সংযোগ: গ্যালারি ৮৮-তে প্রদর্শিত হল শিল্পী সন্দীপ চক্রবর্তীর ভাস্কর্য।
সন্দীপ চক্রবর্তী সরকারি আর্ট কলেজের ডিগ্রি নিয়ে সোজা বরোদায় চলে গিয়েছিলেন ভাস্কর্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে। ভাস্কর্যের প্রতি আকর্ষণ কবে থেকে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, বাল্যকাল থেকেই। মেদিনীপুর জেলার মেচেদা গ্রামের কুমোরপাড়ায় মাটির পুতুলের প্রতি তাঁর আকর্ষণ খুব ছোটবেলা থেকে। তাঁদের কাছেই সন্দীপের হাতেখড়ি, তাই ওই কুমোররাই তাঁর মূর্তি গড়ার গুরু। প্লাস্টারের ছাঁচ তৈরির কৌশল ছোটবেলাতেই আয়ত্তে এনেছিলেন এবং প্রতিমা গড়া শুরু করেন ন’-দশ বছর বয়সে। অনুপ্রেরণা স্বাভাবিক ভাবেই রামকিঙ্কর বেইজ। মীরা মুখোপাধ্যায়ও খুব প্রিয় ভাস্কর।
গ্যালারি ৮৮-এর দু’টি তলা জুড়ে প্রচুর জায়গা নিয়ে শিল্পী সন্দীপ চক্রবর্তীর সব কাজ খুব যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।
শিল্পী এবং অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তীর কাজের পদ্ধতিটি বেশ মজার। একদম প্রথমেই করেন স্কেচ বা ড্রয়িং। তারপর ছোট্ট একটি প্রাথমিক মডেল, যেটি ভাস্করের মোম বা মাটির তৈরি। তাকে বলা হয় মকেট। প্রথমে মাটি, তার পরে প্লাস্টার, তার পরে প্লাস্টারের ছাঁচ এবং তারও পরে মোম। এই যে সিরে পারডু প্রসেস, যাতে সন্দীপ কাজ করেন, তাতে অনেক জটিল কাজও সম্ভব। একেই আবার বলা হয় লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি। প্রথমে মোমের ছাঁচ তৈরি করে, তার উপরে মাটির লেয়ার ফেলা। তারপর তাকে চুল্লিতে ফেলা হলে পুরো মোমটা গলে পড়ে যায়। আর সেই ফাঁক দিয়ে ব্রোঞ্জ বা অন্য ধাতুর ঢালাই হয়। আর সবশেষে নানা রকম অ্যাসিড বাথ দিয়ে রং আনা হয়। চকচকে ব্রোঞ্জ থেকে পালিশ করা মার্বেলের অনবদ্য এফেক্টটা আসে।
এই প্রদর্শনীতে প্রথমেই চোখ কাড়ে ‘এক্সচেঞ্জ’ নামের ব্রোঞ্জের একটি ভাস্কর্য। দু’টি পাখির মূর্তি যেন মুখে মুখে প্রাণের কথা বলছে। এটি আপাতদৃষ্টিতে পাখির অবয়ব নিয়েছে কিন্তু আবার ওই দু’টি পাখিকে শশা বা লাউ বা চালকুমড়ো বলেও ভাবা যেতে পারে। আবার খুব মনোনিবেশ করে দেখলে যেন দু’টি লম্বাটে বেলুনের আকৃতিও চোখে পড়ে, এমনই একটি ইঙ্গিত করেছেন সন্দীপ। দর্শকের কল্পনার জগৎকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, সঞ্জীবিত করেছেন।
এরপর যে ছবিটির কথা একান্ত ভাবেই বলতে হয়, সেটি হচ্ছে ‘ইউনিয়ন’। মা এবং সন্তানের সম্পর্কের পবিত্রতার যে বন্ধন, তাতে জননী সব সময় দৃঢ়ভাবে সন্তানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন মানসিক ভাবে, আবেগে, আদরে। যদিও তারা শারীরিক ভাবে বহু দূরত্বে অবস্থান করতে পারেন। একটি চাদরে ঢাকা ফর্মে মা এবং সন্তানের একীকরণ করেছেন শিল্পী। সুন্দর কাজ ব্রোঞ্জের, কিন্তু ঝকঝকে পালিশ করা প্যাটিনা।
এ বারে যখন মনে প্রশ্ন জাগে যে, শিল্পীর কাজে ওই রকম এক সহজ সরল ভাব কেন, তার উত্তরে পাওয়া গেল যে— চতুর্দশ শতাব্দীতে সুদূর প্রাচ্যে সং রাজবংশের শাসনকালে মু-চি নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী একটি ছবি এঁকেছিলেন, যেটির নাম ‘সিক্স পার্সিমনস’। এই ছবি বিখ্যাত হয় অসামান্য ব্রাশ স্ট্রোক আর সূক্ষতার জন্য। হালকা তুলির টানে ছ’টি পার্সিমন আঁকা হয়েছে, অসম্ভব নিয়ন্ত্রণে। ওই ছবিটি নিয়ে বহু আলোচনার পরে জানা গিয়েছিল যে, মাত্র তিন মিনিট ধরে ওই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে ধীরে ধীরে দর্শকের নিঃশ্বাস শান্ত হয়ে যায় এবং কিছুটা ধ্যানস্থ ভাবও এসে যায়। সন্দীপের কাজ ঠিক মতো দেখতে ও বুঝতে হলে, তাঁর শিল্পচর্চার অনুরূপ দর্শনটিও বুঝতে হবে। ওই ‘সিক্স পার্সিমনস’ ছবিতে বলা হয় যে, এখানে ছয়টি মাংসল শাঁসযুক্ত ফলের মধ্যে প্রকৃতির রহস্যকে শ্রেষ্ঠ ভাবে বেঁধে ফেলা হয়েছে। আশপাশে কোনও কিছু নেই, যা দৃষ্টির বিভ্রম ঘটাতে পারে। সন্দীপ চক্রবর্তীর প্রত্যেকটি কাজেই সেই সমস্ত আপাত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা বর্জন করে ভিতরে, আরও ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা চোখে পড়ে। তিনি যে ভাবে কাজ করেন, সেটাই তাঁর ধ্যান। পাখিই হোক, মানুষের মাথাই হোক বা বুদ্ধমূর্তি— যে কোনও জিনিসের অন্তরতম অংশটিকে ধরেন, মনের গহিনে প্রবেশ করে। সৃষ্টি করেন শুধুমাত্র সেই গভীর নির্যাসটুকু দিয়েই।
শিল্পীর ‘মেমোরিয়াল’ বলে বুদ্ধমূর্তিটি সেরামিকে করা এবং কোনও আপাত বাধাবিঘ্ন নেই। সরল, সুন্দর এক মনোরম বুদ্ধমূর্তি। ‘রিফ্লেকশন’ কাজটিতেও দু’টি পাখির ভাব-মূর্তি। এই প্রদর্শনীতে রাখা সমস্ত ভাস্কর্যই ঠিক ওই চোখেই দেখতে হবে, সেই পার্সিমনের মতো। কিছুটা সময় দিতে হবে, সে সময়ে দর্শককে বাইরের কোনও হট্টগোল বা বিশৃঙ্খলা স্পর্শ করবে না। আমরা যেন কিছুটা অন্তত ধ্যানমগ্ন হতে পারি। যদি আমরা তা করতে সক্ষম হই, সেখানেই শিল্পীর সাফল্য।