হাসবেন না, হাসবেন না। আমারও একটা চার্লি চ্যাপলিন গল্প আছে। আপনাদের শুনতেই হবে। তার পর ঠিক করবেন হাসবেন, না কাঁদবেন।
১৯৭৭-এ একটি কাজে যখন লন্ডনে, তখন দক্ষিণ পল্লিতে কখনও সখনও থেকেছি নিশীথ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক বিশিষ্ট ভদ্রলোকের বাড়িতে। যিনি আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু ও ম্যানেজার ছিলেন।
তো এই নিশীথবাবু যৌবনে নামী ভারত্তোলক ছিলেন এবং ষাটের দশকের গোড়ায় দেশের প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডন গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। পেট চালাতে খুচরো খুচরো যা কাজ পেয়েছেন লুফে নিয়েছেন।
এ রকম এক অস্থায়ী কাজ ছিল লন্ডনের সেকালের সেরার সেরা স্যাভয়-এর ব্যাকরুমে। কিচেনের খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটা, খরচপাতির হিসেব রাখার। সকালে গিয়ে সারা দিন কাটিয়ে রাতে ফিরতেন ব্রেকফাস্ট থেকে রাতের ডিনার সব অন দ্য হাউজ সারার জন্য।
যা দেখেশুনে ম্যানেজারের ধারণা হয়েছিল এর আনুগত্যের তুলনা হয় না। তাই এক দিন ডেকে এক নতুন কাজে বহাল করলেন। এক মহাবিশিষ্ট অতিথি আসছেন তিন দিনের জন্য। সর্বান্তঃকরণে তাঁর জি-হুজুর হয়ে থাকতে হবে। তাঁর স্যুইটের এক কোণে পোস্টিং।
নিশীথবাবুর কথায়, ‘‘জীবনে কারও এমন সেবায় লাগিনি। মুখ ফস্কে কিছু বেরনোর আগেই কাজ শেষ।’’
শেষ দিন ঘটা করে সাহেবের একটা বই লঞ্চ হল স্যাভয়ের বিখ্যাত বলরুমে। যেখানে অবিশ্যি নিশীথের যাওয়ার অনুমতি ছিল না। মাঝরাত অবধি পার্টি চলল। সাতসকালে সাহেব রওনা দেবার জন্য তৈরি।
নিশীথ সাহেবের জিনিসপত্তর গুছিয়ে পোর্টার ডাকার জন্য তৈরি। সাহেব একটা প্যাকেট ওঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘‘নাও, এটা তোমার।’’ ভীষণ আগ্রহ সত্ত্বেও নিশীথ জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেননি, ‘‘মহাশয়ের নাম?’’ কারণ অতিথি সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন করা নিষেধ ছিল ম্যানেজারের।
রাতে বাড়ি ফিরে দুরু দুরু বক্ষে প্যাকেটটা খুলে নিশীথ দেখলেন একটা বই। প্রচ্ছদে লেখা, ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’। লেখক চার্লস চ্যাপলিন। তখনও ব্যাপারটা মাথায় খোলেনি নিশীথের। তিনি আনমনে মলাট উল্টে টাইটেল পেজে যেতে তো চক্ষু চড়কগাছ। সাহেব লিখেছেন দুটো কথা ‘হ্যাভ ফান’। নীচে সই— চার্লস চ্যাপলিন!
এক রাতে ডিনারের পর গল্পটা শুনিয়ে সেই স্বাক্ষরিত হার্ডব্যাক কপিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিশীথদা বললেন, ‘‘নাও পড়ো আর মজা করো। তা বলে রাত পোহালে ওটা নিজের মনে করে নিয়ে হাঁটা দিয়ো না।’’ বিছানায় শুয়ে কতক্ষণ বইটার গায়ে হাত বুলিয়ে গন্ধ শুঁকেছিলাম মনে নেই। তার পর বইয়ের প্রিলিউড বা আলাপ পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হল। প্রথমে গায়ে কাঁটা দেওয়া, ক্রমে ক্রমাগত চোখ দিয়ে জল ঝরা।
গোটা পাঁচেক পরিচ্ছেদ পড়তে না পড়তে টের পেলাম যে এত করুণ আত্মজীবনী আমি জীবনে পড়িনি।
তার পরেও অ্যাদ্দিনে না।
আর সমানে ভাবছিলাম, যে মানুষটির নামটা হাসি, স্ফূর্তি, কমেডি, লাফ্টার ইত্যাদি শব্দের সমার্থক ভাবে সারা বিশ্ব, তিনি জীবনকথা শুরুই করলেন চোখের জলে ভেসে! আর যে-কান্না কিছুতেই থামেও না। শুধু নিজেকে বাঁচাতে হাসির পিছনে লুকিয়ে।
যে-পরিচ্ছেদে চ্যাপলিন ভাগ্যের সন্ধানে মার্কিন দেশ পাড়ি দিচ্ছেন সেই পর্যন্ত পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকাল হতে নিশীথদার গাড়িতে করে বেরিয়ে শুধু চ্যাপলিনের সেই কেনিংটন রোড খুঁজছি মনে মনে। জানি না, সে-তল্লাট কোথায়, তবু খুঁজছি। নিশীথদা থেকে থেকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘কী হল! কী ভাবছ?’’
কিছু বলছি না, কারণ রঙিন, উজ্জ্বল লন্ডনের বদলে একটা পুরনো, সাদা-কালো শহর চোখের সামনে খেলছে। সদ্য পড়া চ্যাপলিনের স্মৃতি এখন সিনেমা হয়ে চোখের সামনে…
• • •
একটা বারো বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে কেনিংটন রোডের উপর দ্য ট্যাঙ্কার্ড নামে এক পানশালার সামনে।
দেখছে ঘ্যামা ঘ্যামা ভদ্রলোকরা সব ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে টুক টুক করে ঢুকে যাচ্ছে লাউঞ্জ বার-এ। নকশা, যাত্রাগানের ডাকসাইটেরা শনিবারের রাত নেচেগেয়ে, পানেভোজে কাটিয়ে রোববার সকালে জড়ো হচ্ছেন ট্যাঙ্কার্ডে। এখানেই শেষ পাত্তরটি গলায় ঢেলে বাড়ি ফিরবেন দুপুরের খাওয়ার জন্য।
লন্ডনের ভোদাভিল বা যাত্রাগানের এই রঙিন পুরুষদের অবাক বিস্ময়ে দেখে বালকটি। ওঁদের চেককাটা স্যুট, ছাই-ছাই বোলার টুপি, আংটি আর টাইপিনের ঝিলিক দেওয়া হিরে! ওঁরা যখন বার ছেড়ে বাড়ির পথে একে অন্যকে বাই-বাই করছে, ছেলেটা তখন ঠায় দাঁড়িয়ে।
শেষের জনও যখন চলে গেছে, ওর ধারণা হল সূর্য মেঘে লুকিয়েছে। আর তখন ওকে ভারী মন নিয়ে গুটি গুটি ফিরতে হচ্ছে কেনিংটন রোডের পিছনের দিকটায় ৩নং পাউনাল টেরেসে।
রোগা, লিকলিকে সিঁড়ি ডিঙিয়ে টঙের চিলেকোঠায়।
বাড়িটায় ঢুকলেই মন ভেঙে যায় বাসি আর পুরনো জামাকাপড়ের ভ্যাপসা গন্ধে।
আর বিশেষ করে ওই রোববারটায় মনটা এক দম খাদে আছড়ে পড়ল। দেখল মা জানলায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দূরে কোথায়।
ছেলেকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে একটা দুর্বল হাসি হাসল। ঘরে মা ছাড়া কেউ নেই। চার বছরের বড় দাদা সিডনি জাহাজের চাকরি নিয়ে সাগরে। গত তিন দিন ধরেই মা এ ভাবে জানলার পাশে। কী একটা ভেবেই চলেছে। কূল-কিনারা পাচ্ছে না। দু’মাস হল সিডনি সমুদ্রে। কোনও খবর নেই। যে-সেলাই মেশিনে কাজ করে টাকা জোগাড় করছিল মা সেটিরও কিস্তি না মেটানোয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
রোববার-রোববার সকালে বিছানাতেই ছেলেকে ব্রেকফাস্ট দেয় মা। আজ বাড়িতে কোনও খাবার নেই। তাতে ছেলের কিছু এসে যায় না। কোনও সমস্যাই ওকে ছোঁয় না। নিতান্ত বালক, সব অশান্তিই ও কাটিয়ে ফেলে সহৃদয় বিস্মৃতি দিয়ে।
বাড়িতে খাবার নেই, কিন্তু মা’র পাশ থেকে নড়ার ইচ্ছে নেই ছেলের। মা কী ভীষণ রোগা হয়ে গেছে এই ক’দিনে! চোখ বসেছে, সুন্দর মুখটা বসেছে, ব্যথায় মুড়েছে চাউনি। আজ কিছুতেই মাকে ছেড়ে যাবার নেই। পাশে থাকলেই শান্তি।
অথচ মা কেবলই বলছে, ‘‘কেন তুই ম্যাকার্থিদের বাড়ি যাচ্ছিস না?’’
