Bronze Art

বহুরূপে সম্মুখে তোমার

গত বছর চারেকের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছিল। মাত্র দু’টি চরিত্র নিয়েই এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সূচনা। এক সাঁওতাল ছেলে মুসুই এবং তারই পরিপূরক আর একটি মেয়ে, মাইয়া।

Advertisement

শমিতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ ০৭:৫৪
Share:

সঙ্ঘবদ্ধ: ইমামি আর্টে প্রদর্শিত শিল্পী কে এস রাধাকৃষ্ণনের কাজ।  ফাইল ছবি।

পঞ্চাশটি পূর্ণ মাপের মানুষের ব্রোঞ্জ মূর্তি, তাতে পুরুষ এবং নারী দুই-ই আছে, সমান ভাবে। কেউ কারও চেয়ে বড় নয়। পুরুষের মুখে এক অদ্ভুত হাসি। এ হাসির কোনও পরিচয় হয় না। খানিকটা যেন শিশুসুলভ। কিছুটা যেন জ্ঞানীর‌ও হাসি। এ রকমই বিভিন্ন ধরনের ব্রোঞ্জ মূর্তির এক প্রদর্শনী দেখা গেল ইমামি আর্টে, নাম ‘দ্য ক্রাউড অ্যান্ড ইট’স অবতার্স’। শিল্পী, কে এস রাধাকৃষ্ণন।

Advertisement

আর শিবকুমার উপস্থাপিত এই প্রদর্শনীটি রাধাকৃষ্ণনের আগের ভাস্কর্যগুলির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। কেরলের কোট্টায়াম জেলা থেকে ১৯৭৪ সালে চলে এসেছিলেন শিল্পী, শান্তিনিকেতনের কলাভবনে শিল্প শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য নিয়ে। শিক্ষাগ্রহণ করেন প্রথমে রামকিঙ্কর বেইজ এবং তার পরে শর্বরী রায়চৌধুরীর কাছে। তাঁর শিক্ষকদের মতোই তিনি মাটি দিয়ে মডেল তৈরি করে, তার পরে কাজটি চিরস্থায়ী করে রাখেন ব্রোঞ্জে। মানুষের ফিগার বা অবয়ব নিয়েই মূলত কাজ করে থাকেন রাধাকৃষ্ণন। মুষ্টিমেয় আর‌ও কয়েক জন ভাস্করের মতো তাঁর হাত ধরেও আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যের উত্তরণ ঘটে এক অন্য মাত্রায়।

গত বছর চারেকের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছিল। মাত্র দু’টি চরিত্র নিয়েই এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সূচনা। এক সাঁওতাল ছেলে মুসুই এবং তারই পরিপূরক আর একটি মেয়ে, মাইয়া। এই দুই চরিত্রকে নিয়ে এক দিকে একটি শারীরিক এবং সামাজিক জগৎকে খুঁজে পাওয়া, আবার অন্য দিকে ভাস্কর্যের সম্ভাবনাকে অন্য সীমারেখায় পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস।

Advertisement

বিভিন্ন ধরনের ব্রোঞ্জ মূর্তির এক প্রদর্শনী দেখা গেল ইমামি আর্টে, নাম ‘দ্য ক্রাউড অ্যান্ড ইট’স অবতার্স’। শিল্পী, কে এস রাধাকৃষ্ণন। ফাইল ছবি।

প্রদর্শনীতে যে কাজগুলি রাখা হয়েছে, তার বেশির ভাগই শিল্পীর কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী ছোট টুকরো মডেল করে নিয়ে, একসঙ্গে জুড়ে ওই অবয়বগুলি সৃষ্টি করে, তার পরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আলাদা করে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই, কারণ বহু অংশ জুড়েই তাদের উপস্থিতি। শিল্পী যেন বলতে চাইছেন যে, আমরা যখন নিজেদের অন্যদের চেয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবি, সেটি একটি মায়ামাত্র। কারণ আমাদের মধ্যেও বহু কিছুর অংশ অজানা ভাবে উপস্থিত এবং আমরা সকলেই যেন এক সূত্রে বাঁধা। আমন্ত্রিত দর্শক ওই ভিড়ের মধ্যেও হেঁটে চলে বেড়িয়ে, স্পর্শ করে, অবয়বগুলির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারেন। আর এই পঞ্চাশটি অসাধারণ মূর্তি যেন মনোরম এক আনন্দ-অনুভূতিতে দর্শককে অনন্ত এক জগতে পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া আরও একটি জিনিস লক্ষণীয়। সেটি হল, সব মূর্তিগুলিরই পাদদেশ বা ভিত্তিমূল সমান্তরাল নয়। নীচ থেকে একটু উপরে উঠতে চেয়েছে যেন। এটি কি কোনও লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য আকুলতা? নাকি নিজেকে উন্নত করার ঐকান্তিক আগ্ৰহ?

এ ছাড়াও বাকি যে সব মূর্তি চারতলায় অবস্থান করছে, সেখানে আমরা দেখি অসংখ্য ছোট ছোট মিনিয়েচার মূর্তি, যেগুলির কোনও মুখাবয়ব নেই। ওরা পুরুষ না নারী, আমাদের বলা হয়নি। ওদের কোনও নিজস্বতা নেই। যৌনতাহীন ওরা। কিন্তু ওরাই আমাদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে, ওদের খেলায় যোগ দিতে বলছে। কীসের ইশারা করছে? মহাকাশে অনন্ত এক ম‌ঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে উচ্ছলভাবে বিহার করার? সমস্ত জীবনটাই কি যেন এক লীলাক্ষেত্র?

‘তপস্যী তরঙ্গিনী’ কাজটিতে মুসুই এবং মাইয়া ক্রীড়ারত। ঠিক যেন জিমন্যাস্টিক্স। ছন্দোময় কাজটি সুচারুরূপে করা। এখানে ওই জুটিকে কিছুটা প্রেমিক-প্রেমিকার ভূমিকায় দেখা যায়। ‘ফ্যানফেয়ার’-এ‌ মিনিয়েচার মূর্তিগুলি পাখার হাওয়ায় দোদুল্যমান। কিন্তু ওরা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, বিচ্ছিন্ন নয়। পড়ে যাচ্ছে না কেউই। কোথাও মুসুই যেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, আবার কোথাও মাইয়া এসেছে সারদা মায়ের রূপে। ‘স্মুদ সেলিং অব দ্য বোট’ কাজটিতে সমুদ্র বা নদীর উত্থান-পতনের কোনও ত্রাস নেই। সবটাই একটা খেলা। এক থেকে বহুত্ব বা বহুর মধ্যেও সেই একতা। প্রতিটি কাজের মধ্যেই শিল্পীর আনন্দময়তার প্রকাশ!

এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ওই পঞ্চাশটি আলাদা কিন্তু একত্রিত মূর্তির আকর্ষক উপস্থিতি। তার পিছনে একটি পঁচিশ ফুট লম্বা আলোকচিত্র প্রদর্শনীর শোভা বর্ধন করছে বেশ কিছুটা। প্রবুদ্ধ দাশগুপ্তর উন্নত লেন্সে ধরে রাখা ছবিগুলি ভাল লাগল। আকর্ষক এই প্রদর্শনীটি না দেখলেই নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement