তিনি জীবনানন্দ দাশ। হেমন্তের কবির রহস্যেঘেরা জীবন-সড়কে হাঁটলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যতাঁর জীবনকালে জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুশোর একটু বেশি, অথচ মৃত্যুর ষাট বছরে তোরঙ্গ থেকে উদ্ধার হয়েছে অসংখ্য অসূর্যম্পশ্যা কবিতা! পাতার পর পাতা থেকে সেই হস্তাক্ষর, সেই কণ্ঠস্বর, সেই শৈলী, সেই মানুষ আর তাঁর নির্জনতা ঝরে পড়ছে। তাঁর প্রিয় ইয়েটস-এর ভাষায় এও এক ‘সেকেন্ড কামিং’, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন জীবনানন্দের এক অভিনব ‘সম্ভবামি’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share:

তাঁর জীবনকালে জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুশোর একটু বেশি, অথচ মৃত্যুর ষাট বছরে তোরঙ্গ থেকে উদ্ধার হয়েছে অসংখ্য অসূর্যম্পশ্যা কবিতা!

Advertisement

পাতার পর পাতা থেকে সেই হস্তাক্ষর, সেই কণ্ঠস্বর, সেই শৈলী, সেই মানুষ আর তাঁর নির্জনতা ঝরে পড়ছে। তাঁর প্রিয় ইয়েটস-এর ভাষায় এও এক ‘সেকেন্ড কামিং’, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন জীবনানন্দের এক অভিনব ‘সম্ভবামি’।

তবে এও সত্যি যে, কবির মরণোত্তর জীবনই ঢের বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ১৯৫৪-য় ২২ অক্টোবর তাঁর অকাল প্রয়াণের পর। ১৯৪৮-এর মে-জুন মাসে রচিত তাঁর দুই উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’ প্রকাশনার আলো দেখল তাঁর মৃত্যুর পর। লেখার দু’বছরের মধ্যে এর একটি প্রকাশ পেলেও পেতে পারত, পায়নি। সেটা ১৯৫০-এ ‘পূর্বাশা’ সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা একটা চিঠিতে ধরা পড়েছে। কবি লিখছেন—

Advertisement

‘‘বেশি ঠেকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি চার-পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন।

এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি, পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাব। আমার একটি উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়— ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপতে পারেন; দরকার বোধ করলে পাঠিয়ে দিতে পারি, আমার জীবনস্মৃতি আশ্বিন কিংবা কার্তিক থেকে পূর্বাশা’য় মাসে মাসে লিখব। সবই ভবিষ্যতে, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই— আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এ রকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেক দিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন— সে জন্য গভীর ধন্যবাদ।’’

চিঠির ‘সবই ভবিষ্যতে’ কথাটা ব্যঞ্জনাময়। কত কি‌ছুই যে লেখার পরিকল্পনা মাথায়, অথচ লেখা হয়ে গেছে এমন অজস্র কিছু সম্পর্কে কী নির্ভার (নাকি গুরুভার?) উদাসীনতা! তাঁর পাণ্ডুলিপির ছবি দেখলেই স্পষ্ট হয় ওঁর ওই অপরূপ মরমি পঙ্‌ক্তি সব কত সচেতন কাটাকুটি পেরিয়ে, প্রায় সীতার মতো অগ্নিপরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে কবিতায় এসেছে; — তা হলে এত কিছুর পরও তারা কেন, কী ভাবে কুমারী, অন্তরালবর্তিনী রইল?

আমার কাছে অন্তত তুলনাটা আসে জগতের প্রিয় দার্শনিক ব্লেজ পাস্কাল-এর। তাঁর অমর কীর্তি ‘পঁজে’ (চিন্তা) বুকের মধ্যে নিয়ে যিনি কবরে গেলেন, এবং সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে রচনাটি ফরাসি গদ্য ও সাহিত্যের শিরোমণি হয়ে থেকে গেল তদবধি।

এই কীর্তির পূর্বে, তাঁর জীবৎকালে, পাস্কালের অপর যে-কাজ ফরাসি গদ্য ও তর্কসাহিত্যকে শিকড় ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ‘লেত্র্ আ প্রোভিন্সিয়াল’-ও (প্রাদেশিক পত্রাবলি) তিনি ছেপেছিলেন বেনামে। অসহ্য শারীরিক কষ্টে কাটানো ওঁর মৃত্যুপূর্ব দিনগুলোর সঙ্গেও মিল পাই জীবনানন্দের শেষ দিনগুলোর। রোগচরিত্র ও আসন্ন মৃত্যুর কথা দার্শনিকের থেকে আড়াল রাখতেন বন্ধুবর্গ, ডাক্তারবৃন্দ। নিজের মৃত্যুর ছায়া, অভিলাষ ও পটভূমিও কি কবি জগতের থেকে আড়াল করার চেষ্টায় ছিলেন শেষ দিকে?

সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’’

এই সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতামত উল্লেখ করে জীবনানন্দের ছাত্র অরবিন্দ গুহ কবির স্মৃতিচারণায় লিখেছেন: ‘‘জীবনানন্দের মুখে শুনে তাঁর পারিবারিক ঘটনাই সঞ্জয় ভট্টাচার্য জেনেছেন, সে সব ঘটনা খুব সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিদিন জীবনানন্দের একটা দ্বন্দ্বের কথা সঞ্জয় ভট্টাচার্য অকপটে ব্যক্ত করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে জীবনানন্দ তার থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন।’’

কবির গণনাতীত ভক্তের মধ্যে যাঁরা পারিবারিক এই ছবির আঁচ পাননি তাঁরাও ‘মহাপৃথিবী’ সঙ্কলনের ‘ফুটপাথে’ কবিতার এই সূচনা স্তবকের দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে পারেননি। কবি যেখানে তাঁর নিলয়যাত্রাকে প্রায় নিটোল অনুমানে এনেছেন:

‘‘ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি: এখন গভীর রাত/কবেকার কোন্ সে জীবন যেন টিটকারি দিয়ে যায়/‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক— ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই/কখন এমন হয়ে হায়!/ আকাশে নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে/কবেকার কোন্ সে জীবন ডুবে যায়।’’

ট্রাম বা ট্রামলাইনও যে এক সময় রূপকালঙ্কার হয়ে ওঁর গদ্যকেও ভর করেছিল তাও ভক্তরা লক্ষ করছিলেন এমন সব বর্ণনায়:

‘‘শচী… প্রকাশের বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল; এই শীতের ভেতরেও প্রকাশের কপাল ঘামিয়ে উঠেছে— আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে স্বামীর কপাল মুছে ফেলে শচী দরজা জানালাগুলো সব খুলে দিল। বড় রাস্তাটার দিকের জানালাটার পাশে এসে রাতের কলকাতার দিকে একবার তাকাল সে— ট্রামলাইনগুলো খালি পড়ে আছে— রাস্তার সেই বিরাট হাঙরদের এখন ঘুমোবার সময়।’’ (গ্রাম ও শহরের গল্প)

এই যে ভক্তদের কথা বলছি, এঁদের একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যিনি উঠতি যৌবনে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে চার আনায় এক কপি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কিনে বোধ করেছিলেন কে যেন দু-চোখে ঘুসি মারল! লিখছেন—

‘‘আমি পাগলের মতন জীবনানন্দ দাশের ভক্ত হয়ে গেলাম। ভক্ত কিংবা ক্রীতদাসও বলা যেতে পারে।’’

এই ভক্ত কিংবা ক্রীতদাস কবির শেষ যাত্রার নাতিদীর্ঘ মিছিলে ছিলেন। লিখেছেন, ‘‘শবানুগমনে খুব বেশি লোক হয়নি। আমাদের অল্পবয়সি কাঁধ বেশ শক্ত, আমরা কয়েকজন কাঁধ দিয়েছিলাম পাল্লা করে। জীবনে একবারই মাত্র সেই কবির শরীর স্পর্শ করেছি, তখন নিস্পন্দ।’’

সেই শবযাত্রায় সাক্ষী অরবিন্দ গুহ নজর করেছিলেন যে, ‘‘শ্মশানের পথে পড়ল সেই জায়গাটা, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ট্রামলাইনের সেই জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস— আশ্চর্য, শানবাঁধা কলকাতায় জীবনানন্দের জীবনের চরম দুর্ঘটনা এমন জায়গাতেই ঘটল যেখানে ঘাস, ঘাস— যে ঘাসের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রগাঢ়, প্রবল।

আর মৃত্যু হল যখন, কোন তারিখ? রাত্রি ১১টা ৩৫মি। ৫ কার্তিক।’’

এই কার্তিকের রাত্রির সংযোগটাও আশ্চর্য করেছিল অরবিন্দকে, যাঁর মামাবাড়ি ছিল বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের কাছে। যে-ব্রজমোহন স্কুলের ছাত্র ছিলেন জীবনানন্দ; পরে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপকও, অরবিন্দ লিখছেন:

‘‘লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন থাকত মামাবাড়িতে। নেমন্তন্ন সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। কোজাগরি পূর্ণিমার রাত। একাধিকবার দেখেছি, স্কুলের মস্ত মাঠ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে, মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের কয়েকটি ঘোড়া জ্যোৎস্নার মাঠে ঘাস খাচ্ছে। বহু কাল পরে জীবনানন্দের ‘ঘো়ড়া’ নামক একটি বিখ্যাত কবিতায় পড়েছি— ‘মহিনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে/প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে/পৃথিবীর কিমাকার ডাইনোসর ’পরে।…‘ঘোড়া’ কবিতাটি পড়ে আমি অনেক দিন ভেবেছি— জীবনানন্দ কি কোনও দিন ওই জ্যোৎস্নার মাঠে স্বচক্ষে মন্তাজ মিঞার আস্তাবলের ঘোড়াদের ঘাস খেতে দেখেছেন?’’

অরবিন্দ ভাবেননি, তবে ভাবতেও পারতেন, শেষ আশ্বিনের ওই ভয়ানক সন্ধ্যার অপঘাতও কি জীবনানন্দ মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন কখনও? কিংবা আধোঅচেতন অনুরাগে অনুভব করেছিলেন, যেমনটি লিখে গেছেন ‘ফুটপাথে’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে…

‘‘কোন্ দিকে যেতে হবে? নিস্তব্ধ শহর কিছু জানে নাকো/ সে শুধু বিছায়ে আছে/ বিশ্বাসীর বিধাতার মতো।/ কোলে তার মুখ রাখি— বিশ্বাস করিতে চাই, তবু মনে হয়/ শহরের পথ ছেড়ে কোনও দিকে হেঁটে যদি চলে যেত আমার হৃদয়’’…।

সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে তো লিখেইছিলেন , আরও অনেককেই মৌখিক ভাবে জানিয়েছিলেন জীবনানন্দ যে তিনি আত্মজীবনীতে হাত দিতে চান। তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যকর হলেই।

সেটা আর হয়নি। এক, শরীর ঠিক জুতে এল না। আর দুই, হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় বালিগঞ্জগামী ট্রামটা এসে পড়ল গায়ের ওপর।

অথচ ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ তিনি নিয়মিত ‘লিটারারি নোটস’ নামে দিনলিপি লিখে গেছেন। লিখেছেন ইংরেজিতে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গল্পের প্লটলাইন ধরে রাখতে। মাঝে মাঝে বাংলাও মিশে গেছে ক্রমশ ডায়েরি হয়ে ওঠা খাতাগুলোয়।

জীবনানন্দের ইংরেজিতে ডায়েরি লেখা নিয়ে যাঁরা কিছুটা চমকিত সেগুলো প্রকাশ্যে আসায় আরওই চমৎকৃত হয়েছিলেন আরেকটি তথ্যে। কবি ১৯১৬-য় কবিতা লেখা শুরু করেন ইংরেজিতে!

ডায়েরির ইংরেজির স্টাইলটাকে বলা যায় টেলিগ্রাফিক। গল্পের ভাবনার বাইরে যে দিনের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় তা বড়ই মর্মান্তিক, পড়তে পড়তে মনে ভেঙে যায়। কর্মহীন জীবনের দৈনন্দিন বিড়ম্বনার ধারাবিবরণী। সদ্য বিবাহিত জীবনে সুখের অভাবেরও ইঙ্গিত এসে পড়ছে থেকে থেকে। মনে হচ্ছে এ বিবাহ না হলেই ভাল ছিল। পথে-ঘাটে কোনও মেয়েকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে কোনও গ্রাম্য কিশোরীর মুখ এবং উন্মনা হচ্ছেন।

কবির কষ্টের ইঙ্গিত দিতে তিনটে ছোট্ট এন্ট্রির উল্লেখ করব। ২৭. ৭. ৩১-এর পাতায় লিখছেন: দুপুরটা কাটল চাকরির আবেদন লিখে লিখে ডাকে পাঠাতে, খেলা দেখে যে একটু আরাম স্বস্তি পাব তা আর কপালে নেই: জীবন থেকে বহু কিছুই উবে গেছে।

তার পর লিখছেন: ঢ্যাঁড়শই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। একই সঙ্গে মাধুর্য ও পরিহাস।

লিখছেন: বেজায় গরম, ঘুমনো গেল না। একবারটি চায়ের দোকান হয়ে আসতে হবে, তবে তিন পয়সার বেশি খরচের মুরোদ নেই। অভাবে থেঁতলে দিচ্ছে, ভাবছি খবরের কাগজ রাখা বন্ধ করে দেব।

এছাড়া ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরী’ পঙ্‌ক্তিটির রচয়িতা ৯.৮.৩১-এর রোজনামচায় তিক্ততা ঝরিয়ে লিখছেন: চাকরি নেই, লোকে প্রশ্ন করছে, ‘বসে আছ?’:

‘‘…on ‘বসে থাকা’— বেকার কখনও বসে থাকে না: they stand and run, throb and palpitate; it is only the well-placed who have the external charm of the easychair or cushions, sofas and bed for themselves.’’

শেষ বয়সে কবি যে-আত্মজীবনীর কথা ভাবছিলেন তাতে কি দিনলিপির এত শোকশোচনার পূর্ণ বয়ান থাকত? আমরা জানি না, অনুমানও করতে পারি না, তবু একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়, এত রক্তক্ষরণ যে-হৃদয়ের, তিনিই তো লিখে রেখে গিয়েছিলেন, ‘তার স্থির প্রেমিকের নিকট’ নামের কবিতায়—

‘‘বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই— আমি বলি না তা/কারও লাভ আছে— সকলেরই— হয়তা বা ঢের/ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতর সমুদ্রের জলে/পেয়েছি ধবল শব্দ— বাতাসতাড়িত পাখিদের।’’

কবির যে দুটি বিখ্যাত বই দিয়ে বাঙালি পাঠকের সাধারণত পরিচয় ঘটে ওঁর সঙ্গে সেই ‘বনলতা সেন’ বা ‘রূপসী বাংলা’ পড়ে তাদের ধারণায় আনাও কঠিন কবির ব্যক্তিজীবনের ওঠাপড়া। অথচ নিয়তি এমন যে, এক সময় ওঁর জীবনের সঙ্গেই মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ার প্রয়োজন হয় ওঁর কবিতা। শুধু কাব্যোপভোগের জন্যই নয়, এক আধ্যাত্মিক আরাম ও দার্শনিক সুকৃতি অর্জনের জন্য। শুধু ওঁর কবিতা পড়ে এক আশ্চর্য জীবনানন্দকে জানা হয়; আর ওঁর জীবন ও কবিতা পাশাপাশি ও মিলিয়ে পড়লে এক পরমাশ্চর্য জীবনানন্দকে আবিষ্কার করে ফেলা যায়। আর এখানে তুলনাটা খুব সহজেই এসে পড়ে ওঁর প্রিয় কবি জন কিটস্-এর।

প্রকৃতি, নির্জনতা, মৃত্যু ও অন্ধকারের প্রতি দু’জনেরই স্বভাবটান। কিন্তু নক্ষত্র, আকাশ, সমুদ্র, নাবিক ও অভিযান যে ভাবে বেঁধেছে দুই কবির দুই সেরা কবিতাকে তা কলেজের প্রথম বর্ষে আবিষ্কার করে যে-হিল্লোল জেগেছিল ভেতরে সে-রোমাঞ্চ আজও ছেড়ে যায়নি অর্ধশতাব্দী পরেও।

কিটসের কবিতা ‘‘On First Looking into Chapman’s Homer’’ একটি চতুর্দশপদী, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ দ্বাদশ পদে ধরা। প্রথমে কিটসের প্রথম চার লাইন:

‘‘Much have I travel’d in the realms of gold,/ And many goodly states and kingdoms seen;/Round many western islands have I been/Which bards in fealty to Apollo hold.’’

এর পর জীবনানন্দের প্রথম চার পঙ্‌ক্তি:

‘‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;’’

এর পর জীবনানন্দের শেষ ক’টি পঙ্‌ক্তি:

‘‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর/হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা/সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর/ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’/ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’’

এ বার কিটসের সেই শেষ কটা অবিস্মরণীয় লাইন:

‘‘Then felt I like some watcher of the skies/When a new planet swims into his ken;/ Or like stout Cortez when with eagle eyes/ He star’d at the Pacific— and all his men/ look’d at each other with a wild surmise— /Silent, upon a peak in Darien.’’

