দিগভ্রান্ত এক বিরহী পথিক পাহাড়ী সান্যাল

তিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত গাইয়ে, দিলদরিয়া প্রেমিক ও অসামান্য এক অভিনেতা। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সুদেষ্ণা বসুতিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত গাইয়ে, দিলদরিয়া প্রেমিক ও অসামান্য এক অভিনেতা। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সুদেষ্ণা বসু

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০৪
Share:

পাহাড়ী সান্যাল

পাহাড়ী সান্যাল হয়ে উঠতে পারতেন অতুলপ্রসাদ সেনের ‘দিনু ঠাকুর’ কিংবা ভারতীয় সংগীত মহলের এক পণ্ডিত গাইয়ে। হতে পারতেন ভারতীয় সিনেমার দ্বিতীয় সায়গলও। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে হয়ে উঠলেন অনন্য এক অভিনেতা। প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, বিকাশ রায়দের সেই বিস্মৃতপ্রায় যুগের এক কুশীলব। সময়টা গত শতাব্দীর তিনের দশক।

Advertisement

বাংলা সিনেমা তখন সবে এ দেশের চলচ্চিত্র আঙিনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে শুরু করেছে। সবাক বাংলা সিনেমার সেই যুগে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গানের গলা থাকলে বাড়তি সুবিধে হত। প্লে-ব্যাক প্রযুক্তি তখনও চালু হয়নি। ফলে শ্যুটিংয়ের সময় অভিনেতারা ক্যামেরার সামনে সরাসরি গান গাইতেন এবং ক্যামেরা ও শব্দগ্রহণ যন্ত্র সেই অভিনয়কে গান-সহ গ্রহণ করত। আর তাই কৃষ্ণচন্দ্র দে, কাননদেবী, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিকের মতো গায়ক-অভিনেতাদের পেয়েছিলাম। এমনই এক পরিবেশে পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। নিউ থিয়েটার্সের বীরেন সরকার (অন্য মতে প্রমথেশ বড়ুয়া) তাঁকে রামপুরের রাজসভা থেকে তুলে এনে কুন্দনলাল সায়গলের সমগোত্রীয় অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! সুন্দর কণ্ঠ ও দেহসৌষ্ঠব থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে সায়গলের জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মিহি, যা তৎকালীন ধ্বনি রেকর্ডিং পদ্ধতির অনুসারী ছিল না।

‘বিদ্যাপতি’তে পাহাড়ী সান্যাল ও কানন দেবী

Advertisement

পাহাড়ী সান্যালের জন্ম, ছেলেবেলা ও জীবন নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য আছে। অনেকেই জানেন, তাঁর জন্ম দার্জিলিংয়ে। কিন্তু তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে ব্রতীন্দ্রনাথ সান্যাল জানালেন, “২২ ডিসেম্বর, ১৯০৬ সালে সিমলার কাছে কসৌলি শহরে ওঁর জন্ম। ওঁর বাবা নৃপেন্দ্রনাথ ওখানে আর্মি ক্যাম্পে চাকরি করতেন। পাহাড়ে জন্ম বলে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পাহাড়ী’— পাহাড়ের ছেলে।” কবি অতুলপ্রসাদ সেনের মতে, “সার্টেনলি এ ইউনিক নেম।”

