বাঙালি সাইনা

ব্যাডমিন্টন-দুনিয়ায় ভারতের এক নম্বর ঋতুপর্ণা দাস। তাঁর এই সাফল্য কোথায় যেন বাংলাকে লজ্জায় ফেলে। লিখছেন সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়প্লিজ আমাকে খেলার অনুমতি দিন। খেলতে না পারলে আমি মরে যাব!’’ সংলাপটি চেনা চেনা? ব্যাডমিন্টন নিয়ে বাংলায় সেই মেগা সিরিয়ালটির মতো? হতে পারে, তবে এ কোনও রিল লাইফের সংলাপ নয়, ঘোরতর রিয়েল লাইফের! সিরিয়ালের দিয়ার তার ব্যাডমিন্টন-বিদ্বেষী বাবাকে বলা কথা নয়, ঋতুপর্ণা দাসের তাঁর ব্যাডমিন্টন-গুরুকে বলা কাতর অনুরোধ!

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

প্লিজ আমাকে খেলার অনুমতি দিন। খেলতে না পারলে আমি মরে যাব!’’
সংলাপটি চেনা চেনা? ব্যাডমিন্টন নিয়ে বাংলায় সেই মেগা সিরিয়ালটির মতো?
হতে পারে, তবে এ কোনও রিল লাইফের সংলাপ নয়, ঘোরতর রিয়েল লাইফের!
সিরিয়ালের দিয়ার তার ব্যাডমিন্টন-বিদ্বেষী বাবাকে বলা কথা নয়, ঋতুপর্ণা দাসের তাঁর ব্যাডমিন্টন-গুরুকে বলা কাতর অনুরোধ!
‘‘কী বলব? খুব কম বাঙালি স্পোর্টসম্যানকেই দেখেছি যে কিনা মারাত্মক চোট উপেক্ষা করেও খেলেছে। জিতেছে। বিশ্রাম নাও বললেও শোনেনি। এমনকী কোচকে হাতজোড় করে কাতর অনুরোধ করেছে, প্লিজ আমাকে খেলার অনুমতি দিন। খেলতে না পারলেই বরং আমি মরে যাব,’’ হায়দরাবাদ থেকে পত্রিকা-কে ফোনে বলছিলেন পুল্লেলা গোপীচন্দ।
অথচ এই গোপীই এক সময় সেই মেয়ের হলদিয়া পেট্রোকেম-কর্মী বাবা আর গৃহবধূ মা-কে অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘হবে না। এই মেয়েকে দিয়ে হবে না। নিয়ে চলে যান বাড়িতে। কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ভীষণ অলস। বাড়তি ট্রেনিংয়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।’’
সেটা ২০০৯ কী ১০-এর ঘটনা।
পরের পাঁচ বছরে কী এমন ঘটল যে, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের মহা-মেন্টরেরও এমন ডিগবাজি!
ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। এখানেও যেন সেই রিল আর রিয়েল লাইফ মিলেমিশে একাকার! মেগা সিরিয়ালের দিয়া আর হলদিয়ার ঋতুপর্ণা যেন সেখানেও একটাই ফ্রেমে ধরা পড়ে!
বারো বছর বয়সে পটনায় অনূর্ধ্ব-১৩ মিনি ন্যাশনালে ঋতুপর্ণা দাসকে ডাবল করতে দেখে (সিঙ্গলস-ডাবলস দু’টোই চ্যাম্পিয়ন) কোর্টেই হায়দরাবাদে নিজের অ্যাকা়ডেমির জন্য চুক্তিবদ্ধ করে নিয়েছিলেন গোপী। তার পর থেকে গাচ্চিবোলি-ই ঠিকানা হলদিয়ার বাঙালি টিনএজার মেয়ের।

Advertisement

যে মেয়ে কিনা সাইনা-সিন্ধুর ব্যাডমিন্টনের পৃথিবীতেও ভারতের এক নম্বর! গত দু’বারের জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন, দু’বারের জাতীয় সিনিয়র রানার আপ।

সত্যিই, এমনই ‘রোলার কোস্টার’ ব্যাডমিন্টন কেরিয়ার কুড়ি বছরে পৌঁছনোর আগেই ঋতুপর্ণার। এই গোপী স্যারের বকাঝকা খাচ্ছে। এই আবার মহাগুরুর প্রশংসা কুড়োচ্ছে।

Advertisement

সাইনা-সিন্ধুর দেশে ঋতুপর্ণার এক নম্বর র‌্যাঙ্কিং নিয়ে চমকানোর কিছু নেই। সাইনা নেহওয়াল আর পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু— দুই হায়দরাবাদি মেগাতারকা যেহেতু ঘরোয়া ব্যাডমিন্টনে খেলেন না, বছরভর পেশাদার সার্কিটে ব্যস্ত থাকেন, সে জন্য ভারতীয় ব্যাডমিন্টন সংস্থার র‌্যাঙ্কিং তালিকায় তাঁরা দু’জন নেই-ই।

তা-ও বাকিদের পিছনে ফেলে কোনও এক বাঙালি মেয়ের দেশের এক নম্বর হওয়াটা কম গৌরবের নয়। বরং জাতীয় গেমসে হাতে গোনা পদক জেতা টিমটিমে বঙ্গ খেলাধুলোর বিরল এবং উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন ঋতুপর্ণা।

তাতেও কী লজ্জা!

ঋতুপর্ণা বাংলার নয়। সে গাচ্চিবোলি অ্যাকাডেমির ডর্মিটরিতে কাটানোর সময়ে নয়। কিংবা বর্তমানে তার থেকে অনতিদূর রামনগরে ছয় হাজার টাকা ভাড়া গুনে আট বাই ছয় খুপরি ঘরে একা একা থাকার সময়ে নয়। অথবা এই সে দিন হলদিয়ায় দিন কয়েকের জন্য ঘুরে যাওয়ার সময়েও নয়!

মাস আড়াই আগে হায়দরাবাদের ঘরে পায়ে প্লাস্টার, খাটে আধশোয়া ঋতুপর্ণা, কিংবা গত সপ্তাহে হলদিয়ায় সিটি সেন্টার, হলদি নদীর ধারে বেড়ানো ঋতুপর্ণা, যা-যা বললেন, তার নির্যাস হল এই—

হলদিয়ায় ছয় বছর বয়সে র‌্যাকেট হাতে নেওয়ার পর সোমনাথ কর, সুরজিৎ সেনগুপ্তর মতো স্থানীয় কোচেদের কাছে কিছু দিন ট্রেনিং নিয়েছেন। আর মাঝেসাঝে কলকাতায় লাল্টু গুহ, বাদল ভট্টাচার্যের টিপস পেয়েছেন। এ বাদে বাংলা ব্যাডমিন্টন মহল বঙ্গকন্যার জন্য বিশেষ কিছু করেনি।

বরং জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি শিবিরে কাঠের মেঝেতে প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় সামান্য অনুযোগ করেছিলেন বলে, খেসারত দিতে হয় তাঁকে। বয়স ভিত্তিক নানা মিনি ন্যাশনালে ভাল পারফরম্যান্সের পরেও জোটে নিজের রাজ্যের উপেক্ষা।

নিটফল? ঋতুপর্ণা এখন তেলঙ্গানার।

এ বছরই কেরলে জাতীয় গেমসে তেলঙ্গানাকে টিম চ্যাম্পিয়নশিপের সোনা এনে দিয়েছেন বাঙালি মেয়ে হাঁটুর চোট নিয়ে খেলেও।

খেলার নেশায় বুঁদ মেয়েটি তার পরে কলম্বো গিয়েছেন ভারতীয় দলের সঙ্গে। গোপী স্যারের বারণ সত্ত্বেও। হ্যামস্ট্রিং ছিঁড়ে সফরের মাঝপথেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। হায়দরাবাদের নামী হাসপাতালে অস্ত্রোপচারও হয়েছে।

সে দিন হলদি নদীর পারে ঋতুপর্ণা।

কিন্তু দেখতে যাকে মুখচোরা, ভিতু গোছের টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে, ব্যাডমিন্টন কোর্টে তিনিই দুর্বার। ভয়ঙ্কর বন্যার মতো। উদ্দাম। মারাত্মক ঝড়ের মতো। ক্ষিপ্র।

মানসিকতা? সেটাও যেন কোনও বাঙালির থেকে অপ্রত্যাশিত! বজ্রকঠিন। অনড়। অফুরন্ত সহ্যশক্তি।

মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে জন্ম বলে দাদুর আদরের ‘গাঁধীবুড়ি’ আজ ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের যুবরানি। বাই-এর (ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া) প্লেয়ার আইডি ২৮৮৫ আজ আর ঋতুপর্ণা দাসের প্রকৃত পরিচয় নয়। হতে পারে না।

বিডব্লিউএফ-এর (ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন) প্লেয়ার আইডি ৬৭৮৬৪-ই ঋতুপর্ণা দাসের এখন আসল পরিচয়। হলদিয়ার বাঙালি মেয়ে আজ যে বাংলা, তেলঙ্গানা, ভারত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক!

‘‘আমার ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং এখন একশো সত্তরের ঘরে। পরের ছয় মাসে ওটাকে প্রথম তিরিশে আনাই আমার এখন টার্গেট। তা হলে পরের বছর রিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পাব,’’ হলদি নদীকে সাক্ষী রেখে বলার সময় অদ্ভুত একটা আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল অষ্টাদশীর গলায়। যেন ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন তা-ই নয়, রীতিমতো জানেন তিনি পারবেন।

যেমন জানেন, ব্যাডমিন্টনে একমাত্র বাঙালি মেয়ে অলিম্পিকে নেমেছেন মধুমিতা সিংহ বিস্ত। বর্তমানে জাতীয় দলে ঋতুপর্ণাদের কোচ।— ‘‘দিদির কীর্তিকে ছুঁতেই হবে আমাকে,’’ বলে দিলেন মহানন্দ দাস-অনন্যা দাসের ছোট মেয়ে। এম টেক দিদি সুপর্ণা দাসের বোন।

এ বছরই কমার্স নিয়ে প্রাইভেটে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে, ভবিষ্যতে গ্র্যাজুয়েশনটাও কমপ্লিট করতে চান। মনে করেন, পড়াশোনা প্লেয়ারের গেমপ্ল্যানিংয়ে বাড়তি সাহায্য করে। গোপী স্যারের কড়া ট্রেনিং শিডিউলের চাপে পুজোর ছুটিতেও বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। তার জন্য কোনও আক্ষেপ নেই।

বরং সেই সময় গাচ্চিবোলির ফাঁকা অ্যাকাডেমিতে সিন্ধু-সাইনার (যত দিন গোপীর অ্যাকাডেমিতে ছিলেন) সঙ্গে বেশি আড্ডা মারার সুযোগ নিয়ে দুই মহারথী সিনিয়র দিদির খেলার ‘প্লাস’গুলো নিজের মাথায় গেঁথে নেন।— ‘সাইনাদির পাওয়ার আর সিন্ধুদির ডিপ স্ম্যাশ আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওই দু’টো জিনিস আমার খেলায় আনতেই হবে,’’ বলছিেলন ঋতুপর্ণা।

মানে বাংলার সাইনা।

মানে আমাদের সাইনা।

ভুল হল, তেলঙ্গানার বাঙালি সাইনা!

ছবি: উৎপল সরকার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement