বাদনরত উস্তাদ আমজাদ আলি খান
ভারতীয় মার্গসঙ্গীতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের অবদানকে স্মরণ করতে কলকাতার কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আয়োজন করে বালিগঞ্জ মৈত্রী মিউজ়িক সার্কল। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্মরণ করা হয় রাধিকামোহন মৈত্র, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-সহ মার্গসঙ্গীতের সেই সব অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বকে, যাঁরা সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি নবীন প্রজন্মকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন একাধিক সঙ্গীতমঞ্চ, সাঙ্গীতিক পরিসর। এ দিনের অনুষ্ঠানটি ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নামাঙ্কিত আয়োজন। তিন পর্বের এই আসর সুসংহত এবং ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া।
অনুষ্ঠানের শুরু তালবাদ্যে। তবলার যৌথবাদন। পরিবেশনায় নয়ন ঘোষ এবং তাঁর পুত্র ঈশান ঘোষ। উপস্থাপনা তিনতালে, নানান যতির গ্রন্থনায় গাঁথা। একই বোলে নানা লয়ের পেশকারি মনে রাখার মতো। পিতা-পুত্রের পারস্পরিক আদানপ্রদান এবং বোঝাপড়ার সুবাদে গোটা পরিবেশনা ছিল সুঠাম এবং তাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল হিরণ্ময় মিত্রের দক্ষ হাতের হারমোনিয়াম।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব কণ্ঠসঙ্গীতের। শিল্পী অজয় চক্রবর্তী। প্রয়াত সরোদিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় এবং স্মৃতিচারণের পরে অজয় চক্রবর্তী শুরু করলেন রাগ মারোয়া দিয়ে। মোটামুটি দীর্ঘ বয়ানের এই উপস্থাপনায় ‘গুরুবিনা জ্ঞান না পাওয়ে’ বন্দিশের পরিবেশনা দারুণ। পরে ছিল ঠুমরি আর শেষে ভজন। মিশ্র পিলুর ঠুমরি ‘কাটে না বিরহ কি রাত’ অনবদ্য। মীরার ভজন ‘বসো মেরে নয়ন মে নন্দলাল’। গোটা পরিবেশনায় স্পষ্ট ছিল অজয় চক্রবর্তীর নিজস্বতার স্বাক্ষর। সঙ্গে ঈশান ঘোষের মার্জিত তবলা সঙ্গত এবং গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের যথাযথ হারমোনিয়াম-সহযোগ উল্লেখযোগ্য।
শেষ পর্বে উস্তাদ আমজাদ আলি খান। এ দিনের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। স্বভাবোচিত ভঙ্গিতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণ করলেন উস্তাদজি। স্মরণ করলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের গুরু পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্রকে। উস্তাদজি তাঁর সরোদবাদন শুরু করলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রিয় রাগ ছায়ানটের একটি বন্দিশ দিয়ে। এই রাগের প্রশান্তি মূর্ত হয়ে উঠল শিল্পীর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে। দীর্ঘ নয়, মিনিট আঠেরোর পরিসরের মধ্যে। ছায়ানটের মায়াবী পরিসরের পরে রাগ ঝিঁঝিট। খাম্বাজ ঠাটের এই রাগটির সঙ্গে বাঙালির বিশেষ সখ্য। বাংলা লোকগানের কাঠামোয় ঝিঁঝিটের প্রয়োগের কারণে। ভাটিয়ালি, বাউল, সারি, কীর্তনে এ রাগ নানা ভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছে। একই ভাবে যেমন করেছে রবীন্দ্রনাথের গানে। উস্তাদ আমজাদ আলি খানের বাদনে ছোট কাঠামোর এই রাগের কোমল গান্ধারের স্বল্প-সংযত ব্যবহার কিংবা মন্দ্রসপ্তক আর মধ্যসপ্তকে ডানা মেলে দেওয়ার স্পষ্ট ছাপের পাশাপাশি ধরা পড়ল তাঁর বাদনজাদু। কাঠামোর মধ্যে থেকেও কাঠামো অতিক্রম করে যাওয়ার ম্যাজিক। ঝিঁঝিট থেকে শিল্পী চলে গেলেন বাগেশ্রীতে। জনপ্রিয় এবং অতি পরিচিত এই রাগ নিজের প্রকাশ ঘটাল শিল্পীর ব্যতিক্রমী প্রাখর্যে। বাকি বাদনগুলির চেয়ে বাগেশ্রী কিছুটা বড় করেই বাজালেন উস্তাদজি।
আরও কিছু চমক ছিল এ দিনের আয়োজনে। যেমন উস্তাদজির নিজের বাঁধা কম্পোজ়িশন তিলং-নিবদ্ধ তারানা। শুরুতে বাদনে রাগরূপ স্পষ্ট করলেন শিল্পী। পরে খানিক গেয়ে তালরূপ গেয়ে দেখানো। সাড়ে ন’মাত্রার তাল। আর এইখানেই সেই জাদু, অনেকটা কবিতার ছন্দে হয় যেমন। কবিতা যেমন জানে না পথ চলতে চলতে আট মাত্রার অক্ষরবৃত্ত কখন টেনে নিয়ে যায় তাকে দশ মাত্রায়। তিলঙের এই তারানাও তেমন তিনতালের ঝোঁক পেরোতে পেরোতে পৌঁছে দেয় সাড়ে নয় মাত্রার মায়াময় দ্বীপভূমিতে।
শুধু মাত্র কম্পোজ়িশনই বেঁচে থাকে পৃথিবীতে, আলাপ-জোড়-ঝালা মুছে যায় শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গে। তাঁর গুরু তথা পিতা উস্তাদ হাফিজ আলি খানের এই কথার উল্লেখ করলেন আমজাদ আলি খান। আবারও যেন আখর-সাহিত্যের কথা ধ্বনিত হল। কবিতার ছন্দ, গদ্যের কাঠামো-বিন্যাস বা নাচের ব্যাকরণের বেড়া পেরিয়ে সত্যি যেমন থেকে যায় সৃষ্টি। সত্যের সুন্দর আর সুন্দরের সত্য। উস্তাদজি ধরলেন রাগ বিহারি। বেশ কিছু রাগ-রাগিণীর সংমিশ্রণে তৈরি রাগরূপে ফুটে উঠল সরোদ-ঘরানার নিজস্ব বন্দিশ। যার উল্লেখও করলেন শিল্পী। দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত-আঙ্গিকের সম্পূর্ণ রাগ চারুকেশী ছিল শিল্পীর শেষ পরিবেশনা। খুব দীর্ঘ করে নয়, অল্প পরিসরেই বাজালেন শিল্পী। মুহূর্তে ফুটে উঠল এ রাগের মাধুর্য।
উস্তাদ আমজাদ আলি খানের সঙ্গে তবলা সঙ্গতে ছিলেন যিনি, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গত শুধু সুঠাম, স্পষ্ট বা সুন্দরই নয়, গোটা পরিবেশনার ভার বহন করার ব্যতিক্রমী উদাহরণও। কোথাও বাড়তি নেই কিছু, কমও নেই।