“আমরা কয়েক পুরুষের প্রবাসী বাঙালি। আদি নিবাস নবদ্বীপের মেরতলা গ্রামে। ওখানে আমাদের বংশের প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির আজও আছে। ‘ঈশ্বরী যাদুয়া মাতা’ বলে তা পরিচিত। আমার ঠাকুরদার বাবা যদুনাথ সান্যাল ও তাঁর স্ত্রী হরিমতীদেবী নবদ্বীপ থেকে সিপাই বিদ্রোহের পরে সপরিবার তৎকালীন ‘অওধ’ রাজ্যের (অযোধ্যা) রাজধানী লখনউ শহরে প্রবাসী হন এবং সেখানকার মকবুলগঞ্জে ১১ সিক্কায় একটি বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করেন। যদুনাথ ও হরিমতীর চার সন্তান ছিল— নৃপেন্দ্রনাথ, রাজেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ ও হরেন্দ্রনাথ। পাহাড়ীজ্যাঠার বাবা হলেন নৃপেন্দ্রনাথ। তাঁর আবার চার ছেলে। সত্যেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ, ধীরেন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ। পাহাড়ী সান্যালের আসল নাম নগেন্দ্রনাথ সান্যাল। ওঁর দুই বোন ছিলেন, পটেশ্বরী ও কমলেশ্বরী। আমার বাবা আর পাহাড়ীজ্যাঠা খুড়তুতো ভাই। আমি ওঁর ভাইপো।”

লখনউয়ের মডেল হাউজ পাড়াটি রাজেন্দ্রনাথের তৈরি। নৃপেন্দ্রনাথ এই মডেল হাউজ অঞ্চলে বাড়ি কিনে সপরিবার থাকতে শুরু করেন। ওই বাড়িতেই পাহাড়ী সান্যাল বড় হয়েছেন। নৃপেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ আর্মিতে সিভিল সাপ্লাই বিভাগে চাকরি করতেন বলে বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে ঘুরতে হত। কসৌলিতে পাহাড়ীর জন্ম হলেও, তাঁর ছেলেবেলা, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে লখনউয়ে। ছেলেবেলা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আদর করে বাবা আমার নামটাকে উলটে নিয়ে ‘ড়ীহাপা’ বলে ডাকতেন। ভোরে উঠে বাবা রামকৃষ্ণের নামগান করতেন, ভজন গাইতেন, আমি
তাঁর কোলের কাছে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম’।

স্ত্রী মীরাদেবীর সঙ্গে পাহাড়ী

লেখাপড়ার পাশাপাশি নবাব ও কবি ওয়াজেদ আলি শাহের লখনউ শহরের হিন্দুস্থানি সাংগীতিক পরিবেশ, বোল, বন্দিশ, মুজরো, মজলিশ আর বাঈজি আসর বা ‘কোঠা’ পাহাড়ীর সংগীতবোধ আর মেজাজ দুটোই গড়ে দিয়েছিল। তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল বা দ্বিজুদা পাহাড়ীকে গানবাজনার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিতেন। লখনউয়ের নামীদামি সংগীতকার উস্তাদ মহম্মদ হোসেন, ছোটে মুন্না খান, নাসির খান, এহমদ খানের কাছে তিনি তালিম নিয়েছিলেন। তাই গানবাজনার আসরে তাঁর তারিফ করার ঢংটা ছিল মজলিশি মেজাজের। রবিশঙ্করের লেখায় পাই, ‘একসময়ে গান-বাজনার লোক ছিলেন বলে ওঁর স্বভাবের মধ্যে, আচারে-ব্যবহারে মজলিশি ঢং এসে গিয়েছিল… উনি খুব ভাল তবলা বাজাতেন।” পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সন্ধানে কলকাতায় এসে কিশোর ভীমসেন যোশী পাহাড়ী সান্যালের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কিছুকাল কাটিয়ে গিয়েছেন, এমনও শোনা যায়।

পাহাড়ীর গানের গলা এতটাই ভাল ছিল যে, রাস্তা থেকে তাঁর রেওয়াজ শুনে স্বয়ং ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিনা আমন্ত্রণে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁদের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে বসে শুনেছিলেন যুবক পাহাড়ীর গান। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পাহাড়ী ভর্তি হন লখনউয়ের সরকারি পলিটেকনিক কলেজে। সেখানে পড়তে পড়তেই ভর্তি হয়েছিলেন তৎকালীন ‘মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক’-এ।

“১৯২৫ কি ১৯২৬ সালে লখনউ শহরে পণ্ডিত ভাতখণ্ডেজির উদ্যোগে স্যর উইলিয়াম মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক প্রতিষ্ঠিত হল। গান শুনে ভাতখন্ডেজি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন মিউজিক কলেজে যোগ দিতে ছাত্র হিসেবে। বহু ওস্তাদের কাছে আমার গান শেখা চলছে। কাজেই স্কুল-কলেজ করে গান শেখা যায়, এ কথাটাতে আমার মন সায় দেয়নি,” তিনিই লিখে গিয়েছেন। সেই মিউজিক কলেজের জন্য অতুলপ্রসাদ সেনের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের আহ্বান সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে শান্তিনিকেতনে গিয়ে বাস করা সম্ভব হয়নি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাহাড়ীর বাবা ইংরেজ ফৌজের হয়ে ‘মেসোপটেমিয়া ক্যাম্পেন’ যুদ্ধে গিয়ে মেসোপটেমিয়াতেই ধরা পড়েন এবং ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে বন্দি হন। পরে ওখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পাহাড়ীর বয়স তখন মাত্র বারো। বাবার স্মৃতি পাহাড়ীর কাছে সারা জীবন ফিরে ফিরে এসেছে স্বপ্নের মধ্যে। আর ওই একই সময়ে আর একজন মানুষ তাঁর জীবনে এসেছিলেন। পিতৃতুল্য অতুলপ্রসাদ সেন। অতুলপ্রসাদের সঙ্গে প্রথম দিনের পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লিখতে বসে তিনি লিখছেন, “শৈশবে আমি মাতৃহারা। আমার বাবা War-এ এবং বোধহয় মারাও গেছেন তখন। কারণ তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমরা অনেক পরে পেয়েছিলাম। মাতৃহারা হওয়ার ফলে এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ার জন্যও বটে, বাবার কাছে থেকে এত ভালবাসা, এত আদর পেয়েছিলাম যে, সে দিন সকালে তাঁর কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল মিস্টার এ পি সেনের সঙ্গে।”

অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গ পাহাড়ীর জীবনে সবচেয়ে মধুর এবং মর্মান্তিক এক পর্ব। বারো থেকে অতুলপ্রসাদের মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ ষোলো বছরের সময়কালে পাহাড়ী যেমন অতুলপ্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী হেমকুসুমের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন, তেমনই অতুলপ্রসাদও এই প্রাণখোলা সংগীতপ্রেমে ভরপুর কিশোরটিকে আপন করে নিজের গানের ‘ভাণ্ডারি’ করে রেখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৈশোর, যৌবনের উদ্দামতার ঝড়ে পাহাড়ী তা বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি অতুলপ্রসাদকে ক্রমশ আবিষ্কার করেছিলেন। প্রখ্যাত অভিনেতা হয়ে ওঠার পর বয়সকালে লিখেছেন, “গানবাজনা আমি বাইশ-তেইশ বছর ধরে মোটেই করিনি, যার জন্যে অতুলদার কাছে শেখা বহু গান ভুলেও গিয়েছি বা। কিন্তু আজ তিন-চার বছর ধরে নিজেকে গান শোনাতে বড় ভাল লাগে। কাজেই প্রত্যহ বসে গানের অভ্যাস করি এবং অতুলদার শেখানো যে গানগুলি ভুলে যেতে পারিনি, সেগুলি নিবিড় হয়ে গাই, হাসি, কাঁদি। একটা বিরাট অস্তিত্বের মাঝে একটা প্রগাঢ় শূন্যতা অনুভব করি।”

পাহাড়ী সান্যালের জীবনে এই শূন্যতাবোধের শুরু অতুলপ্রসাদেরই সংস্পর্শে এসে। তাঁর জীবনের প্রথম প্রেমের নোঙর বাঁধা হয়েছিল অতুলপ্রসাদ ও তাঁর গানের জগতের গভীরে। প্রেমিক অতুলপ্রসাদের মনের ‘বিরহী হিয়া’র ছায়া পড়েছিল তাঁর জীবনেও। সেই বিরহী হিয়াই হয়তো অবচেতনে তাঁকে একদিন লখনউয়ের গানের মজলিশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য করেছিল টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্সের শ্যুটিং ফ্লোরে, গায়ক-অভিনেতা হিসেবে।

মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক-এ ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই পাহাড়ীর পরিচয় হয়েছিল তাঁর প্রথম প্রেমিকা ও স্ত্রী প্রতিভা সেনগুপ্তর সঙ্গে। খুব সুন্দর গান গাইতেন প্রতিভা। প্রেমের উন্মেষের বিস্তারিত বর্ণনা তিনি নিজেই লিখেছেন ‘মানুষ অতুলপ্রসাদ’-এ। অতুলপ্রসাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি খুলে দিয়েছেন নিজের বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলির ঝাঁপি। যা তাঁর চরিত্রের বিপরীত মনে হতে পারে। কারণ দরাজ মনের মজলিসি এই মানুষটি নিজের জীবনের কাহিনি খুব কমই প্রকাশ করতেন।

পাহাড়ীকে ছেলেবেলা থেকেই অনেক কঠিন সময় পার হতে হয়েছে একাই। কিন্তু প্রতিভার সঙ্গে যে সময়টা তিনি কাটিয়েছিলেন, তা ছিল তাঁর জীবনের সেরা সময়। গানই ছিল পাহাড়ী ও প্রতিভার প্রেমের ভরকেন্দ্র। প্রথম প্রেমের উন্মেষে দিশেহারা মনের ব্যাখ্যা পেতে পাহাড়ী ছুটে যেতেন অতুলপ্রসাদের কাছে। প্রেমিক মনের অবরুদ্ধ কান্না অতুলপ্রসাদের স্পর্শে বাঁধ ভাঙত। অতুলপ্রসাদ যুবক পাহাড়ীর মনের অবস্থা বুঝে শিখিয়ে দিতেন তাঁর নতুন গান, ‘জল কহে চল/ মোর সাথে চল/তোর আঁখিজল হবে না বিফল’। অতুলপ্রসাদের প্রশ্রয়ে ও গানে পাহাড়ী ও প্রতিভার প্রেম এক সময় পরিণতি পেয়েছিল বিবাহে। কিন্তু ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে প্রতিভাকে মেনে নিতে পারেননি পাহাড়ী সান্যালের বড় দাদা সত্যেন্দ্রনাথ। এই বিয়ের কারণে বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। “২১-২২ বছরের পাহাড়ী তখন বেকার। প্রতিভা তাঁর চেয়ে বয়সে বড় এবং ধর্মে ব্রাহ্ম। আমদের গোঁড়া পরিবার সেটা মেনে নিতে পারেনি। বড় দাদা সত্যেন্দ্রনাথ পাহাড়ীজ্যাঠাকে বংশচ্যূত করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক রাখা নিষেধ হয়ে গিয়েছিল পরিবারের সকলের জন্য,” এমন অজানা তথ্য জানালেন তাঁর ভাইপো ব্রতীন্দ্রনাথ। অন্য দিকে, বিয়ের কয়েক বছর পর সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় প্রতিভাদেবীর। এর পরের পর্বের ঘটনাপ্রবাহের খবর ব্রতীনবাবুর কাছে তেমন ভাবে নেই। তিনি শুধু জানেন, “জ্যাঠা লখনউ ছেড়ে রামপুরের রাজার রাজসভায় কোর্ট সিঙ্গার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।” কারও মতে দেওয়ারের মহারাজার সেক্রেটারি হিসেবেও পাহাড়ী কাজ করেছেন। সময়টা ১৯৩১-’৩২ সাল। পাহাড়ী সান্যালের বয়স তখন ছাব্বিশ। এর দু’বছর পর ১৯৩৪ সালে অতুলপ্রসাদ মারা যান। প্রতিভা ও অতুলপ্রসাদের মৃত্যুশোক পাহাড়ীর জীবনে শূন্যতা আনলেও তাঁর পথ চলা থেমে থাকেনি। গায়ক জীবন ছেড়ে তিনি প্রবেশ করেছিলেন গায়ক-অভিনেতার নতুন এক জীবনপর্বে।

শোনা যায়, চিত্রগ্রাহক কৃষ্ণগোপালের মাধ্যমে নিউ থিয়েটার্সের প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘রূপলেখা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রথম চুক্তিবদ্ধ হলেও, সে ছবিতে কাজ করা হয়নি পাহাড়ীর। কিন্তু তথ্য বলছে, ‘রূপলেখা’ ছবির হিন্দি ভার্সান ‘মহব্বত কি কাসুত’-এ তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে দু’টি ছবিই মুক্তি পায়। দেবকী বসু তাঁকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে আসেন বলেও অনেকে মনে করেন। পাহাড়ী নিউ থিয়েটার্সে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে মাসিক ১৫০ টাকার চুক্তিতে যুক্ত হয়েছিলেন।

সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পৃথ্বীরাজ কপূর, পঙ্কজ মল্লিক, দেবকী বসু, রাইচাঁদ বড়াল, নজরুল ইসলাম, কাননদেবী, যমুনা বড়ুয়া প্রমুখ বাংলা ছবির প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে। এঁদের সান্নিধ্যে পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমার অপরিহার্য অভিনেতা হয়ে ওঠেন।

তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘ইহুদি কি লড়কি’। পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। চিত্রগ্রাহক নীতিন বসু। প্রধান চরিত্রে ছিলেন কে এল সায়গল, পাহাড়ী এবং রতন বাঈ। সে ছবিতে উমাদেবীর সঙ্গে তাঁর গাওয়া গান ‘প্রেম কি নাইয়া’। চলচ্চিত্র-সান্নিধ্যে তাঁর দিশেহারা মন হয়তো নোঙর ফেলার বন্দর খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু মেকআপ নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে তিনি যে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, তা তাঁর প্রথম দিকের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। অভিনয় নয়, সে সব ছবিতে তিনি বরং বেশি সচেতন ছিলেন গান গাওয়াতেই।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনের দশকে তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘অধিকার’-পরবর্তী ছবিগুলি থেকে অভিনেতা হিসেবে ক্রমশ নিজেকে ঘষে মেজে নিতে শুরু করেছেন, তা বোঝা যায়। সে যুগে কলকাতাতেই বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষারই ছবি তৈরি হত। খুব ভাল উর্দু জানতেন ও বলতে পারতেন বলে পাহাড়ী সান্যালকে আমরা বাংলা ও হিন্দি দুই ভার্সানেই কাজ করতে দেখি। যেমন হিন্দিতে ‘রাজরানী মীরা’, বাংলায় ‘মীরাবাই’, ‘ভাগ্যচক্র’/ ‘ধুপছাঁও’, ‘মায়া’/ ‘মায়া’, ‘দেবদাস’/ ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’/ ‘বড়িদিদি’ ইত্যাদি। তাঁর গাওয়া গানও সে যুগে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলপ্রসাদের গানও পাহাড়ী চলচ্চিত্রে একাধিক বার গেয়েছেন।

‘সদানন্দের মেলা’ ছবিতে ছবি বিশ্বাস, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে

পাহাড়ী সান্যাল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় ১৯৭টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। চারের দশকের গোড়ায় তিনি পৃথ্বীরাজ কপূরের সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দেন। সেখানেও ধারাবাহিক ভাবে ‘মৌজ’, ‘মহব্বৎ’, ‘ইনসান’, ‘আনবান’, ‘প্রীত’, ‘মিলন’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেন। এই সময়েই তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন অভিনেত্রী মীরা বসুকে। মীরাদেবী ‘শকুন্তলা’, ‘বাপ রে বাপ’ নামে দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। মীরাদেবীর প্রথম পক্ষের পুত্র অমিত বসুও একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। পাঁচের দশকে কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে পাহাড়ী সান্যাল ক্রমশ চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে যান। সেই সময় উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবী প্রমুখ পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতার সঙ্গেও তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। ভোলা যায় না ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে তাঁর গাওয়া অতুলপ্রসাদের গানখানি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে আত্মভোলা পক্ষীবিশারদ জগদীশকেই বা কে ভুলতে পারে! চিত্ত বসুর ‘জয়া’তে অভিনয়
করার জন্য তিনি ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পান।

অভিনয়দক্ষতা, দরাজ মন, গানের গলা, নবাবী মেজাজ সব মিলিয়ে পাহাড়ী ছিলেন একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। সন্দীপ রায়ের মনে পড়ে, “ওঁর একটা হুডখোলা ভক্সহল গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে চড়ে উনি কলকাতা শহর ঘুরে বেড়াতেন। লার্জার দ্যান লাইফ পার্সোনালিটি ছিল। আমরা তখন লেক টেম্পল রোডে থাকি। প্রায়ই বাবার কাছে আসতেন। প্রচণ্ড আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ একজন মানুষ। আড্ডার মধ্যেই গান হত। বাবা বুঝতে পারতেন, ইন্সট্রুমেন্ট ছাড়াও কী অসাধারণ গান গাইতে পারেন উনি! তাই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে ওঁকে দিয়ে গাইয়েছিলেন। ‘পরশ পাথর’ আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’তেও কাজ করেছেন। একটা ব্যাপার মনে আছে, তখন তো বিয়ে মানে পাত পেড়ে খাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। পাহাড়ীদাকে দেখলেই সকলে তটস্থ হয়ে যেত। কারণ উনি খুব চেঁচামেচি করতেন যাতে সবার খাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক মতো হয়। নিজে খাচ্ছেন আর খেয়ালও রাখছেন অন্যদের দিকে। মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছেন, ‘এখানে লুচি কম পড়েছে’, ‘ওঁকে চাটনি দাও’। ওঁকে নিয়ে ঘটনার শেষ নেই। একবার আমার জন্মদিনে বাড়িতে এসে আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন ‘এটা মাকে দিও’। আমি কিছু না বুঝে মায়ের হাতে সেই খাম দিলাম। দেখা গেল তার মধ্যে আমার জন্য একশো টাকা ভরা রয়েছে। সে যুগে সেটা অনেক টাকা।”

‘দেবদাস’ ছবিতে

পাহাড়ীবাবুর প্রতিবেশী ছিলেন নরেন্দ্র ও রাধারাণী দেব। নবনীতা দেবসেনের মনে আছে, “উনি জ্যোতি বসুর পাশের বাড়িটায় থাকতেন। আমার মামার সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব ছিল। রবিবার দিন যখন মামার বাড়ি যেতাম, ওঁর সঙ্গে দেখা হত। জমিয়ে আড্ডা মারতেন, গান গাইতেন, শায়েরি বলতেন। চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতেন। আমি তখন সদ্য বাবা-মায়ের সঙ্গে বিলেত ঘুরে এসেছি। ইংরেজিটা ভালই বলতে পারতাম। তাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন।”

সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে পাহাড়ীকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন অলকানন্দা রায়। “আউটডোরে শ্যুটিং হয়েছিল বলে অনেকগুলো দিন আমরা সবাই একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। ফলে শ্যুটিংয়ের বাইরেও মানুষটিকে দেখেছি, জেনেছি। শ্যুটিংয়ের পর দারুণ আড্ডা হত। মজাদার, ‘মাই ডিয়ার’ মানুষ ছিলেন উনি। মদ একেবারেই খেতেন না। পান খেতে ভালবাসতেন। মজা করে বলতেন ‘আমি পানাসক্ত’। ওঁর জরদা আসত লখনউ থেকে।”

লখনউকে এই ভাবেই পাহাড়ী সান্যাল নিজের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকত ওঁর বিখ্যাত বটুয়া বা ভ্যানিটি কেস। যার মধ্যে সিগারেট, পান, ক্লিপ করে রাখা খুচরো টাকা, এমনকী টফি বা চকলেটও থাকত। সে কালে হাওয়াইয়ান শার্টের খুব ফ্যাশন ছিল। চকরাবকরা ডিজাইনের শার্ট পরতেন। একদিন যে শার্ট পরলেন, পরের দিন আর সেটা পরবেন না। বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মনে আছে, ‘‘সেটা ১৯৬৫-’৬৬ সালের কথা। কোনও প্রসঙ্গে আমি ওঁকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে বলায় উনি বলেছিলেন, ‘তোমার তো এই রোগাপটকা চেহারা! এই শরীর নিয়ে তুমি আবার হিন্দুস্থানি গান গাইবে কী করে? হিন্দুস্থানি গান গাইতে গেলে শক্তি লাগে।’’

অরুণবাবু ছিলেন কিরানা ঘরনার শিল্পী, আর পাহাড়ী সান্যাল লখনউ ঘরানার। কিন্তু তাই বলে দু’জনের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠতে কোনও অসুবিধা হয়নি। উস্তাদ মৈনুদ্দিন ডাগরের স্মৃতির উদ্দেশে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। আমি সেই অনুষ্ঠানে নটভৈরব রাগ গেয়েছিলাম। আমার গান শুনে সে দিন উনি আমায় পাঁচশো টাকা, একটা কাশ্মীরি শাল আর একবাক্স মিষ্টি দিয়ে বলেছিলেন ‘সাবাশ’! প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি। খুব ভালবাসতেন কাটাপোনা মাছ খেতে। উনি নিজেও নিয়মিত বাজারে যেতেন। গড়িয়াহাট বাজারের বিক্রেতারা ওঁর খুব ভক্ত ছিলেন। যোগেশ দত্তের বাড়িতেও আমাদের বিরাট আড্ডা বসত। বড় গামলায় মুড়িমাখা খেতে খেতে আড্ডা চলত। আড্ডা মানে গান। কীর্তন, অতুলপ্রসাদ, ঠুমরি এই সব গাওয়া হত। আমার স্ত্রী ওঁর কাছে অতুলপ্রসাদের গান শিখতেন।”

যেটা সবচেয়ে আশ্চর্যের তা হল, পাহাড়ী নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে কখনও পছন্দ করতেন না। অরুণবাবুর মেয়েকে যখন সত্যজিৎ রায় কোনও একটা ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন, পাহাড়ী সান্যাল তাতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন।

শেষ জীবনটা তাঁর বড় অর্থকষ্টে কেটেছিল বলে লিখেছেন সাংবাদিক রবি বসু। তাই হয়তো যে-নাটকের দুনিয়াকে চিরকাল এড়িয়ে চলেছেন, সেই নাটকের মঞ্চেই (‘আসামী হাজির’) তিনি অভিনয় করতে এসেছিলেন আর্থিক কারণে। মীরাদেবীর অসুস্থতা বাড়ির পরিবেশকে ভারী করে তুলেছিল। পাহাড়ী সান্যাল কোনও দিনই সেটা বুঝতে দিতে চাননি। তাঁর হাসিখুশি মজলিসি মেজাজ জীবনের শেষদিন অবধি বজায় ছিল।

তাঁর বড় দাদার মেয়ে রিনা লাহিড়ী জানালেন, “মঞ্চে অভিনয় চলাকালীনই উনি বুকে ব্যথা টের পান। রাতে বাড়ির বাথরুমে পড়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় সেরিব্রাল স্ট্রোক। পরদিন (১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪) সব শেষ।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement