তখন সবে মাত্র পঁচিশ দিন হয়েছে ওর অফিস যাওয়ার! জার্মান কোলাবরেশনের একটা কম্পানি। মাস গেলে সাত-আটশো টাকা বেতন। পঞ্চাশের দশকে টাকাটা কম তো নয়ই, বরং বেশ বেশিই। একদিন বলল, ‘‘ধুর, এ সব পোষায় না। ছেড়ে দেব।’’
আমাদের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। আজ চাকরি ছাড়লে, কাল কী হবে ঠিক নেই। তবু বলে দিলাম, ‘‘না পোষালে কোরো না।’’
দিল ছেড়ে। বদলে চিত্রপরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, ওর কালাচাঁদদা। মাইনে পঞ্চাশ টাকা। কালাচাঁদদা আর ওঁর ভাই পিনাকী, মানে পানুদা, তখন থাকতেন হাজরায়। একদিন কালাচাঁদদা বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা যদি সিনেমায় না আসে, কী করে চলবে!’’
মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের স্কুলবেলার পড়াশোনা দিল্লিতে। সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম। পরে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতির অনার্স। তথ্যগুলো কণ্ঠস্থ কালাচাঁদদার। উনি ছিলেন ওদের কেমন যেন আত্মীয়। কালাচাঁদদাদের বাড়ি ভাগলপুরে। আর ওর মামাবাড়ি ওখানেই। দেশের বাড়ি বলাগড়ে কোনও দিন যেতে শুনিনি, অথচ ছোটবেলায় মামাবাড়ি শুনলেই নাকি এক পায়ে খাড়া! ফলে যা হয়। দুই পরিবারে জানাচেনা সবই ছিল।
শুরু হল ওর সিনেমা-জীবন। ক্যামেরার পিছনে। সেখান থেকে অভিনয়ে আসাটা হঠাৎই। কালাচাঁদদারই পরিচালনায় ছবি, ‘যোগবিয়োগ’। কোনও এক আর্টিস্ট অনুপস্থিত। পরিচালকের মুশকিল আসান হয়ে সেই প্রথম ক্যামেরার সামনে অনিল চট্টোপাধ্যায়। উল্টো দিকে ছবি বিশ্বাস, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়। তাতে কী! ওর অভিনয় দেখে ধাঁ মেরে গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। আনমনা হয়ে ভুল করে ফেলছিলেন। ওর কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথা প্রায়ই বলত, ‘পৃথিবীতে এসেছিস। দাগ রেখে যা।’ ছবি-জীবনে ওর দাগ রাখার সেই শুরু।
ওর সঙ্গে আমার আলাপ ১৯৫১ সালে। আমরা তখন গ্রে স্ট্রিটের কাছে কালী দত্ত স্ট্রিটে থাকি। বাবার চা-বাগান। মা ঘরণী। সাত বোন, চার ভাইয়ের মধ্যে আমি অষ্টম। আমার পিসির বাড়ি নাকতলায়।
নাকতলা হাই স্কুল তৈরি হবে। ঠিক হয়েছে, টাকাপয়সা তুলতে দুটো নাটক করা হবে। একটা নাটক ‘কালিন্দী’। অন্যটা ঐতিহাসিক। নাম মনে নেই। সেখানে আবার যারা অভিনয় করেছিল, তাদের একজনকে পরে লোকে চিনবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় নামে। সাবু আমার কিশোরবেলার বন্ধু।
সত্যজিৎ রায়, সন্দীপ রায় ও বিজয়া রায়ের মাঝে
আমাদের নাটকে ভানুদা (বন্দ্যোপাধ্যায়), ধীরেন দাস, বাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে ডাকা হল। নায়িকা বাছা হল আমায়। নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়। বাবা বেঁকে বসল। শেষে পিসি জোর করে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করাল। সেই আলাপ। এর পর ও আমাদের বাড়িতে আসত। আমার এক দাদার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল খুব। তার বছর দুই বাদেই আমাদের বিয়ে।