বলার কারণ, ম্যাকার্থিদের বাড়ি গেলে ছেলেটা চাট্টি খেতে পাবে। ওদের সঙ্গে মা’র খুব ভাব। ওদের ছেলে ওয়ালির সঙ্গে ওর খেলতে গেলেই কিছু না কিছু খেয়ে আসা হয়। তাও যাবার ইচ্ছে নেই ছেলের। মা শোনে না।
ছেলের চোখ দিয়ে জল ছোটে। বলে, ‘‘আমি তো তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, মা।’’
মা চোখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে ফের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘‘যা যা, ম্যাকার্থিদের ওখানে। ডিনারটা তো পাবি। বাড়িতে কিচ্ছুটি নেই।’’
এ বার মা’র গলায় যেন বকুনির সুর পেল ছেলে। ভাঙা গলায় বলল, ‘‘তাই যদি বলো তা হলে যাই।’’
ম্লান হেসে ছেলের মাথায় আদর করে দিল মা। বলল, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। দৌড়ো, দৌড়ো।’’
একটা পাপবোধ নিয়ে মাকে চিলেকোঠায় একলা রেখে গেল ছেলে। ওর ধারণাই নেই মাত্র ক’দিনের মধ্যে কী ভয়ঙ্কর দুর্দিন ঘনাচ্ছে মা’র জীবনে।
• • •
নিশীথদা’র গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে বালক চ্যাপলিনের বাড়িটা সে দিন ধরতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু এক সময় ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ রোডে এসে পড়েছিলাম। গত রাতে পড়া থেকে তখনও রাস্তাটার নাম মাথায় ঘুরছে। চ্যাপলিনের মা’র অবস্থা যখন ভাল তখন ওদের বাসা ছিল এই রাস্তার ওপর। ওর চোখে পড়ত এবং মজা লাগত ব্রিজ ধরে চলা ঘোড়ায়-টানা ট্রাম দেখতে। তল্লাটটা চেকনাই দোকানপাট, রেস্তোরাঁ আর মিউজিক হলে ঢালা স্ফূর্তির আড়ত।
মা নিজে তখন বিশের কোঠায়। বেগুনি-নীল চোখ, ধবধবে ফর্সা, লম্বা চুল, সুগন্ধি উদ্যানবৃক্ষে যেন! রঙ্গমঞ্চে রসিকা চরিত্রে নিয়মিত ডাক। ছেলের চোখে মা’র রূপটাকে খুব পবিত্র ঠেকে। চ্যাপলিনের বাল্যস্মৃতি ঘিরে শুধুই এই মা। বাবাকে ওঁর কখনও দেখাই হয়নি। বয়সকালে বন্ধুদের কাছে মাঝে-সাঝেই কবুল করেছেন উনি নিশ্চিত নন ওঁর সত্যিকার বাবা-কে। আত্মজীবনীতে লিখছেন—
‘‘আমার যে একটা বাবা আছে সেটাই বুঝিনি। আর তাকে কখনও আমাদের সঙ্গে থাকতে দেখিনি। বাবাও ভোদাভিলে ছিল; কালো চোখের চুপচাপ ভাবুক মানুষ। মা বলত, বাবাকে নাকি নেপোলিয়ানের মতো দেখতে ছিল। একটা হাল্কা ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ছিল আর সবার চোখেই ছিল বড় ভাল শিল্পী। সে যুগেও হপ্তায় চল্লিশ পাউন্ড আয় ছিল। মুশকিলের যেটা তা হল মানুষটার বেহদ্দ পানদোষ, যে জন্য— মা বলত— আর সঙ্গে থাকা গেল না।’’
ছাড়াছাড়ি তো হলই, তার ওপর বাবা মারাও গেল বড় তাড়াতাড়ি। মাত্র সাঁইত্রিশে। মা এই বাবার গল্প শোনাত ছেলেকে হাসি আর কান্না মিশিয়ে। মাল টানলেই মেজাজ চড়ত বাবার। তিরিক্ষি চেঁচামেচি। এরকম এক কাণ্ডের দিন মা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দৌড় লাগাল ব্রাইটন সাগরতীর। তখন বাবা মুহুর্মুহু টেলিগ্রাম ছাড়তে লাগল, ‘‘কোথায় তুমি? কী করছ? এক্ষুনি জানাও!’’
মা তার করে জানিয়ে দিল: ‘‘বলডান্স, পার্টি আর পিকনিক, লক্ষ্মীটি!’’
এই বিয়ের আগে সুন্দরী অষ্টাদশী মা এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোকের সঙ্গে পালিয়ে আফ্রিকা চলে গিয়েছিল। সেখানকার খেতখামারে দাসদাসী আর জিন পরানো ঘোড়ায় চাপার বিলাসী জীবন ছিল। সেখানেই সেই লর্ড পরিবারের কর্তার ঔরসে জন্ম হল বড় ছেলে সিডনির।
কিন্তু মা ইংল্যান্ড ফিরে এল সিডনিকে নিয়ে এবং বিয়ে করল বাবাকে। পরে দুঃসহ অভাবের দিনে চ্যাপলিন গজগজ করত মা’র ওপর, ‘‘কেন ওই সুখের জীবন ছেড়ে চলে এলে?’’ মা হেসে বলত, ‘‘অত শত কী আর বুঝেছি তখন? কী আর বুদ্ধি? কী আর বয়েস?’’
চ্যাপলিনের জন্মের এক বছরের মধ্যে বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মা খোরপোশ চায়নি। তখন তো মা নিজেই তারকা। হপ্তায় পঁচিশ পাউন্ড রোজগার। দুই বাচ্চা আর নিজেকে নিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। গান গেয়েই দিন কাটছে।
চার্লি চ্যাপলিন একবার ওঁর সহকারী এডি সাদারল্যান্ডকে বলেছিলেন, ‘‘কে যা আমার বাবা সেটাই জানি না।’’ খুব সম্ভবত চ্যাপলিন ছিলেন, সেকালের বুলি ধার করে বলতে, এক লভ্ চাইল্ড। প্রণয়ের সন্তান।
চার্লির মা’র কুমারী নাম হানা ছিল। স্টেজে নামলে নাম হত লিলি হার্লি। ১৮৮৪ সালে (চার্লির জন্মের পাঁচ বছর আগে) নাটকের বোর্ডে নাম লেখা হয়েছিল গায়িকা বলে। শুরুর থেকেই মা সাফল্য দেখেছে। চার্লির বাবা ওঁর মাকে বিয়ে করেন ১৮৮৫-র জুনে এবং চার্লির জন্মের (১৬ এপ্রিল, ১৮৮৯) এক বছর পর যখন ছেড়ে চলে যান, ওঁর ঘোর সন্দেহ ছেলেটি ওঁর নয়। তবে ছেলেটিকে তিনি ওঁর নাম ও পদবি (বাবার নামও চার্লস চ্যাপলিন) এবং ওঁর দাদা সিডনিকে ওঁর পদবিটুকু দিয়ে যান।
বাবা চার্লস চ্যাপলিনের এত সন্দেহের কারণ স্ত্রীর অসতীপনা। চার্লি চ্যাপলিন নিজেও স্বীকার করেছেন ওঁর মা’র প্রচুর প্রেম-ভালবাসা ছিল। চরম অভাবে রাস্তা থেকেও লোক ধরতে হয়েছে। এ নিয়ে অসম্ভব তীব্রতার সঙ্গে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেওছেন: ‘‘সাধারণ নৈতিক মান দিয়ে আমাদের পরিবারের চরিত্র বিচার করা হবে ফুটন্ত জলে থার্মোমিটার চুবনোর মতো ভুল কাজ।’’
এই সব স্মৃতি ও অনুভূতি পরে চ্যাপলিনের ছবিতে ক্রমাগত ডেকে এনেছে একের পর এক বেশ্যা চরিত্র। চ্যাপলিন জীবনীকার পিটার অ্যাকরয়েড লিখছেন যে, নিতান্ত বাল্যে চ্যাপলিনের মা’র রক্ষক ও ত্রাতা হয়ে ওঠার স্মৃতিই কাজে এসেছে ওঁর ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে নায়কের তরুণী, অবলা নারীদের অভিভাবক হয়ে ওঠায়।
বালক চ্যাপলিনের মা’র রক্ষক হয়ে ওঠার এক অপরূপ বৃত্তান্ত আছে ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’-তে। চ্যাপলিন লিখছেন—
‘‘গলা নিয়ে মা’র সমস্যা হচ্ছিল। গলাটা কখনওই খুব শক্তপোক্ত ছিল না। সামান্য ঠান্ডা লাগলেই ল্যারিঞ্জাইটিস ধরত। আর ধরলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জ্বালাত; অথচ মা’কে গলা খাটাতেই হত, যাতে স্বরের দশা খারাপ থেকে খারাপ হত। তাতে ভরসা রাখার উপায় ছিল না। গানের মধ্যেই ভেঙে যেত হঠাৎ, আর হারিয়ে যেত ফিসফিস আওয়াজে। শ্রোতাদের মধ্যে তখন হাসাহাসি, টিটকিরি শুরু হয়ে যেত। আর সেই চাপ ওর শরীরে পড়ে পড়ে স্নায়ুর দোষ ধরিয়ে দিল, এই হতে হতে ওর নাটকের কাজ তলানিতে ঠেকল এবং এক সময় উঠেই গেল। মা’র এই গলার অবস্থার জন্যই পাঁচ বছর বয়েসে আমার মঞ্চাবতরণ ঘটল। মা সন্ধেবেলায় আমায় সঙ্গে করে থিয়েটারে আনতেন ভাড়ার ঘরে একলা রাখবেন না বলে। সে দিন মিউজিক হল অল্ডারশটে অভিনয় ছিল। খাবারের গন্ধে ম’ ম’ করত থিয়েটারটা। ভিড় করত সৈন্যরা। এমনিতেই হুজ্জুতে সে-সব দর্শকরা তাল খুঁজত গাল পাড়ার, হই হট্টগোল বাধানোর। অভিনেতাদের কাছে অল্ডারশট মানেই আতঙ্কের সপ্তাহ।
আমার মনে পড়ে মা’র গলা ভেঙে ফিসফিসে নেমে গেলে, অডিয়েন্স হাসাহাসি করতে করতে বেসুরো গান আর আওয়াজ দেওয়া শুরু করল। সবটাই আমার কাছে অদ্ভুত, বুঝতেই পারছি না কী ঘটছে। দেখতে দেখতে হল্লা বাড়ল আর মা’কে স্টেজ ছেড়ে বেরোতে হল।
মা খুব ভেঙে পড়ে উইংসের পাশে ম্যানেজারের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করল। যিনি আবার মা’র বন্ধুদের সামনে আমাকে গাইতে দেখেছিলেন। তর্কটা ছিল মা’র জায়গায় আমাকে স্টেজে গাইতে পাঠানো নিয়ে।
ওই ঝঞ্ঝাটের মধ্যেই ম্যানেজার আমাকে স্টেজে নিয়ে ক’টা কথা বলে একলা ছেড়ে দিলেন। পাদপ্রদীপের ওই চড়া আলোয় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন এক রাশ মুখের সামনে আমি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গান ধরে ফেললাম। একটু চেষ্টায় ওরা আমার স্কেলটাও পেয়ে গেল। আর গান একটু চলতেই বৃষ্টির মতো পয়সা ঝরতে লাগল মঞ্চে।
আমি তখনই ঘোষণা করলাম পয়সা কুড়িয়ে ফের গানে আসব। তাতেও হাসির রোল পড়ল। ম্যানেজার একটা রুমাল এনে আমার পয়সা কুড়নোয় হাত লাগালেন। তাতে আমার ভয় হল পয়সাগুলো কি উনিই গাপ করবেন? এটা অডিয়েন্সের সামনে বলে ফেলতে আবার হাসির বান ডাকল। বিশেষ করে ম্যানেজার টাকা নিয়ে স্টেজের বাইরে হাঁটা দিতে আমিও তখন ওঁর পিছু নিলাম। আর যতক্ষণ না তিনি টাকা আমার মা’র হাতে গচ্ছিত করছেন আমি মঞ্চে ফিরিনি।
কথা বলে, গান গেয়ে, এমনকী মা’র গলা নকল করে গেয়ে প্রচুর পয়সা ছোড়়াছুড়ি, হাততালি আর হাসিতে যখন শেষ করলাম, মা ফের স্টেজে এল আমায় নিয়ে যেতে। ওর উপস্থিতিতে ফের শুরু হল হর্ষধ্বনি। সে-রাতেই মঞ্চে আমার প্রথম আবির্ভাব আর মা’র গান ও অভিনয়ের ইতি।’’
যদ্দিন মা গাইতে পারছিলেন চ্যাপলিনদের ভালই চলছিল, গলার গান চলে যেতে ওদের বাসা বদল আরম্ভ হল। তিন ঘরের আস্তানা থেকে প্রথমে দু’ঘরের, পরে এক ঘরের। ঝকঝকে পাড়া থেকে ক্রমশ ঝঝ্ঝড়ে, বেহাল পরিবেশে। যত ঠাঁইনাড়া দশা, ততই বেচাবেচি চলে বাড়ির জিনিসপত্তরের।
বেচাবেচির পালায় মা’র শেষ হাত পড়ল ওর নাটকের পোশাক-আশাকের তোরঙ্গে। এই জিনিসগুলো প্রাণে ধরে ছাড়তে পারেনি পাছে একদিন গলা ফেরে!
সমাজের নিচু স্তরে বাস করলে খুব সহজেই মানুষ তার ভাষার চেহারা, উচ্চারণের বিশিষ্টতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মা সারাক্ষণ পরিবেশের আঁচ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ওর কাজ, এবং নজর রেখেছিল ছেলেদের কথাবার্তা, বাচন ভঙ্গি, বুলির ব্যাকরণের ওপর। যাতে ছেলেদের কথাতেই ওদের শ্রেণির কেতা ধরা দেয়।
এই বিষণ্ণ দিনগুলোতেই মা’র মাইগ্রেনের ব্যথা হতে লাগল। ফলে ছুঁচ-সুতোর কাজ তাকে তুলে দিনের পর দিন ভেজা চা পাতা চোখের ওপর রেখে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হচ্ছিল। সময়টার অপূর্ব একটা বর্ণনা দিয়েছেন চ্যাপলিন ওঁর জীবনস্মৃতিতে। লিখছেন: ‘‘পিকাসোর ছিল একটা ব্লু পিরিয়ড। নীলের পর্ব। আমাদের ছিল একটা ধূসর পর্ব, যখন স্থানীয়দের দয়া-দাক্ষিণ্য, বিনামূল্যে স্যুপ খাওয়ার জন্য সরকারি কুপন আর ত্রাণসামগ্রীর ওপর দিন চলেছে।’’
এক বার মাইগ্রেনের ধাক্কা সামলে খাড়া হয়ে মা ছেলেদের বেড়াতে নিয়ে গেল সাগরতীরে। সাউথেন্ড-অন-সি। চ্যাপলিন লিখছেন: ‘‘সমুদ্রের প্রথম দর্শনই আমায় মায়াজালে বশ করে ফেলল।’’
কে জানে, সে কি প্রথম হাতছানিও জল পেরিয়ে মার্কিন দেশে ভাগ্যান্বেষণে যাবার! চ্যাপলিন তেমন কিছু লেখেননি, তবে ঘটনা এই যে ১৯৫৭-য় বিশ্ববিখ্যাত চ্যাপলিন একবার মাতৃভূমিতে ফিরে (তখন তিনি মার্কিন দেশ ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করছেন) সাউথেন্ড-অন-সি’র ঠিক সেই গেরুয়া তট দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে-সরু, আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পাহাড়ের মাথায় চড়ে প্রথম সমুদ্র দেখেছিলেন সেটি আর খুঁজে পাননি।
কাজ যখন করা যাচ্ছেই না তখন আর কী করা! স্বামী চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র ছেড়ে চলে গিয়ে বিয়ে করলেও একটা সময় ছেলেদের জন্য হপ্তায় আধ পাউন্ড করে পাঠাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে সেটাও বন্ধ করে দিলেন। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে যখন প্রাণে বাঁচতে ছেলেদের হাত ধরে ল্যামবেথ ওয়র্কহাউজে মা-র প্রবেশ। ওয়র্কহাউজ হল সাধ্যমতো হাতের কাজ জুগিয়ে যৎসামান্য খাওয়াদাওয়া পরার সংস্থান হয় এমন দরিদ্রাশ্রম।
সেখানে ঢুকতে মা’কে মহিলাদের আবাসের দিকে আর ছেলেদের শিশু-কিশোর শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে এক সময় ভিজিটিং রুমে মা’র সঙ্গে দেখা করতে এসে দুই ছেলে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। এ কী হাল হয়েছে মা’র! এক সপ্তাহেই কী রোগা হয়ে গেছে, আর কত বয়েস ধরে গেছে!
ছেলেদের দেখামাত্র তার মুখ আলোয় ঝলমল করে উঠল, কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে দেখে আর কান্না চাপতে পারল না। তার পর কান্না থামিয়ে ওদের আদর করতে লাগল। সৌভাগ্যবশত তিন সপ্তাহের মধ্যে অনাথ ও গরিব শিশুদের বিদ্যালয় হ্যানওয়েল স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা হল সিডনি ও চার্লিকে। ইস্কুলের আশপাশ-ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে ওয়র্কহাউজের সেই তীব্র বিষাদ অনেকটা কাটল, কিন্তু তবু একটা ব্যথা। মা’র থেকে দূরে হয়ে গেল জীবন কিছুটা।
এই সময়ই সিডনির মওকা এল স্কুল ছেড়ে নৌবাহিনীতে যাবার। ওয়র্কহাউজে থাকা ছেলেদের এগারো বছর বয়েস হলে আর্মি বা নেভিতে ক্যাডেট হয়ে যোগ দেবার সুযোগ ছিল। সিডনি প্রথম সুযোগেই সমুদ্রে পাড়ি দিল। যেতে পারত চার্লিও, কিন্তু ও গেল না মা’র কাছাকাছি থাকবে বলে, মা’ও ছেলেকে সঙ্গে রাখবে বলে ওয়র্কহাউজ ছেড়ে কেনিংটন পার্কের পিছনে একটা ডেরা খুঁজে নিল। আর কিছু দিন পর সিডনিও নেভির পাঠ ছেড়ে মা-ভাইয়ের কাছে ফিরে এল।
যে-বিষণ্ণ সকালের ছবি দিয়ে চ্যাপলিন ওঁর আত্মজীবনীর আলাপ পর্ব শুরু করেছেন সে-দিনটি দাদা সিডনির সমুদ্র থেকে ফিরে আসার আগে। যখন একটা দুশ্চিন্তায় খান খান হয়ে যাচ্ছে মা।
• • •
দুশ্চিন্তাটা একটা মামলায় হেরে যাওয়ার। বাবা তত দিনে ছেলেদের খোরপোশ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। গান, অভিনয়, সেলাইকাজ সব চুকেবুকে গেছে।
ছেলেদের নিয়ে একটু সম্মানের সঙ্গে বাঁচবে বলে ওয়র্কহাউজ ছেড়ে নতুন করে বাসা বেঁধেছে। অথচ ছেলেদের জন্য সাহায্যের হাতটাও স্বামী গুটিয়ে নিয়েছে। কেস করা ছাড়া উপায় কী? এবং সেখানেও হার।
বাবার হয়ে মামলা লড়ে যে-উকিল খোরপোশ বাতিল করল তার নাম আর্মস্ট্রং। কেঁদে কেঁদে মুখে গালাগালি সব ঝাড়ছে মা আর্মস্ট্রংকে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে কিছু বলছে না। আসলে চোখের সামনে ভাসছে কেনিংটন পার্কের পিছনের আস্তানা ছেড়ে দরিদ্রাশ্রমের জীবনে ফেরা। যা তাকে যেতেও হল এর পর ঘন ঘন এবং এ ভাবেই এক দিন, সম্পূর্ণ উন্মাদিনী হয়ে গেল।
এক দিন সিডনি যখন মাঠে ফুটবল খেলছে দু’জন নার্স ছুটে এসে খবর দিল মা পাগল হয়ে গেছে। ওকে কেন হিল পাগলাগারদে পাঠানো হয়েছে। খবরটা শুনে সিডনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না, ফুটবল খেলে গেল। খেলা শেষে নির্জন এক কোণে গিয়ে শুধু কেঁদেই গেল।
আর চার্লি? আত্মজীবনীতে লিখছেন—
‘‘ও যখন বলল কথাটা আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। আমি কাঁদলাম না, কিন্তু একটা অবুঝ নিরাশা ছেয়ে ফেলল আমাকে। কেন এটা করতে গেল মা? এত স্ফূর্তি আর আনন্দ তাকেই শেষে পাগল হতে হল? কেমন যেন মনে হল দুঃখের তাড়নায় মা হয়তো নিজের মন থেকেই পালিয়ে গেল। আমাদের ঝেড়ে ফেলেই। সেই হতাশার অন্ধকারে আমি ভেতরে ভেতরে দেখতাম মা যেন করুণ চোখে আমায় দেখে যাচ্ছে, আর একটু একটু করে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।’’
মা’র মাথা ঠিক নেই সেটা সরকারি ভাবে জানানো হল এক সপ্তাহ পর। এর মধ্যে কোর্টেরও নির্দেশ এল তার প্রাক্তন স্বামীকে ভার নিতে হবে দুই ছেলের।
বাবার সঙ্গে থাকা যাবে এই ভাবনাটাই বেশ চঞ্চল করে দিল চার্লিকে। যে বাবাকে মাত্র দু’বার দেখেছে জীবনে!
এক বার যখন মঞ্চে গান গাইছে বাবা। আরেক বার একটা বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে। এক মহিলার সঙ্গে বাগান দিয়ে হেঁটে আসছিলেন চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র। দেখামাত্র একটু থেমে ভাল করে নজর করেছিল চার্লি এবং ভেতরে ভেতরে জেনে গিয়েছিল এ-ই বাবা।
ভদ্রলোক ওকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। পরিস্থিতির নাটকীয়তা আঁচ করে চার্লি কিছু না বোঝার ভান করে বলেছিল, ‘‘চার্লি চ্যাপলিন।’’
ভদ্রলোক তখন পাশের মহিলার দিকে এক বার চোখ ফেলে পকেট থেকে একটা হাফ ক্রাউন বার করে দিয়েছিলেন। চার্লিও সেটা নিয়ে দৌড়ে বাড়ি এসে মা’র সামনে ঘোষণা করেছিল, ‘‘বাবার সঙ্গে দেখা হল।’’
মা উন্মাদ আশ্রমে, আর এই বাবার সঙ্গে থাকতে যাওয়াটা অবশ্য এক অন্য গল্প চার্লি চ্যাপলিনের জীবনে। কান্না-হাসির দোলদোলানির মধ্যেই একটু একটু করে ওঁর বড় হয়ে ওঠা। তার পর এক সময় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকা…
• • •
নিশীথবাবুর বাড়িতে আরও দু’দিন গিয়েছিলাম অন্য অজুহাতে। আসলে ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’ পড়ে শেষ করব বলে। বিশেষ করে সেই বইটাতে যে হাতের স্পর্শ আছে পৃথিবীর সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ শিল্পীর! কমেডি সৃষ্টির প্রতিভা হিসেবে যাঁর নাম বসবে শেক্সপিয়র, মলিয়ের, অস্কার ওয়াইল্ড-এর পাশে।
এবং সেই থেকে চার্লি চ্যাপলিনের বৃহৎ সিনেমাকীর্তির একটা বড় অংশ দেখতে বাধ্য হই ওর শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের চলচ্চিত্ররূপ হিসেবে।
আর দেখতে দেখতে, হাসতে হাসতে কান্না পায়। যে-কান্না থেকে একটু একটু করে উঠে এসেছে ওই সব অমর হাসি।
কবি এলিয়টের লাইন ধার করে বললে বলতে হল— আফটার সো মাচ নলেজ হোয়াট ফরগিভনেস?