মধুসূদনের আগে ‘মাইকেল’ জুড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাঁর বড় কবি হওয়ার ইচ্ছের ভূমিকাও বিরাট।
মধ্য কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটরিতে এত সবুজ, চোখের আরাম হতে বাধ্য। মধুকবি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না, টালি-ফেলা পথের ধারে বড় ফলকের গায়ে লেখা ‘মধু-বিশ্রাম পথ’, ‘বাংলার গৌরব কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাবার রাস্তা’। লোহার রেলিং-ঘেরা এক টুকরো জমি। ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকতেই আবক্ষ মর্মরমূর্তি, নীচে সেই বিখ্যাত এপিটাফ: ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!...’ দু’পাশে নানা রঙের পাতাবাহার পেরিয়ে পাশাপাশি সমাধিতে শুয়ে আছেন মধুসূদন-হেনরিয়েটা। শান্ত, চুপচাপ।
অথচ ৪৯ বছরের জীবনে (১৮২৪-১৮৭৩) কী অশান্তই না ছিলেন ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’! উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গের ঘটনাবহুল ছটফটে মেজাজটা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। রাজা রামমোহন রায় বই লিখছেন, বিলেত যাচ্ছেন, অর্থবান হিন্দু ঘরের ছেলেদের সাহেবি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে কলকাতায় শুরু হচ্ছে হিন্দু কলেজ, অদূরে শ্রীরামপুর থেকে বেরোচ্ছে প্রথম বাংলা খবরকাগজ, কলকাতার বাঙালি সমাজকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো, নিষিদ্ধ হচ্ছে সতীদাহ, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছেন উচ্চবর্ণের বা নামডাকওয়ালা বাঙালি ঘরের কেউ কেউ— এই সমস্তটা নিয়ে একটা যুগের যে দুরন্ত ঘূর্ণি, তার মধ্যিখানে এসে পড়ছেন যশোরে কপোতাক্ষ-তীরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের মধুসূদন দত্ত। পয়সা আর ঠাঁটবাটওয়ালা ঘরের ছেলে সাহিত্যটা মন দিয়ে পড়েছিলেন হিন্দু কলেজে। প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে এক নারীর অনিবার্য উপস্থিতি যদি বা তর্কযোগ্য, এক জন সুশিক্ষকের অবদান নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করবেন বলে মনে হয় না। হিন্দু কলেজে মধুসূদন ডিরোজ়িয়োকে পাননি বটে, তবে পেয়েছিলেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনকে। সাহিত্যের অধ্যাপক, পরে কলেজের অধ্যক্ষ এই মানুষটির ব্রিটিশ রোম্যান্টিক পোয়েট্রির ক্লাস মুগ্ধ করেছিল তারুণ্যের দোরগোড়ায় পা রাখা মধুসূদনকে। বায়রন ছিলেন তাঁর স্বপ্নের কবি, সাময়িক রোল মডেলও— নইলে যে যুগে দেবেন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর থেকে রাম-শ্যাম-যদু সক্কলকে কৈশোর না পেরোতেই বিয়ে দেওয়াটা দস্তুর, সে কালে বায়রন-পড়া ‘মধু’ ব্যতিক্রম। তাঁর সোজা কথা— বিলিতি কায়দায় কোর্টশিপ না করলে সে কি আর প্রেম, আর প্রেম করে বিয়ে না করলে সে কি আর বিয়ে!
অদ্ভুত নিশ্চল লক্ষ্য
প্রেম-বিয়ের মতো কাণ্ডকারখানায় অযৌক্তিক, ব্যাখ্যাতীত কাণ্ডটাণ্ড থাকে। মধুসূদনের সঙ্গে এক জমিদারবাড়ির নাবালিকা মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত। মধু সেই বিয়ে আটকাতে মরিয়া হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন— মধুসূদন-আলোচনার বৃত্তে এই ব্যাখ্যার বিস্তর ঘোরাঘুরি। কিন্তু আসল কথা, মধুসূদনের আগে ‘মাইকেল’ জুড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাঁর বড় কবি হওয়ার ইচ্ছের ভূমিকাও বিরাট। হিন্দু কলেজে পড়তে পড়তেই যে প্রতিভাবান ছাত্রটি দেখছেন তাঁর মাস্টারমশাই নিজে কবিতা লেখেন, সম্পাদনা করেন ইংরেজি কবিতাবই, তাঁর মনেও কবিতা লেখার, ছাপানোর এবং সবচেয়ে বড় কথা— কবি হওয়ার ইচ্ছে ঘাই মারবে বইকি! মধুসূদনের গোড়ার দিকের ইংরেজি কবিতা সেকেলে কলকাতার ‘লিটারারি গ্লিনার’, ‘লিটারারি গেজেট’, ‘কমেট’, ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজ়িন’-এ বেরিয়েছে, আশায় বুক বেঁধে তিনি কবিতা পাঠিয়েছেন লন্ডনের বিখ্যাত ‘বেন্টলিজ় মিসেলেনি’তে। কিন্তু দিনের শেষে বুঝেছেন, তাঁর সময়ে ইংরেজি ভাষায় (তখনও তাঁর বাংলায় লেখালিখির ভাবনা ভবিষ্যৎ-গর্ভে) বড় কবি হতে গেলে তাঁকে কলকাতায় পড়ে থাকলে চলবে না, সাগর পাড়ি দিয়ে বিলেত যেতে হবে এবং তা যে কোনও মূল্যে। তাঁর কবিতায় তাই অতলান্তিক পেরিয়ে সুদূর অ্যালবিয়নের তীরে সুউচ্চ পর্বত, শ্যামল উপত্যকা দেখার আকুলিবিকুলি, স্বজনহীন প্রবাসে এক নামহীন সমাধির জন্য দীর্ঘশ্বাস। এই ছেলে কলেজের প্রিয় বন্ধুকে চিঠিতে লেখে কবি আলেকজ়ান্ডার পোপের উক্তি— কবি হতে গেলে প্রয়োজনে বাবা-মা, ঘর... সব ছাড়তে হবে। বন্ধুর কাছে খুলে দেয় স্বপ্নের পুঁটুলি— এক দিন বিরাট কবি হবে সে। সে দিন যেন তাঁর প্রিয় বন্ধু গৌরচন্দ্র বসাক সেই মহাকবির জীবনী লেখে! নিছক যৌবনোচিত আবেগ? এই ছেলের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও সমীহ করতে হয়।
আরও পড়ুন: অন্তরের অন্দরে রয়ে গেল গান
নিজের শর্তে বাঁচতে ক’জন পারে? মধুসূদনও পারেননি, তা বলে ইচ্ছেটা মরে যায়নি। শিল্পের দুনিয়ায় বহু প্রবল প্রতিভাও জীবনে ঠোক্কর খেয়ে, চেয়েও না পেয়ে চুপ করে গিয়েছেন, আপস করে নিয়েছেন সময়ের সঙ্গে— উদাহরণ বিস্তর। মধুসূদন করেননি। তাঁর কতকগুলো ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। বড় কবি হওয়ার ইচ্ছে ছিল, হয়েছেন। আরামে-বিলাসে জীবন কাটানোর ইচ্ছে ছিল— খানিকটা পেরেছেন। খ্রিস্টান হওয়ার পরে যে কলেজ তাঁর ঠিকানা হয়েছিল, সেই বিশপ’স কলেজে সাদা আর কালো ছাত্রের আলাদা পোশাক-নীতি ছিল। সাহেব শিক্ষকদের লেখা চিঠিতে জানা যায়, মধুসূদন কলেজে সাহেবি পোশাক পরে যাওয়ায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। এ তো পরের কথা, এর আগেই তাঁর বাড়ি গিয়ে গৌরদাস ও অন্য বন্ধুরা দেখেছেন, বাবার সামনে ধূমপান করছেন মধুসূদন। এমনকি বাবা-ছেলে একত্রে মদ্যপানও করছেন!
হেনরিয়েটা। আজীবন ছিলেন মাইকেলের পাশে
সেই ছেলেই খ্রিস্টান হওয়ার সময়ে বাবাকে রেয়াত করেননি। কলকাতার আর্চডিকন যে দিন ব্যাপটাইজ় করলেন মধুসূদনকে, চার্চের বাইরে গোরা সৈন্য নিয়োগ করতে হয়েছিল, পাছে রাজনারায়ণ দত্ত লেঠেল পাঠিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেন। তবে তাতেও লাভ হত বলে মনে হয় না। কারণ মধুসূদন যা বিশ্বাস করেন, তা ভাঙার সাধ্যি কারও নেই। মানুষ বাড়ির লোক না হোক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্তত জানায়, আমি এটা করতে যাচ্ছি। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত তাঁর কাছের বন্ধুরাও জানতেন না, এমনকি গৌরদাস বসাক— যাঁকে লেখা একের পর এক চিঠিতে মধুসূদনের ভালবাসা আর নির্ভরতার প্রমাণ উজ্জ্বল, তিনিও না। এ এক অদ্ভুত, নিশ্চল লক্ষ্যের মানুষ। আমি কবি হব, কবি হতে হলে আমাকে বিলেত যেতে হবে, খ্রিস্টান হলে বিলেত যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, অতএব এই মুহূর্তে আমি ঘর, বাপ-পিতেমোর ধর্মও ছাড়ব। বাবা কী বলল, মায়ের কী হবে, সমাজে কতটা ঢি-ঢি পড়ল, থোড়াই কেয়ার! আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপালে পস্তাতে হয়। মধুসূদনের জীবনও কম কষ্টে কাটেনি— কিন্তু তিনি তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিদ্রোহ তাঁর রক্তকণিকায়। ছেড়ে গেলে কষ্ট পেতে হবে, কিন্তু কষ্ট পেতে হবে বলে ছেড়ে যাব না কেন, এ আত্ম-প্রশ্ন তাঁর আমরণ।
ঘরহারা, ঘরছাড়া
খ্রিস্টান হয়ে হিন্দু কলেজে পড়ার অধিকার হারালেন মাইকেল। নিরাপত্তাও দরকার তখন, তাই ঠিকানা হল ফোর্ট উইলিয়াম। নিয়মকানুন কড়া, বন্ধুরাও সহজে আসতে পারেন না। আর হিন্দু ঘরের ছেলেরা ধর্মচ্যুত মতিভ্রষ্ট ছেলের কাছে গেলে মানসম্মানও গোল্লায় যাবে। মাইকেল পড়তে গেলেন বিশপ’স কলেজে। পড়াশোনার দিগন্ত আরও প্রসারিত হল এখানে। পেলেন গ্রিক, ল্যাটিনের আস্বাদ।
বিলেত যাওয়া কিন্তু হল না। মনে হতে পারে, এই ছেলে আসলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে সামাজিক প্রতিষ্ঠার সিঁড়িটা ধরার মতলবে। কবিযশ, সম্মান, বৈভব-বাসনা তাঁর ছিল, এ যেমন ঠিক কথা, তেমনই সত্য— মাইকেল খ্রিস্টধর্মকে অন্তত তখন মন থেকেই ভালবেসেছিলেন। নিজের ব্যাপটিজ়ম উপলক্ষে তাঁর ইংরেজি প্রার্থনাগান রচনা নিছক আবেগী প্রকাশ নয়। কয়েক বছর পরে, মাদ্রাজে থাকাকালীন ‘দি অ্যাংলো স্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দুজ়’ নামে এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও তাঁর মত স্পষ্ট— হিন্দুধর্মের তুলনায় খ্রিস্টধর্ম উন্নততর। হিন্দুধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন যাঁরা, তাঁরা রক্তচক্ষু ও খড়্গহস্ত হলেও মধুসূদনের ‘মাইকেল’ নাম ও তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ঐতিহাসিক সত্য হয়েই থেকে যাবে। ঠিক যেমন থেকে যাবে মাত্র কয়েক বছরের লেখালিখিতেই তাঁর বাংলা ভাষা, বিশেষত তার কাব্য ও ছন্দকে মোড় ফিরিয়ে দেওয়ার অসামান্য কীর্তি।
যশোর, কলকাতা, মাদ্রাজ, লন্ডন, ভার্সেই... যশোর না হয় তাঁর পিতৃভূমি, শৈশবের কয়েক বছরের ঠিকানা। বাকি প্রত্যেকটি জায়গায় তাঁর থাকা বা ছেড়ে যাওয়াও নিজস্ব সিদ্ধান্তে। বিশপ’স কলেজে খরচ প্রচুর, ছেলে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও বাবা সেই খরচ জোগাচ্ছিলেন। ভবিষ্যতে চার্চের কাজে জীবন উৎসর্গ করবে, ছেলেরা এমন কথা দিলে কলেজ তাদের খরচ মকুব করে দিত। রাজনারায়ণ দত্ত কিন্তু ছেলের খরচ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ছেলের মিশনারি হয়ে যাওয়া আটকাতে। মনে তখনও ক্ষীণ আশা, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে যদি ঘরে ফেরানো যায়! কিন্তু মধুসূদন তো লোক-দেখানো ‘মাইকেল’ হননি, খ্রিস্টধর্মে তাঁর আন্তরিক প্রতীতি জন্মেছে। ছেলেকে ফেরানো যাবে না বুঝে বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করলেন। পয়সা না দিলে কোন কলেজ ছেলে পড়বে? হিন্দু কলেজে পড়াশোনা শেষ হয়নি, বিশপ’স কলেজের দরজাও যখন বন্ধ হওয়ার মুখে, মাইকেল শহর ছাড়লেন। এ বার নিজের জীবন, রোজগারপাতির ব্যবস্থাও নিজের। গন্তব্য তখনকার মাদ্রাজ। এই যাওয়া নিয়েও বন্ধু কি বাড়ির লোক, কাউকে কিচ্ছু বলেননি। বিশপ’স কলেজের এক মাদ্রাজবাসী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধুর সাহায্যে মাদ্রাজের অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে একটা চাকরি জুটল। আজকের স্কুলশিক্ষকেরা গর্ববোধ করতে পারেন, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচয়িতা তাঁদের পেশাতেই ছিলেন। দু’-দুটো স্কুলে পড়িয়েছেন!
রেবেকা থেকে রিজিয়া
এই স্কুলেরই ছাত্রী ছিলেন রেবেকা— মধুসূদন-ঘরণি। পিতৃহীন মেয়েটি থাকতেন স্কুলেই, হয়তো মধুসূদনের ছাত্রীও ছিলেন তিনি। বছর ছয়েকের ছোট মেয়েটির সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে মাইকেলের আর ১৮৪৮-এর জুলাই-শেষে বিয়েও হয়। এই বছরটা মাইকেলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে কালের রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিজগতের কেন্দ্র কলকাতা ছেড়ে তুলনায় অজ-পাড়া মাদ্রাজে আসা, প্রথম চাকরি, প্রেম, বিয়ে। প্রথম কাব্য ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ রচনাও এ বছরই, বই হয়ে বেরোয় পরের বছর। বইটি ছেপেছিল মাদ্রাজের এক মুদ্রক। এই বই নিয়ে গৌরদাস বসাককে যে চিঠি লিখেছিলেন মাইকেল, পড়লে দরদে মন ভিজে যায়। লিখছেন, বন্ধুদের মধ্যেই কয়েক জন যদি দু’টাকা দিয়ে বইটা কেনেন, আর গৌরদাস যদি আরও জনা চল্লিশেক গ্রাহক জোগাড় করতে পারেন, তা হলে তাঁর বই ছাপার খরচটুকু উঠে আসে। প্রথম বই বলে কথা, ভাল রিভিউ বেরোক, কোন লেখক না চায়! মাইকেলও চেয়েছিলেন। বই পাঠিয়েছিলেন ‘অ্যাথেনিয়াম’ আর কলকাতার ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায়। ‘অ্যাথেনিয়াম’ ভাল বলল, ‘হরকরা’ ধুয়ে দিল। বেথুন সাহেবকেও বই পাঠিয়েছিলেন মাইকেল, তাঁরও ভাল লাগল না। তিনি বললেন, ইংরেজিতে না লিখে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে নেটিভ লিখিয়েদের কাজে দেবে বেশি। মাইকেলের মন ভাঙল, কিন্তু লাভটা হল ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের। ইংরেজিতে এর পরে আর কাব্য লেখেননি তিনি, তাঁর জীবনে এল বাংলা কাব্য, সাহিত্য।
প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাক
তারও আগে আর একটা জীবন আছে মধুসূদনের। সে তাঁর সাংবাদিক-জীবন। একে ছেলে ভাল লিখতে পারে, তায় আবার সংসার চালানোর টাকা দরকার, দুইয়ে মিলে উনিশ শতকের মাদ্রাজ সাক্ষী হল সাংবাদিক মাইকেল মধুসূদন দত্তের। ‘ইউরেশিয়ান’ আর ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’— এই দুটো পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরে সহকারী সম্পাদক হয়েছিলেন ‘মাদ্রাজ স্পেকটেটর’ কাগজেরও। লিখতেন সাহিত্যের লেখা, সম্পাদকীয়, এমনকি খবরও! ‘ইউরেশিয়ান’-এই বেরিয়েছিল তাঁর নাটক ‘রিজিয়া’। যে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্য তিনি অমর, ‘রিজিয়া’ সেই ছন্দেই লেখা। মধুসূদনের সাংবাদিক-জীবন স্বল্পায়ু, মাত্র কয়েক বছরের। কাজটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তত দিনে তিনি চাকরি পেয়েছেন মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে! শুনতে দারুণ মনে হলেও, মাইনে ছিল শ্বেতাঙ্গ শিক্ষকদের চেয়ে ঢের কম। পড়াতেন ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল।
শুধু সুখ চলে যায়
চেনা পরিবারবৃত্ত থেকে বহু দূরে এক তরুণ দু’হাতে সামলাচ্ছেন চাকরি আর সংসার। ছেলেপুলে হয়েছে, পরপর দুই মেয়ে— বার্থা আর ফিবি। তার পরে দুই ছেলে জর্জ আর মাইকেল। এরই মধ্যে কী করে প্রেম এল আবার? বছর সতেরোর একটি ইংরেজ মেয়ে, এমেলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট— হেনরিয়েটা নামেই চেনে সবাই। মা-মরা মেয়ে, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে এনেছে যাকে, তার বয়স হেনরিয়েটার আশপাশে। ঘরের দেওয়াল গিলে খেতে এলে ‘বাইরের লোক’-এর কাছে বরং মনের ঝাঁপি উপুড় করে স্বস্তি পায় মন। হেনরিয়েটার জীবনে সেই ‘বাইরের লোক’টা মাইকেল ধীরে ধীরে হয়ে উঠল মনের মানুষ। রোম্যান্সটুকু বাদ দিলে যে নিয্যস নৈতিক সত্যিটা পড়ে থাকে, তা হল— মাইকেল মধুসূদন দত্ত জড়িয়ে পড়েছেন এক পরকীয়া সম্পর্কে! এমনই সে ভালবাসা যে, ১৮৫৬-র জানুয়ারিতে মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতা চলে আসার পরে স্ত্রী রেবেকা আর নিজের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগই করছেন না আর (বছর দুয়েকের শিশুপুত্র মাইকেল মারা গেলেও না)। পরিবারকে নিয়ে আসছেন না কলকাতায়। বরং মাইকেল চলে আসার বছর আড়াই পরে যিনি কলকাতা এসে পৌঁছচ্ছেন আর বাদবাকি জীবনটা থেকে যাচ্ছেন এই ব্যাখ্যাতীত ভাবে অবিবেচক মানুষটার সঙ্গে, তাঁর নাম— হেনরিয়েটা।
মনে হচ্ছে তো, এই লোকটা সুবিধের নয় একদম! যখন যাকে খুশি ছেড়ে চলে যেতে পারে, যখন যা মনে হয় করে বসে! অনেকাংশেই সত্যি কথা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমন এক জীবনের নাম, যাকে খুঁটিয়ে পড়লে হাসি কান্না রাগ অভিমান ক্ষোভ দুঃখ ঈর্ষা করুণা... সমস্ত অনুভূতির সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যায়। রেবেকার সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি মাইকেলের, আবার হেনরিয়েটাকেও কোনও দিন বিয়ে করেননি তিনি। তাতে কী! হেনরিয়েটা তাঁর জীবনের সমস্ত সুখ এই মাত্রাছাড়া দিশেহারা পাগলপারা লোকটার জন্যই জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন বা বলা যায়, মধুসূদনই হয়ে উঠেছিলেন এই মেয়েটির একমাত্র সুখ। তিনটি সন্তানের মা হয়েছেন, অবর্ণনীয় দুঃখ ও দারিদ্র্য যাপন করেছেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে বা এ শহরেও কপর্দকশূন্য দিন কাটিয়েছেন। তবু কোনও দিন ছেড়ে যাননি মধুসূদনকে।
ইতিহাস-গড়া কবি
