আলোচনা

মর্মরতা যখন বাক্যবহ

সুদীর্ঘ সময়ের বিপুল ভাস্কর্যসম্ভার তিনি রিয়্যালিস্টিক, অ্যাবস্ট্রাক্ট, সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট রীতিতে সম্পাদনা করেছেন। কালী, কৃষ্ণ, দুর্গা, বুদ্ধ থেকে আদিবাসী জনজাতির জীবন, সমাজ সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও বিষয় হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৪২
Share:

অপত্য: অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত রামকিঙ্কর বেজের শিষ্য তারক গড়াইয়ের রেট্রোস্পেকটিভ শোয়ে প্রদর্শিত অন্যতম একটি ভাস্কর্য

গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এ কালের শিল্পী তারক গড়াই। ভারতীয় ভাস্কর্যে আধুনিকতার প্রাণপুরুষ রামকিঙ্কর বেজের সুযোগ্য এই শিষ্যের পাঁচ দশকের শিল্পসামগ্রী নিয়ে রেট্রোস্পেক্টিভ শো হল অ্যাকাডেমিতে। সুদীর্ঘ সময়ের বিপুল ভাস্কর্যসম্ভার তিনি রিয়্যালিস্টিক, অ্যাবস্ট্রাক্ট, সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট রীতিতে সম্পাদনা করেছেন। কালী, কৃষ্ণ, দুর্গা, বুদ্ধ থেকে আদিবাসী জনজাতির জীবন, সমাজ সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও বিষয় হয়েছে। যদিও মা-শিশুর আত্মিক সম্পর্ক তথা মাতৃভাবই তাঁর কাছে প্রেয় মার্গ। প্রধানত তিনি অবয়বধর্মী ভাস্কর, পাশাপাশি একজন বলিষ্ঠ, দক্ষ পোর্ট্রেট শিল্পী ও চিত্রশিল্পীও। বিষয়বস্তু, মাধ্যম, শৈলী ও ধারার সব ঘাটেবাটে তাঁর স্বচ্ছন্দ দেওয়া-নেওয়া হলেও তিনি ট্রাইবাল, ফোক, প্রিমিটিভ রীতির মিশ্রণে যুগোপযোগী এক সংশ্লেষণ করেছেন, যা দেশজ ও দেশীয়।

Advertisement

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্রোঞ্জ প্রতিকৃতিগুলিতে প্রধান কাঠামো বা স্কাল থেকে শুরু করে ক্রমে উপরিতলে এসেছেন। ফলে ব্যক্তিত্ব, চরিত্র এবং অভিব্যক্তি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। বিশেষ করে রামকিঙ্করের প্রাণবন্ত পোর্ট্রেটগুলির অায়াসহীন স্বচ্ছন্দ সম্পাদনা খুবই আকর্ষণীয়। ডিডাকশান ও মডেলিং পদ্ধতিতে করা পরিতোষ সেন এবং সোমনাথ হোড়ের কাজ দু’টিতে ধাতুর দৃঢ়তা, মাটির জৈবিক গুণ, সংবেদনশীলতা এগুলিকে সজীবতা দিয়েছে। শিল্পীর টেরাকোটা পদ্ধতির ‘মাদার চাইল্ড’, ‘ট্রাইবাল কুইন’, ‘শৃঙ্গার’ কাজগুলি পরিণত। সহজ আকারের সঙ্গে আদিম সরলতা মিলেমিশে এক অন্য নান্দনিকতা।

কৃষ্ণ ও বুদ্ধের পাথরের প্রতিকৃতি দু’টিতে শিল্পী নিজের গভীর উপলব্ধি সরু সরু চিজেল মার্কের মধ্য দিয়ে ‌ভাস্কর্যে সঞ্চারিত করেছেন। একজন মহাজাগতিক সুরবাদক, অন্য জন চৈতন্যময় সুপার সেলফ, কেবল মাত্র অধরোষ্ঠের ভাব-ব্যঞ্জনাতেই পরিস্ফুট হয়েছে।

Advertisement

ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যগুলি ফ্রি স্ট্যান্ডিং এবং সবই গ্রুপ ফিগার। ‘টুইনস উইথ মাদার’, ‘টুইনস প্লেয়িং উইথ স্নেক’, ‘ফাউন্ডনেস’, ‘শৃঙ্গার’, ‘দি হাস্কিং পেডাল’ কাজগুলিতে সূক্ষ্ম একটি ভূ-লম্ব রেখা বা গ্র্যাভিটেশনাল অ্যাক্সিস এগুলিকে নিখুঁত ভাবে ভারসাম্যে ধরে রেখেছে। কম্পোজিশন কমপ্যাক্ট, পরস্পর সংযুক্তি বা ইন্টারলকিং এগুলিকে বিশেষ ভাবে সুসংবদ্ধ করেছে। ফ্রি জেনারেশন কাজটির সুঠাম ঋজু অবয়বগুলিতে মাটির ছোট ছোট স্ট্রোক পরস্পর মিলেমিশে স্পর্শানুভূতিসম্পন্ন সমৃদ্ধ গাত্রতল তৈরি করেছে। একই সঙ্গে জেশ্চার পশ্চারের ভাবভাষা এবং কনটুর রেখা এগুলিতে গতিময়তা এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্তকরণ থাকলেও একই সঙ্গে ডিটেলে আলংকারিকতা এনেছেন। রচনাগুলি সর্বদাই অদৃশ্য ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ জ্যামিতিক স্পেসের মধ্যে করা হয়েছে। স্ট্রাকচারের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ, ফলে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতাও এসেছে।

‘ডিপ স্লিপ’ ভাস্কর্যটিতে শান্ত অদৃশ্য ছায়াতলে বাচ্চা-কাচ্চা-পোষ্য নিয়ে আদিবাসী পরিবারটি নিদ্রা যাচ্ছে, তা যেন অদ্ভুত মাধুর্যময় এক পরিবেশ।

প্রদর্শনীটি দেখে মনে হল, যুগান্তরের কোনও প্রাচীন সুর যেন মিলেমিশে রয়েছে, যা বড়ই মাটির কাছাকাছি ও দর্শককে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

শমিতা নাগ

মুখোমুখি দুই প্রজন্ম

বিপ্লব, প্রেম, যৌনতা, প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নিয়ে এক আশ্চর্য শক্তিশালী নাটক ‘কিউমুলোনিম্বাস’ প্রযোজনা করেছে বেলঘড়িয়া হাতেখড়ি নাট্যদল। তরুণ নাট্যকার হিমাদ্রীশেখর দে-র লেখা ও দেবাশিস ঘোষ দস্তিদারের নির্দেশনায় এ নাটকের অভিনয় সে দিন মিনার্ভা থিয়েটারে উপস্থিত শ’দেড়েক দর্শককে স্তব্ধ ও বিস্ময়াভিভূত করে রেখেছিল। কার্টেন-হীন সে দিনের মঞ্চে হিরণ মিত্রের নামমাত্র উপকরণে তৈরি দৃশ্যরূপের ব্যঞ্জনা যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তা ক্রমে বিশ্বজিৎ দাসের আগলভাঙা অথচ নিয়ন্ত্রিত অভিনয় এবং হিমাদ্রীশেখরের লেখা আশ্চর্য সংলাপমালার আশাতীত উচ্চারণ অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। তেমনই দুরন্ত সঙ্গত ছিল অরব ও অভিষেকের মিউজিক— নৈঃশব্দ্যের স্তব্ধতা থেকে ব্যর্থতার যন্ত্রণা, ব্যক্তিমনের ভাঙন থেকে ইতিহাসের ভয় ধরানো দাপুটে অভিব্যক্তির স্বর সমস্তই যেন চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। এই অভিনয়ের কেন্দ্রে আছে নকশালবাড়ি আন্দোলনের এক সৈনিক কমরেড তুষার— বিশ্বজিৎ দাস যে চরিত্রে রূপদান করেছেন। চার দশক পেরিয়ে এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও তুষার যেন বেঁচে আছে নকশাল আন্দোলনের সেই বজ্রনির্ঘোষ দিনগুলিতে। তার স্মৃতির দৃশ্যমান বাস্তবে বারবার চলে আসে গুলি খাওয়া কমরেড অনিকেত, অনুপ বোস, শঙ্কু দত্তরা। চলে আসে শ্রীকাকুলাম, বীরভূম, দেবরা, গোপীবল্লভপুর, লখিনপুর, খেরি। চলে আসে কমরেড কানু সান্যালের ঘোষণা, নতুন পার্টির কথা।

ঠিক স্মৃতিময় বাস্তবের ইলিউশনের উল্টো প্রান্তে রয়েছে বৃদ্ধ তুষারেরই পুত্র পরিচয়ে বেড়ে ওঠা বন্ধুসন্তান রেহান ও পুত্রবধূ দিয়ানা। বৃদ্ধ শ্বশুরের যন্ত্রণা ও আর্তির সমব্যথী দিয়ানার সঙ্গে তুষারের আশ্চর্য সংলাপ দৃশ্যগুলি সরলরৈখিক অবস্থান থেকে ক্রমশ জটিল ও কৌণিক হয়ে দুর্দান্ত সব স্পেস তৈরি করে দর্শকের চিন্তাজগতে। প্রেম ও যৌনতা, মধ্যবিত্তের ভোগবাদী মন ও মানসিকতার স্তর ছুঁয়ে এ নাটক প্রায়শই দর্শকদের ছুড়ে দেয় সেই অনতি-অতীতে। কথা ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার, তার বদলে আজ টেকনোলজি, মিডিয়া, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স দিয়ে শহরই মুঠোয় পুরেছে গ্রামকে। ত্যাগ, স্পর্ধা ও সাহস বদলে গিয়েছে ভোগে, বিনয়ে আর আপসে। এ নাটক দুই প্রজন্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দর্শককে অপ্রস্তুত এক আত্মপ্রশ্নে ঠেলে দেয়। শেষ দৃশ্যে তুষারের মৃত্যুর পর এক তরুণ যখন মঞ্চের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত লাল-সাদা ফিতেয় মুড়ে দিতে থাকে, নেপথ্যে ভেসে আসে তুষারের কণ্ঠ— ‘‘হাত ধরে নেমে এসো। খোলা রাজপথে আবার তোমাদের সাহসী, দুর্জয় অপ্রতিরোধ্য মুখ দেখতে চাই। মৃত পুরনো বন্ধুদের মতো।’’ কাঁপনধরা এই সব দৃশ্যাবলি আমাদের স্মৃতিতে চিরদিন থাকবে।

শুধু দুটো আপত্তি— ডাক্তারের মুখে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার কারণতত্ত্ব খুবই বেমানান লেগেছে। আর দিয়ানা চরিত্রে বড্ড জড়োসড়ো মনে হয়েছে রায়তী বসুকে। এটুকু বাদ দিলে এ নাটক দেখা দর্শকের কাছে সত্যিই একটা বড় অভিজ্ঞতা।

মলয় রক্ষিত

মিল নেই গানে ও শিরোনামে

সুরঙ্গমা কলাকেন্দ্র আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘তবু মনে রেখো’ অনুষ্ঠিত হল ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চে। শুরুতেই মহড়া-বিহীন উদ্বোধন সঙ্গীত পরিবেশন করলেন সংস্থার শিল্পীরা। কুড়ি জনেরও বেশি শিল্পীর কণ্ঠে গান ও আবৃত্তি পরিবেশিত হল। তাঁদের মধ্যে স্বপ্না ঘোষাল ও শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান শ্রোতাদের মনকে স্পর্শ করেছে।

বলতে বাধা নেই, অনুষ্ঠানের শিরোনামের সঙ্গে অনেক শিল্পীর সঙ্গীত পরিবেশনে কোনও সাযুজ্য নেই, যা শুনে বিস্মিত হতে হয়।

কাশীনাথ রায়

শব্দ-বন্ধুর সান্নিধ্যে

শব্দের ক্ষমতা অসীম। শব্দে আছে শান্তি। ক্লান্ত মনের শুশ্রূষা করে শব্দের প্রলে‌প। বাচনিক শিল্পী সংস্থা আয়োজিত ‘নান্দনিক বাচনিক’ অনুষ্ঠান শব্দের সঙ্গে আর এক বার সখ্য স্থাপন করল। রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন প্রদীপ ঘোষ। কোরাসে কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শব্দের জয়যাত্রা। দেবেশ ঠাকুর, সোহিনী সেনগুপ্ত, প্রণতি ঠাকুর, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসুর মতো বাচিক শিল্পীদের মনোজ্ঞ পরিবেশনে ভরে উঠেছিল শ্রোতাকুলের মন। সঞ্চালনা করেছেন দেবাশিস বসু ও চন্দ্রমৌলি বন্দ্যোপাধ্যায়।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

অনুষ্ঠান

• সম্প্রতি রঙ্গিলা নাও ও অভিব্যক্তি ইন্দুমতী সভাগৃহে আয়োজন করেছিল ‘প্রাণ দরিয়া প্রেম’। প্রথমেই ছিল মাতৃবন্দনা। গণেশ বন্দনায় ছিলেন অরিত্রা সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রসংগীতে শেষের কবিতা এবং আবৃত্তিতে মৈত্রেয়ী রায়। অভিব্যক্তি আয়োজন করেছিল শ্রুতিনাটক ‘শেষ অন্তরা ও রাক্ষসী’র। অভিনয় করেন চন্দন মজুমদার, প্রসেনজিৎ ঘোষ, হীরালাল শীল প্রমুখ। শেষে ছিল রঙ্গিলা নাও-এর ‘মাটির গানে’। গানে ছিলেন সুদীপ্তা, অমিতা, কল্যাণী প্রমুখ। সমগ্র অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনা করেন অর্পিতা ঘোষ।

• বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সোনারতরী কলাকেন্দ্র আয়োজন করেছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সংগীতে ছিলেন জয়তী ভট্টাচার্য, মধুছন্দা ঘোষ, ঋতুপর্ণা রায়, কল্যাণী রায় সান্যাল প্রমুখ। আবৃত্তি করেন দেবাশিস মিত্র, অরুণাভ বিশ্বাস, মহুয়া দাস প্রমুখ। সঞ্চালনায় নিমাই মণ্ডল ও অর্পিতা গঙ্গোপাধ্যায়।

• ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামে বিস্তার আয়োজন করেছিল চার দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের। এ দিন সরোদে ছিলেন জয়দীপ ঘোষ, দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য, সিরাজ আলি খান প্রমুখ। সেতারে আয়ুষ চক্রবর্তী, শুভ চক্রবর্তী, অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। কত্থক প্রদর্শন করেন শ্রুতি মজুমদার, দেবাংশু মণ্ডল প্রমুখ। কণ্ঠশিল্পী ছিলেন পণ্ডিত দেবাশিস দে, সানিয়া পটনাকর, বেদান্তিকা মুখোপাধ্যায়, অমরেন্দ্র ধনেশ্বর প্রমুখ।

• আইসিসিআর এবং হেরি়টেজ বেঙ্গল-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল ‘কালচারাল ফেস্টিভ্যাল অফ ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী এবং নৃত্য প্রদর্শন করে মঙ্গোলিয়া গ্রুপের শিল্পীরা।

• শিশির মঞ্চে সম্প্রতি কৃষ্ণকলি আয়োজন করেছিল একটি রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান। একক রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শ্যামল সাহা। পরে কৃষ্ণকলি সংস্থার ছাত্রছাত্রীরা মিলে নিবেদন করেছিলেন ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement