ধরিত্রীসম: গ্যালারি বি-ক্যাফে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
সম্প্রতি গ্যালারি ‘বি-ক্যাফ’-এ (ব্রিজিং কালচার অ্যান্ড আর্টস ফাউন্ডেশন) রিনা দেওয়ানের কিউরেট করা এক প্রদর্শনী দেখা গেল। প্রদর্শনীটির নাম, ‘একোস্ অব দি আর্থ’। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা ছিলেন— প্রদোষ পাল, সৌমেন খামরুই, চন্দন দেবনাথ, শুভঙ্কর চক্রবর্তী এবং রত্না বর্ধন।
এই দলীয় প্রদর্শনীতে পাঁচ জন শিল্পীই যেন নিজের নিজের বিশেষ শিল্পমাধ্যমের সহায়তায়, প্রকৃতির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন। এঁদের ভাষা আলাদা হওয়ায় গ্যালারির দেওয়ালে বেশ সুন্দর একটা ট্যাপেস্ট্রি তৈরি হয়েছিল। নিজস্ব শৈলীতে এই শিল্পীরা কোথাও যেন বিশাল প্রান্তরে প্রকৃতির বিপুল আয়তন ধরতে চেয়েছেন। প্রকৃতির সহজতম আকারটিও এঁকেছেন। কোথাও প্রকৃতিকে ধ্যানস্থ দেখিয়েছেন, আবার কোথাও সে প্রতিবাদরত। সমবেত ভাবে যেন একই গানে মেতেছেন শিল্পীরা, নিজের নিজের সুরে তানে।
প্রদোষ পাল বাস্তবধর্মী নিসর্গচিত্র আঁকেন। এখানে তাঁর যে সব জলরঙের ছবি দর্শক দেখতে পেলেন, সেগুলো সবই কাগজে আঁকা এবং সবই প্রায় গ্রামীণ দৃশ্যাবলি। কিছু ছবিতে আলো-কালোর কনট্রাস্ট আকর্ষক।
সৌমেন খামরুই ভূদৃশ্য এঁকেছেন, তবে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক পদ্ধতিতে। প্রধানত টেম্পেরায় কাজ করেন তিনি, তুলট কাগজে। সৌমেনের ভূদৃশ্যে বাস্তবের ছায়াটুকুই সুন্দর রঙে বাড়ি, গাছ, পাহাড় ইত্যাদির পাশাপাশি অবস্থান করে অন্য রূপে, বাস্তবায়ন থেকে বেরিয়ে। আলোচ্য প্রদর্শনীতে একটি শিরোনামবিহীন কাজ বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। আসলে এই ছবিটিতে এক নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন শিল্পী সৌমেন। প্রথমে কাগজে নিজের মতো রং বসিয়ে নিয়ে, তার পরে কাগজটিকে জলে ভিজিয়ে নিয়েছেন, খানিকটা বেঙ্গল স্কুলের ওয়াশ পদ্ধতিতেই। তারপর সেই কাজ শুকিয়ে নিয়ে, ঘষাঘষি করে রংটাকে বেঁধে নেওয়ার পরে টেম্পেরায় শেষ করেছেন। বাস্তবতা হারিয়ে প্রকৃতির এই ছবিটি হয়ে উঠেছে নিগূঢ়, রহস্যময়, এক কথায় অসামান্য।
চন্দন দেবনাথ প্রকৃতি এবং মানুষের গভীর সম্পর্কের রহস্য ভেদ করতে চান তাঁর কাজে। মধুর রঙে রং মিলিয়ে প্রকৃতিতে যেন এক শব্দসঙ্গতি খোঁজেন। নদী, গাছ, কুঁড়েঘর, পাহাড় সবই অদ্ভুত এক সম্পর্কে ধরা দেয়, যে সম্বন্ধ আপাতদৃষ্টিতে সহজ-সরল। কিন্তু আসলে এক মিশ্রিত ভাবের প্রতিধ্বনি সঞ্চারিত হয় ছবিগুলিতে। সহজ হয়েও তাদের আপেক্ষিক সম্পর্ক গূঢ়। একটি ছবিতে নদী এবং পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দুই নারী, কিন্তু পিছন দিক থেকে দেখানো হয়েছে তাদের। কিছুটা যেন এই ছবিতে ঢুকে পড়তে চাইবেন দর্শক। কী ভাবছেন এই দুই মহিলা? কোন যাত্রার অপেক্ষায় আছেন? কারণ সামনের টিলার উপরে দু’টি নৌকোর সামান্য অংশটুকু দৃশ্যমান। অ্যাক্রিলিক এবং ক্রেয়নে-কাগজে আঁকা অনবদ্য ছবি।
শিল্পী রত্না বর্ধন প্রধানত ছাপাই ছবির কাজ করতেন। কিন্তু সদ্যলব্ধ মাতৃত্বের কারণে বাইরের কাজে তাঁর সামান্য অসুবিধে হওয়ায় তিনি ঘরেই এক অভিনব সৃষ্টি করলেন। সূক্ষ্ম ভাবে এনগ্রেভিং শুরু করে সেটিকে অন্য এক শিল্প পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। করলেন অ্যাক্রিলিক শিট বা চাদরের উপরে সুচের খোদাই কাজ। তাঁর কাজের মধ্যে একটির নাম ‘বিজ়ি উইথ নেচার।’ দড়িতে শুকোতে দেওয়া একটি শাড়ি। বিশেষ করে শাড়ির আঁচল ছাড়াও ভাঁজগুলি এবং তার বয়ন অনবদ্য। আশ্চর্যজনক সূক্ষ্মতার পরিচয় দিয়েছেন শিল্পী রত্না, তাঁর এই এনগ্ৰেভিং-এর কাজগুলিতে। এই পদ্ধতি তাঁর একান্ত নিজস্ব। আরও একটি কাজ, একটি পত্রাংশ, যেটি শিরোনামহীন। পাতাটির ভিতরে ছোট ছোট বাড়ির অংশ, বারান্দা, খড়খড়িওয়ালা পুরনো দিনের জানালা, গাড়িবারান্দার অংশ.. ইত্যাদি সুচে খোদাই করেছেন। পটভূমিটি রেখেছেন কালো।
শুভঙ্কর চক্রবর্তীর কাজে শান্তিনিকেতনের আশপাশের ভূদৃশ্য দেখা যায়। প্রকৃতির বিশাল পটভূমিতে মানুষের স্থান একটু যেন নগণ্য তাঁর কাছে। ছবির প্রচলিত গঠনের ধারা সম্পূর্ণ বর্জন করে যে সব ছবি সৃষ্টি করেন, সেখানে নিসর্গ এবং মানুষের চিরকালীন সম্পর্কের বিকাশ লক্ষণীয়। ছাপাই ছবিতে তাঁর অনস্বীকার্য কাজ ‘ব্রোকেন ব্রিজ।’ এটি করা কোলাগ্রাফিতে। এই শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কোলা’ থেকে, যার অর্থ আঠা। এটি একটি ছাপাই ছবির পদ্ধতি, যেখানে ছাপাইয়ের জন্য যে সমস্ত উপাদান লাগে, সেইগুলি আঠা দিয়ে বদ্ধ করে একটা বোর্ডের মতো তৈরি করা হয়। তারপর সেই বোর্ডের উপরে ইঙ্কের কাজ করে সেখান থেকে ছাপাই ছবি তৈরি হয়, কাগজে বা অন্য মাধ্যমে। মোটামুটি একেই বলে কোলাগ্রাফি। এ যেন সম্পূর্ণ অন্য রকম এক ছাপাই ছবি। এটি ছাড়াও তাঁর লিনোকাট, এচিং, অ্যাকোয়াটিন্ট, গ্রাফাইট, জলরং, ডিজিটাল প্রিন্ট এবং পেন অ্যান্ড ইংকের ছবিও দেখা গেল।
তরুণ শিল্পীরা ঐতিহ্যগত ছাপাই ছবি নিয়ে কত রকম যে পরীক্ষা, গবেষণা এবং পরখ করছেন... দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মনুষ্য সমাজের সঙ্গে প্রকৃতির যে অনর্গল কথোপকথন চলতে থাকে, তারই জটিলতা এবং রহস্য উদ্ঘাটন করতে এই পাঁচ শিল্পী উৎসাহী হয়েছেন, প্রমাণ পাওয়া গেল এই প্রদর্শনীতে।