বড় একা লাগে-১

সুখ নেইকো মনে

ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত। নিজেদেরও আর্থিক টানাটানি নেই। হাতড়ে বেড়ান সন্তানের শৈশবের নানা স্মৃতি। অভিমানও হয়, বার্ধক্যে কেন তাঁদের কাছে পাচ্ছেন না? তিক্ততা থেকে আসে অবসাদ। এ থেকে মুক্তির রাস্তা কী? মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বললেন সোমা মুখোপাধ্যায়। প্র: এখন তো অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পড়াশোনা বা চাকরির জন্য বাইরে চলে যাচ্ছেন। বাবা-মায়েরা কী করবেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

প্র: এখন তো অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পড়াশোনা বা চাকরির জন্য বাইরে চলে যাচ্ছেন। বাবা-মায়েরা কী করবেন?

Advertisement

উ: বাবা-মায়েরা সবচেয়ে আগে হাহাকার করাটা বন্ধ করবেন। এক দিকে আমরা চাইব আমাদের সন্তান দারুণ কিছু করুক। স্কুল-কলেজের রেজাল্টে এক চুল এ দিক ও দিক হলে কুরুক্ষেত্র বাধাব। তার পর সে উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য অন্য শহরে ভাল সুযোগ পেয়ে চলে গেলে হা-হুতাশ করব! সবটা তো এক সঙ্গে চলতে পারে না। বরং এখন যা দিনকাল পড়েছে, অনেক আগে থাকতেই আমাদের এ জন্য নিজেদের তৈরি করতে হবে। মানসিক ভাবে তো বটেই, এমন কী শারীরিক ভাবেও।

প্র: শারীরিক ভাবে?

Advertisement

উ: অবশ্যই। শরীর ঠিক থাকলে তবেই তো মনকেও চাঙ্গা রাখা যাবে। শরীর খারাপ থাকলে অনেক তাড়াতাড়ি অবসাদ আসে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে আমাদের একাই থাকতে হবে, এটা যদি বাবা-মায়েরা নিজেদের বোঝাতে পারেন, তা হলে অনেক আগে থেকেই সেটা মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে যাবে। ছেলে বা মেয়ে সময় কম দিচ্ছে, তাই রাগ করে না খেয়ে থাকা, কিংবা ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না, তাই অভিমান করে নিজেও দরকার সত্ত্বেও ডাক্তারের কাছে না যাওয়া, এ সব চলবে না। আমার জীবনটা আমারই, এটা বুঝতে হবে। কিছুটা শরীরচর্চা, মেডিটেশন এগুলো জরুরি।

প্র: এতে কি আত্মবিশ্বাস বাড়ে?

উ: একদম তাই। পঞ্চাশোর্ধ্বদের নিয়ে আমি একটা গ্রুপ বানিয়েছি। সেখানে অনেক রকম আলোচনা হয়। শারীরিক সুস্থতা কতটা জরুরি, সে কথাটা বার বার উঠে আসে। শরীর ভাল থাকলে তবেই না যা ইচ্ছা তাই করা যায়! আর হ্যাঁ, বৃদ্ধাশ্রমের প্রসঙ্গও আসে। বৃদ্ধাশ্রম মানেই সংসার তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, এমন ভাবনা থেকে বেরোনোর সময় এসেছে। এখন অনেক ভাল ভাল বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হচ্ছে। যাঁদের ছেলেমেয়ে দূরে থাকে, অথচ যাঁরা সব সময়ে অন্যের সঙ্গ পছন্দ করেন, তাঁদের পক্ষে তো এই বিকল্পটা খুবই ভাল। একটা বাড়িতে একা থাকতে গেলে অনেক দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়, বৃদ্ধাশ্রমে সেই দায়িত্ব নেই। আগে বাচ্চাদের ক্রেশে রাখা নিয়ে অনেক ছুৎমার্গ ছিল। এখন তো অধিকাংশ চাকরিরত দম্পতির কাছে ক্রেশ একটা বড় সমাধান। বৃদ্ধাশ্রমও সে রকমই। ২০১৬-তে আমরা হয়তো পুরোটা মানতে পারছি না। হয়তো ২০২৬-এ মানব।

প্র: সন্তানকে ছেড়ে থাকার জন্য এই প্রস্তুতিটা কবে থেকে নেওয়া দরকার?

উ: আমার তো মনে হয়, ছেলে বা মেয়ে যখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ছে, তখন থেকেই ভাবা উচিত। সারাক্ষণ ওদের নিয়ে না ভেবে নিজেদের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করা উচিত। পুরুষদের পক্ষে এটা সহজ। যে মহিলারা চাকরি করেন, তাঁদের পক্ষেও তুলনায় সহজ। কিন্তু যাঁরা চাকরি করেন না তাঁরা সমস্ত অস্তিত্বটাই সন্তানকে ঘিরে তৈরি করেন। এটাই মারাত্মক। নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখুন। এটা পরে খুব কাজে আসে।

প্র: কিন্তু যাঁদের বাইরের একটা জগৎ আছে, সন্তান দূরে থাকলে তাঁরাও তো মানসিক ভাবে বেশ খানিকটা একা হয়ে যান। সেই একাকিত্বটা কাটবে কীসে?

উ: সে ক্ষেত্রে নতুন কিছুর সঙ্গে জড়াতে হবে। অনেক কিছু করা যায়। বাড়িতে কাজের লোক যাঁরা, তাঁদের ছেলে বা মেয়েকে পড়াতে পারেন। যদি পশুপাখি ভালবাসেন, তা হলে দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়ে পাড়ার কুকুর-বেড়ালদের খাওয়াতে পারেন। এতে একটা অন্য ধরনের মানসিক তৃপ্তি তৈরি হয়। এ ছাড়া নতুন কিছু শেখা যেতে পারে। কিংবা সকাল-বিকেলে পাড়ায় হাঁটতে যাওয়া শুরু করলেন। একটা গ্রুপ তৈরি হল। তাদের সঙ্গে অনেক ধরনের আদানপ্রদান হয়। এমনকী চেনাশোনা বাড়লে আউটিং-এও যাওয়া যায়। খুব ভাল সময় কাটে এতে।

প্র: আর?

উ: এখন তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের রমরমা। কত মানুষ এর মাধ্যমেই বহু বছর বাদে স্কুল-কলেজের পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাচ্ছেন। একাকিত্ব কাটানোর জন্য এটা একেবারে আদর্শ। পছন্দের বন্ধুদের তালিকা তৈরি করুন। সেই বন্ধুদের সঙ্গে ফের দেখা করুন, আড্ডা মারুন। হয়তো তাঁরাও কারও সঙ্গ চাইছেন। এক সঙ্গে লং ড্রাইভেও চলে যেতে পারেন। তা ছাড়া ইন্টারনেটে ঢুকতে পারলে কত কী জানা যায়। এক বার নেটের দুনিয়ায় ঢুকতে পারলে দেখবেন, সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে বলে আফসোস হবে।

প্র: সব বাবা-মাই কি আর কম্পিউটারে স্বচ্ছন্দ নাকি? জীবনে কখনও কি বোর্ডে হাত ছোঁয়াননি এমন অজস্র মানুষও তো রয়েছেন।

উ: সেটাই তো! ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কারণে এখন কম্পিউটার থাকে অধিকাংশ বাড়িতেই। সময় থাকতে ছেলেমেয়ের কাছে একটু শিখে নিতে ক্ষতি কোথায়? অনেকেরই এটা নিয়ে মানসিক বাধা আছে। এটা কাটানো খুব জরুরি। শুধু তো কম্পিউটার নয়, স্মার্ট ফোন কিনে নিন। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক তো করবেনই, পাশাপাশি বাইরে বেরোনোর জন্য অন্যের ভরসায় না থেকে বাড়িতে বসেই ওলা-উবের ডেকে নিতে পারলে দেখবেন নিজেকে কেমন তরতাজা লাগে।

প্র: টিভি থেকে দূরে থাকতে বলছেন?

উ: বললেও তা মানবে কে? বাড়িতে একা থাকলে টিভি খুব বড় সঙ্গী। কিন্তু সমস্যা হল অনেকেই সিরিয়ালের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেন। তাতে জটিলতা বাড়ে। সিরিয়ালের স্বার্থপর ছেলে-বৌমাকে দেখে মনে হয়, আরে আমারটাও তো ও-রকমই। এটা থেকে বেরোতে হবে। ওটা কাল্পনিক চরিত্র, আর আমি বাস্তব—এটা না বুঝলে নিজের বিপদ নিজেই ডাকবেন।

প্র: আর কোনও পরামর্শ?

উ: নিজেকে ভাল রাখাটা নিজেরই দায়িত্ব বলে মানতে শিখুন। হাসিখুশি থাকুন। তাতে দূরে থেকে আপনার ছেলেমেয়েও ভাল থাকবে। ফোনে আপনার গলা শুনে বা স্কাইপে আপনাকে হাসিখুশি দেখে তারাও নিশ্চিন্ত থাকবে। ছেলেমেয়ের ওপরে অপরাধবোধের বোঝা চাপিয়ে দেওয়াটা বিবেচকের কাজ হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement