নান্দনিক: কেসিসি গ্যালারিতে প্রদর্শিত এ রামচন্দ্রনের চিত্রকর্ম ফাইল ছবি।
সম্প্রতি কলকাতার কেসিসি গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছিল বর্ষীয়ান শিল্পী এ রামচন্দ্রনের এক প্রতিশ্রুতিময় প্রদর্শনী ‘সংস অব রিক্লেমেশন : দি আর্ট অফ এ. রামচন্দ্রন’। তিনটি তলা জুড়ে সুবিস্তৃত এই প্রদর্শনীটির তত্ত্বাবধায়ক বিশিষ্ট শিল্প ঐতিহাসিক ও শিল্পবিদ অধ্যাপক আর শিবকুমার।
ভারতবর্ষ আজও গুরু-শিষ্য পরম্পরার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের জন্য সমাদৃত। গুরু যদি স্বয়ং নন্দলাল বসু, তৎসহ রামকিঙ্কর বেজ ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় হয়ে থাকেন, তা হলে সেই শিষ্যের যাত্রাপথ প্রায়শই হয়ে ওঠে গৌরবময়। সেই রকমই এক বিশিষ্ট শিষ্য, শিল্পী রামচন্দ্রন তাঁর ছাত্রজীবনের দুর্লভ সব পাঠের আত্তীকরণ শেষে, দীর্ঘ পথ চলে বিকশিত হয়ে ওঠার যে সম্ভার— সেই রকমেরই বহু কাজ দিয়ে এই প্রদর্শনীটি সাজানো।
শস্যশ্যামলা কেরলের আত্তিঙ্গল শহরে জন্মগ্রহণ করে, পঞ্চাশের দশকে রামচন্দ্রন পাড়ি দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। সেই যুগের বিশিষ্ট গুরুদের সান্নিধ্যে অসাধারণ সব অভিজ্ঞতায় ভরপুর তাঁর ছাত্রজীবন। তার পর স্বাধীনোত্তর ষাটের দশক থেকে শুরু হয় শিল্পীর নিজস্ব শিল্প ভাষার অন্বেষা। তদানীন্তন শান্তিনিকেতনে শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়ার সুবাদে শিল্পীমনের যে সুচিন্তন, সুগভীর জীবনবোধ, প্রকৃতির প্রতি অপরিসীম ঔৎসুক্য ও ভালবাসা এবং নান্দনিক প্রত্যয় গড়ে ওঠে, তা রামচন্দ্রনের বিগত ছয় দশকের প্রায় প্রতি সময়ের কাজের মধ্যেই প্রতীয়মান। শিল্পী নিজেকে তাই অনায়াসেই ‘বহুরূপী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ কখনও তিনি চিত্রশিল্পী, কখনও ভাস্কর, কখনও বা নকশাকার, আবার কখনও বা শিশুসাহিত্যের রূপকার। এই বহুমাত্রিক পরিবেশনের মধ্য দিয়েই এই প্রদর্শনীটি অতীব পারিপাট্যে আয়োজিত।
শিল্পীমাত্রই তাঁর নিজস্ব পরিবেশ, পরিমণ্ডল ও মনন থেকে খুঁজে নেন তাঁর উদ্দীপক, আঙ্গিক ও উপস্থাপনার মাধ্যম। এ ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে চিরকালীন এক আত্মনির্ভরতা, শ্রদ্ধা ও পরিপূরকতা, তারই প্রকাশ ঘটেছে বারংবার তাঁর বহুবিধ শিল্পমাধ্যমে। কেরলের পরিব্যাপ্ত নিসর্গ, সমুদ্র ও নীল আকাশের মাঝে বেড়ে ওঠা তাঁর শৈশব, পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির মাঝে আবার নতুন করে খুঁজে পায় সেই ছন্দ। সেই সঙ্গে গুরু নন্দলালের নিরন্তর স্কেচ করার যে পাঠাভ্যাস, তা রামচন্দ্রনকে আজীবন এক দৃশ্যময় দৈনন্দিন দলিল গড়ে তুলতে সাহায্য করে, আজও যার লয় ও ছন্দ পুনরুদ্ধারে তিনি নিরলস ভাবে কর্মরত। সেই সব বহুবিধ উপপাদ্য নিয়ে কখনও তিনি রচনা করে চলেছেন কালো কালির ড্রয়িং, কখনও রঙিন কাগজ কেটে শিশুসাহিত্যের অতুলনীয় চিত্রণ, কিংবা কখনও তৈল মাধ্যমে অতিকায় বৃহৎ সব ক্যানভাস,অথবা ভীল উপজাতির আদলে নানাবিধ ভাস্কর্য।
বিংশ শতকের সুবিখ্যাত মেক্সিকান মুরালের প্রখ্যাত তিন ভিত্তি- চিত্রকর দিয়েগো রিভেরা, ওরসস্কো ওসিকের্সের কাজ রামচন্দ্রনকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল, যার স্বাদ পাওয়া যায় তাঁর সব সুবৃহৎ ক্যানভাস চিত্রের মধ্য দিয়ে। তবে আশির দশক থেকে তাঁর শিল্পভাবনা ও বিষয়গত দিক থেকে এক বিশেষ পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ সময় থেকে রাজস্থানের উদয়পুর অঞ্চলের কাছে অবস্থিত আদিবাসী গ্রামের পদ্মপুকুর, পদ্মফুল ও তার বহুবিধ রূপের বিন্যাস তাঁর ছবির এক প্রধান প্রতিপাদ্য হয়ে দেখা দেয়। এ দেশের জাতীয় ফুল পদ্মের দর্শন, তাৎপর্য ও প্রকাশ অতীব প্রাচীন। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার চেতনায় সিঞ্চিত। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে পদ্ম অনেক ক্ষেত্রেই জীবনচক্রের প্রতীকী রূপ হিসেবে ব্যবহৃত। সেই পদ্মফুল, পদ্মপাতা, পদ্মপুকুরকে শিল্পচর্চার মূল কেন্দ্রবিষয় হিসেবে বেছে নিয়ে রামচন্দ্রন অতিকায় মাপের বেশ কিছু ক্যানভাস তেলরং মাধ্যমে প্রদর্শিত করেছেন (৭৮x১৯২ ইঞ্চি)। বিষয় মূলত পদ্মফুল হলেও তার গঠন, রং ও রূপের বিন্যাস ভিন্ন। যেমন কখনও বা পদ্মবনে মৌমাছিদের গুঞ্জন, কোথাও বা মেঘলা হাওয়ায় দোদুল্যমান পদ্মবন, আবার কোথাও বা কীট, পতঙ্গ, মাছরাঙাদের অবাধ আনাগোনা— দর্শককে বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করে। এই ছবিগুলির চিত্রায়নের ক্ষেত্রে তিনি কোনও ধ্রুপদী রচনায় না গিয়ে বিষয়ের রং, রূপ, রেখা, ছন্দ ও বর্ণনকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। পদ্মফুলের চিরকালীন আবেদনকে শিল্পীর সমকালীনত্বের রসে ও রঙে সিক্ত করার এই অনুভব দীর্ঘ চর্চার সাক্ষ্য বহন করে। রবীন্দ্র আদর্শে বেড়ে ওঠার ফলে তাঁর কাজে ঐতিহাসিক উদ্দীপক ও সামাজিক উদ্দীপক, অথবাকৃষ্টি ও পরম্পরার যেসামগ্রিকতা— সেগুলি বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়।
রামচন্দ্রনের কাজে রূপকথা, নিজেকে নিয়ে হাস্যকৌতুক বা ব্যঙ্গরসের উপস্থাপনাও বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোথাও তিনি নিজের প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রজাপতি অথবা কখনও কচ্ছপ ইত্যাদি রূপ সংযোজন করে চিত্রের মধ্যে এক কাল্পনিক কাহিনি বা ‘মিথ’ তৈরি করেছেন। অন্য দিকে গুরু নন্দলালের অতি পরিচিত ‘সহজপাঠ’-এর কালো-সাদা লিনোকাট তাঁর অনুপ্রেরণার আর এক সূত্র। প্রদর্শনীটির তৃতীয় তলাটি তেমনই কিছু অসাধারণ শিশুসাহিত্যের ইলাস্ট্রেশন দ্বারা সুসজ্জিত। এই কাজে তাঁর সহযাত্রী তথা সহধর্মিণী ও শিল্পী চামেলি রামচন্দ্রন তাঁর শিল্পসত্তার পরিপূরক হিসেবে যুক্ত থেকেছেন। এই শিশুসাহিত্যের সব বই-ই তাঁদের যৌথ কাজের অনবদ্য ফসল। এই বইগুলির চিত্রণের ক্ষেত্রে দেশজ লোকশিল্প ও পরম্পরাগত ভারতীয় শিল্পের প্রতি শিশুমনকে প্রভাবিত করার এক অসামান্য প্রয়াস দর্শককে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়। এ ছাড়াও উল্লেখ্য, বর্তমান কালের প্রযুক্তিগত মাধ্যমে অ্যানিমেশন দ্বারা শিশুমনকে আরও উৎসাহিত করার বিশেষ দিকটি।
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর অধ্যাপনায় যুক্ত থেকেছেন বর্ষীয়ান শিল্পী রামচন্দ্রন এবং এ যাবৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু বিশিষ্ট পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু নিরন্তর শিল্পসাধনার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে খুঁজে দেখার ও কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে পুরস্কৃত করার যে আনন্দ, সেটি তাঁর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে সদা জাজ্জ্বল্যমান।
প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের অলঙ্করণের ধারা রামচন্দ্রনের কাজে পরিব্যাপ্ত। গাছপালা, ফুল, পাতা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, নরনারী, কিন্নর-কিন্নরী... প্রতিটি রূপই বেশ আলঙ্কারিক ভাবে গঠিত। ফলত চিত্রপটমাত্রই সেগুলি রং, রূপ, রেখার এক কাব্যিক ভাবনায় বিন্যস্ত। ছন্দোময় রেখার পরিমার্জিত বুনটে ঋদ্ধ ও সুললিত নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ।
রামচন্দ্রন তাঁর নিজের কথায়, বারেবারেই তাঁর ছাত্রজীবনের অপরিসীম অনুপ্রেরণা ও সৌন্দর্যতত্ত্বে প্রভাবিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এই প্রতিফলিত বিদ্যা ও স্বজ্ঞাত বিদ্যার মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয় এক বিশেষ সংলাপ, যার প্রতিফলন ঘটে শিল্পরচকের সৃষ্টিতে। এ ক্ষেত্রে সেই রকম দৃষ্টিনন্দন নজির অফুরন্ত।
গুরু প্রণোদিত শিক্ষা যখন শিষ্যের মাধ্যমে পায় এমন বিস্তার ও উৎকর্ষ, হয়তো বা তখনই গুরুদক্ষিণা স্বরূপ সেটি তার যথার্থ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। আর এ ভাবেই পরের প্রজন্মের উদ্দেশে প্রস্তুত হয়ে ওঠে শিল্পের উত্তরাধিকার স্বত্ব।