(১)
পাথুরে ভাঙাচোরা রাস্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলাম আমি আর কিষণ। কিছু করার নেই। কারণ, প্রায় মিনিট কুড়ি আগে আমাদের মোটরবাইকের পিছনের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছে— পাহাড়ের কোলে এক জনমানবহীন এলাকায়।
(২)
রাংরিক গ্রামের কাছে হিমাচলপ্রদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের অতিথিশালায় গত বছর সেপ্টেম্বরের এক সকালে যখন ঘুম ভেঙেছিল, তখন সূর্যের আলোর ছটায় হাসছে স্পিতি উপত্যকা। পিন-ভাবা পাস ট্রেকিং সেরে তার আগের রাতেই পৌঁছেছিলাম ওই উপত্যকার ছোট্ট শহর কাজ়ায়। রাতে শহরে না থেকে চলে গিয়েছিলাম কয়েক কিলোমিটার দূরের রাংরিক গ্রামে।
সকাল ৭টার মধ্যে তৈরি হয়ে রাংরিক থেকে কাজ়ায় ফিরে গিয়েছিলাম। ওখানে ট্রেকিংয়ের দলের সঙ্গী কিষণকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হাজির হয়েছিলাম মোটরবাইক ভাড়া করার দোকানে। কোথায় ঘুরব, তা আগে থেকে ঠিক ছিল না। একটা বাইক ভাড়া করে চায়ের দোকানে বসে দু’জনে ঠিক করি, কাজ়ার আশেপাশের গ্রাম আর গুম্ফাগুলি দেখে নেব।
আমাদের তালিকায় প্রথমে ছিল হিক্কিম গ্রাম। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত ডাকঘর ওখানেই রয়েছে। তার পর সেখান থেকে যাব কমিক গ্রামের গুম্ফা দেখতে। কমিক বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম, যেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। এর পরে ল্যাংজা, কিব্বের দেখে শহরে ফেরার পথে কিই গুম্ফায় ঢুঁ মারা।
কিব্বের
কাজ়া থেকে হিক্কিম প্রায় ১৬ কিলোমিটারের রাস্তা। রওনা হওয়ার আগে আরও দুই পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। সকলে মিলে সাড়ে
৮টা নাগাদ রওনা দিয়েছিলাম হিক্কিমের উদ্দেশে।
(৩)
কাজ়া শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বেশ ভাল। কিন্তু তার পরেই শুরু ভাঙচোরা পাথুরে পথ। পাকদণ্ডীর মতো রাস্তা উপরে উঠে গেছে। এক পাশে গভীর খাদ, সেখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে স্পিতি নদী। অন্য দিকে উঠে গিয়েছে খাড়া পাহাড়। বাইক চালাতে ভয় হচ্ছিল ঠিকই। তবে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে কাজ়া আর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখে সেই ভয় কেটে গিয়েছিল নিমেষে। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা কিষণের মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল, ‘‘ভাই, ইয়াহা পে বাইক অ্যক্সিডেন্ট পে মরনে পর ভি সুখ হ্যায়।’’ ঘুরতে বেরিয়ে এ কী অলক্ষুণে কথা! কিষণের মাথায় সপাটে একটা চাঁটি বসিয়ে দিয়েছিলাম।
কিই গুম্ফা
(৪)
সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম হিক্কিম গ্রামে। তবে গ্রাম বললে ভুল হবে, মেরেকেটে ১০-১৫টি পরিবার থাকে ওখানে। গাড়ি রেখে নীচে কিছুটা হেঁটে যেতে হয় ডাকঘরে। আর পাঁচটা ডাকঘরের থেকে এটা একদম আলাদা। বাড়ির মাথায় রাখা শুকনো ঘাসের বড় বড় বান্ডিল। জুতো খুলে আলো-আঁধারি ঘরের মধ্যে ঢুকেই গল্প জমানো যায় পোস্টমাস্টারের সঙ্গে। গল্প বলতে তিনি ওস্তাদ। আর গল্পের মাঝেই চাইলে ডাকঘর থেকে পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দিতে পারেন বাড়ির ঠিকানায়।
হিক্কিম থেকে কমিকের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কিছু পরেই আমার আর কিষণের মাথায় হাত। গাড়ির পিছনের চাকা পাংচার! সঙ্গের অন্য দু’জন অনেক আগেই চলে গিয়েছে। মোবাইলের নেটওয়র্কও কাজ করছে না যে, ওদের ডেকে আনব। ফলে প্রায় জনমানবহীন এলাকায় আমরা সে দিন আধ ঘণ্টারও বেশি আটকে ছিলাম। পরে অন্য এক পর্যটক দলের সাহায্যে ওই পাংচার হওয়া বাইক নিয়ে কাজ়া ফিরতে হয়েছিল আমাদের।
(৫)
প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় নষ্ট হয়েছিল সে দিন। তবে কাজ়া থেকে নতুন বাইক ভাড়া করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়েছিলাম। একে একে গিয়েছিলাম কিই গুম্ফা, কিব্বের গ্রামে। কাজ়া শহর থেকে বেরোলেই উঁচু টিলার উপরে অবস্থিত কিই গুম্ফা দেখা যায়। আর গুম্ফার ছাদ থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যায়, তাতে সেখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হলেও অবাক হবেন না। কিব্বের গ্রামে তেমন কোনও দ্রষ্টব্য নেই। কিন্তু গ্রামের ছোট্ট কফিশপে বসে গরম কফি খেতে খেতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যেতেই পারে।
সময়ের অভাবে আমাদের সে দিন বাদ দিতে হয়েছিল কমিক গ্রামের গুম্ফা আর ল্যাংজার বৌদ্ধমূর্তি দেখা। আফসোস হয়েছিল খুব। তবে সন্ধ্যায় কাজ়া ফিরেই হাজির হয়েছিলাম স্থানীয় স্কুলের মাঠে। সেখানে তখন চলছিল ‘স্পিতি উৎসব’। দিনের শেষটা কেটেছিল স্পিতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে। আর তা দেখেই কমিক, ল্যাংজা যেতে না পারার আফসোসটাই কেটে গিয়েছিল নিমেষে।
মনে রাখবেন
• কোনও পর্যটক চাইলেই এক দিনে হিক্কিম, কমিক, কিব্বের আর কিই গুম্ফা ঘুরে ফেলতে পারেন। আর এক দিন যেতে পারেন টাবো, ধাঙ্কার, নাকো গুম্ফা দেখতে।
• কাজ়া শহরে বিএসএনএল ছাড়া অন্য কোনও নেটওয়র্ক কাজ করে না।
• দিনে-রাতে কাজ়ায় ভালই লোডশেডিং হয়। টর্চ বা অন্য কোনও ব্যাটারিচালিত আলো কাছে রাখা ভাল।
কোথায় থাকবেন
• কাজায় অনেক হোটেল এবং হোম স্টে রয়েছে। ঘরের ভাড়া ৫০০-১৫০০ টাকার মধ্যেই।
• ব্যাকপ্যাকারদের জন্য রয়েছে হস্টেল চেন।
কী ভাবে যাবেন
• গাড়িতে সিমলা থেকে কল্পা-টাবো হয়ে কাজ়া পৌঁছনো যায়।
• মানালি থেকে রোটাং পাস এবং কুনজুম পাস পেরিয়ে কাজ়া যাওয়া যায়।