আবহমান: জয়শ্রী বর্মনের চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী ‘আর্ট অফ ফেথ’
গত দশ-বারো বছর ধরে গঙ্গা নিয়ে কাজ করছেন জয়শ্রী বর্মন। গঙ্গার ঐতিহাসিক গুরুত্বই শুধু নয়, ঐতিহ্য থেকে শুরু করে এক বিরাট অধ্যায় জুড়ে আছে অজস্র কাহিনি, যা ভারতীয় সভ্যতা-শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাঁর ছবি প্রধানত দেবদেবীকেন্দ্রিক গঙ্গা।
‘রিভার অব ফেথ’ নামে তাঁর আশির অধিক ড্রয়িং ও পেন্টিং নিয়ে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল কলকাতার গ্যালারি আর্ট এক্সপোজ়ার। সাদাকালো ড্রয়িং থেকে রঙিন কাজ।
গঙ্গা-সম্বলিত তাঁর চিত্রে জয়শ্রী পুরাণ, দেবদেবী, পশুপাখি, ফুল, লতাপাতা কেন্দ্রিক এক আলঙ্কারিক অনুপুঙ্খময় বিন্যাসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বর্ণোচ্ছ্বাসের বাহুল্যহীন অধ্যায়, বরং ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল কিন্তু অপেক্ষাকৃত চাপা বর্ণের সমাহার হয়তো কিছু ক্ষেত্রে চোখের আরাম, কিন্তু সামগ্রিক রচনাবিন্যাসে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। দেবদেবীপ্রধান ছবির নানাপ্রকার। ক্যালেন্ডার সদৃশ চিত্র থেকে সিরিয়াস পেন্টিং। এর মধ্যবর্তী জায়গাটি ধূসর ও বালখিল্যময়। তার অবতারণা এখানে অবান্তর। জয়শ্রীর চিত্র সব ক্ষেত্রে সচিত্রকরণের মতো নয়, কিছু কিছু ছাড়া। তিনি পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেছেন খুব ধরে ধরে। বরাবর তাঁর এই স্টাইল ও টেকনিক তাই কিছু প্রশ্ন তুলে দেয়। অতি কাব্যিক রেখাঙ্কন ও বহু রূপের ব্যবহার ছবিগুলিকে নানা রূপক হিসেবেও প্রতিভাত করে। এইসব প্রতীকী বিন্যাস ও তাৎপর্য ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্মীয় পটভূমিকা, নিয়ম মানা এক ধরনের আঙ্গিকের কথা বলে। অর্বুদ ভারতীয় শিল্পকলার শৈলী নির্মাণে যাকে চিত্রকর ও ভাস্কররা মেনে এসেছেন বহু ক্ষেত্রে। এইসব ক্ষেত্রে আবার আধুনিকতারও উত্তরণ ঘটিয়েছেন বহু শিল্পী। যাঁরা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই বোধ থেকে সৃষ্টি করেছেন অজস্র কাজ। যেখানে পুরাণ বা নিয়মের অবান্তর ভাবনা বা প্রতীককে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাঁদের বিশ্বাস, শিল্প হবে প্রকৃত সত্য, যা আমার ভাবনার রং-রেখার রূপান্তর। প্রকারান্তরে তাঁরা ‘আর্ট ফর আর্ট’স সেক’ ও ‘আর্ট ফর লাইফ’স সেক’ দু’টিকেই ব্যাখ্যা করছেন, যে শিল্প আসলে দু’টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। জয়শ্রী চিত্রের দৃষ্টিনন্দন দিকটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
কম্পোজ়িশন অনুপুঙ্খ উপাদানের বন্টণ নয়। যা এমন এক সন্নিধি, যার মধ্যে দর্শকের দৃষ্টি ছবির ফ্রেমের মধ্যে কী ভাবে চালিত হবে, সে গতিপথের ইঙ্গিত আছে। আবেগ, মনস্তত্ত্বের সুনির্দিষ্ট ভাব, বস্তুপুঞ্জের সমাবেশে চিত্ররূপের অধিক কিছু প্রতীয়মান হয়ে ওঠা, সমস্ত উপাদানের সমন্বয় সুনির্দিষ্ট কল্পমূর্তিকে প্রতীত করে তুলবে। তাঁর কাজ দেখতে গিয়ে ধীমান দাশগুপ্তর এই ধরনের বর্ণনা মনে পড়ে। তাঁর কাজ প্রায় সব ক্ষেত্রেই পটভূমি-জোড়া। রূপ, রূপবন্ধ, ডিজ়াইন, নকশা, আলঙ্কারিকতায় পূর্ণ। প্রায় একই রকম মুখের আদল বিভিন্ন প্রতিমাকল্পের। ভঙ্গি যা-ই হোক না কেন। প্রায় সবই সামনের দিকে, দর্শকের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি। সামগ্রিক ভাবে একটা মোনোটোনি তৈরি হয়। পশুকে দেবত্ব দানের যে বিশিষ্ট ভারতীয় চিন্তা, তা ধরা পড়ে ভারত-শিল্পের আদিবিন্দু সিন্ধু-শিল্পে। মিশর-শিল্পেও তা প্রখর। জয়শ্রীর ছবি দেখতে দেখতে প্রয়াত নিখিল বিশ্বাসের ‘সিন্ধুর শিল্পকথা’ মনে পড়ছিল। জয়শ্রী ছবির বিভিন্ন স্থানে জল-স্থলের প্রাণীদের আধিক্য এনেছেন দেবীরূপের সঙ্গে একাত্ম করে।
তাঁর কাজে পুরাণ, লোকশিল্প, ভারত-শিল্পের ঐতিহ্যগত কিছু শৈল্পিক পরম্পরা, প্রতীক, আখ্যান, আধ্যাত্মবাদ, অবতার, মকর-বাহন, দেবদেবী, মৎস্য, পশুপাখি, পুষ্প-পত্র-পল্লবের সমাহার ইত্যাদি নানা আঙ্গিকের অর্থবহ চিন্তায় বিন্যস্ত। এখানে বিশ্বাস, বাস্তবতাও শৈল্পিক ভাবনায় রঞ্জিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘পদ্মা’, ‘যমুনা’, ‘গঙ্গা’, ‘অম্বা’, ‘পঞ্চকন্যা’, ‘গওহর’, ‘গোদাবরী’, ‘কৃষ্ণা’, ‘সরস্বতী’ ইত্যাদি। জলরং, পেন-ইঙ্কে করা।
স্বপন চক্রবর্তী ‘আর্কেটাইপ’-এর চমৎকার ব্যাখ্যা করেছিলেন। ফ্রাইয়ের মতে, ‘মিথ’ হল আচার-আকাঙ্ক্ষার শাব্দিক রূপ। রিচুয়ালকে তার অর্থ দেয় মিথ, আর স্বপ্নকে দেয় তার আখ্যান বা ন্যারেটিভ। জয়শ্রীর ছবিগুলির মধ্যে কোথাও এমন সব ধ্বনিরূপের সঙ্কেত প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি দীর্ঘকালের এই সুনির্দিষ্ট জার্নির মধ্যে একটা চরম ও নিপুণ সারাৎসারকে তাঁর মতো করেই সৃষ্টি করেছেন। ছবির অনেক রচনায় যেন মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের অজন্তার চিত্র, জন্তু-জানোয়ারের চিত্র-ব্যাখ্যায় রচনার কিছু জায়গা মিলে যায়। পশুপক্ষীর চিত্র কোনও কাহিনির মধ্যে নিবদ্ধ, তা নয়। লতাপাতা অলঙ্করণের মধ্যে মধ্যে তাদের চিত্র সুকৌশলে ব্যক্ত করা হয়েছে। লতাপাতার গতিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে তা মনোরম হয়েছে। যদিও কম্পোজ়িশন ও স্পেসকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে জয়শ্রী তা-ই করেছেন।
রং-রূপের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের মধ্যে তিনি লাইন, ফর্ম, স্পেসিফিক কালার-মোনোটোনির মধ্য দিয়েই যেন সৃষ্টি করেছেন ডিজ়াইন ও প্যাটার্ন। এখানে শিল্পী ন্যাচারাল ডিজ়াইন-প্যাটার্ন, নাকি ইমাজিনারি-আর্টিফিশিয়াল ভাবে তাকে ব্যবহার করেছেন, তার চেয়েও যা বড়, তা হল, সামগ্রিক ভাবে তাঁর ভাবনার প্রকৃত দ্বিমাত্রিক এই রঙিন চিত্রভাষ্যের মূল সুর কতটা অনুরণিত?এককথায় এ আখ্যানে গল্প আছে, কিন্তু গঙ্গার নিস্তরঙ্গ বা তরঙ্গময় উচ্ছ্বাস কোথায়?