গর্ভসঞ্চার ও প্রেগন্যান্সির প্রস্তুতির আগে এক্সারসাইজের নিশ্চিত সুপারিশ করা হয়। তবে ঘন ঘন এবং প্রচুর এক্সারসাইজে হরমোন, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল, এমনকী আপনার সুরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি হতে পারে। পর পর দু’বার মিসক্যারেজ বা গর্ভচ্যুতি হয়ে থাকলে কিংবা আই ভি এফ চিকিৎসা চলাকালীন কতটা এবং কখন এক্সারসাইজ করা উচিত সে বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভাল। অন্যথায় এক্সারসাইজে কোনও আপত্তি নেই। ওভ্যুলেশনের সময়ে কিংবা আপনার মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের শেষ দু’সপ্তাহে যখন ভ্রূণের ইমপ্লান্টেড হওয়ার প্রাথমিক দশায় থাকার সম্ভাবনা থাকে তখন এক্সারসাইজ খুব ভাল। মহিলারা যদি কিছু এক্সারসাইজে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তবে তার মাত্রা এ সময় কমানো উচিত এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা বাড়াতে যে সব এক্সারসাইজ সাহায্য করে তার ভাল-মন্দ বলে কিছু হয় না। আমি সব সময়ে রোগীদের বলি একঘেয়েমি এড়াতে নানা রকমের এক্সারসাইজ করতে পারেন। এক্সারসাইজ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পেশি ব্যবহার করে আলাদা ধরনের উপকার পাওয়া যায়। এক্সারসাইজকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়—অ্যারোবিক ও অ্যানারোবিক। সর্বাধিক উপকারিতা পেতে দু’ধরনের এক্সারসাইজ করাই ভাল। অ্যারোবিক কথাটির অর্থ ‘অক্সিজেনের সাহায্যে’। যে ধরনের এক্সারসাইজে বৃহত্তর পেশিগুচ্ছ ও ফুসফুস কাজ করে এবং হৃৎস্পন্দনের হার বাড়ে তাদের অ্যারোবিক এক্সারসাইজ বলে। মাঝারি গতিতে এই ধরনের এক্সারসাইজ দীর্ঘ সময় ধরে করা দরকার। আদর্শ অ্যারোবিক এক্সারসাইজের উদাহরণ ওয়াকিং, রানিং, সাইক্লিং ও সুইমিং।
‘অক্সিজেনের সাহায্য না নিয়ে’ যে এক্সারসাইজ তাকে অ্যানারোবিক এক্সারসাইজ বলে। সাধারণত সংক্ষিপ্ত ও শক্তিনির্ভর অ্যাক্টিভিটি এ ধরনের এক্সারসাইজের অন্তর্গত। এ ক্ষেত্রে পেশিকে কম সময়ের জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে হয়ে। স্কিপিং, ভারোত্তলন, লাফানো এই এক্সারসাইজের উদাহরণ। টেনিস, ব্যাডমিন্টন, স্কি, ফুটবলের মতো বেশ কিছু খেলায় দু’ধরনের এক্সারসাইজের মিশ্রণ রয়েছে। শক্তি বাড়াতে, ঠিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে ও টেনশন মুক্ত হতে যোগব্যায়ামের জুড়ি মেলা ভার। নিয়মিত এক্সারসাইজে অভ্যস্ত না হলে হঠাৎ করে সাঁতার, জোরে হাঁটা বা সাইক্লিং-এর মতো এক্সারসাইজ দিয়ে শুরু করুন। প্রেগন্যান্সিতে সচেষ্ট হোন বা না হোন, আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য এক্সারসাইজ উপকারী। আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া মানে, গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও ভাল থাকা। এক্সারসাইজ কী ভাবে শরীরের উপকার করে তা নীচে জানানো হল।
এন্ডোমর্ফিন উৎপাদন করে আ্যারোবিক এক্সারসাইজ করলে পিটুইটারি গ্রন্থি ‘মন ভাল করা’ জৈব রাসায়নিক বস্তু এন্ডোমর্ফিন উৎপাদন করতে শুরু করে। এন্ডোমর্ফিন ব্যথা কমায় ও ভাল লাগার অনুভূতি আনে বলে এদের শরীরে ‘ন্যাচারাল পেইন কিলার’ বলা হয়। নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে সারাদিন নিজেকে তরতাজা ও আশাবাদী মনে হবে। এমনকী এক্সারসাইজ শুরুর আগে ক্লান্ত ও অবসন্ন বোধ করলেও এর অন্যথা হবে না। এক্সারসাইজ প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াবে কারণ আপনি বেশি বার মিলনে উৎসাহ পাবেন।
