বৈঠকী’র বয়স মাত্র এক। ইতিমধ্যেই উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও। সম্প্রতি কামারহাটি নজরুলমঞ্চে সংস্থার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে তার প্রমাণ মিলল। শুরুতেই ছিল সংগঠনের শিল্পিবৃন্দের সমবেত সঙ্গীত সরস্বতী বন্দনা। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল শিশু শিল্পী। এর পর শিল্পী মেঘদীপা গঙ্গোপাধ্যায় খেয়াল পরিবেশন করলেন। তাঁর নিবেদনে ছিল রাগ বেহাগ এবং কাজরি। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। মেঘদীপা’র সুমিষ্ট কণ্ঠের সুর মূর্ছনা এবং ওই পরিবেশ মিলেমিশে এক অন্য আবহ সৃষ্টি করেছিল। যা শ্রোতাদের কাছে বাড়তি পাওনা। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করলেন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হারমোনিয়ামে জ্যোতির্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পর শিল্পী অঞ্জন কান্তি চক্রবর্তী সেতার পরিবেশন করলেন রাজেশ্বরী রাগে। শ্রুতিমধুর নিবেদন। তবলায় সঙ্গত করলেন তুষার কান্তি রায়। পরবর্তী নিবেদন ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার জনপ্রিয় প্রবীণ শিল্পী সঙ্গীতাচার্য অমিয় রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। শিল্পী খেয়াল পরিবেশন করলেন। তবলায় ছিলেন সমর সাহা। বয়সের ভার শিল্পীকে শারীরিকভাবে কাবু করলেও চর্চিত কণ্ঠে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি, তা বেশ বোঝা গেল। এ দিনের অনুষ্ঠানের শেষ নিবেদন ছিল সেতার-সরোদ—এর যুগলবন্দি। সেতারে ছিলেন সোহিনী চক্রবর্তী এবং সরোদে সৃঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। দুই শিল্পীর পরিবেশনে ছিল রাগ কিরওয়ানী। এই পরিবেশন প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁদের তবলায় যোগ্য সঙ্গত করলেন জিষ্ণু চৌধুরী এবং গৌরব চক্রবর্তী।
পিয়ালী দাস
গানে গানে তব
সম্প্রতি মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠিত হল স্মার্ত মজুমদারের একক অনুষ্ঠান। সুরেলা কণ্ঠে নিজস্বতা বজায় রেখে পরিবেশন করলেন প্রথম পর্বে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও পরে আধুনিক। প্রথম গান ‘গানে গানে তব’। পরের গানগুলি ছিল ‘আমি যে গান গাই, জানি তোমার অজানা নাহি গো’, ‘এ কি লাবণ্যে পুণ্য প্রাণ’, ‘নীল অঞ্জন ঘন কুঞ্জ ছায়ায়’, ‘এসেছিলে তবু আস নাই’, ‘আবার এসেছে আষাঢ়’। সাবলীল গায়কি। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বেও ছিল ১০টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ শিরোনামে। সব শেষে তিনি গাইলেন ‘নচিকেতা’রও কয়েকটি বাংলা গান। খোকন, খরচ, পাতা ঝরা মরসুমে, এই বৈশাখী হাওয়া প্রভৃতি। ‘স্বপ্নসম’ গানটিতে শিল্পীর সঙ্গে হারমোনিয়ামে সংগত করলেন নচিকেতাও। আয়োজক নবরবিকিরণ।
আলোর পথযাত্রী
অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে মানবজাতীর অবিরাম যাত্রা তাকে নিয়ে চলে উত্তরণের পথে। বনানী চক্রবর্তী ও মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের এই ভাবনাকে উপজীব্য করে সম্প্রতি কলামন্দিরে পরিবেশিত হয় শতাব্দী আচার্য পরিচালিত মিত্রায়নের নবতম নৃত্যালেখ্য ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’। সৃষ্টির আদি যুগ থেকে একটু একটু করে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে ক্ষমতার মদমত্ততা গ্রাস করে মানবজগৎকে। সে মেতে ওঠে হিরোশিমা ও