রঙিন দৃশ্যকাব্য: প্রয়াত মৃদুল দাশগুপ্তর আলোকচিত্রর প্রদর্শনী
আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর প্রভূত নিরীক্ষামূলক ছবির প্রদর্শনী বেশ কিছু বছর যাবৎ নানা জায়গায় প্রশংসিত। দেশ-বিদেশের বহু নামী শংসাপত্রের দাবিদার, সম্প্রতি প্রয়াত মৃদুল দাশগুপ্তের ২৫টি আলোকচিত্রের প্রদর্শনী সম্পন্ন হল বারাসতের চারুকলা গ্যালারিতে।
‘আনন্যাচারাল মেলোডিক লাইনস’ নামে এর আগেও অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে তিনি একক প্রদর্শনী করেছিলেন, তার কিছু ছবিও এখানে দেখানো হয়েছে।
বর্তমান প্রদর্শনীটি প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর রঙিন দৃশ্যকাব্য। মূলত প্রস্তর এবং তার স্বাভাবিক টেক্সচারের বর্ণবিন্যাসের ধর্ম কেমন ভাবে ফোটোগ্রাফিক পদ্ধতির বিভিন্ন পরীক্ষা-উত্তর পর্বে বিবর্তিত হয়ে এক উজ্জ্বল বর্ণবৈচিত্রের আভাস দিচ্ছে— বহু ছবিতেই তিনি তা দেখিয়েছেন। পাথরের ফর্ম ও টেক্সচার নানা ধরনের। পাহাড়-পর্বত থেকে স্থলভূমি... ইতস্তত ছড়ানো পাথরের সমগ্র শরীর, তার গাত্রবর্ণের আসল দ্যুতি অথবা অস্পষ্টতা, স্বাভাবিকতা তাঁর ক্যামেরাবন্দি ছবিগুলিতে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। যে পরিবর্তন এসেছে ফোটোশপে ফেলে পরবর্তী ধাপগুলিতে নানা কায়দায় তাকে দৃষ্টিনন্দন রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে। এখানে তিনি ছবিগুলিতে পরীক্ষানির্ভর একটি তারতম্য ঘটানোর প্রয়াস বরাবর করে গিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, তাঁর বর্তমান আলোকচিত্রগুলিকে তিনটি শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে। সচেতন ভাবেই কম্পোজ়িশন নিয়ে যেমন ভেবেছিলেন, এমনকি জল-পাথরের সহাবস্থান ও পাশাপাশি বিন্যাসের ক্ষেত্রে পেন্টিং কোয়ালিটি নিয়েও ভেবেছিলেন। যে ক্ষেত্রে তিনি আশ্চর্য ভাবেই সফল। প্রথমত তাঁর আলোকচিত্রে সেই অর্থে গ্রাফিক কোয়ালিটি, পেন্টিং কোয়ালিটি এবং টেক্সচারাল অ্যাবস্ট্রাকশন অব লাইট অ্যান্ড কালার ভীষণ ভাবে উপস্থিত। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, ত্বকের স্বাভাবিকতা কী ভাবে বিমূর্ত হতে পারে? তিনি দেখিয়েছেন, এই বিমূর্ততার প্রধান অস্ত্রই হল আলো এবং বর্ণ। যেখানে উল্লিখিত নানা পরীক্ষামূলক পর্ব। তিনি সৃষ্টির স্বাভাবিকতার আলো-অন্ধকার, বর্ণের স্তরগুলিকে এক যান্ত্রিক নিরীক্ষার পরে ফাইনাল প্রিন্টটি বার করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানেই প্রকৃত রূপ ও নির্দিষ্ট আবহের বিবর্তন ঘটছে নানা মাধ্যমে, নানা ভাবে।
কোনও ছবি যেন আদ্যোপান্ত চিত্রকলা, এমনকি ডিজ়াইনও আছে। কোনওটি আক্ষরিক অর্থেই একটি সম্পূর্ণ ভাস্কর্য। এমনকি কোনওটা রঙিন পরীক্ষামূলক একটি এচিং প্রিন্ট। আবার কোনওটা যেন হুবহু বাটিক প্রিন্ট। এই বিভ্রম ও সৌন্দর্যময় প্রকাশ সবটাই ক্যামেরা, ফোটোশপ, শাটার স্পিড ও অন্যান্য ‘এক্সপেরিমেন্টাল মেশিনারি’ উদ্ভূত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রিন্ট। যার সবটাই ক্যানভাসে নেওয়া প্রিন্ট এবং বেশ উন্নত মানের। প্রখ্যাত শিল্পী শক্তি বর্মণের ছাপচিত্রের সূক্ষ্মতা, অনুপুঙ্খময়তা ও সমগ্র আবহে যে একটা অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক রঙিন বিন্যাসের তক্ষণজাত বিশ্লেষণ থাকে, এখানে কিছু ছবির প্রস্তরগাত্রে প্রায় ওই রকম সাদৃশ্য ভীষণ ভাবে বিদ্যমান।
অন্তরীক্ষ থেকে জল, মাটি, আলো, অন্ধকার, প্রস্তরের ভাষা তিনি ক্যামেরার মাধ্যমে যে ভাবে ব্যক্ত করেছেন, তা নেহাত অতি সাধারণ কিছু নয়। বরং যে ভাবেই তাকে বিবর্তিত করুন না কেন, শিল্পগুণ এই আলোকচিত্রগুলিকে মহার্ঘ করেছে, সন্দেহ নেই।
আসলে ফোটোশপে ছবিতে লাইট অপটিমাইজ় করে, রঙের একটা একটা করে লেয়ার চাপিয়েছেন। ডুপ্লিকেট লেয়ার বলা যায়। পটভূমিতে যা আছে, তারই আর এক দ্বৈতবর্ণ, যার ফলে দুটো বেস-কালারের একটা এফেক্ট তৈরি হচ্ছে। পরিবর্তন আসছে। গত ছ’-সাত বছর ধরে এমন নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন তিনি আলোকচিত্রে। তিনি স্বাভাবিক যা দেখছেন, শাটার স্পিড বাড়িয়ে রঙের তারতম্য ঘটিয়ে, আলোরও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যাঙ্গল থেকে কম্পোজ়িশনে আলোকে নানা ভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। আসলে দেখা গিয়েছে, অবজেক্টকে প্রধান হিসেবে রেখে আলো-অন্ধকারের পরীক্ষামূলক জায়গাটি ধরতে চেয়েছেন বারবার। ছবি তোলার পর বাছাই পর্বে ‘ভাল’ কাজগুলিকে ফোটোগ্রাফির পোস্ট-প্রসেসিং ও পরবর্তী ধাপে নানা ভাবে উন্নতি ঘটানোর যান্ত্রিক পদ্ধতির পরেই ফাইনাল প্রিন্টটি বার করেছেন। এ সব কাজে সব সময়ের সঙ্গী তাঁর পুত্রের অবদান অনস্বীকার্য। সমস্ত এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রেই দু’জনে মিলে একটা ‘ক্যালকুলেটিভ ওয়ে’-তে প্রিন্টগুলিকে নির্বাচন করেছেন।
তাঁর ‘ব্রাশ স্ট্রোকস’, ‘স্কাইফল’, ‘ওয়াটার ব্লিঙ্ক’, ‘ইম্প্রেশন ওয়ান’ ও ‘ইম্প্রেশন টু’, ‘স্টোন স্কেপস’, ‘মেলাঙ্কলি’, ‘মুনল্যান্ড’, ‘দ্য লাস্ট সোল’, ‘ওয়াচিং’, ‘ফ্রোজ়েন কর্পস’, ‘আর্গুমেন্টেটিভ’, ‘মোনোলগ’ কাজগুলি উজ্জ্বল অপরাহ্ণ অথবা জ্যোৎস্নার অনন্য এক-একটি আশ্চর্য কবিতা যেন।