স্ট্রেস কমায়—এক্সারসাইজের পরে রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যখন এন্ডোমর্ফিন দ্রুত হারে ছুটে বেড়ায় তখন তারা স্ট্রেস বা মানসিক উদ্বেগের মাত্রা কমিয়ে উৎফুল্লতার অনুভূতি আনে। এই অনুভূতি বলতে গেলে প্রায় সারা দিন ধরেই থাকে। নিয়মিত এক্সারসাইজে তাই স্ট্রেস স্থায়ী ভাবে অন্তর্নিহিত হয়। বলা বাহুল্য, গোটা ব্যাপারটি গর্ভসঞ্চারের পক্ষে উপকারী।
পরিপাকে সাহায্য করে— এক্সারসাইজ করলে কনস্টিপেশন, গ্যাসের সমস্যা ও দুর্বল হজমশক্তির মতো পরিপাকজনিত সমস্যার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। এই ধরনের সমস্যায় অন্ত্র ও ইন্টেস্টাইন শ্লথগতি সম্পন্ন হয়ে থাকে। এক্সারসাইজ এই সমস্যা দূর করে খাদ্যকে তাড়াতাড়ি চালিত করলে মনে প্রশান্তি আসবে, বুক জ্বালা ও বদহজমের সমস্যা থাকবে না। তবে একেবারে খাওয়ার পরে এক্সারসাইজ করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ, পরিপাকের সময় পাকস্থলীর আশেপাশে রক্তপ্রবাহ কেন্দ্রীভূত হয়। এক্সারসাইজ এই পদ্ধতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে—শারীরিক কসরত বা ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিতে প্যানক্রিয়াস নিঃসৃত ইনসুলিন বেশি কার্যকর হয়। তাই এ সময় ব্লাড সুগারে সুস্থিতি আসে। এ ছাড়া নিয়মিত এক্সারসাইজে কোষের ইনসুলিন গ্রহীতা বা রিসেপটারের সংখ্যাও বাড়ে। এই সব রিসেপটারের সঙ্গে ইনসুলিন এমন ভাবে যুক্ত হয় যাতে রক্তের মধ্যে থাকা সুগার শরীরের অন্যান্য কোষে যেতে পারে। বেশি রিসেপটার থাকার অর্থ ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়া। ফলে কম ইনসুলিনেই কাজ চলে যায়।
অবশ্য এক্সারসাইজের সময় যে অ্যাড্রিনালিন নিঃসৃত হয়, তা পেশি ও লিভারে গ্লাইকোজেন রূপে মজুত থাকা সুগারের মুক্তি ঘটিয়ে সাময়িক ভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে। তবে এই বৃদ্ধি মিষ্টি জাতীয় খাদ্য খেয়ে বৃদ্ধি পাওয়া ব্লাড সুগার মাত্রার চেয়ে আলাদা, কারণ এই ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সুগার মাত্রার পুনর্বিন্যাস চলতে থাকে।
রক্ত সংবহনের পক্ষে ভাল—এক্সারসাইজ ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য মাসল-সহ হার্টের পেশিরও উন্নতি করে। ফলে সারা শরীরে ভালভাবে রক্ত প্রবাহিত হয়। এবং শরীরের মৃত কোষ ও বর্জ্য পদার্থ সহজেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। ওজন নিয়ন্ত্রণে ভাল কাজ করে—অ্যারোবিক বা অ্যানারোবিক দু’ধরনের এক্সারসাইজেই পেশির প্রয়োজন। এতে হৃদস্পন্দনও বাড়ে। এতে ক্যালোরি পুড়ে যায় বলে ওজন নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে ডায়েট-এর ঝামেলা এড়ানো যায়।
কতটা এক্সারসাইজ আদর্শ — আইডিয়ালি সপ্তাহে তিন দিন ৩০ মিনিট আ্যারোবিক এক্সারসাইজ এবং সপ্তাহে দু’দিন জিমে গিয়ে কিছু রেজিস্ট্যান্স এক্সারসাইজ করা উচিত। অনেকের ক্ষেত্রেই হয়তো এই নিয়ম মেনে চলা সম্ভব না। তবে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ২০ মিনিট করে যে কোনও ধরনের এক্সারসাইজ করলেও ফিটনেস ও স্ট্যামিনার মাত্রা বাড়ে। তবে এক্সারসাইডের পরিমাণ মাঝারি মাপের হওয়া উচিত। এমন এক্সারসাইজ বা কাজ করুন যেটা করতে আপনার ভাল লাগে। যেমন আধুনিক নাচের ক্লাস, জিম, সাইকেল চালানো ইত্যাদি। আসলে যে কাজটা করতে ভাল লাগে সেটাই অনেক দিন ধরে করা সম্ভব।