নৃত্য পরিবেশনে শিল্পীবৃন্দ।
সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর কালচারাল রিলেশন-এর (আইসিসিআর) সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে প্রজ্ঞাদ্যুতি ওড়িশি নৃত্যবাসা-র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল ‘স্বয়ংধ্বনি’— ওড়িশি নৃত্য পরম্পরার এক মনোজ্ঞ প্রদর্শন। নৃত্য নিবেদনে ছিলেন গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী রতিকান্ত মহাপাত্র, অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব ভট্টাচার্য, সায়মিতা দাশগুপ্ত ও সায়মিতার দুই শিষ্যা প্রিয়াঙ্কা চট্টোপাধ্যায় ও অদ্রিকা ঘোষ। কলকাতায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ওড়িশি নৃত্যের ওয়ার্কশপ শুরু করেন সত্তরের দশকে। তারও আগে কেলুচরণের সুযোগ্যা শিষ্যা সংযুক্তা পাণিগ্রাহীর নৃত্য নিবেদন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কলকাতার নৃত্যশিল্পী ও দর্শক মহলের। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজটি তিনিই সেরে রেখেছিলেন। ফলে সত্তরের দশকে এ শহরের শিল্পীরা কলকাতার ওয়ার্কশপে ও পরে গুরুগৃহে কেলুচরণের তত্ত্বাবধানে যে নৃত্যচর্চা শুরু করেন, তাঁদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে দিয়েছিল সংযুক্তার নাচ ও তাঁর স্বামী রঘুনাথ পাণিগ্রাহীর অবিস্মরণীয় সঙ্গীত। নিরলস নৃত্যচর্চার সেই ধারা অনুসরণ করে পরবর্তী প্রজন্ম যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সায়মিতা দাশগুপ্তের ‘প্রজ্ঞাদ্যুতি— এক ওড়িশি নৃত্যবাসা’ সেই মানচিত্রে ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সায়মিতা এক সময়ে কেলুচরণের কাছে নৃত্যশিক্ষা লাভ করেছেন। এখন কেলুচরণের সুযোগ্য পুত্র রতিকান্ত মহাপাত্রের শিষ্যা।
অনুষ্ঠানের সূচনায় জগন্নাথের চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন রাজীব, অর্ণব, রতিকান্ত, সায়মিতা, প্রিয়াঙ্কা ও অদ্রিকা। এর পর রতিকান্তের রামবন্দনা— অন্তরামা। নৃত্য পরিকল্পনা রতিকান্তের, সঙ্গীত পরিকল্পনা রূপককুমার পারিধার। পরবর্তী নিবেদন প্রিয়াঙ্কা ও অদ্রিকার গুরুবন্দনা। নৃত্য পরিকল্পনায় রতিকান্ত, সঙ্গীত পরিকল্পনায় এস বিঘ্নরাজা। নিবেদিত হল পটদীপ পল্লবী। পরিকল্পনায় রতিকান্ত, সঙ্গীত পরিকল্পনা প্রদীপকুমার দাসের। এর পর একে একে কেলুচরণ মহাপাত্রের শিষ্য রাজীব (কল্যাণপল্লবী ও অষ্টপদী), অর্ণব (অর্ধনারীশ্বর) ও সায়মিতার নৃত্য নিবেদন (নবদুর্গা)। ভুবনেশ্বর মিশ্রের সঙ্গীত পরিচালনা ও কেলুচরণের নৃত্য পরিকল্পনায় রাজীবের ‘প্রিয় চারুশীলে’ পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। অর্ণবের ‘অর্ধনারীশ্বর’ও উপভোগ্য হয়েছিল। সায়মিতার ‘নবদুর্গা’র পরিকল্পনা রতিকান্তের। সেখানেও আমরা শ্রদ্ধেয় গুরু কেলুচরণের পরম্পরাকেই প্রত্যক্ষ করি (সঙ্গীত পরিকল্পনা হরিহর পাণ্ডা)। সে দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল চূড়ামণি প্রদান— কেলুচরণের পরিকল্পনায়। রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে অশোকবনে হনুমানকে সীতার চিহ্নস্বরূপ সিঁথির চূড়ামণি দানের কথা বর্ণিত হয়েছে এই নাটিকায়। দর্শক এক সময়ে হনুমানের ভূমিকায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ও সীতার ভূমিকায় সংযুক্তা পাণিগ্রাহীকে দেখেছেন। শুনেছেন অবিস্মরণীয় কণ্ঠে রঘুনাথ পানিগ্রাহীর সঙ্গীতবিন্যাস। সে দিন এই ঐতিহাসিক রেকর্ডিংকে দর্শক আবার শুনলেন, রতিকান্ত (হনুমান) ও সায়মিতার (সীতা) নাচের সঙ্গে, যে নৃত্যের পরিকল্পনায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র। এ ভাবেই সহযোগী সঙ্গীতের বর্তমান ও অতীতকেও প্রত্যক্ষ করলেন দর্শক। মর্দালায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ও রতিকান্ত, কণ্ঠসঙ্গীতে ড. বিজয়কুমার জেনা, রূপক পারিধা ও সত্যব্রত কথা, ভায়োলিনে সুরমণি রমেশচন্দ্র দাস ও অগ্নিমিত্র বেহেরা, বাঁশিতে নিত্যানন্দ মহাপাত্র ও শ্রীনিবাস সৎপতি, সেতারে রবিশঙ্কর প্রধান, কী বোর্ডে শরৎকুমার রথ ও বিভুপ্রসাদ ত্রিপাঠী। বেঁচে থাক ওড়িশি নৃত্যধারার পরম্পরা।