মাদ্রাজ-ফেরত মধুসূদন কলকাতায় জেরবার হয়ে ছিলেন পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা আদায় নিয়ে। বাবার খিদিরপুরের বাড়ি, যশোরের তালুক, মায়ের অলঙ্কারের উত্তরাধিকার নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায়। এ সব কাজে সময়, শ্রম ও অর্থ খরচ হয় বিস্তর, কিন্তু পেটটাও তো চালাতে হবে। তাই কলকাতার পুলিশ কোর্টে ১২৫ টাকার জুডিশিয়াল ক্লার্কের চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। এরই মধ্যে কলকাতা, বাংলা তথা ভারতে ঘটনার ঘনঘটা— ১৮৫৬-র জুলাইয়ে বিধবাবিবাহ আইন পাশ, পরের বছরেই সিপাহি বিদ্রোহ, তার পরে নীল বিদ্রোহ। দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীল দর্পণ’, জেমস লং-এর প্রচেষ্টায় তার ইংরেজি অনুবাদ হল, সে অনুবাদ নাকি মধুসূদনেরই করা! সেই নিয়েও একপ্রস্ত গন্ডগোল।
মধুসূদনের জীবনে এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলায় তাঁর নাট্য ও কবিপ্রতিভা স্বপ্নের উড়াল দিয়েছিল এ সময়েই। পাইকপাড়ার জমিদাররা বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনয় করাবেন বলে সংস্কৃত-আশ্রয়ী ‘রত্নাবলী’ নাটক লিখিয়েছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্নকে দিয়ে। মধুসূদন পড়ে বললেন, এ অতি বাজে। নিজেই লিখে ফেললেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (যে নাটকের ও চরিত্রের নামে হেনরিয়েটার গর্ভজাত মেয়েরও নাম রেখেছিলেন তিনি)। তুমুল ‘হিট’ হল সেই নাটক, আর মধুসূদনের সবচেয়ে বড় লাভটা হল এই— বাংলা ভাষায় লেখালিখির তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাসটা পেয়ে গেলেন তিনি। কলম থেকে একের পর এক বেরোল নাটক ‘পদ্মাবতী’, জোড়া প্রহসন ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ আর ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বাজি ধরে অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, এ ছাড়াও ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক। এগুলির কোনওটিই লিখতে খুব বেশি সময় নেননি, কিন্তু যে সৃষ্টির জন্য তিনি আজও চিরস্মরণীয়, সেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখেছেন প্রায় এক বছর ধরে। প্রতিষ্ঠিত ও প্রামাণ্যকে প্রান্তিক করে, প্রান্তবর্তীকেই কেন্দ্রে নিয়ে আসার প্রবণতা একুশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বহুচর্চিত। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে রামকে দূরে ঠেলে রাবণকে আপন করছেন এক কবি, লিখছেন নতুন ভাব-ভাষা-রূপকল্পে, এ জিনিস অকল্পনীয়।
১৮৬১ সালে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাস কয়েক আগে প্রথম পাঁচটি সর্গ নিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম খণ্ড বেরোল যখন, তখন বাংলা ভাষা পেয়ে গিয়েছে সে সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিকে। পণ্ডিতরা ধন্য ধন্য করলেন, অনেকে তুলনা টানলেন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর সঙ্গে। কবিযশ-আকাঙ্ক্ষা তো মধুসূদনের ষোলো আনা, কিন্তু মিল্টনের সঙ্গে তুলনা গায়ে মাখেননি তিনিও। চিঠিতে লিখছেন, ‘...মিল্টনের থেকে ভাল আর কিছুই হতে পারে না; অনেকে বলছে (মেঘনাদবধ কাব্যে) কালিদাসের স্বাদ, তাতে আমার আপত্তি নেই। ভার্জিল, কালিদাস, টাসো-র সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নয়। ওঁরা মহিমাময় হলেও জাগতিক কবি, মিল্টন ঐশ্বরিক।’ কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ সংবর্ধনা দিল মধুসূদনকে, উপহার দিল রুপোর সুদৃশ্য পানপাত্র।
এবং বিদ্যাসাগর
এই লেখাটা শুধু মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর নিয়েই হতে পারত। মধুসূদনের জীবন এই মানুষটি ছাড়া অসম্পূর্ণ। মধুসূদন পঞ্চাশ পেরোননি, বিদ্যাসাগরের দাক্ষিণ্য না থাকলে আরও আগেই হয়তো মারা যেতেন তিনি— না খেয়ে, সপরিবার, বিদেশে। কম পয়সায় তাঁর জীবন চলে না। তাই বিপুল কবিখ্যাতি পাওয়ার পরেও প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার হওয়ার বাসনায় মধুসূদন গেলেন বিলেতে। এই পর্বটাই অবর্ণনীয় জীবনযন্ত্রণায় কাটানোর অধ্যায়। কারণ দেশ থেকে মধুসূদনের পৈতৃক সম্পত্তিজাত হকের টাকা পাঠানোর কথা যাঁর, তিনি আর টাকা পাঠাচ্ছেন না। চিঠিরও উত্তর নেই। মধুসূদন আর কাকে বলবেন, করুণাসাগরকে ছাড়া? বিদ্যাসাগর বহু বার টাকা পাঠিয়েছেন, সেই টাকায় মধুসূদনের জীবন চলেছে— লন্ডনে আর ভার্সেইতেও। বেশি পাঠাতেন না, মধুসূদনের স্বভাব জানতেন বলে। বিদ্যাসাগরকে লেখা মধুসূদনের চিঠিগুলো পড়লে স্তম্ভিত হতে হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা মানুষ অনুরোধ, মিনতি, প্রার্থনার স্তরগুলো পেরিয়ে যা বলছে, তার সারমর্ম— বাঁচান, আপনি না দেখলে বাঁচব না। চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার সব আশা আপনার উপরে, আমি নিশ্চিত আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। আর যদি করেন, তবে ভারতে ফিরে দু’-এক জন লোককে সুকৌশলে পরিকল্পিত ভাবে খুন করে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’ বিদ্যাসাগর মধুসূদনের কথায় কখনও তাঁর সম্পত্তি মর্টগেজ করে, কখনও অন্যের কাছ থেকে স্রেফ ধার করে টাকা পাঠিয়েছেন মধুসূদনকে। মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাশ করেছেন (প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার অবশ্য হতে পারেননি, তবে তাঁর ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র বেশির ভাগই এ সময়েই লেখা), দেশে ফিরেছেন, হাইকোর্টে আমল পাননি। তাই আবারও বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হয়েছেন রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্য। সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। তার পরে যখন এই শহরেও মধুসূদনের কেরিয়ার আর জীবন পাখা মেলছে না, ক্রমশই ডুবে যাচ্ছেন ঋণে এবং বারংবার টাকা চাইছেন সেই বিদ্যাসাগরের কাছেই, তখন বিদ্যাসাগরও থামলেন। আর কত করবেন তিনি!
১৮৭৩-এর ২৯ জুন মারা গেলেন মধুসূদন। অপরিমিত মদ্যপানে লিভারে সিরোসিস হয়েছিল, সঙ্গে ড্রপসি, গলার অসুখ, হার্টেরও। তার কয়েক দিন আগেই মারা গিয়েছেন হেনরিয়েটা, বিনা চিকিৎসাতেই। মৃত্যুশয্যাতেই মধুসূদনকে শুনে যেতে হয়েছিল, এই শহরের খ্রিস্টান সমাজের তিনি এমনই চক্ষুশূল যে, কলকাতার কোনও সমাধিক্ষেত্রে তাঁর ঠাঁই হবে কি না, এমনকি অ্যাংলিকান চার্চ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করবে কি না, সন্দেহ! মৃত্যুর পরে এক দিন কেটে গেলেও মেলেনি বেরিয়াল-এর জন্য বিশপের অনুমতিপত্র। শেষমেশ লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধিস্থ হলেন, হেনরিয়েটার পাশেই। গৌরচন্দ্র বসাক-সহ কয়েক জন বন্ধু বহু বছর পরে স্মৃতিফলক বসিয়েছিলেন, তাতে মাইকেলেরই লেখা নিজের প্রয়াণলেখ: ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!...’
ঋণ: যোগেন্দ্রনাথ বসু, নগেন্দ্রনাথ সোম, প্রমথনাথ বিশী, সুরেশচন্দ্র মৈত্র, বনফুল, গোলাম মুরশিদের লেখা মধুসূদন-জীবনী ও অন্যান্য গ্রন্থ; মধুসূদনের চিঠিপত্র