মা তাঁকে ডাকতেন ‘দুখী’ বলে।
‘বামাক্ষ্যাপা’ ছবিতে যখন বামার মায়ের মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সুশীলারানী হলের মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘‘ওরে আমার দুখীকে নিয়ে যাচ্ছে!’’
তা, দুখীই বটে!
জনমদুখিনী না হলে কি আর আট বছরের মেয়েকে রাত-জাগা থিয়েটারে সখীর দলে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচতে হয়? না কি একটু বড় হতেই এ মঞ্চ-সে মঞ্চ করে শেষে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় স্টুডিয়ো পাড়ায়?
মেয়েটির ভাল নাম ‘মলিনমালা’। কে যে কেন এই নাম দিয়েছিলেন, তা অকথিতই রয়ে গিয়েছে। তবে নিষ্করুণ মহানগরের শানে ঠোক্কর খেতে খেতে সেই মলিনমালার অভিনেত্রী মলিনা দেবী হয়ে ওঠার আখ্যান শুধু প্রতিভা আর পায়ের নীচে মাটি পাওয়ার মরিয়া লড়াই নয়, বাংলা ছবির সাবালক হয়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গেও তাঁর আঙুলে আঙুল জড়ানো।
পতন ও প্রমথেশ
১৯২৯ সাল। দমদমের একটি বাগানবাড়িতে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্ম কোম্পানির ‘পঞ্চশর’ ছবির শুটিং চলছে। সে সময়ের বাংলা ছবির অন্যতম ভগীরথ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ডিজি, দেবকীকুমার বসুরা ওই কোম্পানি গড়েছেন। গৌরীপুরের রাজকুমার প্রমথেশ বড়ুয়া এসেছেন শুটিং দেখতে। হঠাৎই শান বাঁধানো রাস্তায় শাড়িতে পা জড়িয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলেন এক কিশোরী। সহজাত সহবতে রাজকুমার ছুটে গিয়ে হাত ধরে তাঁকে টেনে তুললেন। কিশোরীটি স্ট্রাগলার, ছবিতে যদি কোনও ছোটখাটো রোল পাওয়া যায় এই আশায় এসেছিলেন। প্যান্ট-শার্ট পরা রাজকুমারও যে হয়, তা তাঁর ধারণার অতীত! উটকো লোক হাত ধরেছে ভেবে তিনি কটমট করে তাকালেন। ডিজি ছুটে এসে বললেন, “তুমি কার দিকে অমন চোখ পাকিয়ে দেখছ? জানো উনি কে?” মেয়ে তো লজ্জায় লাল! ক্ষমা চাইতে গেলেন। দ্বিগুণ লজ্জা পেয়ে বিরাট গাড়িতে উঠে চলেই গেলেন প্রমথেশ।
সে ছবিতে মলিনা চান্স পেলেন না। তাঁর বয়স তখন মোটে তেরো। কিন্তু তার মধ্যেই বেশ কিছু কাজ করা হয়ে গিয়েছে। মাত্র আট বছরে তাঁকে মিনার্ভা থিয়েটারে ‘কিন্নরী’ নাটকে সখীর দলে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। পেশাদার থিয়েটার তখন চলত প্রায় রাতভর, মাঝে-মাঝে সখীর দলের নাচ হত। কখন ডাক পড়বে সেই অপেক্ষা করতে-করতে ছোট্ট মেয়েটা কোথায় কোন ড্রেসের বাক্সের ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ত। নাচের দলের বড় মেয়েরা ঠিক খুঁজে বার করে চড়চাপড় দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে যেত মঞ্চে।
সেই সময়ে মিনার্ভায় ‘মিশরকুমারী’ নাটকে ‘আবন’ চরিত্রে অভিনয় করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। ছোট্ট মেয়েটি তার কী-ই বা বোঝে? ‘কিন্নরী’র পরে সেই নাটকেও সে রাতজাগা চোখে হাত-পা ঘুরিয়ে নেচে যায়।
এর কয়েক বছর পরে বালকত্ব প্রাপ্ত হল মলিনমালার। টাকাপয়সা নিয়ে মিনার্ভার সঙ্গে তার ‘গার্জেনদের’ কী গোলমাল হয়েছিল, তাঁরা তাকে মিনার্ভা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মনমোহন থিয়েটারে পাঠালেন। ছেলের পার্ট। প্রথম ‘জাহাঙ্গীর’ নাটকে বালক দারা, তার পর ‘কণ্ঠহার’ নাটকে শ্যামল। সত্যি বলতে, এই তাঁর প্রথম ‘অভিনয়’ যা নিছকই নাচ নয়। কিন্তু সে-ও ভাগ্যে বেশি দিন সইল না। ‘গায়ে গতরে পুরুষ্টু’ হয়ে যাচ্ছিলেন বলে ছেলে সাজা কঠিন হয়ে উঠছিল। মনমোহন থেকে চাকরি গেল। পরে স্টার থিয়েটারে নাচের জন্যই মিলল কাজ— ‘শকুন্তলা’ আর ‘স্বয়ংবরা’ নাটকে। অভিনয়ের সুযোগ নেই।
মলিনমালা সিনেমায় কাজ খুঁজতে শুরু করে দিলেন। এবং তখনই ওই পতন। কয়েক বছরের মধ্যে দর্শকের চোখের মণি হয়ে ওঠা নায়ক-পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া তখনও ছবিতে পা রাখেননি। জল মাপছেন। নিউ থিয়েটার্সের জন্ম হয়নি। ভারতীয় সিনেমার তখনও কথা ফোটেনি।
এক ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন
সে বছর গ্রীষ্মে লবণ সত্যাগ্রহ হল, ডান্ডি মার্চ করলেন গাঁধীজি। ১৯৩০ সাল। শীতে অন্য একটা বিপ্লব ঘটল।
হিন্দু স্কুলের ছাত্র বীরেন্দ্রনাথ সরকার বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসে সিনেমা হল তৈরির কাজ পেয়েছিলেন। ১৯৩০-এর ২০ ডিসেম্বর, রাধা ফিল্মসের ১০ রিলের ছবি ‘শ্রীকান্ত’ ছবি দিয়ে দ্বারোদ্ঘাটন হল সেই প্রেক্ষাগৃহ ‘চিত্রা’র (পরে নাম বদলে ‘মিত্রা’)। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস নিয়ে পরে যে বাংলা তথা অন্য ভারতীয় ভাষায় একগুচ্ছ ছবি হবে, এটিই সম্ভবত তার প্রথম। ছবির নায়ক ছিলেন পরে গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি ডাহা ফ্লপ। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ড তখনও বেরোয়নি, শরৎচন্দ্রের কাছে ব্যাপারটা বিশেষ সুখকর ছিল না নিশ্চিত। কিন্তু দু’টি বড় ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল।
এক, সে কালে কলকাতার সেরা প্রেক্ষাগৃহ যাত্রা শুরু করল — “চিত্রার সহিত তুলনায় নিউ এম্পায়ার ও গ্লোবেরও দোষ ধরা যাইতে পারে।... টকির এমন নিখুঁত আয়োজন কলিকাতার অন্য কোনও চিত্রাগারে নাই—।” (চিত্রলেখা পত্রিকা)
যদিও ‘টকি’ কথাটি ব্যবহৃত হল কেন, তা ভেবে দেখার। কেননা ভারতীয় ছবি তখনও কথা কইতে শেখেনি, সে নেহাতই নিঃশব্দে নড়েচড়ে বেড়ানো ‘মুভি’। প্রথম ভারতীয় টকি হিন্দি ‘আলম আরা’ ভূমিষ্ঠ হতে এক বছর বাকি (মুক্তি ১৪ মার্চ ১৯৩১, ছ’সপ্তাহ বাদে ২৫ এপ্রিল প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’)।
কিন্তু হলিউডে ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ ছবিতে ১৯২৭-এ শব্দের যে কেরামতি শুরু, তার ধাক্কায় তত দিনে মার্কিন ছবি প্রায় পুরোপুরি টকির দখলে। পরাধীন শিক্ষিত বাঙালি যে সে দিনও নিয়মিত সাগরপারের খোঁজ রাখত, তাদেরই কম্পাসে দিগ্দিশা দেখত, সেটা বেশ বোঝা যায়।
দুই, ওই ছবিতেই একটি ছোট্ট রোলে আত্মপ্রকাশ করলেন কিশোরী মলিনা, যিনি তার পরের প্রায় সাড়ে চার দশক বাংলা ছবিতে থেকে যাবেন। ইতিমধ্যে বীরেন্দ্রনাথ ওরফে বি এন সরকার ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফটস’ তৈরি করেছেন। এই সময়ে বিষেণচাঁদ ওরফে জলু বড়ালের সঙ্গে মলিনমালার পরিচয়। জলুবাবুই তাঁর নাম পাল্টে রাখলেন ‘মলিনা’। ১৯৩১ সনে ম্যাডান কোম্পানির ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর ফিল্ম ক্রাফটসের ‘চাষার মেয়ে’ ছবিতে মুখ দেখালেন তিনি। বলার মতো কিছু নয়, কিন্তু ‘চাষার মেয়ে’ ছবিই তাঁকে প্রথম জনসমক্ষে পরিচিতি দিল।
ওই ১৯৩১ সালেই বি এন সরকার তৈরি করলেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স’। জলু বড়াল হলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার। সে কালের ‘স্টুডিয়ো সিস্টেম’-এ পরিচালক থেকে অভিনেতা থেকে যন্ত্রী, সকলেই ছিলেন মাসমাইনে করা। কিছু দিন বাদে মলিনারও সেখানে অভিনেত্রীর চাকরি জুটে গেল। রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ করলেন পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নির্মলার চরিত্রে মলিনা। অতি সাধারণ ছবি, সাধারণ পার্ট। কিন্তু এই প্রথম সবাক ছবিতে অভিনয় করলেন মলিনা।
কথা কও কথা কও
ছবির সবাক হয়ে ওঠা বহু কিছু পাল্টে দিচ্ছিল তখন। রূপের জৌলুসে আর শরীরী সাহসিকতায় যে অ্যাংলো আর পার্সি মেয়েরা রুপোলি পর্দা দখল করে রেখেছিলেন এত দিন, ঝরঝরে বাংলা বা হিন্দি সংলাপ বলতে না পারায় তাঁরা পিছু হটছিলেন। সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে দ্রুত উঠে আসছিলেন কাননবালা, চন্দ্রাবতী, লীলা দেশাই, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, মলিনারা। সবাক যুগের প্রথম সুপার গায়িকা-নায়িকা হওয়ার দৌড়ে বাকিদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যান রূপবতী কানন। কিন্তু সময় যত গিয়েছে, স্রেফ অভিনয়ের জোরেই নিজের স্বাক্ষর তৈরি করে নিয়েছেন সমবয়সি মলিনা।
প্রথম দিকটায় সিনেমাতেও কিন্তু নাচই ছিল মলিনার তুরুপের তাস। সে ১৯৩৩ সালে দেবকী বসুর ‘মীরাবাঈ’ হোক বা পরের বছর হীরেন বসুর নর্তকী-নায়িকার ছবি ‘মহুয়া’। অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় বলেন, “শুনেছি, ‘মহুয়া’ ছবিতে মলিনাদির নাচের জন্যই প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাগানবাড়ি কিনে নিউ থিয়েটার্স-২ স্টুডিয়ো করা হয়েছিল, এখন যেটা সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি।”
নিউ থিয়েটার্স মলিনাকে নিজের মতো করে গড়ে-পিটে নিচ্ছিল। জলু বড়ালের ছোট ভাই রাইচাঁদ বড়াল নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর কাছে গান শিখলেন মলিনা। বড়ালেরা তিন ভাই— কিষেণচাঁদ, বিষেণচাঁদ আর রাইচাঁদ। বিষেণচাঁদের আগেই একটি বিয়ে ছিল। কিন্তু মলিনার প্রেমে পড়লেন তিনি, দু’জনের বিয়েও হয়ে গেল। ললিতমোহন গোস্বামীর কাছে নাচ শিখছিলেন মলিনা, খেমচাঁদ প্রকাশের কাছেও তালিম নিলেন। অভিনেতা-পরিচালক অমর মল্লিকের কাছে শিখলেন অভিনয়। সে কালে নিউ থিয়েটার্সের অধিকাংশ ছবি হত ‘ডাবল ভার্সন’, অর্থাৎ একই ছবি বাংলা-হিন্দি দুই ভাষাতেই তৈরি হত। অভিনেতা এবং কলাকুশলী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক। তার জন্য মাস্টার রেখে অভিনেতাদের হিন্দি শেখানো হত। মলিনাও অন্যদের মতো মুনশি আসগর হোসেন শোরের কাছে শিখলেন হিন্দি আর উর্দু।
নায়িকা সংবাদ
