শান্তিনিকেতনের হিন্দি ভাষার শিক্ষক হিসেবে বলরাজ সাহনি ছাত্রদের নিয়ে বার্নাড শ-এর ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’ মঞ্চস্থ করতে চলেছেন। ১৯৩৭ সাল। নাটক করার আনন্দ ও উত্তেজনায় তাঁর খেয়ালই নেই যে, নাটক করার মতো কোনও অর্থই তাঁদের কারও কাছে নেই। অনেক খুঁজে পেতে মাত্র দশটা টাকা জোগাড় হল। কিন্তু তা দিয়ে এত বড় একটা নাটকের মঞ্চসজ্জা, পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র কিছুই তো হবে না!
মধ্যপ্রদেশের টিকমগড়ের মহারাজা দ্বিতীয় বীর সিংহ তখন শান্তিনিকেতনে রয়েছেন। তাঁর কাছে হাজির হলেন বলরাজ চাঁদা বা অনুদান পাওয়ার আশায়। সব শুনে খুশি মনে মহারাজা বলরাজের হাতে একশো টাকা তুলে দিলেন। আশ্রমে ফিরে নাটকের তোড়জোড় শুরু করতেই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তলব এল, ‘এভাবে আশ্রমের কোনও অতিথির কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নেওয়া নীতিবিরুদ্ধ। এখনই টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে’। শত অনুরোধেও কাজ হল না। বলরাজ টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। হাতে মাত্র দু’দিন সময়। সে দিনই বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হতাশ বলরাজ দেখেন নন্দলাল বসু তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর নিজের কথায়, “অবাক হয়ে দেখলাম মাস্টারমশাই আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে একান্তে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি শুনলাম তুমি নাটক বাতিল করেছ, তোমার কি মনে হয় ঠিক কাজ করেছ?’ ”
বলরাজের উত্তর, “হ্যাঁ, আর উপায় কী?” নন্দলাল বললেন, “এমন কথা এখানে আগে কখনও কেউ শোনেনি। তুমি আমার সঙ্গে কলাভবনে এসো আর তোমার কী কী চাই লিখে দাও।”
বলরাজ ভেবেছিলেন নন্দলাল বোধহয় তাঁর সঙ্গে মশকরা করছেন। কলাভবনে গিয়ে তাঁর প্রয়োজনের তালিকা দিয়ে এলেন। নন্দলাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলেন। সার্বিয়ার সামরিক বাহিনীর পোশাক ও হেলমেট কেমন ছিল থেকে শুরু করে নানা প্রসঙ্গ। নন্দলাল তাঁকে দু’দিন পর দেখা করতে বললেন। তার পরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা! কলাভবনসহ গোটা শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীর দল নন্দলালের নেতৃত্বে দিন-রাত এক করে নেমে পড়ল নাটকের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে। নির্দিষ্ট দিনে নাটক মঞ্চস্থ হল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সামনের সারিতে বসে পুরো নাটক দেখলেন এবং প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। নাটকের শেষে বলরাজকে বলেছিলেন নন্দলাল, “মনে রেখো, যে কোনও লোক টাকা থাকলে নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে। কিন্তু শিল্পী সে-ই, যে মাত্র দশ টাকা খরচ করে সেই নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে।”
বলা যায়, অভিনেতা, শিল্পী বলরাজ সাহনির জন্ম হয়েছিল সে দিন।
বলরাজ সাহনির জন্ম ১৯১৩ সালের ১ মে রাওয়ালপিন্ডি শহরে। তাঁর বাবা হরবংশলাল সাহনি ও মা লক্ষ্মীদেবী। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় যুধিষ্ঠির, যা পঞ্জাবি জিভে উচ্চারিত হত ‘যুধিস্থার’। তাঁদের এক পিসি সেই উচ্চারণকে ক্রমে বদলে ফেলেন ‘রেজিস্টার’-এ। ফলে নতুন নামের দরকার হল, যা সহজে উচ্চারণ করা যায়। সেই নাম হল ‘বলরাজ’। আর্যসমাজী হরবংশলালের সংসারে পর পর পাঁচকন্যার জন্ম হলেও শৈশবেই তিন কন্যা মারা যায়। অবশেষে প্রথম পুত্র বলরাজের জন্ম। বাড়িতে প্রথম পুত্রসন্তানের আগমনের খবরে হরবংশলাল আনন্দে এতই আত্মহারা হয়ে পড়েন যে, বাজার থেকে ব্যান্ড পার্টি এনে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। তারাও তারস্বরে সেই ব্যান্ডের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। পাড়ার লোকের কান ঝালাপালা হয়ে যায় আর সেই বাজনার তীব্রতায় সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়া মা অজ্ঞান হয়ে যান। ফলে পৃথিবীতে বলরাজ বেশ সশব্দ এসেছিলেন। যদিও ছোটবেলায় তিনি ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। মুখ বুজে বাবা-মায়ের আদেশ মেনে চলাতেই স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। বলরাজকে আদর্শ আর্যসমাজী বানাতে চেয়েছিলেন হরবংশলাল। প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তুলতে তাঁকে ‘গুরুকুল’ বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে বলরাজ তাঁরই মতো একজন আমদানি-রফতানির কারবারি হয়ে তাঁর ব্যবসার হাল ধরবে।
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ছোট্ট রাওয়ালপিন্ডি শহরে স্ত্রী লক্ষ্মী, দুই কন্যা বেদবতী ও সাবিত্রী এবং দুই পুত্র বলরাজ, ভীষ্মকে (নাট্যকার) নিয়ে ধর্মপ্রাণ হরবংশলালের মধ্যবিত্ত পঞ্জাবি পরিবার অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বাঁধা থাকত পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবন। মেয়েদের বাড়ির বারান্দায় পর্যন্ত দাঁড়ানোর অধিকার ছিল না, পাছে পথচলতি কোনও পথিকের গাওয়া প্রেমসঙ্গীত তাঁদের কানে পৌঁছে যায়! বলরাজ ও ভীষ্মকেও কড়া নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছিল। কৈশোরে বলরাজকে ব্রহ্মচারীর জীবনযাপন করতে হত। তিনি তাঁর দীর্ঘ সুগঠিত শরীর, মুণ্ডিত মস্তক, উপবীত, হাতে লাঠি নিয়ে ব্রহ্মচারীর বেশে ভিক্ষাপাত্র হাতে শহরের রাস্তায় ঘুরে যখন ভিক্ষান্ন জোগাড় করতে বেরোতেন, তাঁকে দেখে মনে হত যেন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
এর পর হঠাৎই একদিন বলরাজ মত ও মন বদলে ফেললেন। শহরের ডি এ ভি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আচার আচরণ, স্বাধীনতা, ইংরেজ যুবকদের রীতি রেওয়াজ বালক বলরাজের মনে ছাপ ফেলেছিল। তিনি একদিন পিতা হরবংশলালের সামনে দাঁড়িয়ে সোজা ভাষায় জানিয়ে দিলেন পরের দিন থেকে আর আর্য সমাজের গুরুকুল বিদ্যালয়ে পড়তে যাবেন না। তিনি চান শহরে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর যোগ্য শিষ্য মহাত্মা হংসরাজ প্রতিষ্ঠিত ‘দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক’ (ডি এ ভি) শিক্ষা পদ্ধতি মেনে তৈরি বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। সেখানে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবেন। ফলে বলরাজের রাওয়ালপিন্ডির ডি এ ভি স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয় আর এখানেই তিনি দেখা পান তাঁর জীবনের প্রথম মেন্টর শিক্ষক যশবন্ত রাইয়ের।
বলরাজের কলেজ জীবন কেটেছিল লাহৌর শহরে। হরবংশলাল চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে ‘হেইলি কলেজ অব কমার্স’-এ ভর্তি হোক। বলরাজ বাবাকে নানা ভাবে বুঝিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন গভর্নমেন্ট কলেজে। এখান থেকেই পরবর্তী চার বছরে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেন তিনি। সেখানকার শিক্ষকদের মধ্যে এরিক ডিকিনসন্স ও লংহর্ন তাঁর সাহিত্যবোধকে গড়ে দিয়েছিলেন। বলরাজকে হতবাক করে দিয়েছিল যখন একদিন ক্লাসে শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ পড়াতে পড়াতে ডিকিনসন্স বলে উঠেছিলেন, “এবার শোনো, স্ট্র্যাটফোর্ডের অ্যাভন নদীর তীরের গেঁয়ো ভূতটা কী বলছেন!”
রাওয়ালপিন্ডি ছাড়া বলরাজের জীবনে কাশ্মীরের ভূমিকা ছিল অনেকখানি। কাশ্মীর ছিল তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। লাহৌরের গভর্নমেন্ট কলেজ বলরাজকে পাশ্চাত্য নাট্যকলার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল। সেখানে অভিনয় খুব বেশি না করলেও নাটকের আয়োজনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকতেন তিনি। কলেজের ড্রামাটিক ক্লাবের পুরোধা ছিলেন পরবর্তীকালের দুই প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক আহমেদ শাহ বুখারি ও গুরু দত্ত সোন্ধি। এঁদের সাহচর্য বলরাজকে পরবর্তীকালে নাটক ও চলচ্চিত্র জগতে একজন সফল অভিনেতা হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু ১৯৩৩ সাল নাগাদ যখন বলরাজ কলেজের শেষ বছরের ছাত্র, দেখা গেল তিনি কলেজের পাশ্চাত্যঘেঁষা রীতিনীতির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছেন। আসলে নিজে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলেও নিজের পরাধীন দেশ ও তার নিপীড়িত মানুষদের কথা তিনি ভুলতে পারছেন না। তাঁর কাছে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ফাঁপা বলে মনে হতে শুরু করে। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে প্রচলনবিরোধী (নন-কনফর্মিস্ট) প্রবণতার জন্ম হতে শুরু করে। ১৯৩৪ সালে কলেজ জীবন শেষ করে বলরাজ রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে আসেন। এর পর কীভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন। চাইলে তিনি সরকারি চাকরি করতেই পারতেন। কিন্তু সে দিকে যাননি আদর্শগত কারণে। কোথায় তাঁর উপযুক্ত স্থান তার নিরন্তর সন্ধান তখন চলেছে তাঁর মনের মধ্যে। এই অবস্থাতেই তাঁর বিয়ে হয় যশবন্ত রাইয়ের ছোট বোন দময়ন্তীর সঙ্গে। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি এই মেয়েটিকে সবাই আদর করে ‘দাম্মো’ বলে ডাকত। বলরাজের জীবনে দময়ন্তীর অবদান ছিল অনেকখানি। নিজে যেমন একজন ক্ষমতাবান অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন তেমনই বলরাজের দিশাহীন জীবনে ভরসার জায়গা ছিলেন তিনি।
শেষে একদিন অস্থির বলরাজ পরিবারের সকলকে চমকে দিয়ে দময়ন্তীকে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন। এই নিরুদ্দেশ যাত্রাই বলরাজের জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমে তাঁরা পৌঁছন লাহৌরে। সেখানে কিছুদিন গল্প লিখে বা একটি খবরের কাগজ প্রকাশ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে তিনি এসে পৌঁছন কলকাতায়। তাঁর এক সহপাঠীর দাদা এস এইচ বাৎস্যায়নের বাড়িতে প্রথমে থাকতে শুরু করেন। কলকাতা তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের পীঠস্থান। নিউ থিয়েটার্স, প্রমথেশ বড়ুয়া, পৃথ্বীরাজ ও রাজ কপূর তখন কলকাতারই বাসিন্দা। এঁদের সঙ্গে দেখা করে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ চেয়েছিলেন বলরাজ। কিন্তু বলরাজকে আমল না দিলেও সুন্দরী দময়ন্তীকে অভিনয়ের সুযোগ দেবেন বলে চিঠি দিয়েছিলেন প্রমথেশ। এই কলকাতায় বসেই হাজারি প্রসাদ দ্বিবেদীর সুপারিশে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকের চাকরির খবর পেয়ে দময়ন্তীকে নিয়ে ১৯৩৭ সালের এক শীতের সন্ধেয় বলরাজ শান্তিনিকেতনে পৌঁছন। সেখানে তখন পণ্ডিত দ্বিবেদীর নেতৃত্বে হিন্দি ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছিল। ক্ষিতিমোহন সেন, বনারসীদাস চতুর্বেদী এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই উদ্যোগে শামিল ছিলেন। প্রথম দিন ভোরে বলরাজ ও দময়ন্তীর ঘুম ভাঙে গানের শব্দে। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণরত ছাত্র-শিক্ষকদের বৈতালিক প্রত্যক্ষ করেন এবং অবাক হয়ে যান। এমন একটি জায়গা যে এই ভূ-ভারতে থাকতে পারে কোনও ধারণাই ছিল না তাঁদের। তাঁরা দেখেন এখানকার পথেঘাটে ইংরেজদের চিহ্নমাত্র নেই। মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে পাশ্চাত্য রীতি রেওয়াজের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই। এখানে জীবন আবর্তিত হয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। এমন জায়গাকে ভাল না বেসে তাঁরা পারেননি। দময়ন্তী বিশ্বভারতীতে ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। বলরাজ বাংলা শিখতে শুরু করেন। বলরাজ জানিয়েছেন, বাংলায় গোটা রবীন্দ্রনাথ তিনি পড়েছেন। বাংলা বলতেও পারতেন সহজেই। দু’জনের আনন্দে ভরা সেই দিনগুলির কথা বলরাজ লিখে গিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। ক্ষিতিমোহন, নন্দলাল, হাজারি প্রসাদ, হরিচরণ, ক্ষিতীশ রায়দের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনাও তিনি করতেন। এমনই এক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ জানতে পারেন বলরাজ মাতৃভাষা ছেড়ে হিন্দিতে গল্প-কবিতা লেখেন। রবীন্দ্রনাথ পরামর্শ দিয়েছিলেন বলরাজকে নিজের মাতৃভাষা পঞ্জাবিতে লিখতে। কারণ, “একজন রক্ষিতা সে যতই সুন্দর হোক, কখনও স্ত্রীর ভূমিকা নিতে পারে না।” বলরাজ এর পর ক্রমশ নিজের ভাষায় লেখালিখি শুরু করেন।
শান্তিনিকেতনে এক বছর কাটিয়ে বলরাজ চলে গিয়েছিলেন গান্ধীজির সেবাগ্রামে। সেখানকার একটি পত্রিকার কর্মী হিসেবে চাকরি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের পর গান্ধীর সাহচর্য বলরাজকে ঋদ্ধ করেছিল। সেই সময়ে সারাদেশে শান্তিনিকেতন ও সেবাগ্রামের বিশেষ পরিচিতি ছিল। একটি ভারতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র এবং অন্যটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রভূমি। সেবাগ্রামে কর্মরত অবস্থায় বলরাজ লন্ডনের বিবিসিতে কাজ করার সুযোগ পান। কয়েক মাসের শিশু পরীক্ষিৎকে মায়ের কাছে রেখে বলরাজ ও দময়ন্তী লন্ডন রওনা হন ১৯৪০ সালে। খাদি ছেড়ে সাহেবি পোশাক গায়ে লন্ডনে চাকরি নেওয়াকে মেনে নিতে পারেননি তাঁর ভাই ভীষ্ম। তবে বলরাজের এই চাকরি গান্ধীর কারণেই হয়েছিল সেটা তিনি জানতেন।
বলরাজ ও দময়ন্তী যে দিন লন্ডনে পৌঁছন সে দিনই প্রথম বার হিটলারের যুদ্ধ বিমান লন্ডন শহরে বোমা ফেলে। বিবিসি-তে কাজ করতে গিয়ে বলরাজ ও দময়ন্তী একদিকে যেমন দক্ষ রেডিয়ো প্রযোজক হয়ে ওঠেন, তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন হয়ে ওঠেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ভয়াবহ আগ্রাসন রুখতে মিত্র শক্তির মরণপণ লড়াই ও শেষকালে রাশিয়ার লালফৌজের সাফল্য ইত্যাদি ঘটনা বলরাজ ও দময়ন্তীর মনে গভীর ছাপ ফেলে। দু’জনেই মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ও কার্ল মার্ক্সের লেখা পড়তে শুরু করেন। তঁদের দ্বিতীয় সন্তান শবনমের জন্ম হয় লন্ডনে।
লন্ডন বলরাজকে আমূল বদলে দিয়েছিল। তিনি তখন মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী একজন কর্মী। তাঁর লক্ষ্য আর আগের মতো দিশাহীন নয়। ভাই ভীষ্ম সাহনি লক্ষ করেছিলেন চেতন আনন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দময়ন্তী পাঁচ বছরের পরীক্ষিৎ এবং ন’ মাসের শবনমকে নিয়ে চলে আসেন মুম্বই শহরে। চেতন আনন্দের ‘নীচা নগর’ ছবিতে কাজ করতে। যদিও অর্থাভাবে চেতন আনন্দ সে ছবি তখন করতে পারেননি। ফলে বলরাজকে হিন্দি সিনেমার জগতে নতুন করে অভিনয়ের চেষ্টা শুরু করতে হয়। আর ঠিক এই সময়েই কাকতালীয় ভাবে তাঁর দেখা হয় খাজা আহমেদ আব্বাসের সঙ্গে একটি নাটক পাঠের আসরে। আহমেদ তাঁর লেখা ‘জুবেইদা’ নাটক পাঠ শেষ করার পর বলরাজকে অবাক করে দিয়ে নাটকটির পরিচালনার ভার নিতে অনুরোধ করেন। বলরাজ বাধ্য হয়ে সে দায়িত্ব নেন। আর এরই ফলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে ‘ইন্ডিয়ান পিপলস্ থিয়েটার’ গ্রুপের মুম্বই শাখার সঙ্গে।
এ দিকে অনেক চেষ্টা করেও চেতন আনন্দ তাঁর ‘নীচা নগর’ ছবির অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। অবশেষে যখন পারলেন তখন প্রযোজক নিজেই নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার শর্ত দেওয়ায়, বলরাজের আর সেই ছবিতে অভিনয় করা হয়নি। দময়ন্তীও সরে এসেছিলেন। অথচ এই ছবিতে অভিনয় করবেন বলেই দময়ন্তী ও বলরাজের ভারতের চলচ্চিত্র দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বলরাজের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা ঘটে কে এ আব্বাসের ‘ধরতী কে লাল’ ছবির পর। ছবিটি বক্স অফিসে সফল না হলেও গুণিজনের প্রশংসা পেয়েছিল এবং সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও বুঝেছিল বলরাজ একজন ক্ষমতাবান অভিনেতা।
কিন্তু আকস্মিক ভাবে ১৯৪৭ সালের ২৯ এপ্রিল দময়ন্তীর মৃত্যু ঘটে মাত্র ২৮ বছর বয়সে। ‘ধরতী কে লাল’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে গ্রামের পুকুর থেকে জল খেয়ে তাঁর ডিসেন্ট্রি হয়। স্থানীয় একজন ডাক্তারের অতিরিক্ত ডোজ়ের ইঞ্জেকশন দেওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। গণনাট্য সঙ্ঘের নিজস্ব সার্থক প্রযোজনা, খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘ধরতী কে লাল’, ইবসেনের ‘ডলস্ হাউস’ অবলম্বনে আর পাণ্ডে এবং অচ্যুৎ গোবিন্দ রানাডের ‘গুড়িয়া’ ছবি দু’টিতে অভিনয় করে দময়ন্তী আজও অমর হয়ে আছেন।
দময়ন্তীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে ভারত ভাগ হয়ে যায়। বলরাজ ও দময়ন্তীর পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসে। বলরাজের লেখায় আছে, “আমি ও দময়ন্তী মিলে যে তাসের ঘর বানিয়ে ছিলাম তা ভেঙে পড়ল।” ১৯৪৯ সালে বলরাজ তাঁর তুতো বোন সন্তোষকে বিয়ে করেন।
একা বলরাজ এর পর আর্থিক দৈন্য ও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য হন্যে হয়ে মুম্বইয়ের স্টুডিয়োগুলিতে ঘুরতে থাকেন কাজ পাওয়ার জন্য। এই সময়ে বলরাজ তৎকালীন দিকপাল পরিচালকদের দরজায়-দরজায় ঘুরেছেন। ভি শান্তারাম থেকে ফণী মজুমদার সকলের প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা রেখে দিন গুনেছেন। তাঁর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়েছে।
শেষকালে ফণী মজুমদার তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি বলরাজকে তাঁর ‘জাস্টিস’ ও ‘দূর চলে’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন। কিন্তু তিনি তেমন ভাবে নিজের জায়গা করে নিতে পারছিলেন না মুম্বই চলচ্চিত্র জগতে। চলচ্চিত্রের চড়া মেকআপ নিয়ে, তীব্র আলো, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই তিনি যেন আর নড়তে পারতেন না। তাঁর মনে হত কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে অভিনয় করতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়ত তাঁর অভিনয়ে। শুটিং ফ্লোরে দাঁড়িয়ে পরিচালকদের বকুনি খেতে হত। এমনকি সেকালের অভিনেত্রীরা বলরাজের সঙ্গে অভিনয় পর্যন্ত করতে চাইতেন না।
