মৃতপ্রায় প্রাচী সিনেমার লাগোয়া গলিতে এখনও রয়েছে বাড়িটা। ঘিঞ্জি জটলায় আলাদা ভাবে চোখে পড়ে সেই উপস্থিতি। ২৫ নম্বর লেখা বাড়িটা এনআরএসের ডাক্তারি পড়ুয়াদের হস্টেল। সাবেক জানালার খড়খড়ি, বারান্দা, বাহারি গ্রিলের আধারে কলকাতার গত জন্মের ইশারা। একুশ শতকের দোরগোড়ায় কোনও এক বিকেলে, যার টানেই কয়েক জন প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া ও যুবক সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
২৫ ডিক্সন লেন
সঙ্গীতগুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের প্রয়াণের দু’-তিন বছর পরের ঘটনা। তাঁর পুত্র মল্লার, অসুস্থ মা ললিতাদেবীকে ধরে ধরে বাড়িটায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর জ্ঞানবাবুর দুই প্রবীণ ছাত্র, তবলায় স্বনামধন্য শঙ্কর ঘোষ, শ্যামল বসুরা তখন অনর্গল, তাঁদের যৌবনের দুর্দান্ত দিনগুলোর উত্তাপে উজ্জীবিত। হস্টেল কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে ডিক্সন লেনের উঠোনে সেই জ্ঞানপ্রকাশ-স্মরণ অনুষ্ঠানে তাঁর ছাত্র অজয় চক্রবর্তী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় গান-তবলার নিবেদনে ছিলেন। এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না। কণ্ঠসঙ্গীতে জ্ঞানবাবুর শিষ্যা-সহধর্মিণী ললিতাদেবীর সঙ্গে ডিক্সন লেনে শিখতে আসার সোনালি দিনগুলোর কথা ফুরোতে চাইছিল না শঙ্কর বা শ্যামলবাবুর। জ্ঞানবাবুর শাগির্দ অগ্রজ শিল্পীরা অনুজদের দেখাচ্ছেন, এক তলার কোণায় কোন ঘরটিতে দিনের পর দিন বসবাস করতেন বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব। রবিশঙ্করই বা কোথায় রেওয়াজ করতেন! দোতলায় ওঠার সম্ভ্রান্ত সিঁড়িটা মনে পড়াচ্ছে, এক বিকেলে আচমকাই কাউকে না-জানিয়ে হাজির ঠুমরির সম্রাজ্ঞী রসুলন বাই। শশব্যস্ত জ্ঞানবাবুকে তাঁর মিনতি, ‘আমি মোটেই বেশি সময় নেব না! একবারটি আপনার নতুন বৌকে দেখেই চলে যাব।’
এ সব গল্প জানা থাকলে, আজও এ বাড়িতে ঢুকতে গায়ে কাঁটা দেবেই। মার্বেলের চক-মেলানো দালান, সিঁড়ির পাশে কাপড় শুকোনোর দড়ি-টাঙানো হস্টেলসুলভ ম্যাড়মেড়ে উঠোনটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন জাগবে, এখানেই কি সান্ধ্য আসরে জ্বলজ্বল করতেন ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তিরা? হাফিজ় আলি খাঁ সাহেব, ফৈয়াজ় খাঁ, বড়ে গুলাম, আমির খাঁ, ভীমসেন জোশী, কেশরবাই, হীরাবাই, ডিভি পলুসকর, আলি আকবর, রবিশঙ্কর, রাধিকামোহন মৈত্র (রাধুবাবু), বিলায়েত খাঁ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বা জ্ঞানবাবুর চিরপ্রণম্য তবলার উস্তাদ মসীত খাঁ, আহমদজান থিরাকওয়া, ফিরোজ় খাঁ, বন্ধু করামতুল্লা খাঁ সাহেবের মতো নক্ষত্রের আগুন সেখানে মিশে আছে। দর্শকাসনে উপবিষ্ট সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে সত্যজিৎ রায়, পাহাড়ী সান্যালের মতো সুরসিক সুরেলা বাঙালি। জ্ঞানবাবু, রাধুবাবুদের ‘ঝঙ্কার’ প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানের পুরনো সব রেকর্ডিং সঙ্গীতরসিকদের কাছে আজও মহার্ঘ।
ভারতীয় সঙ্গীত-চর্চার ইতিহাসের আধুনিক যুগে রীতিমতো স্মরণীয় সব ঘটনাও নিঃশব্দে ঘটেছে, এই বাড়িতে! তাঁর কাছে ঠুমরি শিখতে আসা নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই বাড়িতে বসেই চিঠি লিখে দিচ্ছেন গুরু জ্ঞানপ্রকাশ, যাতে নিখিল মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের তালিমে সেতার শিখতে পারে! অথবা জ্ঞানবাবুর প্ররোচনাতেই বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে গাণ্ডা বাঁধছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মীরা চট্টোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায়)। আবার ‘বসন্ত বাহার’ ছবির জন্য বসন্ত বাহার রাগে ‘নভেলি কলি’ গানটি নিয়ে জ্ঞানবাবুর কাছে বসছেন মরাঠি ঠুমরি শিল্পী মানিক বর্মা, এটি কানন। ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ ছবির গান নিয়ে আলোচনা করতে কানন দেবী, উত্তম, সুচিত্রাদেরও পায়ের ধুলো মিশেছে এই তল্লাটে।
গুলাম আলি খাঁ সাহেবের ‘পথ্যি’ লাহৌরি ঘিয়ে উমদা বিরিয়ানি বা মুখে মিলিয়ে যাওয়া জব্বর মাংসও ডিক্সন লেনের উঠোনে তৈরি হত বটে। প্রেশার কুকারে চটজলদি সিটি-পড়া রান্না নয়, কাঠের জ্বালে তরিবত করে প্রস্তুত স্বাদের সঙ্গে সঙ্গীত কলাকেও তুলনা করতে ভালবাসতেন জ্ঞানবাবু। তবে সবচেয়ে আগে যেটা মনে করার, সেই বাড়িতে প্রায় গোটা দিন পড়ে থাকা শিষ্যদের নিরন্তর সঙ্গীতের তালিমে বা আলোচনায় পুষ্ট করার কাজ চালাতেন অনুচ্চ চেহারার এক বঙ্গসন্তান। দক্ষিণা নেওয়া দূরে থাক, কার্যত তাঁদের নিজের কাছে রেখে খাইয়ে-পরিয়ে শিক্ষা দিতেন সেই আশ্চর্য গুরু। কোনও প্রাচীন ভারতটারত নয়, বিশ শতকের কলকাতাতেও ছিল এমন উজ্জ্বল গুরুগৃহবাসের স্মারক।
গোটা ভারতের সঙ্গীতভুবন সে দিন উঠে এসেছিল সাবেক কলকাতার এক হামবড়াবিহীন, শিক্ষিত, মার্জিত ঘটি-সন্তানের কক্ষপথে। কাশীতে, মহারাষ্ট্রে বড়ে মোতি, সামতাপ্রসাদ, কণ্ঠে মহারাজ, বিনায়ক পটবর্ধন, নারায়ণ রাও ব্যাস, গজানন রাও-ও জ্ঞানবাবুর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। আহরণ ও শিখে বিলিয়ে দেওয়ার উদগ্র নেশায় তাঁর ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষময়। তবে জ্ঞানবাবু নিজে এর পিছনে তাঁর যৌবনে গড়ের মাঠের ফুটবল প্রতিপক্ষ এক খেলোয়াড়ের অবদান স্মরণ করেছেন। তাঁর লাথির ঘায়ে ডান চোখটা নষ্ট না হলে হয়তো সঙ্গীতভুবনে এই একনিষ্ঠ সমর্পণ সম্ভব হত না।
কূল ছেড়ে এসে মাঝদরিয়ায়, পিছনের পানে চাই
সে কলকাতায় বহুবিশ্রুত বাদ্যযন্ত্র বিপণি ‘ডোয়ার্কিন’-এর বাড়ির ছেলে জ্ঞানপ্রকাশের দিনগুলো তখন নানা রোমাঞ্চে খোলতাই। ক্রিক রোয়ে ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঘোষের বাড়িতে যৌথ পরিবার। গানবাজনা, তবলা পাখোয়াজে চড়চাপাটি, বিচিত্র দেশি-বিদেশি বাজনা নাড়াচাড়া, পারিবারিক অর্কেস্ট্রায় গলায় সানাইবাদনের সুরেলা সময়... কিন্তু প্রায় রেনেসাঁস নায়কের মতো সর্ববিদ্যা বিশারদ তরুণের কাছে সঙ্গীত ঠিক জীবনের কেন্দ্রস্থলে ছিল না।
খোদ অবন ঠাকুর স্কুলজীবনে এ ছেলের ছবি আঁকা দেখে শেখাতে চাইলেও গা করেননি জ্ঞানপ্রকাশ। প্রেসিডেন্সি কলেজে পালি ভাষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তরুণ একই সঙ্গে আইন এবং এমএ পড়ছিলেন। বিকেলটা পারিবারিক ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ফুটবল-হকি-ক্রিকেটে মশগুল। সে দিন বিকেলে ক্যালকাটার সঙ্গে প্রথম ডিভিশন হকি ম্যাচ খেলে ফেরার সময়ে হঠাৎ ডান চোখে ধর্মতলায় হোয়াইটওয়ে লেড্লের ঘড়িটা আবছা দেখলেন তিনি। সেটা ১৯৩০-এর দশকের শুরু। ধরা পড়ল, বছর উনিশ-কুড়ির যুবার দু’টি চোখই যায়-যায়! কিছু দিন আগে ফুটবল ম্যাচে হেড করতে উঠে ডান চোখের উপরেই ভয়ানক লাথি খেয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ। তারই পরিণতি। বাঁ চোখ ঠিক হলেও ডান চোখটি কিছু করা যায়নি। পড়াশোনা, খেলাধুলো বন্ধ। ভাগ্যের এই দুর্বিপাকই তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়।
দুনিয়ার হাটে এসে কেনাবেচায়
বাবা কিরণচন্দ্র ঘোষের একটাই আর্জি ছিল তাঁর ‘জ্ঞেনু’র কাছে। গানবাজনা করো, শেখো, কিন্তু টাকা রোজগারের যন্ত্র হিসেবে দেখো না। মাপা পেশাদারি মনোভাবটাকে ভাল চোখে দেখতেন না জ্ঞানবাবুও। তা বলে মাটি কামড়ে উস্তাদদের বকাঝকা সয়ে আহরণে ক্লান্তি ছিল না। কিরণচন্দ্র তখন ডোয়ার্কিন ছেড়ে ‘রেডিয়ো সাপ্লাই স্টোর্স’ করেছেন। ডিক্সন লেনে বাবার তৈরি বাড়িতে আসার আগেই জ্ঞেনুর শিক্ষা পোক্ত হচ্ছিল। পূর্ববঙ্গীয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে তখন অনেক উস্তাদেরই কলকাতায় বাস। ডোয়ার্কিনের অভিভাবকপ্রতিম এক কর্মচারীর যোগসূত্রে তবলায় আজ়িম খাঁ এবং কণ্ঠসঙ্গীতে গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে শুরু হল তালিম। সে যুগে গান শোনা তত সোজা ছিল না। ১৯৩৪-এ নিতান্তই ক্ষীণ দৃষ্টিতে ইলাহাবাদে সঙ্গীত সম্মেলনে গিয়েই হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বরূপ নিয়ে চোখ খুলে গেল জ্ঞানপ্রকাশের। কিন্তু রগচটা আজ়িম খাঁ খুনের দায়ে উত্তরপ্রদেশে জেলে গেলেন। ফলে ফের উস্তাদ খুঁজতে হল। রাইচাঁদ বড়ালের মাধ্যমে মসীত খাঁয়ের কাছে নাড়া বাঁধা। মসীত খাঁয়ের পুত্র করামতুল্লার সঙ্গে অনুশীলনেরও শুরু। মসীত খাঁ রামপুর-মোরাদাবাদ-ফারুকাবাদ ঘরানার। শত ঘাটে জল খেয়ে কত জনের কাছে গাণ্ডা বেঁধে শিখেছেন জ্ঞানবাবু, তার ইয়ত্তা নেই।
একবার অল বেঙ্গল মিউজ়িক কনফারেন্সে বড়ে গুলাম আলির সঙ্গে হারমোনিয়ামে সবে সঙ্গত করে উঠেছেন তিনি। নিজেকে জ্ঞানবাবুর হারমোনিয়াম শিক্ষক পরিচয় দিয়ে খুশি মহম্মদ নামে এক উস্তাদের উদয়। গাণ্ডা বাঁধার পরেই সেই ব্যক্তিটি কোথায় উধাও হয়েছিলেন, তার অবশ্য কূলকিনারা পাননি জ্ঞানপ্রকাশ। ফিরোজ় খাঁয়ের কাছে শিখতে বসে নতুন নতুন গৎ বা টুকরার লোভে ৫০ টাকা থেকে ২৫০-৫০০ টাকা অকাতরে দিয়ে চলেছেন। তবলার বোলের পাশে ৩০০, ৫০০ সব সংখ্যা লেখা খাতাটা ছিল জ্ঞানবাবুর আমৃত্যু সঙ্গী।
মেহেদি হোসেনের একটি পারিবারিক সারেঙ্গিও তরুণ জ্ঞানপ্রকাশের সংগ্রহে ছিল। তা ফেরানোর বিনিময়ে তাঁর কাছ থেকে ৫০-৬০টি বিভিন্ন রাগের গান আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। আরও কত জনকে হিরের বোতাম, সোনার হার বা বহুমূল্য কাশ্মীরি শাল খুলে দিতে হয়েছে। কিরণচন্দ্র সঙ্গীতপাগল পুত্রের জন্য অনেক কিছুই রেখে ছিলেন। তবু দবীর খাঁয়ের কাছে ঠুমরি শিক্ষার সময়ে অস্টিন গাড়িটা বিক্রি করতে হয় জ্ঞানবাবুকে।
এরই মাঝে বম্বেয় নীতিন বসুর ডাকে ছবির মিউজ়িক করছেন। ‘পরায়া ধন’-এ জ্ঞানপ্রকাশই প্রথম সিনেমায় গাওয়াচ্ছেন মান্না দে-কে। কিন্তু তখনও টাকা রোজগারের তাগিদ নেই। এ দিকে, বন্দিশের সংগ্রহ বাড়াতে সুকিয়া স্ট্রিটে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যাওয়াটা ভাল চোখে দেখেননি গুরু গিরিজাশঙ্কর। কিন্তু জ্ঞানপ্রকাশকে থামায় কে! তিনি তো বম্বের চৌপট্টির বাড়ির অনুষ্ঠানে বৃদ্ধা জড্ডন বাইয়ের দাদরির ভাববিন্যাসেও শেলবিদ্ধ! তখনই বাথরুমে ঢুকে সদ্য শোনা গানের বাণী-স্বরলিপি নোটবুকে টুকছেন। হঠাৎ কোন মৃদঙ্গগুরুর হদিস পেয়ে পড়ে থাকছেন কর্নাটকের এক অখ্যাত শহরে।
রাতদিন শিখেও বড়সড় অনুষ্ঠানের ঝোঁক নেই। কিন্তু পান্নালাল ঘোষের ভাই নিখিল ঘোষ, কানাই দত্তদের পারলে নিজের কাছে বাবার হোটেলে রেখেই শেখান। ‘তুমি তো নিজে শিখছ? তুমি আবার কেন শেখাবে?’— এই ছাত্রের ছাত্রদের দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন মসীত খাঁ। জ্ঞানবাবু সঙ্গে সঙ্গে কানাই দত্তকেও তাঁর কাছে গাণ্ডা বাঁধালেন। আসলে গুরুগিরি ফলাতে নয়, নিজে যা শিখেছেন তা রপ্ত করার প্রয়াসেই তক্ষুনি অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়াটাও চর্চার অঙ্গ হিসেবেই দেখেছেন জ্ঞানপ্রকাশ। ‘ঝঙ্কার’ প্রতিষ্ঠার পরে ডিক্সন লেনে রবিশঙ্কর, আলি আকবরের মতো গুণিদের আসরে সঙ্গতের জন্যও বারবার ছাত্র কানাই, শঙ্কর, শ্যামলদেরই ঠেলে দিয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়েও অজয় চক্রবর্তীকে সব কিছু শিখিয়ে বড়ে গুলামপুত্র মুনাব্বর আলির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন গুরু জ্ঞানপ্রকাশ।
ক্যালিফোর্নিয়ায় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে রবিশঙ্কর
ভূশণ্ডীর মাঠে
স্বাধীনোত্তর দেশে সঙ্গীতের সেবায় কিছু স্মরণীয় অবদান ছিল ব্যতিক্রমী সম্প্রচার মন্ত্রী বিশ্বনাথ কেশকরের। ফিল্মি গানার দাপটে কোণঠাসা ভারতীয় সঙ্গীতকে সহজ, গভীর রূপে শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দিতে তিনি বাড়ি বয়ে এসে জ্ঞানবাবুরই শরণাপন্ন হলেন। অতএব আকাশবাণীর নবগঠিত সুগম সঙ্গীত বিভাগের প্রযোজক জ্ঞানপ্রকাশ। সরস বাংলা গানে শ্রোতাদের রাগ চেনাতে তাঁর উদ্ভাবনায় ‘রম্যগীতি’ সে যুগের অনন্য স্মৃতি।
কবীর সুমনের চোখে, “উপমহাদেশের সঙ্গীতের সেরা জিনিয়াসদের দলে পড়বেন এই জ্ঞানপ্রকাশ। তিনি তবলার কুলগুরু, ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরির সাধক হয়েও আধুনিক গানের বিস্তারে কম নন। এবং একজন আধুনিক মিউজ়িশিয়ান। খুব কম বয়সে আমাকেই আকাশবাণীতে নানকের ভজন গাওয়ানোর সময়ে গিটার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।” সুমন নিজে লিখেওছেন, আকাশবাণীর স্টুডিয়োয় রাজকীয় পিয়ানো, সেতার, সানাই, বেহালা, ক্ল্যারিনেট, অজস্র তালবাদ্যের সামনে নেচে নেচে ধুতিপাঞ্জাবিধারী ‘জ্ঞানদা’র সঙ্গীত পরিচালনা ছিল দেখার মতো। বেগম আখতারের ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’-এর আধুনিক বাংলা রূপান্তর বাণী কোনারের কণ্ঠে ‘কোয়েলিয়া গান থামা এ বার’-এ বুনে দিয়েছেন ওয়াল্টজের তাল। রম্যগীতিতে মানবেন্দ্রকে দিয়ে গাইয়েছেন, ‘তোমায় চেয়ে সারাবেলা, কাটল নিয়ে সুরের খেলা’। আবার তিনিই নানা বয়সের কণ্ঠ মিশিয়ে, তবলার বোলের ফাঁকে মজাদার সব বাজনায় সুকুমার রায়ের ‘রোদে-রাঙা ইটের পাঁজা’ বা ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’-এ মাত করে দিয়েছেন।
সুমনের স্মৃতি জুড়ে জ্ঞানপ্রকাশের রম্যগীতিতে ভূশণ্ডীর মাঠে-র নাদু মল্লিকের গানও। পরশুরাম-কাহিনিতে ভুঁড়িতে এঁটেল মাটি থাবড়ে বাজানোর বোল তবলায় শোনাচ্ছেন, ‘ধা ধা ধিন্ তা কৎ তা গে, গিন্নি ঘা দেন কর্তা কে’...
নগেনের গিন্নি বা নিতাই খুড়ো
তবলার বোলে পেটে খিল ধরা এমন হাসির শরিক খোদ বড়ে গুলামও। তালবাদ্যের লয় বা ছন্দকে নিছক অঙ্কের নিয়মে না দেখে রসাশ্রয়ী ইমেজে সার্থক করে তোলায় বিশ্বাসী ছিলেন জ্ঞানবাবু। সেই অভিনব বোল এখনও ঘোরে ছাত্রদের মুখেমুখে।
‘নগেনের গিন্নির দাঁত কনকন/ মাড়ি টনটন/ মাথা ঘোরে/ ঘন ঘন কত্তাকে ঠোকে/ খ্যাঁদা নেকো মর্কট/ গণ্ডাগণ্ডা খোকাখুকু/ ধেনো তাড়ি টেনে ঢুকুঢুকু...’ ডিক্সন লেনের চায়ের দোকানদার নগেনের দাম্পত্য নিয়ে গৎ শুনে হাসি চাপতে পারেননি গুলাম আলি। একবার শান্তিনিকেতনে জ্ঞানবাবুর কাছে তা শুনে অমলাশঙ্করও মুগ্ধ, মুখে না বললেও তবলার বাজনাতেই সবটা বোঝা যাচ্ছে। আ? ???? ???? ?র একটি গতের ‘নিতাইখুড়ো’ যেন গুরু জ্ঞানপ্রকাশের চোখে বহু ভেকধারী গুরুর ব্যঙ্গচিত্র! যিনি দিনরাত খদ্দের ধরে কানে মন্তর দেন। এবং ‘তক্ষুনি ধরে ঘাড়/ ট্যাঁকে মেরে টান/ তেড়ে ক’ন/ গুরুদক্ষিণা দে (২)’! তবলার শিষ্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “গুরুজির জীবনের শেষ পর্বের ঠিকানা বালিগঞ্জের হেমছায়ার ফ্ল্যাটেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কোনও পারিশ্রমিক দিতেন না। শেষটায় আমি গুরুমাকে বলে সবার কাছ থেকে টাকা আদায় শুরু করি।” অজয়বাবুও কত জনকে বলেছেন, তাঁর যুবা বয়সে গুরুজির পায়ের কাছে দক্ষিণা রাখতে গেলে আকছার শুনতে হয়েছে, “তুমি বরং একদিন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরো। শরীরের বিশ্রাম হবে।”