নাগাসাকির মতো ধ্বংসের খেলায়। এই সময় অন্তরাত্মার আলোই তাকে দিশা দেখায়, যা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শঙ্খচিল’ ও সলিল চৌধুরী রচিত ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানদুটির যথাযথ প্রয়োগে ও শতাব্দীর সুন্দর নৃত্যবিন্যাসের মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারু রূপে বর্ণিত হয়। এছাড়া পৃথিবীর সৃষ্টি, আগুনের আবিষ্কার, কৃষিকাজ ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রার দৃশ্যগুলি সূর্যপ্রণাম, ‘প্রথম আদি তব শক্তি’, ‘ওরে আগুন আমার ভাই’, ‘মাটি তোদের ডাক দিয়েছে’ গানগুলির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অনুষ্ঠানটিতে সহকারী নৃত্যশিল্পী রূপে সহযোগিতা করে বিক্রমশিলা ও গৌড়ীয় নৃত্যভারতীর শিক্ষার্থীরা। শঙ্খচিলের ভূমিকায় অয়ন মুখোপাধ্যায়ের নৃত্য দর্শকদের মুগ্ধ করে।
চৈতী ঘোষ
অভিসারে রাধা
সম্প্রতি শ্রুতিনিকেতন আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরু নৃত্য-গীতি আলেখ্যর মাধ্যমে। পরে ছিল ময়ূখ গোষ্ঠীর সম্মেলক গান। অলোক রায়চৌধুরীর গান ‘আমি কান পেতে রই’ অনুষ্ঠানে অন্য মাত্রা এনে দেয়। এ ছাড়াও গান শোনালেন দেবারতি সোম ‘হৃদয় আমার’। তনুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’, পূবালি দেবনাথ ‘ভালবেসে সখী’, সুছন্দা ঘোষ ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।
প্রকৃতির নানা রূপের বৈচিত্র গানের মধ্যে ধরে রাখলেন তানিয়া দাশ, অনিন্দ্য নারায়ণ বিশ্বাস, স্বপন সোম ও অদিতি গুপ্ত। অনুষ্ঠানের শেষে ছিল নৃত্য-গীতি-আলেখ্য ‘শ্রীরাধার অভিসার’। শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় কথাকলি, নৃত্যে দীপ্তাংশু পাল এবং শ্রীরাধার ভূমিকায় গার্গী নিয়োগী মানানসই। গানে ছিলেন তনুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঠে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তপশ্রী গণ।
দুঃসময়ে নালন্দা
বহুরূপীর ‘কথা নালন্দা’ দেখে লিখছেন মনসিজ মজুমদার
অতীতে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির নিদারুণ দুঃসময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় লুঠ ও ধ্বংস করে তুর্কী ফৌজ। বহুরূপীর নতুন নাটক ‘কথা নালন্দা’র (রচনা: কাজল চক্রবর্তী) নাটকীয় কাহিনির কেন্দ্রে এই ধ্বংসলীলার নায়ক বখতিয়ার খিলজি। বৌদ্ধবিহারের ধনসম্পত্তি ছাড়া লুটের লক্ষ্য ছিল বৌদ্ধবিহারে আশ্রিতা এক ইহুদী নারী যাকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা জীবন দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। এমন কাহিনির যে নাটকীয়তা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন পরিচালক দেবেশ রায়চৌধুরী। আবার নিষ্ঠুর অত্যাচারী নারীলোলুপ নায়ক বখতিয়ারের ভূমিকায় তাঁর মঞ্চ-কাঁপানো অভিনয় প্রযোজনার অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু বিধর্মী বহিঃশত্রুর আক্রমণে নালন্দা ধুলিসাৎ হল এমন ঘটনা যতই আকর্ষণীয় হোক এই নাটকের মূল বিষয় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ী অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব বিধর্মী হিংসার সঙ্গে বৌদ্ধ অহিংসার নয়, কিন্তু তার চেয়েও বিপর্যয়ী। মূল বৌদ্ধ আদর্শ আক্রান্ত সদ্যোদ্ভূত তান্ত্রিক বৌদ্ধদের বিকৃত আচার-আচরণে। শক্তি-সাধনার নামে নারী-আসক্ত এই বৌদ্ধরা গ্রামের বালিকাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করায় গ্রামবাসী সংঘের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানায়। নাটকের শুরুতেই আচার্য বসুসঙ্গ (সুমন মুখোপাধ্যায়) ও সংঘাধ্যক্ষ শিরভদ্রের (প্রবাল মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধ আচার্য বিকৃতিদেবের (মনোজ গঙ্গোপাধ্যায়) এই আদর্শগত তর্ক-দ্বন্দ্বে নাটকীয় টেনশনের সূচনা হয়। উদ্বেগক্লিষ্ট সনাতনপন্থীদের সৌম্য ব্যক্তিত্বের পাশে খলনায়ক সংস্কারবাদী তান্ত্রিক ভ্রষ্টাচারীর ধৃষ্টতায় সংঘ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট আর নালন্দার আদর্শগত বিপর্যয়ের অনিবার্য প্রতীকী পরিণতি।
তিরিশ জন কুশীলবের এই প্রযোজনায় প্রতিটি দৃশ্যের নিখুঁত নির্মাণ, নাটকীয় পরিস্থিতির স্বচ্ছতায় ও অভিনয়ের সার্বিক সুষ্ঠুতায় নাটকটি অর্জন করে এক স্বচ্ছন্দ গতিময়তা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকমন মজে থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্যে। কিন্তু কেন এই সময়ে এই নাটক? এমন প্রশ্ন কারও মনেও আসে না। নাটক শুরুর আগে একটি ঘোষণায় বলা হয় ইদানীং নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতি তার প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে নাটকটিতেও। সে-কথাও কারও মনে পড়ে না নাটক দেখার সময়ে।
তুমি যে সুরের আগুন
শিশির মঞ্চে দেবব্রত বিশ্বাস স্মরণ কমিটি আয়োজিত কবিপ্রণাম অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনার দিক থেকে একেবারেই গতানুগতিক। সংস্থার সভাপতি তুষার তালুকদারের স্মৃতিচারণে উঠে এল দেবব্রতর গান নিয়ে সেই বহুচর্চিত শান্তিনিকেতনী আপত্তির কথা— সঙ্গে পুরনো কিছু অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ। এই উপলক্ষে দেবব্রত বিশ্বাস ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈত কণ্ঠে গীত ‘আমরা আছি কাছাকাছি’ শীর্ষক একটি সিডি প্রকাশ করে প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন তিনি। শিঞ্জন কলাতীর্থের দুই কিশোরীর শিক্ষার্থী সুলভ নৃত্য প্রদর্শন অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে পারেনি। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সত্যকাম সেনের পরিচালনায় ‘সোহিনী’র শিল্পিবৃন্দ পরিবেশিত সম্মেলক গানের মাধ্যমে যেগুলি সুমহড়া যুক্ত।
একক গানের আসরে রাজশ্রী ভট্টাচার্যের তিনটি গানই ছিল পূজা পর্যায়ের। তাঁর গলার মধুর গাম্ভীর্য রবীন্দ্রনাথের যে কোনও গানের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। তার প্রমাণ ‘ও অকূলের কূল’ গানটি। ‘আমার মাঝে’ গানটি শোনাও ছিল এক স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা। শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়ের গানও অনেক দিন পরে শোনা গেল। সত্যকাম সেন ‘তুমি যে সুরের আগুন’ দিয়ে শুরু করলেন ভালই। দ্বিতীয় গান ‘যারা কথা দিয়ে’ লয় নির্বাচন সঠিক ছিল না। দেবাশিস রায়চৌধুরী ও রোহিণী রায়চৌধুরী একসঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। দেবাশিস এর গায়নে সহজিয়া ভাবটি রয়েছে বলে ভাল লাগে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানটি। রোহিণীর গায়নে আনন্দ আছে কিন্তু ভীষণ উচু স্কেলে গান করায় ‘আমি চঞ্চল হে’র তারসপ্তকে কিছুটা চিৎকৃত বলে মনে হয়। অনাবশ্যক কথা বলে সময় অতিবাহিত করলেন বাংলাদেশের বাচিক শিল্পী বিধানচন্দ্র পাল। উচ্চারণ পরিষ্কার হলেও অকারণ আবেগে ভেসে যান।
বারীন মজুমদার