বিয়ে নিয়েও বাড়িতে অশান্তি। একে আমরা কুমিল্লার গুপ্ত। ওরা এদেশি। ব্রাহ্মণ। বাবার চেয়ে মা’রই ছিল বেশি আপত্তি। আবার রণে অবতীর্ণ পিসিমা! বোঝালেন তিনি। বিয়ে হল। দিন কতক বাবার বাড়িতে থেকে আমাদের নতুন সংসার শুরু হল সুইস পার্কের কাছে, বখতিয়ার শাহ রোডে। সেখানে বছর কয়েক কাটিয়ে ১৪/১০, গল্ফ ক্লাব রোডের ভাড়াবাড়ি। এর মধ্যে ছবিজগতে ওর ব্যস্ততা বাড়ছে। যে জন্য রেডিয়োয় ঘোষকের চাকরি পেয়েও ছাড়তে হল। কিন্তু সেই চাকরির পরীক্ষা দিতে গিয়ে একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
আলাপ হয়ে গেল পুলুর সঙ্গে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পুলুও বসেছিল পরীক্ষায়। পুলু হল দ্বিতীয়। ও প্রথম। একটাই পদ। ব্যস্ততার জন্য ও চাকরি নিল না বলে, পুলু আকাশবাণীর ঘোষক হল। কিন্তু সেই যে ওদের বন্ধুত্বের শুরু, চলেছিল শেষ দিন পর্যন্ত। আমরা দুই চাটুজ্যে পরিবার একসঙ্গে বেড়াতেও গেছি, পুরী!
আরও পড়ুন: বিবাহ বিভ্রাট
বেড়ানো বলতে মনে পড়ল, কার্শিয়াংয়ে গিয়ে একবার আমরা ‘জেসমিন ভিলা’ নামে একটা বাড়ি ভাড়া করে এক মাস টানা ছিলাম। বলা বাহুল্য, হুজুগটা ওরই। সে কত জন যে গিয়েছিল! শুধু ট্রাঙ্কের সংখ্যা হয়েছিল কুড়ি।
বন্ধুত্ব খুব ছিল রমাদের (সুচিত্রা সেন) সঙ্গেও। রমা আর ওর বর দিবানাথ, মানে তুতু তখন বন্ডেল রোডে আদিনাথ সেনের বাড়িতে। মুনমুন বছর চারেকের শিশু। ওকে আমাদের কাছে রেখে ওরা কর্তাগিন্নি প্রায়ই বেরোত। আমরা একসঙ্গে সিনেমাও দেখতে গেছি। মনে আছে, রমার জন্মদিনে একবার একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গিয়ে কী মজাটাই না হল!
আর উত্তমদাকে নিয়ে তো ওর জীবনের গায়ে গায়ে গল্প। একবার হাজরা মোড় দিয়ে উত্তমদা পাস করছিলেন গাড়িতে। জানালার ধারে বসা। হাত দিয়ে মুখটা অল্প আড়াল করা। যাতে কেউ চিনতে না পারে!
ও তখন বসুশ্রী-কফিহাউসে ওদের রোজের আড্ডায় বসত ও-পাড়ায়। হঠাৎ দেখে উত্তমদার গাড়ি। তখনই দুষ্টুমি খেলে গেল মাথায়। চিল চিৎকার দিল, ‘‘আরে, গুরুউউউ, আমাদের একটু দেখো।’’
থতমত খেয়ে উত্তমদা ঘুরে দেখে হা-হা করা হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রাণের বন্ধুটি! রাস্তাসুদ্ধু লোক তখন ওদের দেখছে!
আমাকেও কি কম অস্বস্তিতে ফেলেছে! একদিন লেক মার্কেটে বাজার করতে গিয়ে টাকা কম পড়ল। বসুশ্রী-কফিহাউসে গিয়ে ওর কাছ থেকে টাকা নিলাম। আমায় ট্রামে তুলে দিল। টিং টিং করে ট্রাম ছাড়তে হঠাৎ শুনি, চেঁচিয়ে বলছে, ‘‘এই যে দিদি, শুনুন, আপনার স্বামী না আমার কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েও ফেরত দিচ্ছে না!’’
ভাবুন, কী অবস্থা তখন আমার!
এই ছেলেমানুষটার নামও অনিল চট্টোপাধ্যায়! শেষ বয়সে যখন ব্লাডসুগারে ধরল, কী করত জানেন? চকোলেট কিনে এনে আলমারিতে লুকিয়ে রাখত। রাত্রিবেলা হঠাৎ খসখস আওয়াজে ঘুম ভাঙতে দেখি, আলমারি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে চকোলেট নিয়ে খাচ্ছে!
একটাই ‘মোটো’, আনন্দে বাঁচা। নইলে স্টুডিয়োর মধ্যে কেউ ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানায়!
গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়িতে সাবু আসত। মাধু (মাধবী চক্রবর্তী) আসত। বেণু (সুপ্রিয়াদেবী) আসত। ওরা সবাই তখন পারিবারিক বন্ধু। এমনকী টেকনিশিয়ানদেরও অনেকে তাই। আর গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে মান্না দে, হেমন্তদা, শ্যামল মিত্র কে নন! মাঝে মধ্যেই ওদের গানের ঘরোয়া আসর বসত।
শর্মিলার (ঠাকুর) সঙ্গে সেই কবে থেকে সম্পর্ক! বিকাশ রায়ও তাই। অশোককুমার ওর আবার মাসতুতো ভাই। মনে আছে, একবার একটা অনুষ্ঠানে উনি মজা করে বলেছিলেন, ‘‘হুম, অনিল আমার মাসতুতো ভাই, তবে ভাববেন না যেন চোরে চোরে!’’
মুম্বইয়ের অনেকের সঙ্গেই ওর সম্পর্ক খুব ভাল। অমিতাভ বচ্চন, স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমি। শত্রুঘ্ন সিংহ তো আমার শাশুড়ি-মায়ের সঙ্গেও কত গল্প করতেন!
রাখীর চলচ্চিত্রে আসার নেপথ্য-কাহিনিতেও ও। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আহ্বান’-এর শ্যুটিং হচ্ছিল রানাঘাটে। ছবির নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়। নায়িকা সন্ধ্যা রায়। ওই আউটডোরে হঠাৎ করে ফ্রক পরা স্থানীয় একটি মেয়ে এসে প্রথমে সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে ভাব জমায়। তার পর সবার সঙ্গে। এক সময় সে কলকাতায় আসতে চেয়ে আবদারও করে। তখন সন্ধ্যা রায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় আর ও গিয়ে মেয়েটির বাবার কাছে অনুমতি চায়। এর পরই রাখীর কলকাতায় আসা। সন্ধ্যা রায়ের কাছে থাকতে শুরু করা। এখানেই তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় সন্ধ্যা নিজে।
ঋত্বিকদা (ঘটক) আমাদের পাড়াতে থাকত। এক-আধ দিন চলে আসত। ঋত্বিকদার প্রতি ওর যে কী শ্রদ্ধা, কী ভালবাসা ছিল! বলত, ‘‘লোকে ওর মদ খাওয়াটাই শুধু দেখে, ঋত্বিকদা যে কতটা টেকনিকালি সাউন্ড!’’ তবে ঋত্বিকদার ওপর একদিন দেখি প্রচণ্ড খেপে গেল। বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছিল ওরা। হঠাৎ শুনি ওর চিৎকার, ‘‘আপনি নিজেই নিজেকে শেষ করবেন!’’ কী হয়েছিল কে জানে!
রোম্যান্টিক চরিত্র একেবারে সহ্য করতে পারত না। একবার ‘হাইহিল’ বলে একটা ছবিতে ওকে নিয়ে প্রোডিউসারের কী ঝুলোঝুলি! ও যত বলে, এ চরিত্র আমার জন্য নয়, প্রযোজক তত ভাবে, আপত্তিটা বোধহয় পারিশ্রমিকের পরিমাণ নিয়ে। শেষে টাকা বাড়াতে বাড়াতে সে-আমলে উত্তমদা যা পেতেন, তার চেয়েও বেশি দিতে চাইলেন তিনি, ওর বোধহয় তখন সঙ্কোচ হল। বলেছিল, ‘‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমায় অত দিতে হবে না। আমি যা নিই, তাই দেবেন। করে দেব।’’এমনটাই মানুষ ছিল ও!
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের চরিত্র করার অফার এল। শুনেই বলে দিল, ‘‘অমন মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার যোগ্য আমি নই।’’ কোনও ক্রমে যখন রাজি করানো গেল, ছবি দেখে দেশবন্ধু-স্ত্রী বাসন্তীদেবী পর্যন্ত প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর মেয়ে অপর্ণা ফোন করে কেঁদে ভাসাল। বলেছিল, ‘‘কত দিন বাদে বাবাকে দেখলাম যেন!’’
একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আগে অনিল ধাওয়ান, জিতেন্দ্র, জনি ওয়াকার, অমিতাভ বচ্চন, দিলীপকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ
অসম্ভব সেন্টিমেন্টাল। ভীষণ নরম মন। একবােরর কথা। পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভদ্রলোক জাহাজে কাজ করেন। ওঁর স্ত্রী বাচ্চাকে বেধড়ক মারেন। একদিন সহ্য করতে না পরে লুঙ্গি পরেই সটান হাজির হয়েছিল ওঁদের ফ্ল্যাটে, ‘‘ভেবেছেনটা কী! এ ভাবে বাচ্চাকে মারবেন, আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব!’’
অত বইয়ের পোকাও কম দেখেছি। আর কিছু একটা মাথায় চাপলেই হল, শেষ দেখে ছাড়ত। একবার ঠিক করল, উড়োজাহাজ নিয়ে পড়াশোনা করবে। রাজ্যের বই কিনে ফেলল। আর সময়ের ব্যাপারে ভীষণ পার্টিকুলার। কোনও দিন এক চুলও এ-ধার ও-ধার হতে দেখিনি। জীবনে একবারই ট্রেন মিস করেছিল। সে দিন মেয়ে ছিল অসুস্থ। আমায় যেতে হয়েছিল মেয়ের স্কুলে। ও ছিল মেয়ের সেবায়।
রোজ রাতে ডায়েরি লিখত। তাও এক কালিতে নয়, নানা রঙের কালিতে। আঁকার হাতটা দেখবার মতো। নিয়ম করে খাতায় আঁকত, তা নয়। কেউ হয়তো চিঠি পাঠিয়েছে, তার ফাঁকা জায়গাটায় এঁকে ফেলল। কফিহাউসের বিল-এর পেছনেও এঁকেছে। ডটপেন, পেনসিল, ক্রেয়ন, ওয়াটার কালার, চারকোল যখন যা পেত, নিয়ে বসে যেত। স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তেও আঁকত। বলত, এতে নাকি মনঃসংযোগ বাড়ে! এ সব এখন মেয়ে যত্ন করে জড়ো করছে, ইচ্ছে আর্কাইভ করার।
ছেলেবেলায় স্কুলে হিন্দি, ইংরেজিতেই পড়েছে। ফলে প্রথম প্রথম বাংলাটা তেমন আয়ত্তে ছিল না। কিন্তু তার পর? এমন শান দিল বাংলায়, ঈর্ষা করার মতো ছিল সাহিত্যের জ্ঞান। ভাষা নিয়ে ছিল অদ্ভুত প্যাশন। জামাল নামের এক টেকনিশিয়ানের কাছে উর্দু শিখেছিল। জার্মানি যাওয়ার আগে জার্মান, রাশিয়া যাওয়ার আগে রাশিয়ান। হিন্দিটা তো ভাল জানতই। মুম্বইতে গিয়ে হিন্দি ছবি করল ‘সন্নাটা’, ‘ফরার’। অমল পলেকরের সঙ্গে ‘অন্কাহি’ করতে গিয়ে খুব ভাব হয়ে গেল ওর! অমল কতবার বলেছেন, ‘‘চলে আসুন এখানে।’’ যায়নি। হেমন্তদার (মুখোপাধ্যায়) বেলাতেও তাই। ওর বাংলা ছবি ‘রক্তপলাশ’ করতে চেয়েছিলেন উনি হিন্দিতে। কিছুতেই গেল না। যাবে কী! প্রচণ্ড ঘরকাতুরে যে!
বার্লিন ফেস্টিভ্যালে গেল সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’। ওখানেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব সিডনি পয়টরের সঙ্গে আলাপ। সিডনি ওর কাজের বহর শুনে আড্ডার ছলে বলেছিলেন, ‘‘চলে আসুন হলিউডে।’’ হলিউডে যাবে! ও? ক’দিন বাড়িছড়া থাকলে যে কিনা মরমে মরে! কী কাণ্ড করেছিল শুনুন একবার। বার্লিন থেকে ইউরোপ ট্যুর করে ফেরার কথা। এয়ারপোর্টে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হয়েছিল, এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। ফলে রইল ঝোলা, চলল ভোলা। ব্যাক টু ইন্ডিয়া!
বাড়ি। আড্ডা। কাছের লোকজন। এ সব ছাড়া ও ভাবতেই পারত না। খুব যে দায় নিয়ে আলুটা-মুলোটা বাজারহাট করে সংসার করেছে তেমন নয়, কিন্তু তাও আপনজনের সঙ্গে লেপটেলুপটে না থাকলে, ও যেন কেমন হাঁপিয়ে উঠত। ছেলেমেয়ে বলতে অজ্ঞান।
ছোট্ট একটা ঘটনা। মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা। ওর ভূগোলটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ঘ্যানঘ্যান করছে। ‘‘আয় তো মামণি, কী প্রবলেম বল,’’ বলে এমন গোড়ার থেকে শুরু করল যে, মেয়ে তখন ছাড়লে বাঁচে! কিন্তু এ সব জায়গায় ওর সারল্য, নিষ্ঠা সত্যি চোখে জল এনে দিত।
নিজের শখ-আহ্লাদ, ন্যূনতম বললেও কম। নেশা বলতে পান। খাবার বলতে, শেষ দিকে খুব ভালবাসত পোস্তবাটা আর বোঁদে দেওয়া টকদই। ব্যস। যা রোজগার করেছে, দু’হাতে বিলিয়েছে। সতেরো-আঠেরোটা সংস্থার সঙ্গে যোগ ছিল, তাদের জন্য কী না করত! না ছিল ব্যাঙ্কে টাকা, না নিজের বাড়ি। বয়েই গেল তাতে। নিজেই বলত, ‘‘আমি তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই।’’
মানুষের সঙ্গে মিশতে কোনও আড় ছিল না ওর। উত্তমদা কত বলত, ‘‘একটু তো আড়াল রাখবি!’’ কে কার কথা শোনে!
‘সাগিনা মাহাতো’ ছবির শ্যুটিঙের সময় দিলীপকুমারের সঙ্গে আড্ডায়
গ্রামে আউটডোর থাকলেই, এ-রাস্তা ও-জমি চষে, এর দাওয়ায় ওর সদরে বসে মাত করে দিত। মানুষের প্রতি অসম্ভব কৌতূহল, প্রচণ্ড মায়া যে! এই মায়া থেকেই ওর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। তবে ওর ওই একটা সিদ্ধান্ত একটু যেন খটমট লেগেছিল কারও কারও! ওকে নিয়ে আমাদের একটাই অভিযোগ। একটাই। ‘‘কেন তুমি নিজের শরীরটার দিকে একটু নজর দিলে না!’’ তা হলে তিন ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে এই ভরন্ত সংসারটা ছেড়ে অমন অকালে চলে যেতে হত না!
১৫ মার্চের গভীর রাত, ১৯৯৬। বুকে অসহ্য ব্যথা। কমছে না। এ দিকে পরদিন শ্যুটিং, তাই কিছুতেই হাসপাতালে যাবে না। ডাক্তার এল বাড়িতে। তাও কিচ্ছুটি হল না। জোরজার করে পিজি নিয়ে যেতে যেতে ভোর।
পরের দিনটা কাটল উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে। রাত নামল। ‘মহানগর’ যখন আড়মোড়াও ভাঙেনি, আর তর সইল না।
চলেই গেল লোকটা। চিরদিনের মতো। কীসের যে এত তাড়া ছিল মানুষটার!
অনুলিখন: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়