অরুন্ধতী-তপন
একনাগাড়ে শ’পাঁচেক রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বলে দিতে পারতেন অরুন্ধতী। কিশোরী বয়েসে তাঁর গানের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!
তপন সিংহ বলতেন, ‘‘আমরা যে দু’জন এক হতে পেরেছিলাম, তার মূলেও কিন্তু ওই রবীন্দ্রনাথই।’’
ওঁদের ঘনিষ্ঠতার শুরু বার্লিন শহরে। জায়গাটির নাম ‘কুর ফুর্স্টডাম’। সংক্ষেপে ‘কুডাম’। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই পার্ক।
নির্জন সন্ধ্যা। দু’জনে পার্কে বসেছিলেন পাশাপাশি। তপন সিংহ লিখেছেন, ‘‘তাঁকে একটা গান করতে অনুরোধ করেছিলাম। অরুন্ধতী গাইলেন, ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’। ... বার্লিনের সেই সন্ধ্যায় এক গানেই মাত করেছিলেন অরুন্ধতী। আমিও কাত হয়ে গেলাম, পরের ইতিহাসে শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখার্জি হলেন শ্রীমতী অরুন্ধতী সিংহ।’’
সাহিত্যিকদের মধ্যে অরুন্ধতীর পছন্দ ছিল সন্তোষকুমার ঘোষ আর গৌরকিশোর ঘোষকে। মানুষ গৌরকিশোরকেও তিনি ভালবাসতেন খুব। অরুন্ধতী বলতেন, ‘‘ও যে কত বড় দুষ্টু, ওর ‘ব্রজবুলি’ পড়লেই তা বোঝা যায়, আমাকেও ছাড়েনি— ওর ব্রজদা নাকি আফ্রিকা থেকে অরুন্ধতী তারার দিকে তাকিয়ে পথ চিনে কলকাতায় এল। রাম পাজি!’’
নিউ আলিপুরের বাড়ির ছাদে এ দু’জনকে নিয়ে প্রায়ই আড্ডায় বসতেন তপন-অরুন্ধতী।
তপন সিংহর ছবিতে অরুন্ধতীর প্রথম অভিনয় ‘কালামাটি’-তে। অরুন্ধতীকে নিয়ে লিখতে বসে তপন সিংহ এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘অরুন্ধতীর রূপ ছিল সর্বজনবিদিত। ... রূপের মতোই তাঁর মেজাজ।... সত্যভাষণ করতেন।... সঙ্গে ছিল মিথ্যার প্রতি ঘৃণা। যে-কারণে চিত্রজগতে তাঁপ প্রাপ্য সমাদরের অনেকটাই পাননি। কিন্তু বাইরে সম্মান পেয়েছেন।’’
‘সফেদ হাতি’ ছবি করার পর তপন সিংহর হার্ট অ্যাটাক হয়। ভোরবেলা উডল্যান্ডস-এ তাঁকে ভর্তি করে আসেন অরুন্ধতীদেবী একাই। তখন কে জানত, তাঁর জীবনের ভয়ঙ্কর দিনটা আসতে চলেছে আর কিছু দিনের মধ্যেই?
আট সপ্তাহ পর ছাড়া পেলেন তপনবাবু। তাঁর বাড়ি ফেরার দু’সপ্তাহের মধ্যেই সেরিব্রাল অ্যাটাক হল অরুন্ধতীর। ডান দিকটা ‘প্যারালাইজড’ হয়ে গেল।
এই ভয়ঙ্কর সময়টা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তপন সিংহ একবার বলেছিলেন, ‘‘আমি বড় নিষ্ঠুর। বড় স্বার্থপর।... ওই অসুস্থ হবার পর থেকে আমাদের দু’জনকেই নিয়মিত ওষুধ খেতে হত। আমি একটা করে, অরুন্ধতী পাঁচটা করে ট্যাবলেট। রোজ সকালে ব্রেকফাস্টের টেবলে উনি আমার ট্যাবলেটটা সাজিয়ে রাখতেন। আমি কিন্তু কোনও দিন তিনি ওষুধপত্র খাচ্ছেন কিনা, অথবা শরীর কেমন আছে, তার খবর নিইনি।...আজ সে সব কথা ভাবি, আর বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে।’’
’৯০ সালে জীবনের সব মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। শ্যুটিং-এ ছিলেন তপনবাবু। খবর পেয়ে ফিরলেন। বিছানায় শোওয়ানো অরুন্ধতীর নিষ্পন্দ শরীর।
ঘরে ঢুকে এক বার শুধু ঠান্ডা কপালে হাত ছোঁয়ালেন মুহূর্তকালের জন্য। তার পর চলে গেলেন ঘরে ছেড়ে। আর আসেননি সেই ঘরে।