বিষণ্ণ এক অক্ষরপুরুষ

তাঁর পায়ে পায়ে অপমান, অপূর্ণ প্রেম, মায়াময় দাম্পত্য, সাহিত্যের আড়ালে কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্রর বহুরঙা জীবনের খোঁজ দিলেন পুত্র অভিজিৎ মিত্র।তাঁর পায়ে পায়ে অপমান, অপূর্ণ প্রেম, মায়াময় দাম্পত্য, সাহিত্যের আড়ালে কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্রর বহুরঙা জীবনের খোঁজ দিলেন পুত্র অভিজিৎ মিত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭ ১২:৪০
Share:

প্রশান্তির এক দেহ শায়িত। মনে আছে ঠাকুমার আবেগের স্বর। ‘‘মা হারালি রে’’।

Advertisement

বিকেলের ছেঁড়া ছেঁড়া আলো। বিরাজবালার নিথর মুখ দেখে চার বছরের নরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ওই মুখেই যেন সকাল হচ্ছে…

তিনি তখন পালিকা মা জগৎমোহিনীর কোলে। মৃত্যুশয্যায় মাকে চেনার কান্নাচাপা স্মৃতি এত তীব্র ছিল যে, সারা জীবন আমার বাবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র খুঁজে গেলেন তাঁর মাকে। বাবা লিখেছিলেন,

Advertisement

‘বাল্য কৈশোর পার হয়ে প্রথম যৌবনে, যখন মা নয়, নারীর মধ্যে মনোরমাদের আমি দেখতে পাচ্ছি তখন আমার খেয়াল হয়েছিল আমার মা কেমন দেখতে ছিলেন সে কথা জানবার।’

মায়ের গন্ধ খোঁজা চলল আমৃত্যু। সেই গন্ধ থেকেই বিষণ্ণতা।

বাবার লেখা ফিরে দেখলে টের পাই, ‘চেনা মহল’ উপন্যাসের চরিত্র অরুণ, করবীর কাছে চিঠি লিখছে। প্রেয়সীর কাছে প্রথম প্রেমপত্র, কিন্তু সেখানেও মায়ের কথা।লিখছে, ‘‘মাকে যে প্যশনেটলি ভালবাসতে পারে না, সে আর কোনও মেয়েকেও পারে না। কোনও মেয়েকে তীব্র ভাবে ভালবাসতে হলে গানের ধুয়োর মতো বার বার মার কাছে ফিরে আসতে হয়।’’

ভাবতে অদ্ভুত লাগে, আমার বাবাই কিন্তু তাঁর হারিয়ে যাওয়া মা বিরাজবালাকে মৃত্যুর পরে সৃষ্টি করেছিলেন। অথচ বিরাজের গর্ভেই তো আমার বাবার জন্ম!

না বলা প্রেম

বাবার মধ্যে দেখেছি অতৃপ্তি।

যার ভাণ্ডার যেন ভরে ভরে উঠত।

যে অঞ্চলে বাবা যখন বাস করেছেন তখন তার আশপাশ নিয়ে বরাবর কলম চালিয়েছেন। এ রকমই এক জায়গা বউবাজারের দ্বিতল মাঠকোঠা।সেখানে উনিশ বছরের নরেন্দ্রনাথ রাধাকে পড়াতেন। রাধার পড়াশোনার দিকে ঝোঁক ছিল না। কিন্তু বাবা যখন লিখতেন তখন তিনি বুঝতেন, এ লেখা কলেজি লেখা নয়, এটা একটা বিশেষ গুণ! বউবাজারের বাড়িতেই ফস ফস করে বেরিয়ে এল সেই ‘বিশেষ গুণ’।বাবার প্রথম ছাপা লেখা। কবিতার নাম ‘মূক’। দেশ। শ্রাবণ ১৩৪৩। তার পর মাঠকোঠায় একের পর এক লেখা। কিন্তু এই মাঠকোঠা শুধুই লেখার নিরিখে নয়, মৃত্যুর বছরেও রক্তিম স্মৃতি হয়ে বাবার নৈঃশব্দ্যে ছন্দ নিয়ে এসেছিল। বাবা থেকে থেকেই ওই সময়ে ফিরে যেতেন। কিন্তু কেন? সেটা জানতে হলে বাবার গল্পে ঝুঁকতে হবে। ওটাই একমাত্র পথ। মাঠকোঠার সূত্রেই ‘পরোক্ষ’ গল্পে যেমন বাবা নিয়ে এলেন দেবব্রত-পারুলের না বলা প্রেম। আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ১৩ এপ্রিল ১৯৪১ এই গল্প প্রকাশিত হয়। বাবার প্রথম দিকের গল্প, কবিতায় প্রথম প্রেম নিদারুণ ঝরে পড়ল।

‘তোমাকে বাসি ভাল একথা ক্ষণে ক্ষণে/ বলিব তোমা ভাবি সদাই মনে মনে/ বলিতে যবে যাই কথা না খুঁজে পাই/ হতাশ হয়ে ফিরি আপন গৃহকোণে’। ‘মূক’ নামের মোট ষোলো লাইনের এই কবিতাটি প্রকাশ পেল দেশ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায়।

কবির নাম নরেন্দ্রনাথ মিত্র।

হ্যাঁ, কাহিনিকার নরেন্দ্রনাথের এত তো পাঠক, কিন্তু ক’জনই বা জানেন তাঁর কবিতার কথা? অথচ প্রায় টানা কুড়ি বছর ধরে কবিতা লিখেছেন তিনি।

বুদ্ধদেব বসু আর কবি নরেন্দ্রনাথ

‘নিরিবিলি’ নামে নিজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন নরেন্দ্রনাথ। আর সেই বই নিয়ে লিখলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু।

‘কবিতা’ পত্রিকায় কী লিখলেন বুদ্ধদেব?

‘‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের পাঠকসংখ্যা আজ বিপুল, কিন্তু এ-বইখানা পড়ে (বা দেখে) আজকের দিনে কম পাঠকেরই সন্দেহ হবে যে এর প্রণেতা ও তঁাদের প্রিয় কথাশিল্পী একই ব্যক্তি।’’

প্রথম থেকেই নরেন্দ্রনাথকে কবিতা লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকায় অনেক কবিতা ছাপিয়েছিলেন তিনি।

তবুও বাবা ছিলেন এক বিষণ্ণ কবি। মনকেমন বাবার সর্বক্ষণের সঙ্গী। শুধু জীবনে নয়। সাহিত্যেও। বাবার ডায়েরি ভর্তি দুঃখ। দুঃখের কথা না লিখতে পারার দুঃখ ।

কোনও দিনই কোনও কিছুতেই মুখ খোলেননি আমার কান্না চাপা বাবা।সেও বোধহয় তাঁর মা বিরাজের স্বভাব!

ডায়েরি থেকেই জেনেছি তাঁর মনকেমনের কথা।

গাছেরও খান, তলারও কুড়োন

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। সুবোধ ঘোষের বড় ছেলের জন্মদিনে বাবা গিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ পেয়ে। তার কিছু দিন পরই আনন্দবাজার পত্রিকার লিফটে সুবোধ ঘোষের সঙ্গে দেখা। ও মা! সুবোধ ঘোষ চিনতেই পারলেন না বাবাকে। কষ্ট পেলেন বাবা।

কাউকেই কিছু বললেন না। কিন্তু ডায়েরিতে লিখলেন, সুবোধ ঘোষ নিশ্চয় কোনও কারণে সমস্যায় আছেন, তাই এই ব্যবহার! বাবা যে বন্ধুদের সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিলেন তাঁরা বাবার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ খুব একটা করেননি। বাবা রাগ, দুঃখ, অভিমান, অসুখ কিছুই মুখে আনতেন না। মুখে যা আসত, তা কেবল নিজের অক্ষরমালার অনুরণন। কোনও কালেই নিঃশব্দে লিখতে পারতেন না নরেন্দ্রনাথ। লেখার সময় মুখে বলে বলে লিখতেন। আজ বুঝি, গদ্যের মধ্যেও যে ছন্দ আছে সেটা মনে করতেন বলেই বাবা মুখে শব্দ আওড়াতেন।

নারায়ণ চৌধুরির সঙ্গে বাবার সখ্য ছিল। উনি প্রাবন্ধিক। বাবা গল্পও লিখেছিলেন ওঁকে নিয়ে। ‘দর্পণ’ বলে একটি পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করলেন নারান কাকা। সেখানে লিখলেন, ‘নরেন্দ্রনাথ মিত্র গাছেরও খান, তলারও কুড়োন।’ হয়তো প্রচারের জন্যই এই মন্তব্য করেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর সেটা নিয়ে আমার কাছে খুব আফসোসও করেছিলেন। কিন্তু বাবা কিছুই বলেননি। আমাদের লিনটন স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ম করে পঁচিশে বৈশাখে আসতেন নারান কাকা। মা গান গাইতেন। কী দারুণ সব সময় ছিল! রাজনীতি যে মানুষকে কতটা স্বার্থকেন্দ্রিক করে তোলে! নারায়ণ চৌধুরী এই সব লেখার মাধ্যমে বামপন্থী মহলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। আর আমার বাবা কী করলেন? নারান কাকার শরীর খারাপ হল তো বাবা দেখতে চলে গেলেন। বাবা লেফট-রাইট কিছুই ছিলেন না। সে কারণেও তাঁর বিশেষ কিছু নামডাক জুটল না। কোনও দিনই বামপন্থীরা বাবাকে লেখক হিসেবে গ্রহণ করেননি।

েমানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যের জন্য যদিও আমার বাবা এগিয়ে এসেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যার্থে বরানগরে একটি দল তৈরি হয়েছিল, সেই দলকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার বাবাই। এমনকী আমি ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যর কাছে শুনেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর শ্মশানে সাহিত্যিক হিসেবে একমাত্র আমার বাবাই উপস্থিত ছিলেন। কোথাও অপমানিত হলেও বাবা এ সব নিয়ে আলোচনা করতেন না। আমরাও বাবার সামনে বাবার বন্ধু মারফত পাওয়া অপমান নিয়ে কিছু বলতে পারতাম না।

পোস্টম্যানকে সাহিত্য পড়ালেন

পরে বুঝেছি, এই মানুষগুলোর জন্য বাবার হদয় কাঁপত, তাই তিনি যোগাযোগ রেখে গেছেন। গ্রামের ছেলে তো, উদারতাটা ওখান থেকেই এসেছিল। ছোটবেলায় শুনেছি নমঃশূদ্রদের পাড়ায়, জেলেদের অঞ্চলে বাবা চলে যেতেন। ওঁদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। বরং নামী ব্যক্তির সঙ্গ এড়িয়ে চলতেন বাবা।

খুব যে বাইরে ঘুরেছেন এমনও নয়, অন্দরের মানুষ, আশপাশের মানুষ ছিলেন বাবার গল্পের লোকজন। এক পোস্টম্যান আসতেন বাবার কাছে। তাঁর অসম্ভব সাহিত্যপ্রীতি, সেই দেখে বাবা তাঁকে সাহিত্য পাঠে উৎসাহ দিতেন।একজন চর্মকার ছিলেন বাবার খুব প্রিয়। এমন অনেক দিন হয়েছে বাবা পাশে বসে ওঁর জীবনের নানা গল্প শুনেছেন।

বাবার মেডেল মা বিক্রি করলেন

তবে না পাওয়া নিয়ে একেবারেই যে বাবার ক্ষোভ ছিল না, তা নয়। শেষের দিকের রচনা, ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ গল্পে এই বিষয়টা বোঝা যাবে। গল্পে মুখ্য চরিত্র রাতে এক পুরস্কার অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘আমি তো কোনও দিন প্রথম হইনি। পুরস্কারও পাইনি! না, ছোটবেলায় অবশ্য একটা সিল্ভার মেডেল পেয়েছিলাম।’ বাড়ি ফিরে তিনি ড্রয়ারে সেই মেডেল যখন খুঁজছেন স্ত্রী এসে বলছেন ওটা গলিয়ে নাতনির পায়ের মল কেনা হয়েছে। এটা সত্যি ঘটনা। স্ত্রী হচ্ছে আমার মা। সে দিন বাবাকে খুব অসহায় লেগেছিল।

ফাউল কাটলেট আর গ্যারি কুপার

মজার গল্পও আছে।

একই ঘরের মধ্যে দুই উঠতি সাহিত্যিক গল্প লিখছেন। ঘরে চেয়ার-টেবিলের কোনও বালাই নেই। দুজনেই যে যার তক্তপোশে।

একজন উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কলম চালাচ্ছেন, আর অন্যজন বাবু হয়ে বসে সামনে টিনের বাক্স রেখে তার ওপর খাতা রেখে লিখছেন। প্রথম জন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় জন নরেন্দ্রনাথ। তখন শোভাবাজারের এক মেসে একটি ঘরে পাঁচ জন। নরেন্দ্রনাথ, ভাই ধীরেন্দ্রনাথ, বন্ধু নারায়ণ আর বাকি দুই বোর্ডার গেঞ্জিকলের শ্রমিক। মাথাপিছু মাসিক ভাড়া দু’ টাকা।

কিছু দিন আগেই ভাইকে কলকাতার কলেজে পড়াবেন বলে নিয়ে এসেছেন। এ দিকে নিজের আয় বলতে মাত্র দুটি টিউশনির টাকা। নিজেরই চলে না। তবুও ভাইকে কিছুতেই মফস্‌সল কলেজে বি এ পড়াবেন না।— ‘‘তুই চলে আয়, কলকাতার কলেজে পড়বি। দায়িত্ব আমার,’’ বলে ভাইকে ডেকে নিলেন।

মেসে খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। টানাটানির সংসারে পাইস হোটেলে দু’আনায় দু’বেলা ডিমভাত খেয়ে দিনের পর দিন চলত। তবে নারায়ণ কিংবা নরেন্দ্র যারই গল্প লেখার টাকা যে দিন আসত, সে দিন এক এলাহি ব্যাপার। তিন জনে মিলে ‘রূপবাণী’ রেস্তোরঁায় ফাউল কাটলেট আর টকি শো হাউজে তিন আনার সিটে গ্যারি কুপারের ছবি।

তা ছাড়া মাঝেমধ্যেই ওই মেসের ঘরে বসত সাহিত্যের আসর। দুই লেখকেরই বন্ধুরা আসতেন। নীচের শ্যামসুন্দর কেবিন থেকে আসত এক পয়সা কাপের চা।

অনেক রাত অবধি চলত সাহিত্য নিয়ে ধুন্ধুমার চর্চা। তখন বেচারি ওই দু’জন গেঞ্জিকলের কর্মীর মুখগুলো শুধু দেখতে হয়। বেজার মুখে রাত কাবার করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকত না তাঁদের।

গল্পলেখক হিসেবে অল্পস্বল্প নাম হতে শুরু করেছে তখন। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’ পড়ে ‘দেশ’-এর দফতর থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন, ‘‘আপনার গল্প আমাদের ভাল লেগেছে। আপনি আরও গল্প পাঠান।’’

বিয়ে করতে চাননি

আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়-র সম্পাদক মন্মথনাথ সান্যালও প্রায় একই রকম চিঠি দিয়েছেন। উৎসাহে লিখে চলেছেন নরেন্দ্রনাথ।

ঠিক তখনই বাড়ি থেকে চাপ এল বিয়ে করতে হবে।

কান্নাকাটি অবস্থা নরেন্দ্রনাথের। কিছুতেই বিয়ে করবেন না। নিজেরই চলে না, বউকে খাওয়াবে কী?

কিন্তু শেষমেশ করতেই হল।

যদিও বউ রইল সদরদি ফরিদপুরে দেশের বাড়িতে আর বর কলকাতায়। ভাইয়ের সঙ্গে।

কিন্তু সে আর কত দিন?

বউ শোভনাকে নিয়ে কলকাতায় আসতেই হল এক সময়। তার আগেই দুই ছেলে হয়ে গেছে। এর পর চলতে লাগল একের পর এক বাসা বদল।

ছোটভাই ধীরেন্দ্রনাথও বিয়ে করে সস্ত্রীক দাদার সঙ্গে থাকে। কখনও বস্তিতে টালির ঘর, তো কখনও দেড়খানা কোঠাঘরে, সবাই মিলে।

সে ঘর আবার এমন ছোট যে, ছোট একটা খাট পাতলেও, একটা চেয়ার রাখারও জায়গা নেই।

একবার কিছু দিনের জন্য নিমতলার কাঠগুদামের কাঠের ঘরেও থাকতে হয়েছে। এমন দিনও গেছে, সকাল বিকেল দু’বেলা চাকরি করতে হয়েছে সংসারের খরচ মেটাতে।

তার মধ্যেও লেখা কিন্তু থামাননি।

তারাশঙ্করের জন্য সিগারেট খেলেন

সিগারেট নিয়ে একটা গল্প বলি। বাবা সিগারেট খেতেন না। কিন্তু ধরেছিলেন। তখন তিনি ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র। আই এ পড়েন। শুধু যে ধরেছিলেন তা-ই নয়, ধরিয়েওছিলেন সহপাঠী বন্ধু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে। নারায়ণ কাকা সেই যে ধরলেন আর ছাড়লেন না। বাবা ঠিক উল্টোটা করলেন। ধরলেন। ধরালেন। তার পর ছেড়ে দিলেন। বাবাকে আমি সিগারেট খেতে এক বারই দেখেছি। সে ছিল দোলের দিন। বছরটা ১৯৫৬ বোধ হয়। আমরা তখন পাইকপাড়ায় তিন বছরের পুরনো বাসিন্দা। পাইকপাড়া তখন শিল্পী সাহিত্যিকদের পাড়া। দোলে আবির খেলা। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে শোভাযাত্রা। আবার ধুয়ো উঠল তো ‘মন ওরে জয়হিন্দ বল’ বলে তারাশঙ্করের বাড়ি গিয়ে হাজির। পরনে সাদা ধুতি, সাদা গেঞ্জি তারাশঙ্কর বাইরে আমাদের দলকে রিসিভ করার জন্য হাজির। শোভাযাত্রা শেষ হতেই কোলাকুলি আর রসগোল্লা। তার সঙ্গে বিকেলের নেমন্তন্ন। একতলার বড় ঘরে শতরঞ্চি পেতে দোলের সান্ধ্য গান। সঙ্গে কবজি ডুবিয়ে লুচি, পাঁঠার মাংস। সজনীকান্ত আর তারাশঙ্কর পাশাপাশি। তাঁদের ঘিরে আর সকলে। আর অন্নদা মুন্সী আগে থেকেই দু’ ঢোঁক খেয়ে গান ধরতেন ‘মাটিতে চাঁদের উদয় কে দেখবি আয়’। তারাশঙ্কর আর সজনীকান্তের থুতনি ধরে নেচে নেচে গাইতেন তিনি। এর পরেও চলত গান, কবিতা, আলোচনা। হঠাৎই আলোচনায় অংশ নেওয়া নরেনের দিকে তারাশঙ্করের চোখ পড়তেই কৌটো থেকে সিগারেট বার করে বাবার সামনে ধরলেন। বাবা চূড়ান্ত নার্ভাস, ‘দাদা আমি তো—।’ তারাশঙ্কর দিলেন এক ধমক, ‘রাখো তো দেখি! খাও! খাও বলছি।’ তারাশঙ্করের আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা বাবার ছিল না। বাবা খানিকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন, তার পর দু’ আঙুলের মাঝখানে ধরে রাখলেন সিগারেট। সেই ধোঁয়া এঁকেবেঁকে আমাদের কাছেও এল। তার পর জানালার ফাঁক দিয়ে ভেসে গেল বাতাসে। আজও সেই ছবি চোখের সামনে ভাসে।

দুর্বলতা বাংলাদেশের সেই নারী!

স্ত্রী শোভনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। বিয়ে করতে না চাইলেও বিয়ে যখন হল, তখন মাকে চিঠি লিখে কবিতা পড়াতেন। গল্পের বই পাঠাতেন। শিল্পবোধ তৈরি করে দিয়েছিলেন মা’র মধ্যে। তবে এখানে একটা কথা বলি, বাবার অস্ফুট প্রেমকে মা কিন্তু কোনও দিন গ্রহণ করতে পারেননি। এক মহিলার বাড়িতে আনাগোনা ছিল। তিনি বাবার ছবি তুলতেন বাড়ি এসে। বাংলাদেশের এক নারী। মা সেটা পছন্দ করতেন না। বড় হয়ে আমি মাকে বোঝাতাম। আজও মনে হয়, ও পার বাংলায় গেলে সেই মহিলাকে খুঁজে বার করি।

বাবা যদিও সব কথা ভাগ করে নিতেন মার সঙ্গে। মেয়েদের সেজে গুজে থাকাটা খুব পছন্দের ছিল নরেন্দ্রনাথের। মাঝেমাঝেই স্ত্রীর জন্য নিয়ে আসতেন খোঁপায় বাঁধার জন্য ফুল, ফুলের মালা। তবে এটাও মনে করতেন, সাজ ব্যক্তিকে ছাপিয়ে না যায়। আসল সাজ ব্যক্তি নিজে! আম খেতে খুব ভালবাসতেন, মা মজা করে বলতেন, ‘কই, এ বার আম খাওয়ার টাকা দিলে না?’ বাবা বলতেন,

‘এই লেখা শেষ হোক, দেব।’ তখন গল্প লিখে হয়তো দেড় থেকে দু’ টাকা পেতেন। বাবার জীবনে একমাত্র সম্মান আনন্দ পুরস্কার।

একবার হল কী, বেশ কিছু দিন ধরে কোনও লেখা মাথায় আসছে না। ভীষণ ভীষণ মন খারাপ। স্ত্রীকে ডাকলেন, ‘‘ছবি, আমি আর লিখতে পারছি না।’’

‘‘পারবে, ঠিক পারবে।’’

তা-ই হল। একদিন সত্যি সত্যিই আবার লেখা ফিরে এল। লিখতে শুরু করে শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ।

নিজের লেখার টেবিলে।ছবি: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

স্ত্রীকে সব কথা বলা চাই

মাঝেমাঝেই লেখার টেবিলের কাছে শোভনাকে ডেকে নিয়ে বলতেন, ‘‘এই দ্যাখো সত্যি সত্যি একটা উপন্যাসের ছক গেঁথেছি। লিখতে খুব ভাল লাগছে, জানো। বলা যায় না, হয়তো এটা একটা গ্রেট নভেল হয়ে যেতে পারে।’’এমন জোর দিয়ে লেখার বিষয় আগে কোনও দিন শোনেননি শোভনা। ভারি খুশি হয়ে বললেন, ‘‘বেশ তো! তা হলে লেখো না। এ বার বরং পুজোর লেখা বন্ধ রেখে এই উপন্যাসটিই শেষ করো।’’

তাই শুনে হাঁ হাঁ করে উঠলেন নরেন্দ্রনাথ, ‘‘বলো কী! পুজোর লেখা লিখব না, তাই কখনও হয়! পুজোর লেখার আনন্দই যে আলাদা। তোমরা যেমন পুজোয় নতুন জামাকাপড় পরে বা অন্যকে দিয়ে আনন্দ পাও, আমরা লেখকরা তেমনই পুজোয় নতুন লেখা পাঠকদের দিয়ে আনন্দ পাই।’’

আর একদিন বললেন, ‘‘ছবি, আমার আত্মজীবনী লিখতে ইচ্ছে করছে। বেশ মোটা করে একটা নিজের কথা লেখার ইচ্ছে।’’ বলেই মুচকি হেসে আবার বললেন, ‘‘না না, মন খারাপ কোরো না। ওতে তুমিও থাকবে অনেকটা জুড়ে।’’

শোভনাও পালটা উত্তর দিলেন, ‘‘নিজেই লিখবে? আমার তো ইচ্ছে ছিল, তোমাকে নিয়ে একটা মস্ত লেখা লিখব। তোমার যা অদ্ভুত স্বভাব। জমিয়ে লিখতে পারলে পাঠকরা খুব মজা পাবে।’’

‘‘বেশ তো তা হলে লিখো। তবে শুধু ত্রুটির কথাই লিখো না। একটু বানিয়ে বানিয়েই নাহয় নিজের স্বামীর গুণের কথাও লিখো।’’

তার পর দুজনের সে কী হাসি!

আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পরে অভাব আর অনিশ্চিত জীবন শেষ হল। আমার মনে আছে, বাবা এসে গল্প করেছিলেন আনন্দবাজারে লিফটে অশোক সরকারের সঙ্গে দেখা। উনি জানিয়েছিলেন আনন্দ পাবলিশার্স তৈরি করছেন ওঁরা। আরও বলেছিলেন,‘আপনি লিখবেন। বই দেবেন।’ বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন।

বাবার গল্পে অমিতাভ বচ্চনের ‘সওদাগর’

বাবার গল্প ‘রস’ নিয়ে যখন মুম্বইতে ‘সওদাগর’ হল, অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করলেন। আমরা পুরো পরিবার মিলে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। বাবার খুব আনন্দ হয়েছিল। অগ্রগামীর ‘বিলম্বিত লয়’ ছবির চিত্রনাট্যও বাবা লিখেছিলেন। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু দিন আমাদের বাড়িতে থাকার সুবাদে জেনেছি, উত্তমকুমারও বাবার গল্প নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন। আর এক জন মানুষও বাবার গল্প নিয়ে খুব আগ্রহ দেখাতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওঁর বাড়িতে বসে আমার সঙ্গেই গল্প করতেন। তিনি সত্যজিৎ রায়।

জীবনে অনেক জায়গায় বহু কষ্টে কাটিয়েছেন বাবা, তাই পাইকপাড়ায় এসে বুঝি শখ হল নিজের একটা বাড়ি তৈরির।

তাই প্রকাশকদের কাছ থেকে টাকা ধার করে জমি কিনলেন একেবারে মেন রাস্তার ওপর।

তার পর দোতলা বাড়ি করলেন। তিনতলা করারও শখ হল। ভাই বললেন, ‘‘কী হবে দাদা আবার তিনতলা করে?’’

‘‘থাক না। রিটায়ার করবার পর না হয় ভাড়া দিয়ে দেব।’’

আসলে হয়তো মনের কথা অন্য ছিল। কখনও খুপচি বস্তি, কিংবা মেসের একচিলতে ঘরে দিনের পর দিন কাটানোর যন্ত্রণা ভুলতে চেয়েছিলেন প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ঘর করে।

তিনতলার কাঠামোও শুরু হল। হেড রাজমিস্ত্রিকে ডেকে বললেন, ‘‘জয়নুল, আমার কাজটা ভাল করে কোরো। তা হলে তোমায় নিয়ে ভাল গল্প লিখব একটা। দেখো, আমার গল্পের মধ্যেই তুমি বেঁচে থাকবে।’’

মাথায় শুধু চিন্তা ঘুরপাক খেত রিটায়ারমেন্টের পর কী করবেন? কীভাবে চলবে?

তাই কখনও পাড়ায় লাইব্রেরি তৈরির জন্য মাতেন, তো কখনও তিনতলা তৈরির কথা ভাবেন। আবার কখনও আত্মজীবনী লেখার ভাবনাও চেপে বসে মাথায়।

উপনিষদ, গীতা কাব্যগ্রন্থ

আবু সৈয়দ আইয়ুব বাবার গুণগ্রাহী। বাবার মৃত্যুর পর যখন ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘আমি বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারি?’’ বাবাকে নিয়ে লিখছি শুনে উনি বলেছিলেন, ‘‘লেখাটা যেন পুজো না হয়ে যায়।’’

সংস্কার, ধর্ম কিছুই পছন্দ করতেন না বাবা। শিল্পচর্চাই ছিল বাবার পুজো। উপনিষদ আর গীতা আওড়াতেন বাড়ির বারান্দায়। এই গ্রন্থ ছিল বাবার কাছে কবিতা।

রোজের মতো সে দিনও সকাল হয়েছে। পুজোর লেখা চলছে পুরোদমে। সকালে একটি গল্প শেষ করে অফিস গেলেন নরেন্দ্রনাথ।

বিকেলের দিকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলেন। কোথায় যেন একটু অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু চিরকালের মুখচোরা যে! কাউকে কিছুই বললেন না।

বাড়িতে গানের আসর বসেছে। অনেক বন্ধুবান্ধব। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। এই করতে করতেই মাঝরাত।

কষ্টটা বাড়ছে.. বাড়ছে...

চেনাজানা কেউ মারা গেলে আফসোস করে নরেন্দ্রনাথ বলতেন, ‘‘জীবন এই রকমই। চলতে চলতে হঠাৎ কখন থেমে যায়। সব কিছু অসমাপ্ত পড়ে থাকে।’’

১৪ সেপ্টেম্বর সেই গভীর রাত। সত্যি সত্যিই হঠাৎ থেমে গেলেন নরেন্দ্রনাথ।

পড়ে রইল তাঁর অধরা আত্মজীবনী! মৃত্যু না কি জীবন? কাকে বেছেছিলেন আমার বাবা?

বাবার উত্তর ছিল এই রকম: মৃত্যু নিষ্ঠুর, কারণ সে জীবনের সমাপ্তি এনে দেয়। জীবন নিষ্ঠুরতর, কারণ সে মৃত্যুকে ভোলায়।

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement