Art Exhibition

তিন সদস্যের হাত ধরে বত্রিশে পা

২০০৪ সাল থেকে শিল্পী প্রাণগোপালের ছবির উদ্দেশ্য ঘুরে যায় প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সম্মুখীন অবস্থাকে তুলে ধরেন কাল্পনিক এক গভীর উপলব্ধিতে।

Advertisement

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:১৮
Share:

ত্রয়ী: ‘দ্য ফ্রেম’ আয়োজিত শিল্পীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

শহরের প্রতিশ্রুতিমান শিল্পীদের একটি দল ‘দ্য ফ্রেম’ সম্প্রতি আয়োজন করেছিল একটি প্রদর্শনীর। অংশগ্রহণকারী বরিষ্ঠ তিন শিল্পী— সৌমিত্র কর, প্রাণগোপাল ঘোষ ও দেবাশিস সামন্ত। ১৯৯২ সালে গড়ে ওঠা এই দলটি এ বছর বত্রিশে পা রেখেছে। সেই উপলক্ষে দলের তিন প্রধান প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য সৌমিত্র, প্রাণগোপাল ও দেবাশিসের পুরনো ও নতুন ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হল, আলিপুরে, দলের নিজস্ব গ্যালারিতে। শিরোনাম ‘থ্রি ফ্রেম’।

Advertisement

অভিনব কাঠামোয় নির্মিত এই প্রদর্শনীর অভিমুখ অনুসারে প্রদর্শনীকক্ষের বাঁ দিকের দেওয়ালে প্রথমেই চোখে পড়ে ক্যানভাস বোর্ডে করা শিল্পী প্রাণগোপাল ঘোষের পাঁচটি সম মাপের ছবি। কম্পোজ়িশন অনুসারে আগের আর পরের কাজের সময়, বেগ ও রঙের প্রকৃতিতে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। প্রথম দিকের অবয়বধর্মী ড্রয়িংয়ে পশ্চিমি আন্দোলনের ইঙ্গিত থাকলেও, ছবির নির্দিষ্ট জমিতে হালকা মিশ্র রঙের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

২০০৪ সাল থেকে শিল্পী প্রাণগোপালের ছবির উদ্দেশ্য ঘুরে যায় প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সম্মুখীন অবস্থাকে তুলে ধরেন কাল্পনিক এক গভীর উপলব্ধিতে। যার প্রকাশ দেখা যায় বাকি তিনটি ‘নেচার’ ছবিতে। অনবরত টেক্সচার নিয়ে কাজ করার ফলে ছবির সৌন্দর্য উঠে আসে রঙের বিভিন্ন স্তরের মূল্যায়নে। শিল্পীর কথায়, “আমার ছবির আসল জায়গা হল, রং দিয়ে আবহ সৃষ্টি করা। যা দেখেছি বা সরাসরি এঁকেছি, তা নয়। আমার মতো করে ইম্প্রোভাইজ় করা।”

Advertisement

অ্যাক্রিলিক কালার ও অ্যাক্রিলিক জেল সন্তর্পণে ব্যবহার করার কথাও তুলে ধরেন প্রাণগোপাল। এতে রং অনেকক্ষণ নরম থাকার ফলে স্ক্র‍্যাচ করতেও সুবিধে হয়। যেমন— ‘হোপ ইন ব্ল্যাক’ দিনের বেলায় দেখা লাউগাছের ফুলের রূপ। রাতের ঘন অন্ধকারে কী ভাবে তা আশার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, সেই ভাবনা থেকে ছবিটি করা। লক্ষ করা যায়, ব্যাকগ্রাউন্ড গাঢ় অন্ধকার হলেও, টোনের ক্রম-পরিবর্তনে পাতা ও সরু সরু ডালের গতিপথে, আলোকিত হয়েছে গায়ের রোঁয়া নিয়ে ধবধবে সাদা একটি লাউ ফুল। নীলের ক্রমিক পর্দায় চিত্রভাষার গুণমান বাড়িয়ে তোলেন শিল্পী।

পরের দেওয়ালে ছিল গোয়াশে করা দেবাশিস সামন্তর তিনটি কম্পোজ়িশন ও কালি-কলমের বেশ কিছু ড্রয়িং। ’৯৭ সালের অস্থিরতা একজন সমাজসচেতন শিল্পীকে যে কতটা তীব্র ভাবে নাড়া দিতে পারে, তার চরম উদাহরণ কালি-কলমের ‘ভিসুয়াল ডায়েরি’। ২০১১ সালে করা ‘গার্ডেন’ সচেতন ভাবে কোনও নির্দিষ্ট আখ্যানের কথা বলে না, বরং অনেক ঘটনার সমষ্টিকে একটি সারফেসে তুলে ধরার নিপুণ সম্পাদনার প্রতীক হয়ে ওঠে।

দেবাশিস সামন্তর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মানব-প্রকৃতির ধ্বংসাবশেষ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বনির্মিত গুঁড়ো রঙের আশ্রয়ে, তুলট পেপারের উপরে ‘বার্ড’ কম্পোজ়িশনটিতে টোনের হ্রাস বৃদ্ধি না থাকলেও, ইয়েলো অকার, বার্ন্ট সায়না ও গ্রেইশের অস্তিত্বে, টুকরো গাছের দিকে পাখির উড়ে আসার ভঙ্গিতে, সঙ্কটের আবহ তৈরি হয়। ইদানীং কাজের মধ্যে বিষাদ, বিক্ষোভ নিয়ে করা আটটি জোরালো ড্রয়িংয়ের ফর্মে (২০২৪) অতীতের আয়তন ও কাঠামো থেকে সরে এলেও, শিল্পীর বক্তব্যের শিকড় একই ভাবে ধ্বনিত হয়।

দীর্ঘ অন্বেষণের পথে বিরামহীন চিত্রশিল্পী সৌমিত্র করের রচনায় ফুটে ওঠে গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি ও লোকাচারের প্রতি অটুট বিশ্বাস। অ্যাসিড ফ্রি বোর্ডে টেম্পারায় করা পাঁচটি কাজের প্রথম ছবির নাম ‘ট্র‍্যাডিশন’। এক সময়ে নিজের ভাবনায় বারাণসীর কিছু সিরিজ় করেন। সেখান থেকেই ভার্টিক্যালি এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি শিবলিঙ্গ। শীর্ষে রয়েছে একটি চোখ, যেটির ব্যবহার শিল্পীর প্রায় প্রতিটি কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পূজারি ছাড়াও, অবস্থানের সৌন্দর্যে গঙ্গাতীর অভিমুখী পায়ের ছাপ, কমণ্ডলু, ষাঁড়, ঘুড়ির ব্যবহার, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ছবিটি সরাসরি ক্লাসিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। আপাত দৃষ্টিতে ফ্ল্যাট টোনের ছাপ মনে হলেও, গভীর ভাবে লক্ষ করা যায়, অজস্র রঙের লেয়ার এবং তার উপরে নিখুঁত ঘন স্ট্রোক। অনুমান করা যায়, এ ধরনের ছবির নির্মাণ বেশ সময়সাপেক্ষ। শিল্পীর ছবির ঢাল ভারতীয় মিনিয়েচারের দিকে গেলেও, পরিপ্রেক্ষিতের মূল সূত্রে পাশ্চাত্য রীতির প্রভাব দেখা যায়।

আর একটি ছবির নাম ‘নবান্ন’। শিল্পীর খুব প্রিয় একটি বিষয় এটি, কারণ গ্রামীণ এই উৎসবগুলিকে কাছ থেকে তাঁর দেখা। শস্যপুজো, ভূমিপুজো ইত্যাদি নিত্য পালনীয় আচার-বিশ্বাসে নিজেকে সঁপে দিয়ে একের পর এক মনোভূমি রচনা করেন শিল্পী। কখনও মিশ্রিত সবুজ-হলুদ রঙের জমিতে ধানের ছড়া, মাটির রং উঠে আসে সমীকরণের উন্নয়নে। রাধাগোবিন্দ করের (আর জি কর) বংশের ছেলে সৌমিত্র কর এ বিষয়ে বলেন, “বাড়ির ঐতিহ্য ছোট থেকেই আমার রক্তে মিশে। তাই ট্র্যাডিশনাল ও ক্লাসিক্যাল জিনিস আমাকে টানে। ঘুড়ি-লাটাইয়ের মধ্যেও আমি আভিজাত্য খুঁজে পাই। আসলে অতীত ঐতিহ্যের কোনও ক্ষয় হয় না। সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যকরণ জানলে, তবেই তো ভাঙাগড়া করা যায়। আর তবেই নতুন দিশা রচনা করা যায়।”

বর্তমানে শিল্পসমাজ জুড়ে যে হালকা চালের কাজ চলছে, সেখানে এই ত্রয়ী শিল্পীর স্থায়ী অবদান শিল্পের মর্যাদা বাড়ায়। মনে রাখার মতো একটি প্রদর্শনী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement