অন্তর্ভেদী: শিল্পী ভোলানাথ রুদ্রর কাজ
দুঃসময়ের এই দীর্ঘকালীন পরিভ্রমণের প্রেক্ষাপটটি পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, এক জায়গায় থিতু হয়ে বসে শুধুমাত্র চোখেরই অবিরাম চঞ্চল চলাচল। গ্যালারি বন্ধ। ক্রমাগত সৃষ্টি হয়ে চলা ছবি, ভাস্কর্য মানুষ দেখছেন অনলাইনে। প্রদর্শনীর দেওয়াল, পেডেস্টাল ধীরে ধীরে জাগছে। ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। ততদিন অনলাইনে নয় নয় করে কম প্রদর্শনী তো দেখা হল না! শরীর এক জায়গায় তো মন আর চোখ অনলাইন শিল্পকলায় মজে থাকবে না, এমন হয় নাকি! যদিও দু’রকম প্রদর্শনের আবহে বিস্তর বিভাজন। নিঃসন্দেহে এই তফাত গুণাগুণ বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও একটা ফাঁক রেখে যায়। তবু বেশ কিছু অনলাইন প্রদর্শনীর আয়োজনে শিল্পীদল বা গ্যালারি অকুণ্ঠচিত্ত।
‘ইনসাইটস’ একটি অনলাইন প্রদর্শনী। দু’জন তরুণ চিত্রকর— ভোলানাথ রুদ্র, সুমন দে। ২৪টি ছবির এই প্রদর্শনীর আয়োজক ছিল ইমামি আর্ট। ভোলানাথ জলরঙে ১৩টি কাজ করেছেন কাগজে। ক্যানভাস, কাগজ, বোর্ড, নেপালি হ্যান্ডমেড কাগজে অ্যাক্রিলিক, চারকোল, প্যাস্টেল, মিশ্র মাধ্যমে কাজ করেছেন সুমন দে। তাঁর ১১টি ছবি ছিল। এই প্রদর্শনীটিতে দুই শিল্পীরই ‘অন্তর্দৃষ্টি’ তাঁদের চিত্রকলায় দু’রকম ভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।
ছাত্রাবস্থাতেই ভোলানাথ বিরাট মাপের দেশি-বিদেশি কাগজে হাত খেলিয়ে জলরং করতেন। কম্পোজ়িশনের ক্ষেত্রে বরাবর স্পেস খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বিস্তৃত পরিসরে বর্ণের মোহময় প্রেক্ষাপট নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতা লক্ষণীয়। রূপ, অন্যান্য অনুষঙ্গ ওই নিঃসীম পরিসরের বিস্তারের সঙ্গে কোথাও না কোথাও একটা ঘটনা বা গল্পের রেশ রেখে যেত। সেই ধারাবাহিকতা-সমৃদ্ধ একটি বিন্যাসকে সযত্ন লালন করতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁর ঘটনাবহুল পট জন্ম দিল আরও কিছু রূপের। এই রূপসমূহ, ভিন্ন অনুষঙ্গের বিবিধ মাত্রায় প্রকাশিত হল অতি স্বল্প, অপেক্ষাকৃত বেশি বর্ণের সঙ্গে অত্যধিক জলমিশ্রিত বর্ণের আবহকে মুখরিত করে। এমন ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার তৈরি হল এক আশ্চর্য সদবাস্তববাদ। ঘটনা। গল্পের এক ধারাবিবরণী। এখানে আলো, তার অবক্ষয়, অবশেষে অন্ধকারের অলৌকিকতায় রয়ে গেল কিছু ক্ষত, যন্ত্রণা, বেদনাবোধ। জীবন-উজ্জীবনের মধ্যে কুঁড়ির মতো জেগে উঠতে চাইল প্রকৃতির সবুজ। কারণ প্রকৃতি নগর-সভ্যতার শিকার, সে আহত, রক্তাক্ত। একটি জ্বলে যাওয়া বৃক্ষের পোড়া শরীর সাক্ষাৎকার দিচ্ছে প্রচুর দাঁড়ানো ক্যামেরার সামনে। চমৎকার গোলাপি আগ্নেয় আকাশ। যেন ধ্বংসের পরের নৈঃশব্দ্যে সে একা, নিঃসঙ্গ গাছটির মতো। এমনই প্রতীকী যৎসামান্য শরীরী প্রত্যঙ্গ, কয়লা উত্তোলন, খনিমুখ, ঝাড়ুদার সাফ করছে যান্ত্রিক সভ্যতা, ক্রেন, পাথর, এরোপ্লেনের উড়ে যাওয়া, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পিপিই কিট পরা মানুষ দুঃসময়ে স্প্রে করছে অন্যজনকে। এমন অনেক নাটকীয় আলো-আঁধারের ছবি এঁকেছেন ভোলানাথ। তাঁর রিয়্যালিজ়ম ছবিরই নক্ষত্রখচিত আকাশের মতো। টেকনিক ও স্টাইল তাঁর জলরঙের মন কেমন করা প্রদোষকালের মতো। বড় অন্তর্ভেদী।
সুমন দে’র প্রথাগত শিল্পশিক্ষা নেই। সেই সিলমোহর না থাকলেও তাঁর কাজ পাকা একজন শিল্পীর মতো। রূপ ও তার নির্দিষ্টতা তিনি ভেঙেছেন। একটি পেন্টিংয়ের প্রাথমিক শর্তে আধুনিকতার বিবর্তনকে খুঁড়ে দেখেছেন। এখানেই তৈরি হয়েছে সেই রূপ ও অরূপের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, এমনকি মিলনও। যে বর্ণ, পরিসর, রূপবিন্যাস তাঁকে সংঘবদ্ধ করেছে। একটি ফর্মকে সামান্য বিবর্তিত করেও কত রকম ভাবে তাকে অ্যারেঞ্জ করা যায়, এই অনায়াসলভ্যতার আড়ালে সুমনের শৈল্পিক অনুসন্ধান চমৎকার। মিশ্র মাধ্যম ও অন্য বর্ণের ব্যবহার টেক্সচার, এমনকি টেক্সচারলেস সমতলীয়তার গভীরে তৈরি করছে অদ্ভুত সুররিয়ালিজ়ম। তা রূপ ও অরূপের ক্ষেত্রে আবার দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন এক স্থিতধী অধ্যায়। তাঁর পেন্টিং কোয়ালিটি আশ্চর্য ভাবেই এক সেরামিক অনুভূতি আনে। একটি ফর্ম রেখা ও বর্ণের সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত যে সাজপোশাকে অবতীর্ণ, সেখানে পূর্ণাঙ্গ এক আধুনিকতার কিছু অধ্যায় তৈরি করে দেয়। আপাতনিরীহ, ধূসর অনুজ্জ্বল বর্ণেরও এমন আকুতি থাকতে পারে? ঝলসানো রুটি বা চাঁদের প্যাটার্ন, ভাঁজ করা কাগজের রঙিন বিন্যাস, বর্তুল অফ-হোয়াইট ফর্ম, আপাতঅন্ধকার অন্তরীক্ষের মধ্যেও ক্ষতচিহ্নের অনুরণন, ত্রিকোণাকৃতি রূপের আড়ালে যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি— যা চাপা, একা, সংবেদনশীল। সমতলও যেন ত্রিমাত্রিকতার রূপকেই বহন করছে। মিহি ও শীতল বর্ণ বড় মায়াবী। ক্ষত ও জীবন একই সঙ্গে উজ্জীবিত।