বনাম বাবা আলাউদ্দিন
শেখানোই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তবে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, বড়ে গুলাম আলির সঙ্গে জ্ঞানবাবুর চেয়ে বেশি সঙ্গত কে করেছেন, জানা নেই! বিস্ময়ে ভরপুর ছকভাঙা তান সরগমের জন্য বিখ্যাত আমির খাঁ সাহেবও ‘তেজ দিমাগ’ জ্ঞানবাবুকেই খুশি হয়ে বারবার হারমোনিয়ামে পাশে বসাতেন।
তবলায় ফৈয়াজ খান, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর থেকে দেশেবিদেশে রবিশঙ্কর, আলি আকবর... বসেছেন সবারই সঙ্গে। নিজেকে অযথা উচ্চকিত প্রকাশ না করে সঙ্গতে সংযমের ধর্মই বরাবর মানতেন জ্ঞানবাবু। তিনিই একবার আচার্য আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। রবিশঙ্করকে চিঠিতে লেখেনও, ‘আপনার ওস্তাদ আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমি এর প্রতিবিধান চাই।’
রবিশঙ্করেরই অনুরোধে কলকাতার কয়েকটি অনুষ্ঠানে খাঁ সাহেবের সঙ্গে তবলায় বসেন জ্ঞানপ্রকাশ। তেমনই একবার ঘণ্টাখানেক সাথসঙ্গতের পরে তিনি দেখলেন, তবলার সম পার হয়ে গেলেও আলাউদ্দিন ফের সজোর নায়কী তারে টোকা দিয়ে তাঁকে একটা পৃথক সম সম্বন্ধে সচেতন করছেন। বার কয়েক এমন হলে জ্ঞানবাবু জানতে চান, কোথাও কি তাঁর বুঝতে ভুল হচ্ছে? তখনই আলাউদ্দিন খাঁ বাজনা থামিয়ে সক্রোধ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ডাঁয়া-বাঁয়া ঠিক হয় না, কলকাতার উস্তাদ হইয়া বইসা আছেন!’ শুনেই তবলা ফেলে ‘আমার ছাত্র শ্যামল আপনার সঙ্গে বাজাবে’ বলে মঞ্চ ছাড়েন জ্ঞানবাবু।
রবিশঙ্কর, আলি আকবরের মধ্যস্থতায় এর পরে অ্যাম্বাসাডর হোটেলে জ্ঞানবাবুর মুখোমুখি হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন আলাউদ্দিন। আপনি কি আমায় ইচ্ছে করে বেতালা হয়ে বেতালা করছিলেন? এ প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি। তবে জ্ঞানবাবু আর টানেননি ঘটনাটা। বাবা আলাউদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত হলেও দু’জনের আর বাজানো হয়নি।
পিয়া ভোলো অভিমান
জ্ঞানবাবুর পুত্র তথা শিষ্য তবলা-শিল্পী মল্লার ঘোষের স্মৃতি জুড়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে সকাল থেকে রাত অবধি বাবার সঙ্গে সঙ্গীত আলোচনায় মশগুল রবিশঙ্কর। তাঁর মা ললিতাদেবীর রান্না শাক দিয়ে সবুজ মাছের ঝোল তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। প্রিয় জ্ঞানদার সঙ্গে দেখা করতে কখনও কাকভোরেই অটোয় চেপে হাজির আলি আকবর। কলকাতা বা আমেরিকায় এই দিকপালদের সঙ্গে অটুট জ্ঞানবাবুর সৌহার্দ্য সেতু। আবার পুজোর গানের রেকর্ডিংয়ের একদিন আগে এইচএমভি-র বিমান ঘোষের আবদারে বাড়িতে হাজির গীতিকার শ্যামল গুপ্ত আর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যথাযথ লিরিক, সুর ঠিক করে জ্ঞানদা ‘মানব’কে পুরোদস্তুর তৈরি করে দিলেন।
পরিবারের পরম সুহৃদ মালেকা-এ-গজ়ল বেগম আখতারও একদিন এসেছিলেন আর্জি নিয়ে। জ্ঞানবাবুকে তাঁর জন্য ক’টা বাংলা গান ঠিক করে দিতে হবে। দুই দিকপাল দুটো হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন। জ্ঞানবাবুর গানের খাতা ঘেঁটে বেগম আখতারের উপযোগী গান বাছাই চলছে। করামতুল্লার তবলা, জ্ঞানবাবুর হারমোনিয়ামের সঙ্গে বেগমের সেই সব গানের আর্তি আজও বাঙালি হৃদয় মথিত করে। হারমোনিয়ামে জ্ঞানপ্রকাশের সঙ্গে ভিজি যোগ, ভি বালসারার অনুষ্ঠানও বহু দর্শকের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
মুক্ত মনের আচার্য
জ্ঞানপ্রকাশের গানজীবনীর নাম ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’। বাংলা অর্থ ‘সঙ্গীত-সংস্কৃতি’। উর্দুভাষী যে গুণী উস্তাদদের শিক্ষায় তিনি সমৃদ্ধ, এ নামে তাঁদের প্রতি কুর্নিশ— লিখেছেন জ্ঞানবাবু। হিন্দু, মুসলিম বা নারীপুরুষে ভেদাভেদ, দুয়েরই ঘোর বিরোধী এই সঙ্গীতগুরু। গুণী শিল্পীদের বাইজী বলে অপমান বিঁধত তাঁকে। মহিলাদের গুণগত বিচারে সামাজিক কুসংস্কারকে জড়িয়ে ফেলা নিয়েও জ্ঞানপ্রকাশ তীব্র আক্ষেপ করে গিয়েছেন। আরতি মুখোপাধ্যায়, অলকা যাজ্ঞিক থেকে কৌশিকী চক্রবর্তী, বিভিন্ন প্রজন্মের গায়িকারাও তাঁর তালিম পেয়েছেন। তাঁর দেশবিদেশের ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিচারণে, বারবার সেন্টের গোলাকার বোতল থেকে চিৎপুরের রকমারি ঘণ্টার স্বর নিয়ে মজাদার নিরীক্ষার গল্প। তবে গানবাজনা সবেতেই জ্ঞানপ্রকাশের মূল মন্ত্র, পরিমিতি। সমসময়ের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে কোনও আতিশয্য দেখলে অকপটে মুখ খুলেছেন। গানের কথা বুঝে গাইতে বলতেন। বাড়তি কালোয়াতি শুনলেই সরস ভর্ৎসনা, পায়েসে বেশি মিষ্টি দিলে কি খেতে ভাল হয়!
ছাত্রদের জন্য জীবন দিলেও গাণ্ডা বেঁধে গুরুগিরিতে ঘোর আপত্তি ছিল তাঁর। তবু অনিন্দ্য, সঞ্জয়, গোবিন্দ বসুদের নাছোড় আবদারে বৃদ্ধ বয়সে গুরুকে হার মানতে হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ৮৫ বছরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে প্রয়াণের সময়েও গানবাজনার কত কী শেখা বাকি থাকল বলে আক্ষেপ করেছেন। পদ্মভূষণ বা সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির সর্বোচ্চ সম্মানের মাপে এ মানুষটিকে ধরা যায় না।
নিজেকে নিয়ে রসিকতাও অটুট ছিল বরাবর। অনেকেই জানেন না জ্ঞানবাবুর জন্মদিনও পঁচিশে বৈশাখ। ডায়েরিতে মজা করে বুড়ো বয়সে কবিতাও লিখেছেন...
‘কোথায় রবীন্দ্রনাথ / ভালবেসে মূঢ় / আত্মীয়বন্ধু গূঢ় / ভেবেছিল আমারও বা বুঝি সেই ধাত!’
সঙ্গীতের ভুবনে পঁচিশে বৈশাখের এই জাতকের অবাধ বিচরণেও রসিকজন সেই রবি-বিচ্ছুরণই টের পেয়ে থাকেন।
ঋণ: তহজীব-এ-মৌসিকী, কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী, মল্লার ঘোষ, পরবাস পত্রিকায় পূর্ণিমা সিংহের স্মৃতিচারণ