আত্মজীবনী লেখা না হলেও নিজের বাবা ও মা’কে নিয়ে সুন্দর একটা প্রবন্ধ রেখে গেছেন জীবনানন্দ, যার শিরোনামাটিও সরল— ‘আমার মা বাবা’।

শুরুটাও সরল— ‘‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ ১৩… সালে ২১ শে পৌষ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাঝে মাঝে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখতেন মনে পড়ে। তার পরে কলেজে উঠেও তাঁকে কোনো কোনো সময় তাঁর নিজ জীবন ও নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা ভাবনা লিখে রাখতে দেখেছি। সে সব লেখা কোথায় তিনি রেখে দিয়েছিলেন— কিংবা নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছেন কিনা কিছুই জানি না। তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোনো লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। এখন সে সব কবিতাও খুঁজে পাচ্ছি না।’’

এই মায়ের ওপর নির্ভরতার একটা মিষ্টি ছবি আছে ছাত্রাবস্থায় হার্ডিঞ্জ হস্টেলে থেকে ওঁকে লেখা জীবনানন্দের একটি চিঠিতে। লিখছেন:

‘‘Golden Treasuryটা পাঠাইতে লিখিয়াছিলাম, পাঠাইয়া দিও। আমার Hostel ও Law College-এর টাকা এখনও আসিতেছে না কেন? তা ছাড়া বইর জন্য ৫০ টাকা পাঠাইতে হইবে।… Paradise Regained আমাদের পাঠ্য। আগে কিনি নাই। আজকাল তো পাওয়া যাইতেছে না। জিতেন মুখার্জ্জীর বইটা থাকিতে পারে। ভুবন যদি তাহার নিকট হইতে সেই বইটা এবং Scott-এর নভেলের তিনটা (Kenilworth, Old Morality, Talisman) লইয়া আসে তাহা হইলে ভাল হয়।’’

বাবা সম্পর্কে জীবনানন্দের বিচারটা এমন ছিল:

‘‘একমাত্র জ্ঞানযোগই যে বাবার অন্নিষ্ট ছিল সে কথা সত্য নয়; কিন্তু মধ্যবয়স পেরিয়েও অনেক দিন পর্যন্ত সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান এমনকি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চ্চায় তাঁকে প্রগাঢ় হয়ে থাকতে দেখেছি মানুষের জীবন ও চরাচর সম্বন্ধে যত দূর সম্ভব একটা বিশুদ্ধ ধারণায় পৌঁছবার জন্যে, নিজের হিসেবে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। উচ্ছ্বাস দেখিনি কখনো তাঁর, কিন্তু জীবনে অন্তঃশীল আনন্দ স্বভাবতই ছিল— সব সময়ই প্রায়। কিন্তু গদ্য লেখা ছাড়া বাবা সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেননি, কিন্তু পাঠ করেছিলেন অনেক, আলোচনার প্রসারে ও গাঢ়তায় আমাদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন— দৃষ্টি তিনিই খুলে দিয়েছিলেন।’’

নাতিদীর্ঘ এই রচনা থেকে জীবনানন্দের চিন্তা ও চলনের উৎসমুখ শনাক্ত করা অসুবিধের না। এই প্রবন্ধ এবং ‘লেখার কথা’, ‘কেন লিখি’, ‘কবিতা সম্পর্কে’ শীর্ষক রচনাত্রয়ী এবং ওঁর চিঠিপত্র, দিনলিপি ও কবিতার বইগুলো মিলিয়ে পড়লে কবির একটা আত্মজীবনী পড়া হয়ে ওঠে।

বোন সুচরিতা দাশের বিবরণে জানা যাচ্ছে কী ‘ভীষণতম হিংস্র দুর্দিন’ ঘনিয়ে আসায় সাধের বরিশাল ছাড়তে হয়েছিল কবিকে। কিন্তু তাতেও তাঁর ‘এষণাশক্তি, ভাবনাপ্রতিভা, mother wit’ (কথাগুলো কবির থেকেই নেওয়া) বিস্রস্ত হয়নি এতটুকু।

সুচরিতা লিখছেন: ‘‘বাইরে থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁরা তাঁকে গম্ভীর নির্জন, স্বপ্নালোকবাসী বলেছেন, বলেছেন সর্বক্ষণ একটা অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করে তাঁর নিজের চারিদিকে তিনি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতেন। …

যে মানুষ অত গুরুগম্ভীর কবিতা লিখতেন, তিনি যে অমন চারিদিক উচ্চকিত করে প্রকম্পিত হাসি হাসতে পারতেন, বা অন্যকেও হাসিয়ে হাসিয়ে ক্লান্ত করে দিতে পারতেন, তা যেন না দেখলে বিশ্বাস করাই যায় না।’’

জীবনানন্দের যাবতীয় রচনার সাক্ষ্যে একটা ভয় কিন্তু থেকে যায়। তা হল আত্মজীবনীটা লিখে ফেললেও নিজের witty, কৌতুকপ্রিয় সত্তাটাকে সেখানে মেলে ধরতেন কিনা। এখানেও তুলনাটা এসে পড়ে অন্য নির্জন কবি কিটসের। যাঁর চরিতের জীবনোচ্ছল ছবিগুলোর জন্য নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক ও জীবনীকারদের বৃত্তান্তে। আমাদের সৌভাগ্য জীবনানন্দের এরকম একজন ছিলেন অরবিন্দ গুহ, যিনি অগ্নিমিত্র নামে চমৎকার রসরচয়িতা হয়েছিলেন পরে। তাঁর বর্ণিত জীবনানন্দের কতিপয় রসিক ছবির একটি দিয়ে শেষ করব।—

‘‘সিনেমায় গান লেখার ব্যাপারে একদা জীবনানন্দ কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছেন, তিনি আমাকে এক দিন জিজ্ঞেস করলেন— সিনেমায় গান লিখলে নাকি অনেক টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এ বিষয়ে?

আমি জানি না এমন কোনো বিষয় জগতে নেই, আমি সর্বজ্ঞ— আমার নিজের মতে। সর্বজ্ঞের গলায় বললাম— হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সিনেমায় গান লিখলে অনেক টাকা পাওয়া যায়।

তিনি বললেন— আমি লিখতে পারি না?

বললাম— নিশ্চয়ই পারেন।

—আমাকে কী করতে হবে?

—বাংলা সিনেমার পরিচালক হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের খুব নামডাক, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো,

বললাম— তা হলে আর কী কথা? তাঁকে বলুন। উনি অনায়াসে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।

দিন কয়েক বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

জীবনানন্দ বললেন— না, এ বার করে ফেলব।

ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেছি— সর্বজ্ঞের অনেক দায়। আবার রাসবিহারী এভিনিউতে দেখা। বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে…।

জীবনানন্দ বললেন— না, এখনও ঠিক হয়নি, কিন্ত এ বারে আর দেরি করব না।

বললাম— থাক, এ ব্যাপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

জীবনানন্দ বললেন— খুব ভালো।

আমি তুড়ি মেরে বললাম— তা হলে আর কথা নেই। ওঁকে বলুন সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে ওঁর দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে।

জীবনানন্দ আগ্রহী হলেন— কী কথা?

বললাম— প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না। এই অবস্থায়…

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জীবনানন্দ বললেন— বুঝেছি, আর বলতে হবে না। আমি শিগগিরই শৈলজাকে বলব।

বলব— ঠিক আছে।

দশ-বারো দিন বাদে আবার রাসবিহারী এভিনিউতে এক দিন। নির্ঘাত শৈলজানন্দের সঙ্গে কথা বলেছেন?

জীবনানন্দ বললেন— না, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বলে আমাকে নিয়ে গেলেন ফুটপাথের এক পাশে। সেখানে সাবধানে গোপন কথা বললে আর কারও শোনার আশঙ্কা কম। বললেন— শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জান?

বললাম— না। কেন?

খুব হতাশভাবে বললেন— যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তা হলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাধে-এ-এ-এ ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়’।

এখনো আমার মনে গেঁথে আছে চোখমুখের সকৌতুক ভঙ্গির সঙ্গে জীবননান্দের গলায়— রাধে-এ-এ-এ…

বলা বাহুল্য হলেও বলা দরকার, ইহজন্মে সিনেমার গান লেখার সৌভাগ্য জীবনানন্দের হয়নি,’’

মৃত্যুশয্যায় এই জীবনানন্দকে দেখে অরবিন্দর মনে হয়েছিল যেন নীচের ঠোঁট কামড়ে দুরন্ত হাস্যস্রোতকে ঠোঁটের ওপারে বন্দি করে রেখেছেন। হয়তো খানিক আগেই সেই নিজস্ব হাসি হেসেছেন। নাকি একটু পরেই হেসে উঠবেন প্রচণ্ড শব্দে?

সংশোধনী: ৯ জানুয়ারি, ২০১৬-র ‘পত্রিকা’য় ‘হেমেন্দ্রসরণি’ শীর্ষক লেখায় ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’ কাহিনির দুই প্রধান চরিত্র ভুলবশত জয়ন্ত-মানিক বলা হয়েছে। ওটি হবে বিমল-কুমার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement