Bijoya Ray

যাঁর কণ্ঠে ছিল সোপ্রানোর কোলোরাটুরার কাজ

হতে পারতেন পাশ্চাত্যের ‘অপেরার সোপ্রানো কোলোরাটুরা’ গায়িকা। অথচ হলেন সত্যজিৎজায়া ও তাঁর সহযোগী। নানাগুণের অধিকারিণী বিজয়া স্বেচ্ছায় নিজের পরিচয়কে লুকিয়ে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সহধর্মিণীর আড়ালে।

Advertisement

সুদেষ্ণা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৫:১৩
Share:

২৫তম বিবাহবার্ষিকীর দিন বিজয়া-সত্যজিৎ। —ফাইল চিত্র।

আধুনিক মানবীচর্চাবিদরা বলে থাকেন বাঙালি সত্যজিৎ রায়ের উচ্চতার একজন মহান শিল্পীকে পেতই না যদি তাঁর পিছনে সুপ্রভা ও বিজয়ার মতো দুই নারী না থাকতেন। তাঁরা যে ভুল, এমন নয়। সফল পুরুষদের পিছনে একজন নারীর ভূমিকার বিষয়টি অনেকেই মানেন। তবে তাঁরা হন স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে একজন তাঁর মা, অন্যজন স্ত্রী। এই লেখা এঁদেরই একজনকে নিয়ে। তবে প্রথমজনের কথাও মাঝে মাঝে যে এসে পড়বে তা বলে রাখা ভাল। কারণ, সত্যজিৎকে গড়ার প্রয়োজনেই সুপ্রভা গড়ে নিয়েছিলেন বিজয়াকে।

Advertisement

সত্যজিৎ-বিজয়াকে বিযুক্ত করে দেখা অসম্ভব। তবে বিজয়া রায়ের ব্যক্তি পরিচয় আরও ব্যাপক। নানাগুণের অধিকারিণী বিজয়া স্বেচ্ছায় নিজের পরিচয়কে লুকিয়ে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সহধর্মিণীর আড়ালে। ঠিক যেমন ভাবে সুপ্রভা রায়ও নিজেকে আড়াল করেছিলেন সুকুমার রায়ের স্ত্রী হিসেবে। অথচ তিনিও ছিলেন একজন সৃজনশীল মনের শিক্ষিকা, অনবদ্য গায়িকা, সূচিশিল্পী ও ভাস্কর। এঁরা সেকালের বাঙালি সমাজে ‘ব্রাহ্মিকা’ বলে পরিচিত ছিলেন।

বিজয়ার জন্ম ১৯১৭ সালের ৪ এপ্রিল, পটনায়। তাঁর বাবা চারুচন্দ্র দাশগুপ্ত এবং মা মাধুরী (মতান্তরে প্রতিমা) দাশগুপ্ত। ওঁদের চার কন্যা গৌরী, সতী, জয়া ও বিজয়া। মাধুরী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর ছোট বোন। বিজয়ার দাদামশাই হলেন বরদানাথ হালদার। দিদিমা স্বর্ণময়ী। বিজয়ার পিতৃকুলের কুলপতি ছিলেন কালীনারায়ণ গুপ্ত (১৮৩০-১৯০৩)। তিনি আজকের বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ডিভিশনের ‘আকানগর’ গ্রামের জমিদার ছিলেন। তাঁর স্ত্রী অন্নদাসুন্দরী। কালীনারায়ণ গুপ্ত ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি এক দিকে যেমন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক ছিলেন, তেমনই তাঁর লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত ব্রাহ্মসমাজে খুবই জনপ্রিয় ছিল।

Advertisement

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট ভাই প্রমদারঞ্জনের নাতি প্রসাদরঞ্জন রায় জানিয়েছেন, কালীনারায়ণ ও অন্নদাসুন্দরী মোট পনেরো জন পুত্রকন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে পাঁচজন মারা যায় ছেলেবেলায়। পুত্রদের মধ্যে প্রথম পুত্র কে জি গুপ্ত ছিলেন আইসিএস অফিসার। দ্বিতীয় পুত্র প্রিয়মোহন গুপ্ত সিভিল সার্জেন। কনিষ্ঠ কন্যা সুবলা অনবদ্য গায়িকা ছিলেন। বড় মেয়ে সৌদামিনীর সঙ্গে বিয়ে হয় জগৎচন্দ্র দাশের। এঁদের একমাত্র সন্তান চারুচন্দ্রর জন্মের পর সৌদামিনী মারা গেলে জগৎচন্দ্র সৌদামিনীর বোন সরলাকে বিয়ে করেন। সরলার গর্ভে জন্ম নেয় ছয় সন্তান প্রতিভা, সুপ্রভা, সুধীন্দ্র, প্রশান্ত, কনক ও অনিল। সেক্ষেত্রে সত্যজিতের মা সুপ্রভা হলেন বিজয়ার বৈমাত্রেয় পিসি এবং সত্যজিৎ তাঁর বৈমাত্রেয় পিসতুতো ভাই।

চারুচন্দ্র বিলেতে গিয়েছিলেন আইসিএস হতে। কিন্তু ব্যারিস্টার হয়ে ফিরেছিলেন। হাবেভাবে তিনি ছিলেন পাক্কা সাহেব। পটনায় ওকালতি করতেন। তাঁর পসার ছিল জমজমাট। দীর্ঘদিন বিলেতবাসের কারণে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তাঁর মজ্জায় মিশেছিল। পটনায় চারুচন্দ্রর লাল ইটের প্রথম বাড়িটির নাম ছিল ‘লিলি ভিলা’। সামনে গোল ফুলের বাগান, বাগানের পাশে কুয়ো, বাগানের সামনে টেনিস কোর্ট। সেখানে টেনিস খেলা যেমন হত, বাড়িতে টেনিস পার্টিও হত। জুড়ি গাড়ি রাখার গ্যারাজ পেরিয়ে একটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছিল। তার পর বাবুর্চিখানা, যেখানে বাবুর্চি রাম খেলাওনের তৈরি বিলিতি রান্নার স্বাদ পরিবারের সদস্যদের বিভোর করে রাখত। পরে তাঁরা চলে আসেন ‘লিলি কটেজ’-এ।

বিজয়া রায়। —ফাইল চিত্র।

চারুচন্দ্র ও মাধুরীর মেয়েদের সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়দের ছেলেমেয়েরাও সারা বাড়ি গানে গল্পে গুলজার করে রাখত। বাড়ির কাছেই ছিল ‘পিকচার হাউস’ সিনেমা হল। সপ্তাহে দুটো তিনটে হলিউডের নির্বাক ছবি দেখা ছিল আবশ্যিক পারিবারিক কাজ। বাড়িতে ফিল্ম ম্যাগাজিন আসত নিয়মিত। পাশ্চাত্য আদবকায়দা, খাওয়াদাওয়া, জীবনযাপন, গানবাজনা সবেতেই চারুচন্দ্রের লিলি ভিলা ও পরে লিলি কটেজের পরিবেশ ভরে থাকত। অন্য দিকে মাধুরী ছিলেন স্বদেশী ভাবাপন্ন। জীবনে বিলিতি পোশাক তাঁর গায়ে ওঠেনি। তাঁর মেয়েদেরও খদ্দর ছাড়া অন্য কাপড়ের পোশাক পরাননি কখনও।

বিজয়ার ছেলেবেলার পরিবেশ ছিল এইরকম। ফলে তাঁর রুচি ও বোধের মধ্যে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যর মেলবন্ধন ঘটেছিল সহজেই। ব্রহ্মসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের গান, হিন্দুস্তানী রাগাশ্রয়ী গান, পাশ্চাত্য গান ও সঙ্গীত সর্বদা বাড়ির হাওয়ায় ভাসত। চারুচন্দ্রের চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে গৌরী ছাড়া সকলেই ভাল গাইতেন। বিজয়ার মেজদি সতীদেবীর গানের খ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনায় তাঁর নাটকে গেয়েছেন ও অভিনয় করেছেন তিনি। মুম্বইতে পৃথ্বী থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গায়িকা-নায়িকা হিসেবেও খ্যাতি পান।

দাশগুপ্ত বংশেরই কনক দাশ, সুপ্রভা রায় রবীন্দ্রনাথের গানের গায়িকারা ছিলেন বিজয়ার পিসিমা। সে সময় যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সাহানা দেবী, প্রতিমা দত্ত, অমিয়া ঠাকুর, পূর্ণিমা ঠাকুর, চিত্রা ঠাকুর, সতীদেবী, রাজেশ্বরী দেবীদের মাধ্যমেই মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান পৌঁছত। সাহানা দেবীর কাছে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের গান যেমন বিজয়া শিখেছিলেন, তেমনই ক্লাসিক্যাল, সেমি-ক্লাসিক্যাল গানও শিখেছিলেন। তবে বিজয়া রায়ের মতে সবচেয়ে ভাল গাইতেন সুপ্রভা। কিন্তু নিজেকে তিনি কখনও জনসমক্ষে আনেননি। শান্তিনিকেতনে গেলে সুপ্রভাকে নিজে তাঁর নতুন গান শিখিয়ে দিতেন রবীন্দ্রনাথ। সুপ্রভা রায়ের গাওয়া একটি গানের স্মৃতি বিজয়ার কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে গিয়েছিল।

তিনি জানিয়েছেন, “মেজপিসিমা যখন তখন গান গেয়ে উঠতেন। মানিক তখন খুব ছোট। টাইগার হিলে ওঁরা বেড়াতে গিয়েছেন। সূর্যোদয়ের আগে বেশ ভিড়। তার মধ্যে বিদেশিই বেশি। হঠাৎ দেখা গেল পাহাড়ের মাথা ফুঁড়ে সূর্য উঠছে। মেজপিসিমা ওই অচেনা ভিড়ের মধ্যে চিৎকার করে গেয়ে উঠলেন, ‘তিমিরদুয়ার খোলো, এসো এসো নীরব চরণে’। সবাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। মেজপিসিমার ভ্রুক্ষেপ নেই।” এই গল্পটি শুনে যে কোনও সত্যজিৎ ভক্তর মনে তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির দৃশ্যের কথা মনে পড়া উচিত।

বিজয়া রায়। —ফাইল চিত্র।

বিজয়া রায়ও গায়িকা হিসেবে কিছু কম ছিলেন না। বিজয়ার গানের ভক্ত ছিলেন দিলীপ রায়। তাঁর গলায় নিজের গান শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সুকুমার রায়ও মৃত্যুর আগে তাঁর গান শুনে গিয়েছেন। চারুচন্দ্রর ঠিক করা এক সঙ্গীত শিক্ষক বিজয়াকে গান শেখাতে আসতেন। তিনি বিজয়ার গান শুনে কিছু দিন পর কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল বিজয়া তাঁর চেয়েও ভাল গান।

ছুটির সময়ে পটনা থেকে চারুচন্দ্র গোটা পরিবার নিয়ে কলকাতায় আসতেন। একবার কলকাতার বকুলবাগানে কাকা প্রশান্তকুমারের বাড়িতে আসার পরে তাঁর ছোট পিসি (কনক দাশ) বিজয়াকে দিয়ে জোড়াসাঁকোয় ‘শেষবর্ষণ’ গীতিনাট্যে গাইয়েছিলেন। বিজয়ার বয়স তখন আট। কনক দাশ বিজয়াকে গান তুলিয়ে দিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাজি হবেন কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল বিজয়ার মেজ পিসি সুপ্রভার। কনক ও সুপ্রভা দু’জনে শিশু বিজয়াকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে হাজির হলেন। সুপ্রভার দায়িত্ব ছিল তিনিই রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রস্তাবটা রাখবেন। প্রস্তাব শুনে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত। তিনি ভাবতে পারেননি আট বছরের একটি মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারবে। রবীন্দ্রনাথকে একবার বিজয়ার গান শোনার অনুরোধ করলেন সুপ্রভা। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে বিজয়া অবলীলায় গেয়ে দিলেন ‘শেষবর্ষণ’-এর দু’টি গান। বিজয়া লিখছেন, “গান শেষ হলে পর ধীরে ধীরে আমার মাথার উপর হাত রাখলেন, একটু কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, আজ বিজয়াই গাইবে।’” বিজয়ার জীবনে এই অভিজ্ঞতা অমূল্য সম্পদ হয়ে থেকে গিয়েছিল আজীবন।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাই প্রফুল্লচন্দ্রের (বুলা) উদ্যোগেই বিজয়ার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি হয়েছিল। সেখানে দু’টি গান ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’ এবং ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’ লোকের মুখে মুখে ফিরত। পরে ৮ থেকে ১০টি গান হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। গায়িকা হিসেবে বিজয়া যে কেবল রবীন্দ্রনাথের গান, হিন্দুস্তানি ভজন গাইতেন এমন নয়। পাশ্চাত্য অপেরার গান, সোপ্রানোও গাইতে পারতেন অনায়াসে। পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক রেকর্ড চারুচন্দ্র বাড়িতে রেখেছিলেন। সেই রেকর্ড শুনে শুনে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা জন্মেছিল তাঁর। সেকালের প্রখ্যাত অপেরা গায়িকা যেমন ইটালির অ্যামেলিটা গ্যালি কুর্চি (১৮৮৫-১৯৬৩), গায়ক এনরিকো করুসোর (১৮৭৩-১৯২১) গান বিজয়ার প্রিয় ছিল। এ ছাড়া রুশ গায়ক ফিওডোর ইভানোভিচ চ্যালিয়াপিনও (১৮৭৩-১৯৩৮) বিজয়াকে মুগ্ধ করতেন।

গ্যালি কুর্চির খ্যাতি ছিল তাঁর গলার কাজের জন্য, যাকে অপেরা গানের জগতে ‘কোলোরাটুরা সোপ্রানো’ বলা হয়ে থাকে। বিজয়া ইটালীয় ভাষা না জেনেও গ্যালি কুর্চির গাওয়া উঁচু পর্দায় কোলোরাটুরা সোপ্রানো অনায়াসে গাইতেন শিশু বয়সেই। তাঁর ‘গলায় কুল কুল করে কাজ আসত’। যাঁরা সোপ্রানো শুনেছেন তাঁরা জানেন গলায় ‘কোলোরাটুরা’র কাজ তুলে আনা কতখানি শক্ত ব্যাপার। চারুচন্দ্র বিজয়ার গলায় এই কোলোরাটুরার কাজ হঠাৎই একদিন শুনে ফেলে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। অত ছোট একটি মেয়ে যে অমন অবলীলায় কোলোরাটুরা সহযোগে সোপ্রানো গাইতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন বিজয়াকে প্যারিসে পাঠিয়ে আরও বড় সোপ্রানো গায়িকা হিসেবে তৈরি করবেন। তবে ভাগ্যের ফেরে চারুচন্দ্রের সেই ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি ১৯৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাতে বাহান্ন বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই মারা যান। দাশগুপ্ত পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চারুচন্দ্রের ভাই প্রশান্তকুমার গোটা পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ১৯৩২ সালের ২ জানুয়ারি পটনার মাধুরী দাশগুপ্ত তাঁর চার কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন।

তাঁরা কলকাতায় এসে প্রশান্ত কুমার দাশের বকুলবাগানের বাড়িতে ওঠেন। এই বাড়িতে আসার তিন মাসের মধ্যে বিজয়ার বড় দিদি গৌরীর বিয়ে হয় সেকালের বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সোহনলালের ভাই মদনলাল সাক্সেনার সঙ্গে। প্রসঙ্গত, ১৯২৩ সালে সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর সুপ্রভা পুত্র সত্যজিৎকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকতেন। এই বাড়িই ছিল সত্যজিতের মামার বাড়ি। বিজয়া লিখেছেন, “কলকাতায় এসে ভালোভাবে পড়াশুনা আরম্ভ হল। অনাদিবাবু (অনাদি দস্তিদার) প্রায়ই আসতেন, আমাকে গান শেখাতেন।” কলকাতায় বিজয়া ‘নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’-এ ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা হিসেবে পেয়েছিলেন তটিনী দাসকে। ১৯৩৪ সালে বিজয়া ম্যাট্রিক পাশ করে ভবানীপুরের আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে তিনি আই এ পরীক্ষা দেন। একটি বাঙালি পরিবারে বিবাহযোগ্যা মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়দের মধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আই এ পরীক্ষা দেওয়ার আগে ও পরে বিজয়ার বিয়ে নিয়ে দু’টি ঘটনা তাঁকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। দু’টি ক্ষেত্রেই সম্পর্ক এনগেজমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছেও ভেঙে যায়।

ইতিমধ্যে বিজয়া এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। বড়দির কাছ (লাহোর) থেকে ফিরে বেলতলার বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বিজয়ার কানে এল বৈঠকখানা ঘরে খুব গম্ভীর গলার কে যেন কথা বলছে। গলাটা চেনা মনে হলেও ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে যান। বিজয়া লিখছেন, “মানিকের গলা। এবং শুধু গলা নয়, এই দু’মাসের মধ্যে ও অন্তত একহাত লম্বা হয়ে গেছে। ছ’ফুট তো বটেই। ওকে যেন চেনাই যায় না। সেই গাল ফোলা মানিকের গাল ভেঙে মুখটা লম্বা হয়ে গেছে, আর ওর দিকে তাকাতে গেলে মুখটা অনেকখানি তুলতে হয়।”

এই ভাবেই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শুরু। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বিজয়ার কাছে সে দিন তাঁদের বকুলবাগানের বাড়িতে নিজের পিসতুতো ভাই যেন দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। সত্যজিতের শিক্ষা, রুচি, প্রজ্ঞা আর কণ্ঠের প্রত্যয় বিজয়াকে চমকে দিয়েছিল। তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট লাজুক ভাই মানিককে এত দিন ওই বাড়িতেই যে ভাবে দেখেছেন, তার এই অভাবনীয় রূপান্তর বিজয়াকে একজন সত্যিকারের পুরুষ বন্ধুর সন্ধান দিয়েছিল। যে বন্ধু তাঁরই মতো শিক্ষিত, পরিশীলিত রুচি ও মননের গভীরতার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। এমন মানুষের সঙ্গেই তো বিজয়া বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তাও বিজয়া জানতেন।

তবে বন্ধুত্ব হতে বাধা ছিল না। ১৯৪০ সাল থেকে সেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে শুরু করেছিল পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও হলিউডের সিনেমাকে ঘিরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে প্রতি রাতে রেডিয়োয় বাখ, বিঠোফেন, মোৎজ়ার্ট প্রমুখ দিকপাল সঙ্গীত রচয়িতাদের সিম্ফনি শোনা ও প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে হলিউডের ছবি দেখা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। বিজয়া জানিয়েছেন, “মানিকের সঙ্গে এইভাবে একসঙ্গে বসে মিউজিক শুনতে শুনতে কবে যে সেটা গভীর প্রেমে পরিণত হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে ‘ও’ আমার চেয়ে ছোট, তার ওপর আত্মীয়। কাজেই বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। দু’জনেই ঠিক করলাম। কোনওদিন বিয়ে করব না। যে-ভাবে চলছে চলুক।”

স্নাতক হওয়ার পরে বিজয়াকে নজর দিতে হয় তাঁর পরিবারের প্রতি। চাকরি করার প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি। কমলা গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি দিয়ে বিজয়ার কর্মজীবন শুরু। তার পর বেথুন স্কুল। এখানে পড়ানোর পাশাপাশি গানও শেখাতেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধের আবহাওয়ায় বেথুন স্কুল ঢাকায় স্থানান্তর করার উদ্যোগ শুরু হলে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মা ও বোনকে নিয়ে নিজের পরিবারের ভরণপোষণের চিন্তা তখন তাঁকে পেয়ে বসেছে। সত্যজিৎ কাজ করছেন ডি জে কেমার বিজ্ঞাপন সংস্থায়। তিনি আর্থিক সাহায্য করতে চাইলে বিজয়া তা নিতে অস্বীকার করেন। পরে কাকা প্রশান্তকুমারের এক বন্ধুর চেষ্টায় তিনি যুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মির সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে চাকরি পান। দু’জনের অফিস একই পাড়ায় হওয়ায় ছুটির পরে সিনেমা দেখার সুবিধে হয়েছিল।

মনে রাখা দরকার, গত শতকের চল্লিশের দশক ছিল হলিউডের স্বর্ণযুগ। প্রবাদপ্রতিম পরিচালকদের ছবি তখন কলকাতার সাহেব পাড়ার সিনেমা হলগুলিতে প্রতি সপ্তাহে মুক্তি পেত। বিজয়া জানিয়েছেন, প্রথম প্রথম তাঁদের সিনেমা দেখার আগ্রহ ছিল ছবির কাহিনি, গান ও অভিনেতাদের ঘিরে। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা দু’জনেই উপলব্ধি করেন অভিনেতারা ছাড়া পরিচালক বলে একজন ব্যক্তির উপস্থিতি একটি ছবির ভালমন্দর সঙ্গে জুড়ে আছে। তার পর থেকেই নাকি সত্যজিৎ সিনেমা পরিচালনার দিক নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে বিজয়া সিনিয়র ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। মাইনে ভাল হলেও তিনজনের সংসার টানার পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে আরও রোজগারের পথ খুঁজতে হয়েছিল। এই খোঁজই তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের দিকে নিয়ে যায়। যদিও তাঁর নিজের পরিবারের ও সত্যজিতের এতে মত ছিল না। কিন্তু কেউ তাঁকে বাধা দেননি। বিজয়া প্রথমে পরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ‘শেষরক্ষা’ ছবির নায়িকা হিসেবে কাজ করেন। তার পর মণি ঘোষের ‘সন্ধ্যা’। কিন্তু ছবি দু’টি বক্স অফিসে সাফল্য পায়নি। ফলে বিজয়া মুশকিলে পড়েন। এমনই এক সময়ে তাঁর মেজদি সতীদেবী তাঁকে মুম্বই ডেকে নেন। সতীদেবীর মুম্বইয়ে অনেক যোগাযোগ ছিল। তাঁর মেয়ে রুমা (গুহঠাকুরতা) ‘বম্বে টকিজ’-এ দেবিকা রানির কাছে কাজ করতেন। সতীদেবী নিজেও হিন্দি সিনেমা ও নাটকে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় ও গান করেছেন। পৃথ্বী থিয়েটারের প্রথম নাটক ‘শকুন্তলা’য় তিনি অভিনয় করতেন।

মুম্বইয়ে বিজয়া ‘জনতা’ (পরিচালক রাম প্রকাশ), ‘রেণুকা’ (পরিচালক রমেশ সায়গল) ও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ অবলম্বনে ‘মশাল’ (পরিচালক নীতিন বসু) ছবিতে কাজ করেন। যদিও মুম্বইয়ের অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি এবং তিনি তাঁর অভিনেত্রী জীবনকে ভুলতে চেয়েছেন। অথচ যে আর্থিক সুরাহার খোঁজে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেছিলেন তাও যখন সফল হল না, তিনি আবার চিন্তায় পড়লেন। সত্যজিৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে মাঝেমাঝেই মুম্বই যেতেন। ইতিমধ্যে তিনি চাকরি জীবনে আরও উন্নতি করেছেন। কিন্তু বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও আর্থিক সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে তিনি রাজি করাতে পারছিলেন না বিজয়াকে। বিজয়ার যুক্তি ছিল, যেহেতু তাঁদের বিবাহ সম্ভব নয়, তাই আর্থিক সাহায্য নেওয়াও সম্ভব নয়।

সত্যজিৎ এর পরে বিজয়াকে একটি আংটি উপহার দেন ও মুম্বইতেই তাঁদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করেন কাফ প্যারেডে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ১৯৪৮ সালের ২০ অক্টোবর। অতিথিদের মধ্যে সে দিন পৃথ্বীরাজ কপূর উপস্থিত ছিলেন। অনেক আত্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও সুপ্রভাকে তাঁর ছেলের বিয়ের খবর দেওয়া হয়নি। কারণ, সেই সাহস কারও হয়নি। সত্যজিতেরও না। শেষে তাঁদের পারিবারিক ডাক্তার নসুবাবুর (সুধীরকুমার মখোপাধ্যায়) সাহায্যে সুপ্রভাকে এই বিয়ে মেনে নিতে রাজি করানো হয়।

১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ বিজয়া ও সত্যজিতের ব্রাহ্ম মতে বিয়ে হয় কলকাতায় ক্ষিতিমোহন সেনের পৌরোহিত্যে। বিয়ের পরে কুটনো কুটতে কুটতে সুপ্রভা একদিন বিজয়াকে বলেছিলেন, “তুমি রায় বংশের মান রাখতে পারবে তো?” কারণ, তাঁর মতে, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই আমাদের রায় বংশ, এটা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে।” বিজয়া তাঁর সারা জীবন দিয়ে সেই মান রক্ষা করে গিয়েছিলেন।

পরের বছর ডি জে কেমার সংস্থা সত্যজিৎ রায়কে ইংল্যান্ডে কাজ করতে পাঠায়। সে কথা জানতে পেরে সুপ্রভা একা সত্যজিৎকে বিদেশে যেতে দিতে রাজি হন না। তাঁর শর্ত ছিল, যেতে হলে বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন বিদেশবিভুঁইয়ে তাঁর মানিক একা কিছুই করে উঠতে পারবে না। সে একজন শিশুর মতো। সুপ্রভা বা বিজয়া ছাড়া তাঁর দিন চলে না। ফলে সত্যজিৎকে অফিসের অনুমতি চাইতে হয়। অফিসের কাজে বিদেশ ভ্রমণ বদলে যায় মধুচন্দ্রিমায়। ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল কলকাতা থেকে বিজয়া ও সত্যজিৎ বিদেশের উদ্দেশে রওনা হন। ৮ মে ইংল্যান্ডের টেমস নদীর তীরের ‘টিলবারি’ বন্দরে তাঁরা পৌঁছন। পরের দিন ৯ মে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। আর সেই দিনই তাঁরা ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ ছবিটি দেখেন। হলিউডের ছবি দেখা চোখে সেটা এতই অন্যরকম লেগেছিল যে, “ছবি দেখতে দেখতে কখন দু’জন দু’জনের হাত ধরেছি মনে নেই।”

এর পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা। দু’জনের ভালবাসার ফসল হিসেবে বাঙালি তথা গোটা মানবজাতি পেয়েছিল একটি ছবি, ‘পথের পাঁচালী’। বিজয়া সত্যজিতের হাত আর কখনওই আলাদা হয়নি ২৩ এপ্রিল ১৯৯২ অবধি, যে দিন বিজয়া ও সকলকে ছেড়ে চলে যান সত্যজিৎ। তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রাপথের সহযাত্রী ছিলেন বিজয়া সারা জীবন। সত্যজিতের প্রয়াণের তেইশ বছর পর আটানব্বই বছর বয়সে ২ জুন ২০১৫ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

তথ্যসূত্র: আমাদের কথা

(ছবি সৌজন্য); সুপ্রভা রায়,

দি আনভ্যানকুইশড

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement