মোহন-ইস্ট ম্যাচে মাঠেই তক্কাতক্কি
মরসুম শুরু হওয়ার আগে ক্লাবের পাপোসটাকে দেখিয়ে
কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি জানতে চাইতেন,
‘‘এর ইংরেজি কী বলতো?’’এ কে়মন যেন রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন?
সন্তোষ ট্রফি। পটনায়। তার ঠিক পরেই দল বদল। চব্বিশ ঘণ্টা ইস্টবেঙ্গলের দুই জবরদস্ত কর্তার কড়া নজর শ্যাম থাপার দিকে। সে বছর মোহনবাগানীদের এক নম্বর টার্গেট যে শ্যামই। শেষমেশ কী হয়েছিল? সে এক চমকপ্রদ গল্প!
বড় ম্যাচের ঠিক আগে খবরের কাগজে বেরিয়ে গেল লাল-হলুদের কাজল ঢালির মা মারা গেছেন। অথচ মা যে তখন বহাল তবিয়তে জীবিত! কে রটিয়েছিল অমন খবর? কেনই বা?
সত্তর দশকের ময়দান মানেই এমন টানটান রহস্যে মোড়া অসংখ্য কাহিনির যোগফল। আসা যাক সেই সব অবাক-করা গল্পকথায়।
বড়দার চায়ের দোকানে যে তুমুল কোলাহলটা শুরু হল, সেটাকেই বোধ হয় জয়ধ্বনি বলে!
২৫ সেপ্টেম্বর। সাল ১৯৭০।
সত্তরের ফুটবলের সেই উন্মাদনার কাহিনি লিখতে গেলে ওই তারিখটিকে ভুলে যাওয়া যাবে না। বলতে গেলে, এই দিনটাই যেন দিয়েছিল সত্তরের ফুটবল ঝড়ের পূর্বাভাস!
তখনও সাংবাদিকতা পেশায় আসিনি। নিছকই ছাত্র। ব্যান্ডেলের লাটবাগানের কিশোর তরুণদের কফি হাউস বড়দার চায়ের দোকানে ট্র্যানজিস্টারে কান পেতে শুনেছিলাম ইস্টবেঙ্গলের আইএফএ শিল্ড জয়ের কাহিনি।
ম্যাচ শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে পরিবর্ত পরিমল দে-র গোলে ইরানের প্যাস ক্লাবকে হারানোর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
তখনও টেলিভিশনের যুগ আরম্ভ হয়নি। রেডিয়োতে সম্ভবত অজয় বসুর গলাই জ্বলে উঠল। ইস্টবেঙ্গল বিদেশি দলকে হারিয়ে এই মাত্র জিতে নিল ভারতীয় ফুটবলের নীল ফিতে আইএফএ শিল্ড। এ এক স্মরণীয় মুহূর্ত।
লাটবাগানের রাস্তায় মুহূর্তের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থক একজোট হয়ে গেল। এ তো ভারতের জয়। রং দেখে উদ্যাপনের দিন এ তো নয়!
ইডেনে বিদেশি দলকে হারিয়ে ভারতীয় একটি ক্লাব সে দিন বাঙালিকে জাতীয়তাবাদী করে তুলেছিল। মনে আছে, এল ডোর্যাডো নামের একটি দোকানের সামনে ত্রিকোণ পার্কে যেন গুপ্তধন পাওয়ার আনন্দে অনেক রাত পর্যন্ত উড়েছিল তুবড়ি, হাওয়াই বাজি। কলকাতা ময়দানে অখ্যাত দলের স্টপারে খেলা, চুঁচুড়া লিগে বড় দলের শান্তিদা, যার পোশাকি নাম শান্তি ঘোষ, রসগোল্লা বিলি করেছিলেন। সত্তরের ফুটবলকে কেন্দ্র করে আবেগের এই অসাধারণ ঢেউয়ের সেই হয়তো সূত্রপাত।
সময়টা ইংরেজি পরিভাষায় এক ট্র্যানজিশন পিরিয়ড। এক দিকে নকশাল আন্দোলন দানা বাঁধছে। কখনও ভেঙে যাচ্ছে, এ দিক-সে দিক নকশাল দমনে সিআরপি ক্যাম্প। রাতের বেলা পুলিশের গাড়ির শব্দ। কলেজ স্ট্রিট প্রতি দুপুরেই উত্তাল হচ্ছে বোমায়-গুলিতে, কাঁদানে গ্যাসে।
কাকা মানে অসীম চট্টোপাধ্যায়, আজিজুল হক-রা কখনও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে, কখনও রণাঙ্গনে ভেসে উঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্দোলনের। সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো যুব নেতারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা দ্বারভাঙ্গা হলের সামনে সমবেত হচ্ছেন।
বড় আগুনে সেই সময়।
আর এই মাহেন্দ্রক্ষণেই যেন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হল কলকাতার ফুটবল মাঠে। প্রতিভার বিচ্ছুরণে এই প্রতিভাবানরা ষাটের দশকের ভারতীয় ফুটবলের কীর্তির জোয়ারে নাবিক হল। কলকাতা ফুটবলেও এল নবজাগরণ।
তারুণ্যে রেনেসাঁ।
রেফারির সঙ্গে করমর্দনে সুরজিৎ, পাশে প্রসূন
তখনও নিছক ফুটবল দর্শক। নিয়মিত ব্যান্ডেল থেকে ইএমইউ ১টা ৫০-এর ট্রেনে মোহনবাগান কিংবা ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ দেখতে নিয়মিত হাজিরা দিই গড়ের মাঠে। দাদা-কাকাদের, মেম্বরশিপ কার্ড তখন আমাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লটারির টিকিট।
সপ্তাহে চারদিন, অর্থাৎ বড় দুই ক্লাবে সপ্তাহের দুটি ম্যাচের কোনওটাই বাদ যায় না আমার আর আমার বন্ধু সুমন্ত অর্থাৎ সুমন্ত সেনরায়ের।
মাঠ কাঁপাচ্ছে তখন সুভাষ ভৌমিক-সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদাররা। আনন্দবাজার লিখছে— জোড়া ফলা। মোহনবাগানের প্রণব গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহেবের মতো চেহারা। প্রবীর মজুমদারকে দেখে বেশ রোম্যান্টিক লাগে। কাজল মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কেমন যেন একটা হেড স্যার-হেড স্যার ভাব। শান্ত মিত্রর ভাল নাম যে শান্তজ্যোতি মিত্র তা জানিয়ে দেয় গড়ের মাঠ কিংবা অলিম্পিক পত্রিকা, স্বপন সেনগুপ্ত ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে দিয়ে খেলেন, কিন্তু তাঁর নাম কেন চিংড়ি সেই প্রশ্নের উত্তর পাই না। সুমন্ত বলে, কোনও ছেলের নাম ইলিশ হয় না বলেই বোধহয়!
গড়ের মাঠের দুপুরের রোদ, বিকেলের মায়াবী আলোয় পরিণত হয়। ম্যাচ শেষে তাঁবুতে কুতুহলি চোখ মেলে চলে আসি অনাদির মোগলাই পরোটার দোকানে। এক কাপ চা আর মোগলাই পরোটা।
এর পর হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরা। ব্যান্ডেলে আমরা তো হিরো, রোজ বড় দলের ম্যাচ দেখতে যাই।
ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে দুপুর একটা পঞ্চাশের ট্রেন ধরত সে। কাঁধে একটা কিট ব্যাগ। একটু উপেক্ষার চোখেই দেখতাম তাকে। আমরা যাচ্ছি বড় ক্লাবের খেলা দেখতে, আর এ কিনা যাচ্ছে ফোর্থ ডিভিশন ক্লাবে খেলতে। রবার্ট হাডসনের এই ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত, মানে আমাদের বিশুর খেলা দেখার জন্য ক’বছরের মধ্যেই যে লাইনে দাঁড়াতে হবে, তা কি তখন জানতাম?
এই সুরজিৎ সত্তরে অসাধারণ দুটি ঘটনা ঘটায়। প্রথমটি ১৯৭৮ সালে গুয়াহাটিতে বরদলুই ট্রফিতে ব্যাংককের পোর্ট অথরিটির বিরুদ্ধে সোলো রান দিয়ে দুটি গোল করে। এমনই সে দুটি গোল যা আজও পাড়ার রকে কিংবা ফুটবলের পুরনো আড্ডায় আলোচনার ঢেউ তোলে।
সুরজিৎ যখন মাঝমাঠ থেকে তার সর্পিল দৌড়টি শুরু করে তখন তাকে তাড়া করেছিল ব্যাংকক পোর্ট অথরিটির কয়েকজন খেলোয়াড়। আর সে যখন গোল দুটি করে তখন তারা সেন্টার সার্কেলের কাছ বরাবর জায়গায়।
আজকাল আন্তর্জাতিক ম্যাচে কোনও ভারতীয় ফুটবলার গোল করলেই হইচই শুরু হয়ে যায়, এই সুরজিৎরা এই রকম গোল কত করেছে!
১৯৬৯ সালে আইএফএ শিল্ডের সেমিফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়া কম্বাইন্ড ইলেভেনের বিরুদ্ধে সুরজিতের শূন্য ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে বাঁক খাওয়ানো শটের গোলটি তো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এমন গোল লাখে একটি হয়। সুরজিতের ট্রেডমার্ক ছিল এই গোল।
সত্তর দশকের ফুটবল উন্মাদনার তখন সূত্রপাত ঘটে গেছে।
বড় ম্যাচে হাবিব
শুনলাম, হুগলির পুলিশ সুপার অমল দত্তর ভাইপো, হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করা প্রদীপ দত্তও নাকি দুর্দান্ত ফুটবল খেলছে। বড় দলে চান্সও পেয়ে গেল প্রদীপ দত্ত।
এক ঝাঁক তরুণ ফুটবলার তখন কলকাতার ফুটবল ধমনিতে নতুন রক্ত— গৌতম সরকার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত ভট্টাচার্য, শ্যামল ঘোষ, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ বসু— কাকে ছেড়ে কার নাম করব?
আর স্টলওয়ার্ট সুধীর কর্মকার, সমরেশ চৌধুরী, অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন সিংহ, হাবিবরা তো আছেই।
সত্তর দশকের ফুটবল যেন এক জলপ্রপাত। অবিরাম, অবিশ্রান্ত প্রতিভাবানরা আসছে। মাঠ কানায় কানায় ভরে যাচ্ছে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের টিকিটের লাইন দু’রাত আগেই পড়ছে। র্যামপার্টেও থাকছে কয়েক হাজার লোক। প্রায়ই কাঁদানে গ্যাস চলে মাঠে। পুলিশ লাঠি হাতে তেড়ে যায় গ্যালারিতে, রেড রোডে গাড়ির কাঁচ ভাঙে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় হেডলাইন হয়।
একটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদারের করা গোলে মোহনবাগান ১-০-য় এগিয়ে থাকার সময় বিরতিতে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা হয় প্রবল বৃষ্টির জন্য। কিংসওয়ে ধরে হাওড়ার বাস ধরার জন্য হাঁটছি আমি আর সুমন্ত। হঠাৎ মালকোঁচা মারা এক যুবক লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠল— ‘‘পাইছি, পাইছি। এই দুই ভাই ঘইট্যা।’’
বলে বুঝিয়ে উঠতে পারি না আমরা মোহনবাগানের ম্যাচ দেখি, ইস্টবেঙ্গেলেরও ম্যাচ দেখি। ১৯৭৪ সালে ইস্টবেঙ্গল মাঠে সুভাষ ভৌমিকের সঙ্গে হেডঅন কলিশনে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পা ভেঙে স্ট্রেচার বাহিত হয়ে মাঠের বাইরে যাওয়ার সময় দু’হাত জোড়া করে নমস্কারের ভঙ্গিতে সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা আমাদের চোখের কোল তখনও শিরশির করে ওঠে।
সত্তরের দশক যে কাঁপাবে মাঠের মধ্যে এবং মাঠের বাইরে সে তত দিনে গড়ের মাঠে এসে গেছে। শ্যামনগরের অত্যন্ত দরিদ্র একটি পরিবারের সন্তান, ঢ্যাঙা, মাথায় কদমছাঁট চুল। নাকের নীচে এক চিলতে গোঁফ। যুগের প্রতীক, বালি প্রতিভা, বিএনআর হয়ে মোহনবাগান। সুব্রত ভট্টাচার্য।
ইস্টবেঙ্গলে সই করা পাকা হয়ে গিয়েছিল। পল্টু দাস, জীবন চক্রবর্তীরা ফাইনাল করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন চুনী গোস্বামী। শ্যামনগরের সুব্রত ভট্টাচার্য, যার ডাক নাম বাবলু, তাদের বাড়িতে সটান হাজির। মোহনবাগানে খেলতে হবে।
সুব্রতর মামারা আদ্যন্ত মোহনবাগান। শ্যামনগরের সুযোগ্য সন্তান কেষ্ট পাল মোহনবাগানে খেলে বেজায় সম্মান পেয়েছেন। সুব্রতর পিতৃদেব ফরমান দিলেন— ‘‘চুনীবাবু যখন এসেছেন তখন তুমি মোহনবাগানেই খেলো।’’
আসলে চুনী গোস্বামী খেলা ছাড়লেও তখনও হিরো। শ্যামনগরের গাঁধী কলোনি এই রকম আলোক দ্যুতিময় উপস্থিতি আগে দেখিনি।
রক্তাক্ত দর্শক
মনেপ্রাণে মোহনবাগানি সুব্রতর রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তখন কি সুব্রত জানত, মোহনবাগানই তার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন হয়ে উঠবে?
মোহনবাগানে প্রথম বছর সুব্রত দুটি নাম পায়। লগা আর সিআরপি। এরিয়াল বলে তার হেড দেওয়ার দক্ষতা সুব্রতকে লগা নামটি এনে দেয়। আর বিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের তছনছ করার প্রবণতাটি দেয় সিআরপি নামটি। আদরের নাম। পরে অবশ্য গ্যালারি তাকে মোহনবাগানের উত্তম কুমার কিংবা অমিতাভ বচ্চন বলেও ডেকেছে।
সেই সময়ে ময়দানে এসে গেছে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুজ। মোহনবাগানেই। কথা বলে দাদার মতোই অনর্গল। কাইজার স্ট্রিট থেকে স্কুটার নিয়ে ময়দানে প্র্যাকটিসে আসে। বিকেলে খেলা থাকলেও সেই স্কুটার।
ইস্টবেঙ্গলে তখন দাপাচ্ছে বরানগরের ছেলে গৌতম সরকার। কেউ কেউ তখন বলত, ডানপিটে ডাকাবুকো গৌতম নাকি নকশাল করত, সেই মোডটাই ঘুরে যায় ফুটবলে।
আমাদের সেই রবার্ট হাডসনের সুরজিৎ সেনগুপ্ত তত দিনে ইস্টবেঙ্গলে। পরিশীলিত পরিমিত আচরণে সম্ভ্রম আদায় করে নেয়।
সমরেশ চৌধুরী, মানে ময়দানের পিন্টু মাঠ কাঁপাচ্ছে। ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ, কিন্তু মাঠে নেমে ভয়ঙ্কর।
সুধীর কর্মকার তো তখন ইস্টবেঙ্গলের পিলার। সুরজিতের মতোই বর্ধমান কিংবা ব্যান্ডেল লোকাল ধরে মাঠে আসত।
এক ঝাঁক বর্ণময় চরিত্রের উপস্থিতিতে সত্তর দশক তখন উত্তাল।
পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের সেই পাঁচ গোলের পদস্খলন দেখেছিলাম এক টাকা দশ পয়সার গ্যালারিতে বসে।
আমার সে দিনের সঙ্গী ছিল এখানকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তবলিয়া ব্যান্ডেলের ছেলে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাগ্যক্রমে টিকিট দুটো পেয়েছিলাম ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের গ্যালারিতে। সুনীল আবার এতটাই মোহনবাগানি যে সবুজ মেরুন হারলে অন্নজল ত্যাগ করে। মোহনবাগান এক-একটি গোল খাচ্ছিল আর সুনীল কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
ম্যাচ দেখব কী, ওকে সামলাতেই আমার হিমশিম অবস্থা। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে এই রকম কট্টর মোহনবাগানিকে নিয়ে। সন্দিগ্ধ চোখে দু-চারজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তাকাচ্ছিলেন।
শিল্ড ফাইনাল, ১৯৭৯
ওঁদের বললাম, দলের এই রকম পারফরমেন্স দেখে আনন্দে ওইরকম করছে! ম্যাচ শেষে সুনীলকে নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচি।
মনে আছে, ওই ১৯৭৫ সালে কী আগ্রাসী ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কাজল ঢালি তখন ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত ব্যাক। আইএফএ শিল্ডের ফাইনালের সকালে কলকাতার একটি খবরের কাগজে চার লাইনের একটি খবর প্রকাশিত হল— কাজল ঢালির মাতৃবিয়োগ!
অথচ কাজল ঢালির মা বহাল তবিয়তেই ছিলেন। শোনা যায়, ইস্টবেঙ্গলের মানসিকতায় চিড় ধরানোর জন্যই নাকি কাগজে খবরটি খাওয়ানো হয়। পরদিন অবশ্য কাগজটি ভ্রম সংশোধন করতে দ্বিধা করেনি।
পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের পর রাতে মোহনবাগান ফুটবলাররা তো পালিয়ে বাঁচে। সুব্রত ভট্টাচার্য মাঝগঙ্গায় নৌকায় আশ্রয় নেয়। তখনকার দিনে নগদ ৩০ টাকা গুনে। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মগোপন করে।
এত দিন পর্যন্ত সার্কাসের এরিনার বাইরে দর্শক আসনে বসে আমি দুরন্ত দুর্নিবার সত্তরকে দেখছিলাম। এক ধাক্কা দিয়ে কে যেন আমাকে এরিনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল মধ্য সত্তরে।
আমি সাংবাদিকতা পেশায় এলাম। আর আমার সামনে যেন চিচিং ফাঁক মন্ত্রে আলিবাবার গুপ্তধনের দরজা খুলে গেল। ফুটবল মাঠের কুশীলব যে চরিত্রগুলিকে এত দিন রূপকথার নায়কের জায়গায় বসিয়ে রেখেছিলাম, তারা নিদারুণ ভাবে কাছাকাছি চলে এল।
এত দিন গ্যালারিতে বসে ম্যাচ দেখতাম, এখন কাঠের প্রেসবক্সে আমার অবারিত দ্বার। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কিংবা মহামেডান তাঁবুর বাইরে রেলিং ধরে অবাক বিস্ময়ে খেলোয়াড়দের, কিংবদন্তি কর্মকর্তাদের দিকে এত দিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, এখন তাঁবুতে আমার অনায়াস প্রবেশ।
ছোট্ট একটা হলুদ রঙের প্রেস কার্ডের কী অপার মহিমা!
নকশাল আমলের বিপ্লবী রোম্যান্টিকতা ভুলে বাঙালি তখন দুর্দান্ত ভাবে মজেছে ফুটবলে আর সিনেমায়। উত্তমকুমার-সুপ্রিয়াদেবী একটার পর একটা হিট ছবি দিচ্ছেন। আর দুপুরের পরেই বাঙালি ছুটছে ময়দানে।
বড় ক্লাবের ফুটবলাররা এক একজন আইকন। সকালে ময়দানে প্র্যাকটিসের পর তাঁবুতেই দুপুরের খাওয়া। তার পর অফিস। অফিসে সই সেরেই ক্যান্টিনে আড্ডা, নয়তো ম্যাটিনি শো। তার পর পাড়ায় ফিরে হিরো ওয়ারশিপ কুড়িয়ে নেওয়া।
ম্যাচের দিনটা ব্যতিক্রম।
সে দিন আর প্র্যাকটিস নেই। দুপুর-দুপুরই ক্লাব তাঁবু। দরজা জানলা বন্ধ করে কুল ডাউন। তার পর ওয়ার্মআপ।
দলবদলের স্বাক্ষরে সুব্রত ভট্টাচার্য
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ভোকাল টনিকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। অরুণ ঘোষ আপাত নির্লিপ্ততা নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে এঁকে স্ট্র্যাটেজি বোঝাচ্ছেন, সাত্তার সাহেব ঠান্ডা মাথায় দল নির্বাচন করছেন। অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক খেলোয়াড় তৈরি করছেন। স্বরাজ ঘোষ দেখা হলেই বোঝাচ্ছে আধুনিক ফুটবলের অভাবটা কোথায়, নিখিল নন্দী শান্ত চিত্তে খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিচ্ছেন।
ম্যাচ না থাকলে বিকেল হতেই তাঁবুতে তাঁবুতে জটলা।
ভিড় প্রায় উপচে পড়ে পড়ে। তার মধ্যেই স্যুট-টাই পরিহিত ধীরেন দে রাজকীয় মেজাজে নাকে সুগন্ধিমাখা রুমাল চেপে মোহনবাগানের গোলটেবিলে বসছেন। বাইরের লনে কাঠের বেঞ্চিতে ধুতি পাঞ্জাবিতে কুমারবাবু, মানে উমাপতি কুমার। বিকেলেও নানা প্রশাসনিক কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন শৈলেন মান্না। চুনী গোস্বামী এলে তখনও তাঁকে ঘিরে ভিড়ের বলয়।
ইস্টবেঙ্গলে নিশীথ ঘোষ, সুপ্রকাশ গড়গড়ি, স্বপন ঘোষদের পদচারণা। জিপ, মানে জীবন চক্রবর্তী, পল্টু দাসদের দাপট আরেকটু পর থেকে। সুপ্রকাশ গড়গড়ি বিখ্যাত ইমপ্রেশারিও। লতা মঙ্গেশকর থেকে কিশোরকুমার তাঁর এক ডাকে উড়ে আসেন। ব্যস্ত গড়গড়িদাকে দেখলেই ইস্টবেঙ্গল জনতা আশান্বিত। এ বার কিছু একটা ঘটবে। স্বপন ঘোষ স্ট্র্যাটেজিস্ট। সন্ধের পর হাইকোর্ট পাড়ার একটা রেস্তোরাঁয় বসে ক্লাবের রাজনীতির ছক কষেন। সিআইটি রোডের অরুণ ভট্টাচার্য কিংবা দেবুদারা তখন রীতিমতো ক্লাবে নেপথ্যের চালিকাশক্তি।
মহমেডানে যেমন কখনও এরফান তাহের র্যান্ডেরিয়ান কিংবা তাঁর মামা গোলাম মোস্তাফা। আর পরে তো এসে গেলেন ডন মীর মহম্মদ ওমর কিংবা ইব্রাহিম আলি মোল্লারা।
খেলোয়াড়দের মতোই সত্তর দশকে এঁদের কার্যকলাপ নিয়েও প্রভূত কৌতূহল।
মোহনবাগান তাঁবুতে অসাধারণ ঘুগনি- আলুর দম বিক্রি করে সদর স্ট্রিটের একজন মানুষ। ঘুগনিতে আবার চাকা চাকা করে কেটে ছড়িয়ে দেয় ডিমসেদ্ধ। ফুটবলার, কর্মকর্তা থেকে সমর্থক সবার কল্যাণে শালপাতার পর শালপাতা ঘুগনি-আলুরদম উড়ে যায়।
মাঝমাঠে সুভাষ ভৌমিক
ইস্টবেঙ্গল মাঠের ক্যান্টিনটির তেমন নামডাক ছিল না। ছিল শরিক দল এরিয়ানের ক্যান্টিনের। জনৈক বড়ুয়ার ক্যান্টিনে চপ-কাটলেট, ফিশফ্রাই, গরম চা মিলত।
মোহনবাগানের ক্যান্টিনের বিখ্যাত ছিল মাটন কিংবা চিকেন স্টু। মহমেডানে গেলেই মিলত তেলেভাজা। পেঁয়াজিকে কেন যে ওঁরা পেঁয়াজু বলে ডাকতেন কে জানে!
সত্তরের দশকে ফুটবলের উন্মাদনার সঙ্গে এ সব খাবারের গন্ধ ম’ম’ জড়িয়ে আছে অনুষঙ্গ হিসেবে।
ম্যাচের সময় গ্যালারিতে লজেন্স বিক্রি করতেন লজেন্স দাদু। বয়ামে করে লাল-হলুদ-সাদা লজেন্স। ভারতের যে কোনও মাঠে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান কিংবা মহামেডানের খেলা থাকলে সেখানে পৌঁছে যেতেন লজেন্স দাদু।
পরে এলেন লজেন্স দিদি। ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। কিন্তু মোহনবাগান গ্যালারিতেও সমান আদৃত।
সত্তর দশকের ফুটবলের এমনই মহিমা যে দলের ম্যাসিওররাও রীতিমতো বিখ্যাত, তাদের নিয়ে ফিচার লেখা হয়। মোহনবাগানের ফুটবল সচিব তখন তিওয়ারি ব্রাদার্সের তিওয়ারিদা, ম্যাসিওর লক্ষ্মণ। এই লক্ষ্মণ কত গোপন খবর যে আমাদের দিয়েছে!
যেমন ইস্টবেঙ্গলের সেই বিখ্যাত রোগা ম্যাসিওর ভদ্রলোক, যিনি কোনও খেলোয়াড় চোট পেলেই হাতে মাসাজ অয়েল আর লোশন নিয়ে কার্ল লিউইস হয়ে যেতেন।
শ্যাম-মনোরঞ্জন ডুয়েল
সত্তর দশকের সেই অলৌকিক রূপকথার বর্ণনা দিতে গিয়ে এঁদের উপেক্ষা করি কী ভাবে?
সেই সময়ে খবরের কাগজও বদলাচ্ছে। ফুটবলারদের জীবনের কাহিনি, তাদের মাঠের বাইরের জীবনযাত্রাও খবর হচ্ছে। নানা ধরনের ফিচার বের হচ্ছে। ফুটবলাররাও দিব্যি উপভোগ করছে তাদের স্টারডম।
লিন্ডসে স্ট্রিটে ধুলনের টেলারিং শপটি ছিল সেই সময়ের মাঠ কাঁপানো কয়েকজন ফুটবলারের আড্ডার জায়গা, ঝুলন নামটি যতই রোম্যান্টিক বলে মনে হোক, এই ঝুলনের চোখে চশমা এবং নাকের নীচে পুরুষ্টু একটি গোঁফ।
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম সরকার আর অন্য ফুটবলাররা নিয়মিত দুপুরবেলা আড্ডা দিতে আসত ঝুলনের টেলারিং শপে।
সুব্রত ভট্টাচার্যকেও বোধ হয় দু-একবার দেখেছি এখানে। এই ফুটবলারদের সঙ্গে সাংবাদিক আমার বয়েসের ফারাক প্রায় না থাকাতে প্রত্যেকের সঙ্গেই একটা নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল
সেই সময়ে। যেটা পেশাগত
ক্ষেত্রে কাজ দিত, আবার অসুবিধারও কারণ হত।
এই লিন্ডসে স্ট্রিটে যাওয়ার মুখে আমি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম সরকারকে মব্ড হতে দেখেছি। জনতার ভি়ড় থেকে তাদের মুক্ত করতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এমন দৃশ্যও দেখেছি।
(চলবে)
ছবি: নিখিল ভট্টাচার্য, তপন দাস, সন্তোষ ঘোষ, দেবীপ্রসাদ সিংহ