পরিপ্রেক্ষিত: ‘দিবাস্বপ্ন ও বাস্তবতা: যোগেন চৌধুরী’ প্রদর্শনীর কাজ
অজস্র নির্মাণের মধ্যে মাধ্যমগত ভিন্ন ব্যবহারে তিনি নিজেকে কত রকম ভাবে বারবার বদলেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। যে কোনও রকম কাজে কিন্তু তাঁকে মুহূর্তে চিনে নিতে কোনও অসুবিধেই হয় না দর্শকের। এ হেন চিত্রকর যোগেন চৌধুরীর আরও অনেক সত্তার মধ্যেও শিল্পকর্মের বিবিধ কর্মকাণ্ড থেকে সংসদীয় রাজনীতি ভায়া বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভ্রমণপর্বের আবশ্যিকতার কথা সুবিদিত। তাঁর প্রদর্শনী এ বার নিজের প্রিয় শহর কলকাতায়। সম্প্রতি ইমামি আর্টে শেষ হল তাঁর গত ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে করা মোট ১৬৫টি কাজের এক বিরাট প্রদর্শনী। নাম ‘দিবাস্বপ্ন ও বাস্তবতা: যোগেন চৌধুরী’।
এই প্রদর্শনী বিশেষ করে সমস্ত শ্রেণির শিল্পশিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ। কী ধরনের, কী কী মাধ্যমের কাজ প্রাথমিক পর্ব থেকে স্নাতকোত্তরের সিলেবাসে শিক্ষানবিশদের জন্য আজও প্রযোজ্য, তার একটি বড় সিরিজ়ই এখানে প্রদর্শিত। স্টাডিমূলক পেনসিল-ওয়র্ক থেকে জলরং, চারকোল, ইঙ্ক ওয়াশ, প্যাস্টেল, মোনোক্রোম, কালি-তুলি, পেন-ইঙ্ক... কী নেই! ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর বিস্ময়কর রিয়্যালিস্টিক ড্রয়িং, স্টাডি, ফোলিয়েজ, আউটডোর, প্রতিকৃতি, স্থিরচিত্র, আত্মপ্রতিকৃতি, লাইন ড্রয়িং, দ্রুত স্কেচ ইত্যাদি সবই ছিল।
অনেক পরে প্রথাগত রিয়্যালিজ়ম থেকে সরে এসে, তার সম্পূর্ণ নির্যাসকে ধরে রেখেই তিনি মূল কম্পোজ়িশনের রূপ-অরূপের মধ্যেও আশ্চর্য রকম নিজস্বতা তৈরি করেছিলেন। কোন বিষয় নিয়ে, কী ভাবনায়, কোন পরিপ্রেক্ষিতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছবি করেছেন, সেটিই একমাত্র নয়। কী ভাবে তিনি রং-রেখা-ছায়াতপ-আলো-অন্ধকার-পট ও তার সীমা, পটভূমি... এ সব নিয়ে ভেবেছেন, বিশেষ করে ড্রয়িং ও কম্পোজ়িশনের মধ্যে একটি দুস্তর ফারাক রেখেও অবিশ্বাস্য সংযোজন করেছেন দুই সত্তার মধ্যে— তা দৃষ্টান্তমূলক। শুধু এক বা দুই রঙের ড্রয়িংয়ের গুণাগুণ যখন অন্য বহুবর্ণ ছবির রক্তমাংসের একটি নির্দিষ্ট অংশ হয়ে উঠছে, লক্ষ করা যাবে দুটি কাজেই কেমন ব্যবধান, আবার অদ্ভুত মিল! ইঙ্ক ও প্যাস্টেলের এমন নম্র ও অপেক্ষাকৃত গূঢ় ব্যবহার ছবির বহিরঙ্গের চরিত্রে যেমন মায়াবী টেক্সচার তৈরি করছে, একই ভাবে অবয়বী ছবির থলথলে বা বাঁকানো প্যাঁচানো রক্তমাংসের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা মেদবাহুল্যের অভ্যন্তরে যেন প্রকৃত অ্যানাটমিকেও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এই দৃশ্য-অদৃশ্য দর্শনের নিহিতে প্রচ্ছন্ন তাঁর শরীরী বিভঙ্গের অভ্যন্তরীণ নিখুঁত জ্ঞান। বস্তু, বস্তু-বহির্ভূত জগতেরও যে একটি ভাষা থাকে, তা তিনি পড়তে পেরেছিলেন ছাত্রাবস্থা থেকেই। আসলে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপনা— দু’টিই যেন কখনও গভীর দ্বন্দ্ব, আবার যুগল-মিলনের কথাই জানায়।
রেখা ও তার ব্যবহার, একই ভাবে বর্ণ ও তার ব্যবহার— পটের চরিত্র অনুযায়ী কখনও তার ত্বককে অতি সাধারণ মানে রেখেও, নিজস্ব স্টাইলকে বিধৃত করেছেন। এই দ্বিমাত্রিকতার ব্যবহারিক রূপ ও রূপান্তরের সমগ্র সত্তা জুড়েই কিন্তু প্রতিটি ড্রয়িংয়ের প্রখর বাস্তবতা ও নিজস্ব টেকনিকের অনন্য এক জ্যামিতি তৈরি হয়েছে বারবার। অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে, শরীরের কন্টুর লাইনের বহিরঙ্গের ফাঁক ও দূরত্বের ওই জ্যামিতিক ভারসাম্য চোখের এক আশ্চর্য আরাম। ছবিকে সে ভাবেই পর্যবেক্ষণ করতে বলছেন যেন শিল্পী নিজেই। শিল্পীর কৌশলী প্রয়োগের এমন পরিণতিই তো বহু কাজের অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর আঙুলের বিচিত্র অবস্থান ছবির আর এক অলঙ্কার!
আসলে যোগেন অনেক ভাবেই নিজের মনের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, কামনা-বাসনা-জটিলতা-নৈঃশব্দ্য-যন্ত্রণা-বিষণ্ণতা-উচ্ছ্বাসের জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকেই ব্যাখ্যা করেছেন।
সূক্ষ্ম আঁচড়ে, ধাতব নিব-পেনের অর্বুদ কাটাচিহ্নে সমগ্র শরীর আচ্ছন্ন। এর মধ্যে প্যাস্টেল ও আপাত-অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়াতপে, একই সঙ্গে রচনায় আলো ও অপসৃয়মাণ আলোকে রোমাঞ্চকর করেছেন। তাঁর অবয়বী ছবির পৃথুল রমণী-পুরুষ বা কৃশ শরীরী বিভঙ্গের বৃহৎ, ঈষৎ দীর্ঘ প্রত্যঙ্গের এক-একটি আলিঙ্গন যেন বহু স্মৃতি-বিস্মৃতির গভীরতর কবিতা। সে মাধ্যম যা-ই হোক। আর আছে বিক্ষত জীবনের পর্যবেক্ষণ।
বিভিন্ন শরীরে ক্ষতচিহ্নের অদ্ভুত উপস্থিতি গোটা ছবির শিহরন জাগানো চিত্রকল্প। চারকোলের ঘষা-মাজা লাইন, রেখার কাব্যিক-বঙ্কিম চলনের বাঁক, রেখার নিরীহ পদচারণ, প্রতিটি চোখের আশ্চর্য রহস্যময় কথোপকথন স্বপ্ন-বাস্তবতার গল্প-উপন্যাস। কাগজ-ক্যানভাসের মহাকাব্যিক উপাখ্যান!