‘হলচল’ ছবির শুটিংয়ের সময়, একদিন বাড়ি ফিরে হতাশ বলরাজ বাড়ির দেওয়ালে এমন ভাবে মাথা ঠুকতে শুরু করেন যে, সকলে ভয় পেয়ে যায়। তাঁকে কেউ থামাতে পারছিল না। এমনই এক সময়ে বলরাজের বাড়িতে হাজির হন ‘হলচল’ ছবির সহকারী পরিচালক নাগারত ও সেই দৃশ্য দেখে চমকে ওঠেন। হঠাৎ তিনি মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বয়োজ্যেষ্ঠ বলরাজকে এমন ধমক দেন যে, বলরাজের হুঁশ ফেরে। বলরাজকে তখন নাগারত বলেন, “কে বলেছে আপনি অভিনয় করতে পারেন না? আপনি তারকা অভিনেতাদের জীবনযাপনের দিকে না তাকিয়ে নিজের অভিনয়ের দিকে নজর দিন। দেখবেন আপনি ওদের চেয়েও ভাল অভিনয় করতে পারবেন। চেষ্টা করে দেখুন।” নাগারতের কথায় বলরাজের ভুল ভাঙে। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কোথায় ভুল হচ্ছে। যেন একটা দিশা পান তিনি।
বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির ‘শম্ভু মাহাতো’ চরিত্রে বলরাজ সাহনি আজও অমর হয়ে আছেন। এ ছাড়া আরও অনেক চরিত্রের কথাই হয়তো মনে পড়বে যা তাঁর ভক্তদের কাছে প্রিয়। ভীষ্ম সাহনির মতে, বলরাজ প্রায় ১৩৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে ১০৫টি ছবির খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে দু’টি ইংরেজি ও একটি করে অসমিয়া, পঞ্জাবি ও ঊর্দু ছবিও আছে।
‘দো বিঘা জমিন’ ছবির সাফল্যর পর রামানন্দ সাগরের কাছ থেকে ডাক আসে ‘বাজুবন্দ’ ছবিতে কাজ করার জন্য। তাঁর তখন বয়স একচল্লিশ। মুম্বই আসার দশ বছর পরে বলরাজ অবশেষে সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন। তাঁর মুম্বই জীবনের শুরুতে ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৪র মধ্যে দশটির মতো ছবিতে কাজ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী উনিশ বছরে তিনি একশো কুড়িটির কাছাকাছি ছবিতে কাজ করেন বলে জানিয়েছেন ভীষ্ম সাহনি, যার মধ্যে ‘অওলাদ’, ‘টকসাল’, ‘আকাশ’, ‘রাহী’র মতো সফল ছবিও আছে। বলরাজের এই সাফল্য তাঁকে যেমন স্বস্তি দিয়েছিল, তেমনই তাঁর বাবাও সবার অলক্ষ্যে গর্বিত পিতা হিসেবে নিজের ডায়রিতে বলরাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন খবরের কাটিং আটকে রাখতে শুরু করেন। বলরাজের প্রশংসাতখন সারা দেশের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছিল। তাঁরমুম্বইয়ের বাড়িতে গেলে সাজিয়েরাখা বিভিন্ন পুরস্কারের স্মারকগুলি দেখলে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। ১৯৬৯ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
বলরাজ সাহনি মনে করতেন সাহিত্যের মতোই চলচ্চিত্রও সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিশে থাকবে। অভিনয় জীবনের প্রান্তবেলায় তিনি মন দিয়েছিলেন সাহিত্য সাধনায়।আর খুঁজেছিলেন এমন এক স্থান যেখানে তিনি পাবেন তাঁর মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। ভাইকে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন, “আমরাদু’জনে কাশ্মীরে একটা শান্তিনিকেতন বানিয়ে বাকি জীবন কাটাব।” কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবির নির্মাণকালে ১৩ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।a