আমান আলি খান এবং রাশিদ খান।
অতিমারির আবহে স্তব্ধ জনজীবনকে ছন্দে ফেরানো মোটেই সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে করোনা-আতঙ্কে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে এগোলেও, করোনা-উত্তর পৃথিবী ‘স্বাভাবিক’-এর সংজ্ঞা পালটে দিয়েছে। এমতাবস্থায় ঐতিহ্যবাহী এই সঙ্গীতানুষ্ঠান হবে কি না, হলে কী ভাবে সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে কর্মকর্তাদের কপালে ভাঁজ ছিলই। তবে কলকাতা এবং মফস্সলের সঙ্গীতানুরাগের প্রতি আস্থা রেখে, পরিকল্পনায় বেশ কিছু বদল ঘটিয়ে অনুষ্ঠিত হল ৬৯তম ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন।
প্রথম দিনের অন্যতম শিল্পী ছিলেন অজয় চক্রবর্তী। তাঁকে ‘সঙ্গীত সম্মান ২০২১’ প্রদান করা হয়। শিল্পীর প্রথম নির্বাচন ছিল বাগেশ্রী। সুমিষ্ট বিস্তারে বাগেশ্রীর মেজাজ তৈরি করলেন তিনি। বিলম্বিত একতালে শোনালেন জনপ্রিয় বন্দিশ ‘সখী, মন লাগে না’। পরবর্তী রাগ ভৈরবীতেও পাওয়া গেল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গায়নভঙ্গি।
সন্ধ্যার আবহকে ভরিয়ে তুলল ভারতী প্রতাপের কণ্ঠে শ্রী রাগের পরিবেশনা। প্রাচীন এই রাগটি শিল্পীর জড়তাহীন কণ্ঠের সাহচর্যে শ্রুতিমধুর হয়ে উঠেছিল। ‘সাঁঝ ভয়ি তুম আও’— একতালে নিবদ্ধ বিলম্বিত বন্দিশ দিয়ে শুরু করলেন ভারতী। পরে মধ্যলয় ঝাঁপতাল এবং দ্রুত তিনতালে আরও দু’টি বন্দিশ শোনালেন। মন্দ্রসপ্তকের তুলনায় তারসপ্তকে তাঁর কণ্ঠ অনেক বেশি সাবলীল। সে কারণেই হয়তো শিল্পী তারসপ্তকের সুরবিস্তারে অধিক মনোনিবেশ করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে তারসপ্তকে সঞ্চরণ একটু চড়া লেগেছে। নন্দ রাগে আগরা ঘরানার বিখ্যাত ‘নোমতোম’ আলাপ শোনা গেল ভারতীর কণ্ঠে। অত্যন্ত সুগঠিত এবং সুপরিবেশিত ছিল এই আলাপটি। নোমতোম আলাপের পরে শোনালেন তিনতালের বন্দিশ ‘পায়েল মোরি বাজে’। মীরার ভজন দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করলেন শিল্পী।
তাঁর কাছে আরও খানিক প্রত্যাশা ছিল। ওমকার দাদরকরের এ বারের উপস্থাপনায় মন ভরল না। তিনি শোনালেন মারোয়া এবং তিলক কামোদ। মারোয়ায় বিলম্বিত একতালের পরে চমৎকার একটি তারানা শোনালেন। তারানার পরে দ্রুত বন্দিশ সাধারণত গাওয়া হয় না, ওমকার সে-কথা স্বীকার করেই দ্রুত বন্দিশ পরিবেশন করলেন একতালে। তাঁর গায়নভঙ্গি শ্রোতার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। দ্রুত লয়ে সপাট তান, অলঙ্কার, বোলতান দিয়ে পরিবেশনাকে সাজিয়ে তুলেছিলেন শিল্পী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই। তবে এ বার তাঁর পরিবেশনা একটু কৃত্রিম লেগেছে। তবলার সঙ্গে কসরতে অতিরিক্ত মন দেওয়ায় রাগমাধুর্য সে ভাবে পাওয়া গেল না। তিলক কামোদ রাগে মধ্যলয় ঝাঁপতাল এবং দ্রুত তিনতালে দু’টি সুন্দর বন্দিশ শোনালেন। তবে সুমিষ্ট এই রাগটিতেও শিল্পীর অতিরিক্ত তানকর্তব রাগভাব প্রকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডোভার লেন বরাবরই নতুনদের জায়গা করে দিয়েছে। শিল্পী-তালিকায় নবাগত ছিলেন অনেকেই। কণ্ঠসঙ্গীতে নবাগতা অত্রি কোটালের কণ্ঠে ভীমপলশ্রী মন্দ লাগেনি। শিল্পীর বলিষ্ঠ গায়নে নিজস্বতার ছাপ রয়েছে। তিনতালে বাঁধা জনপ্রিয় দ্রুত বন্দিশ ‘যা যা রে আপনে মন্দরবা’ বেশ ভাল লেগেছে। একতালের বন্দিশটিও ভাল গেয়েছেন শিল্পী।
রাশিদ খানের পুত্র আরমান খানের পুরিয়া শ্রোতাদের বাহবা পেয়েছে। অনুশীলনের ছাপ তাঁর কণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছে।
দরাজ কণ্ঠে মুগ্ধ করেছেন জয়তীর্থ মেভুণ্ডি। শুদ্ধ কল্যাণ রাগের বিলম্বিতে শিল্পীর স্বকীয় ভঙ্গির প্রকাশ ছিল আবেদনময়। ধীর লয়ে বিস্তার থেকে দ্রুত লয়ের তান— জয়তীর্থের কণ্ঠ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দৃপ্ত। পরবর্তী উপস্থাপনা বসন্তেও অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন সেই ভাল লাগার রেশ।
সমাবেশের শেষ দিন অন্য মাত্রা পেল রাশিদ খানের উপস্থাপনায়। রাগ যোগ দিয়ে শুরু করলেন শিল্পী। রাশিদের আবেদনময় কণ্ঠে দুই গান্ধারের বৈচিত্রমণ্ডিত প্রয়োগে রাগটি পরিপূর্ণতা লাভ করল। শিল্পীর মনোময় সুরসঞ্চালনা শ্রোতাদের আবিষ্ট করেছে। পরবর্তী নায়কি কানাড়া এবং সোহিনীতেও গায়নের আভিজাত্য ধরে রেখেছিলেন রাশিদ। তাঁর কণ্ঠে বহুশ্রুত ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ সে দিনও প্রশংসিত হয়েছে। সিন্ধু ভৈরবী রাগে অনুষ্ঠান শেষ করলেন তিনি।
কণ্ঠসঙ্গীত এবং বাঁশির যৌথ উপস্থাপনায় আসর জমালেন সঞ্জীব অভয়ংকর এবং শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যম। তাঁদের উপস্থাপনায় ছিল মধুবন্তী, ভূপালি এবং আড়ানা। মধুবন্তী রাগটি স্বভাবে মধুর। সঞ্জীবের উদাত্ত গায়কি আর শশাঙ্কের সুমিষ্ট বংশীবাদনে তা আরও মনোময় হয়ে উঠেছিল। তবে ভূপালি এবং আড়ানায় বাঁশি ততটা শোনা গেল না, যতটা সঞ্জীবের কণ্ঠ। তবলায় তাঁদের সঙ্গ দিয়েছেন বিক্রম ঘোষ। তিনজনের মিলিত পরিবেশনা উপভোগ্য ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু পৃথক ভাবে তাঁদের গায়ন এবং বাদন শ্রোতাদের যে ভাবে মুগ্ধ করে, মিলিত উপস্থাপনায় তার আস্বাদ মেলেনি।
দীপক মহারাজ এবং রাগিণী মহারাজের কত্থক পরিবেশনা বেশ ভাল লেগেছে। তবলার বোলের সঙ্গে পিতা-কন্যার পদসঞ্চালনা মনোরঞ্জক ছিল। লখনউ ঘরানার নৃত্যের ছন্দ উঠে এসেছে তাঁদের উপস্থাপনায়। কুমার বসুর তবলা তাতে বাড়তি মাধুর্য যোগ করেছে। তবে উমা মেমোরিয়াল কলালয়ম-এর কথাকলি নজর কাড়েনি। যথার্থ বোঝাপড়ার অভাবে তাঁদের প্রয়াস সফল হয়নি।
প্রতি বছরের মতো যন্ত্রসঙ্গীতেও ডোভার লেন নতুনদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশিষ্ট সরোদিয়া আলি আকবর খানের পৌত্র সিরাজ শুরু করলেন রাগ হেম-বেহাগ দিয়ে। সংক্ষিপ্ত আলাপের পর শোনালেন জোড়, ঝালা। সিরাজের সরোদবাদন শুনতে খারাপ লাগে না। যদিও দ্রুত-বাদনে দু’-একবার সুর থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। হেম-বেহাগের পরে শোনালেন মধুমালতী। বিলম্বিত এবং মধ্যলয় তিনতালে দু’টি গৎ বাজালেন শিল্পী। সংক্ষেপে মিশ্র ভৈরবী বাজিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন। সাঙ্গীতিক পরম্পরা তিনি জন্মসূত্রে পেয়েছেন। সেই শৈলীকে শ্রুতিমধুর করে তোলে শিল্পীর মেজাজ। সিরাজের উপস্থাপনায় সেই ‘মেজাজ’ অনুপস্থিত ছিল।
অভিষেক লাহিড়ী সরোদে জৌনপুরি বাজান। তার পর আহিরি রাগে একটি গৎ শোনালেন। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেছেন আর-এক তরুণ শিল্পী ঈশান ঘোষ।
নন্দিনী শঙ্করের বেহালা এবং দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় রণদিভে-র বাঁশির যৌথ উপস্থাপন খুব ভাল। পটদীপ রাগে বিলম্বিত ঝাঁপতাল, মধ্যলয় এবং দ্রুত তিনতালে দুই শিল্পীই নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় রাগ-পরিবেশনা আরও মনোহর হয়ে উঠেছিল।
সতীশ ব্যাসের সন্তুরে মধুবন্তী এবং কিরওয়ানি মোটামুটি। মধুবন্তী রাগে মধ্যলয় ঝাঁপতাল এবং দ্রুত একতালে দু’টি কম্পোজ়িশন শোনালেন তিনি। পরে কিরওয়ানিতে তিনতালে নিবদ্ধ সুন্দর একটি গৎ পরিবেশন করলেন।
শুভেন্দ্র রাওয়ের সেতার এবং সাসকিয়া রাওয়ের চেলো-র যৌথবাদন চলনসই। তাঁদের উপস্থাপনায় ছিল বসন্ত পঞ্চম এবং ষণ্মুখপ্রিয়া। সূচনা ভাল লাগলেও শেষ পর্যন্ত সেই রেশ ধরে রাখতে পারেননি তাঁরা।
ইন্দ্রজিৎ বসুর বাঁশি তেমন জমেনি। পটদীপ রাগে বিলম্বিত এবং দ্রুত তিনতালে একটি কম্পোজ়িশন শোনালেন শুরুতে। শেষ করলেন বসন্ত দিয়ে। সুর থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি বেশ কয়েকবার।
মিতা নাগের সেতারবাদন প্রশংসাযোগ্য। তাঁর উপস্থাপনা পরিমিতি এবং পরিচ্ছন্নতার মিশেলে নজর কেড়েছে। রাগ ললিতা গৌরীতে আলাপ-জোড়, পূর্বীতে মধ্যলয় ঝাঁপতালে একটি গৎ এবং পুরিয়া কল্যাণে দ্রুত কম্পোজ়িশন— প্রতি উপস্থাপনাতেই পরিণত বাদনের আভাস পাওয়া গিয়েছে।
অনুপমা ভাগবতের প্রত্যয়ী সেতারবাদনে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছিল ঝিঁঝিট। আলাপ, জোড়, ঝালার পরে তিনতালে গৎ পরিবেশন করলেন শিল্পী। তাঁর সেতারের বলিষ্ঠ ঝঙ্কার অনুরণিত হয়েছে শ্রোতাদের হৃদয়ে। ইমদাদখানি ঘরানার বিশেষ ভঙ্গি তাঁর বাদনে ফুটে উঠেছিল।
তন্ময় বসু (তবলা), সতীশ পত্রী (মৃদঙ্গম) এবং গিরিধর উদুপা-র (ঘটম) ‘তালবাদ্য’ উপভোগ্য ছিল।
সঙ্গীত তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সাঙ্গীতিক আবহেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। আমান আলি খান। তরুণ সরোদিয়াদের মধ্যে তাঁকে পৃথক ভাবে চিনে নেওয়া যায় স্বকীয় বাদনশৈলীর গুণে। আমান এ বারও নিরাশ করেননি। ব্যাধি-কবলিত এই অবরুদ্ধ সময়ে সঙ্গীতরসিক কলকাতাবাসীকে মাতিয়ে তুললেন সুরের মাদকতায়। রাগ সরস্বতী তাঁর উপস্থাপনার কথামুখ উন্মোচন করল। একতাল গতে রাগটির আভিজাত্য ফুটিয়ে তুললেন তিনি। সরস্বতীর রেশ ধরে প্রবেশ করলেন ললিতা গৌরীতে। মন্দ্র ও মধ্য সপ্তকের সুনিয়ন্ত্রিত সুরসঞ্চালনা, মীড়ের মুনশিয়ানা এবং দ্রুত লয়ের তান-বিস্তারে আমানের সরোদবাদন প্রশ্নাতীত। শেষতম উপস্থাপনা মালকোষেও আমানের বাদন চমৎকার মেজাজ তৈরি করেছিল।
চার দিনের এই সঙ্গীত সম্মেলনে কণ্ঠশিল্পী এবং যন্ত্রশিল্পীদের সহযোগিতা করেছেন যে সব শিল্পী তাঁরা হলেন— তবলায় শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সাহা, শুভেন চট্টোপাধ্যায়, তন্ময় বসু, অরূপ চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, উজ্জ্বল ভারতী, শুভজ্যোতি গুহ, সঞ্জয় অধিকারী, সন্দীপ ঘোষ, বিভাস সাংহাই, ঈশান ঘোষ, অমিত চট্টোপাধ্যায়। হারমোনিয়ামে হিরণ্ময় মিত্র, রূপশ্রী ভট্টাচার্য, সনাতন গোস্বামী, গৌরব চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ পালিত এবং বিনয় মিশ্র। সারেঙ্গি সঙ্গতে মুরাদ আলি এবং সারওয়ার হুসেন।
এ বছরের ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনে তাল কেটেছে অনেক ক্ষেত্রেই। কোথাও শিল্পী নির্বাচনে, কোথাও সময়ের সদ্ব্যবহারে। গমগমে প্রেক্ষাগৃহ, শীতরাত্রির আমেজ, নৈশ-আড্ডা কোনও কিছুই আগের মতো পাওয়া সম্ভব হয়নি এই অতিমারির অচলাবস্থার দরুন। থমকে যাওয়া এ সময়ে যখন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, আড়াল ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই, দূরত্ব ছাড়া গত্যন্তর নেই, তখন এই কলকাতার বুকে চার দিন ধরে মুখোশ-ঢাকা সারি সারি মুখের আড়ালে সঙ্গীতপিয়াসী অজস্র কান বুঁদ হয়ে ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহাসমারোহে। সুরের উদ্যাপনে পারস্পরিক দূরত্ব মুছে গিয়েছিল আন্তরিক সাহচর্যে। অবরুদ্ধ এ সময়ে এটাই বা কম কী!