ওজন যত তাড়াতাড়ি বাড়ে, খাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক কসরতে ঠিক তত তাড়াতাড়িই তা কমিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এক বার কমানো ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না অনেকেই। সমীক্ষা জানাচ্ছে, তন্বী ও সুস্থ থাকার জন্য যে মহিলারা কষ্ট করে ওজন কমান, তাঁদের মাত্র ২০ শতাংশ সেই ছিপছিপে শরীরটা ধরে রাখতে পারেন! তবে ওজন কমানোর পরেও একটু মেপে খাওয়াদাওয়া করলে আর ঘাম ঝরালেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
প্রথমে ওজন কমান
অতিভোজনই অতি ওজনের মোদ্দা কারণ। চার দিকে জাঙ্ক ফুডের হাতছানি, তার উপরে পাড়ায় পাড়ায় প্রতি উইকএন্ডে ফুড ফেস্টিভ্যালের ট্রেন্ড। সব মিলিয়ে খাওয়াদাওয়াটা কেমন নেশা হয়ে যাচ্ছে! ‘‘শরীরের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা অসুখেও ওজন বেড়ে যায়। যেমন থাইরয়েড, গ্যাসট্রাইটিস। অ্যানিমিয়াতেও শরীরে ফোলা ভাব আসে। বড় অসুখ বা অস্ত্রোপচারের পরেও ওজন বেড়ে যায়। অতিরিক্ত যত্নআত্তি, সেবা-শুশ্রূষা এর বড় কারণ। লো ফ্যাট, লো কার্ব ডায়েট আর ব্যায়ামের রুটিনেই এই বাড়তি মেদ কমানো যায়,’’ জানালেন পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী।
ফিটনেস বিশেষজ্ঞ চিন্ময় রায়ের পরামর্শ, ‘‘জোর বাড়ানোর ব্যায়াম করুন। এই এক্সারসাইজ়ে পেশি তন্তু বেশি তৈরি হবে। বিপাক হার (বিএমআর— বেসিক মেটাবলিজ়ম রেট) বাড়বে। ফলে ক্যালরি ঝরে ঝরঝরে থাকবেন।’’
মেনটেন করার কায়দা
পুষ্টিবিদ অর্পিতা দেব ঘোষ বলছেন, ‘‘ওজন কমলে সুখতৃপ্তি জুড়ে বসে। সেটাকে জয় করতে ওজন কমানোর মোটিভেশন বজায় রাখুন।’’ সুন্দর পোশাক পরা, সুস্থতা বা প্রেম— কোনও একটির তাড়নাতেই তো নিশ্চয়ই ওজন কমিয়েছিলেন? ভাজাভুজির প্লেটে হাত বাড়ানো বা ধপাস করে বসে পড়ার আগে সেই প্রেরণাকেই এক বার মনে করুন। এই মনস্তত্ত্বের হার নেই।
টানটান থাকার টিপস
• স্বাস্থ্যকর প্রাতরাশ মাস্ট। থাকবে ওটস, মিউজ়লি বা মুয়েসলি, ব্রাউন ব্রেড। চিঁড়ে, মুড়ি বা সুজিও বেছে নিতে পারেন। সঙ্গে ডিম কিংবা ছানা। আর মরসুমি ফল
• অফিসের বাইরে শুধু ক্যান্টনিজ় নুডলস আর চিকেন তন্দুরিই মেলে না। খোঁজ নিলে রুটি-তরকারি, ফলের রস, দই-চিঁড়েও পাবেন
• রাতে কম খান। কার্বোহাইড্রেটের বদলে প্রোটিন, আনাজ বেশি খান
• হালকা কিছু খেয়ে তবে নেমন্তন্ন বা পার্টিতে যান। ওভারইটিং হবে না
• গালের মেদ কমাতে বলুন ‘এক্স, ও’
• পেটের চর্বি কমাতে প্ল্যাঙ্ক (উপুড় হয়ে ৪-৫ সেকেন্ড হাতের ভরে শরীর ধরে রাখা), সাইডপ্ল্যাঙ্ক, ব্রিজ (শুয়ে পা ৯০ ডিগ্রি কোণে রাখুন। পায়ের পাতা মাটিতে রেখে পিঠটা তুলুন)। এ সবই কোর এক্সারসাইজ়। নিয়মিত করলে কোমরের মাপ নামবে ত্রিশ ইঞ্চির নীচে
শরীরের গড়ন আকর্ষক রাখতে হলেই যে জীবনের সব আকর্ষণ বাদ দিতে হবে, রোল-চাউমিন নৈব নৈব চ— ভুল ধারণা। ক্র্যাশ ডায়েটিংয়ে অসুস্থ দেখাবে। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, মিনারেল, ভিটামিন— প্রত্যেকটিরই নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। সবই খান, তবে অল্পস্বল্প। সুবর্ণা বললেন, ‘‘কাজের ধরন, শারীরিক গঠন, ওজন, বয়স, ফ্যাটের চাহিদা হিসেব করে ব্যালান্সড ডায়েট মেনে চলুন। এক্সচেঞ্জ লিস্ট করে খান। সব রকম প্রোটিনই খান, কিন্তু একসঙ্গে নয়। কার্বোহাইড্রেট খাবারের ক্ষেত্রেও তাই। এক দিন চিঁড়ে খেলে, পরের দিন মুড়ি।’’ আর বিরিয়ানি? ‘‘খাবেন, খাবেন,’’ হেসে ফেললেন সুবর্ণা। ‘‘তবে মেপে, হিসেব করে। ধরুন, ৬০ গ্রাম ভাত আর ১০০ গ্রাম চিকেন খাওয়ার কথা। খেয়াল রাখুন, বিরিয়ানিতে যেন ওই পরিমাণই চাল আর মাংস থাকে।’’ অর্পিতাও বলছেন, পাঁচ-ছ’দিন রুটিন মানার পরে এক দিন ডায়েট ভুললে ক্ষতি নেই। তবে এক্সারসাইজ় বাদ দেবেন না।
ওজন ধরে রাখতে কঠিন এক্সারসাইজ়?
অনেকেই মনে করেন, বেশিক্ষণ হাঁটলেই শরীর আর ভারী হবে না। কারণ, হাঁটা বেশ সহজ ব্যায়াম। চিন্ময় বললেন, ‘‘গদাইলশকরি চালে লম্বা সময় হাঁটলেও ওজন তেমন কমে না। হাঁটা থামালেই তো বিপাকের হার কমে যাবে! যাঁদের বয়স বাড়তির দিকে, হাঁটু-কোমরে ব্যথা-বেদনার ধাত, তাঁদের পক্ষে হাঁটা সব সময়ে সম্ভবও না। বরং বাড়িতেই জোর বাড়ানোর ব্যায়াম করুন। এতে কম সময়ে বেশি মেদ ঝরে। এই এক্সারসাইজ়ের পরে শরীর বিশ্রামে থাকলেও বিএমআর বেশিই থাকে। দোকান থেকে ‘রেজ়িস্ট্যান্স টিউব’ বা ডাম্বেল কিনতে পারেন। কিংবা এক লিটার বা দু’লিটার জলের বোতলও রেজ়িস্ট্যান্স হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। শরীর টানটান রাখতে সপ্তাহে চার দিন জোর বাড়ানোর ব্যায়াম করুন আর দু’দিন হাঁটুন।’’ হাঁটলে পেশি শক্ত হয়, সন্ধিস্থল সচল থাকে।
জোর বাড়ানোর ব্যায়াম
এক লিটার জলের বোতল নিয়েই শুরু করুন। সপ্তাহে দু’দিন শরীরের উপরের অংশের ব্যায়াম, দু’দিন নীচের অংশের কসরত। দু’হাতে জলের বোতল নিয়ে দাঁড় বাওয়ার ভঙ্গি করুন, চেস্ট প্রেস ও শোল্ডার প্রেস করুন (বুকের কাছে ও কাঁধের উপরে ওঠানো-নামানো)। পা ছড়িয়ে স্কোয়াট (উবু হয়ে বসা), স্টেপ আপ (সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা) করুন। সবই তিন বার করে দিনে ১২ বার। ১৫ দিন পর, দু’লিটার বোতল নিয়ে একই ব্যায়াম করুন। ব্যায়ামের অভ্যেস হবে, ফিট শরীরটা ধরে রাখার ইচ্ছেও হবে। অন্যান্য ব্যায়াম শুরুর আগ্রহ জন্মাবে।
ডায়েট, ব্যায়ামে অক্ষম, সময়ও কম! তখন?
গ্যাস-অম্বলের রোগীদের দু’ঘণ্টা অন্তর খাওয়া বাধ্যতামূলক। সেই অজুহাতে চিপ্স, ক্রিম ঠাসা বিস্কিট বা নোনতা মুখরোচক নয়, বরং মারি, থিন অ্যারারুট বিস্কিট খান। পেট খালি থাকবে না, মেদও জমবে না। অফিসে ঘনঘন চা-কফি, লাঞ্চে বাইরে খাওয়ায় সংযম রাখুন। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ চানাচুর, শিঙাড়া নয়। চা-কফির দুধ-চিনিও ওজন বাড়ায়। পরিবর্তে ফল, বিস্কিটে অল্প খিদে মেটান।
অফিসে বসে কাজের ফাঁকেই কিছু ব্যায়াম করে নিন। বসে পা তুলে টানটান করে সোজা রাখুন। ওয়াশরুমের আয়নার সামনে শ্যাডো বক্সিং (শূন্যে চার বার ঘুসি, পা ছোড়া) করুন। কুড়ি মিনিট জোরে হাঁটুন, দু’মিনিট দৌ়ড়। আবার দু’হাতে জলের বোতল নিয়ে আয়নার সামনে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দৌড়ানো বা জগিং করুন।
বাড়িতেও এক জায়গায় বসে এই সব ‘ইন্টারভ্যাল কার্ডিয়ো’ করা যায়। চিন্ময় বললেন, ‘‘হাঁটুতে ব্যথা না থাকলে ‘জাম্পিং জ্যাক’ (লাফিয়ে মাথার উপরে তালি দিয়ে আগের অবস্থানে ফেরা) এক্সারসাইজ় করুন আধ মিনিট। ম্যাজিকের মতোই ক্যালরি ঝরবে।’’
মডেল: ত্বরিতা, ছবি: দেবর্ষি সরকার, মেকআপ: সৈকত নন্দী, পোশাক: রিবক, ক্যামাক স্ট্রিট, লোকেশন: দ্য ভর্দে ভিস্তা কনক্লেভ, চকগড়িয়া