সে কালে কিন্তু স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির একটা বাজার ছিল, এ কালে যা নেই। সাধারণত বড় ছবির সঙ্গেই দেখানো হত। ’৩৩-৩৪ সালে ডিজি-র দু’টি ছোট ছবি, পাঁচ রিলের ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ এবং তিন রিলের ‘মাস্তুতো ভাই’-তে প্রথম নায়িকার রোল পান মলিনা। দু’টিই হাসিতে ঠাসা, দ্বিতীয়টি তো বিপুল জনপ্রিয়। এর পর ‘মহুয়া’ হয়ে ফের ছোট ছবি ‘অবশেষে’, নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়া। ১৯৩৬-এ বড়ুয়াসাহেবেরই পরিচালিত ‘গৃহদাহ’ ছবিতে তিনি মৃণাল। ’৩৮ সালে প্রফুল্ল রায়ের ‘অভিজ্ঞান’। হিট নায়িকা মলিনা রইলেন সেই ছবির হিন্দি ভার্সন ‘অভাগীন’-এও, বিপরীতে নায়ক পৃথ্বীরাজ কপূর।
এর পর বিপুল সাফল্য এল ‘বড়দিদি’ ছবিতে মাধবীর ভূমিকায়। কাহিনিকার শরৎচন্দ্রের তরল আবেগকে পর্দায় জীবন্ত করে তুললেন মলিনা। তখনও তিনি ‘দেবী’ সম্বোধনে অভ্যস্ত নন। এক মুগ্ধ দর্শকের চিঠির উত্তরে লিখলেন, “আমার নামের পিছনে দেবী কথাটি জুড়ে দিয়ে আপনি দেবীত্বের অপমান করেছেন মাত্র। আমি এ-জীবনে দাসী হয়ে জন্মেছি এবং দাসীই থাকতে চাই।”
কিন্তু নায়িকা নন, বরং চরিত্রাভিনয়ের দিকে যত ঝুঁকেছেন, তত রূপ-রং খুলেছে মলিনার। তার প্রমাণ ১৯৩৯-এ প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত-অভিনীত ‘রজত-জয়ম্তী’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্র হয়েও পাহাড়ী সান্যালের পাশাপাশি তাঁর অভিনয়।
রিয়াল টিয়ার্স
১৯৩৯-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। ভারতের মাটিতে সরাসরি তার ধাক্কা না লাগলেও অর্থনীতিতে ভাটার টান লাগছিল। ১৯৪০ সালে পাকা চাকরির ব্যবস্থা তুলে দিয়ে ছবি প্রতি চুক্তির বন্দোবস্ত চালু করল নিউ থিয়েটার্স। সুরক্ষিত মাসমাইনের দিন শেষ। অনেকেই বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন। আবার এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন এমন প্রতিভা যাঁদের আছে, তাঁদের কাছে নিউ থিয়েটার্সের বাইরে কাজ করার সুযোগও তৈরি হল, যা এত দিন তাঁরা পাননি।
এম পি প্রোডাকসন্সের ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবিতে অভিনয় করলেন মলিনা। প্রশংসাও পেলেন। পরের বছর অগস্টে দেশ স্বাধীন হল। ডিসেম্বরে মুক্তি পেল ‘রামের সুমতি’, মলিনা রামের বৌদি। তুমুল হিট। আর্দ্র স্নেহের যে জ্যান্ত এবং প্রায়শ উচ্চকিত প্রকাশ মূলধারার বাংলা তথা ভারতীয় ছবিতে শরৎচন্দ্রকে ক্রমশ অক্ষয় করে তুলছিল, মলিনা যেন তারই জীবন্ত ত্রিমাত্রিক প্রতিভূ। ‘রামের সুমতি’র হিন্দি ভার্সন ‘ছোটা ভাই’ তাঁকে দেশজোড়া খ্যাতি এনে দিল। কিন্তু মলিনা নিজে বোধহয় বুঝছিলেন, তিনি ছাঁচে পড়ে যাচ্ছেন।
’৫২ সালে নিউ থিয়েটার্সে ফের শরৎবাবুরই গল্প নিয়ে হল ‘বিন্দুর ছেলে’। সেই একই জোয়ার। তার পর হিন্দি ভার্সন ‘ছোটি মা’-র কাজ শুরু হল। পরিচালক হেমচন্দ্র চন্দ্র। “প্রথম দিন স্ক্রিপ্ট শুনতে এসেছেন। আমরা সহকারী। স্ক্রিপ্ট শুনে বললেন, ‘দেখো, শরৎবাবুর ‘রামের সুমতি’র বৌদি, ‘বিন্দুর ছেলে’-তে বড়বৌ, ‘বৈকুণ্ঠের উইলে’র সৎমা এবং ‘নিষ্কৃতি’র সিদ্ধেশ্বরী— এই চরিত্রগুলো প্রায় একই ধরনের। যা বুঝতে পারছি, এগুলো বোধহয় আমাকেই করতে হবে। তোমরা দেখো, যেন রিপিট না হয়,” স্মৃতি থেকে বলেছেন পরে প্রতিষ্ঠিত পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।
বিন্দু তার নতুন বাড়িতে চলে যাচ্ছে। বড়বৌ মলিনা তুলসীতলায় এসে দাঁড়াবেন, তাঁর চোখ বেয়ে জল নামছে। হেমচন্দ্র বললেন, ‘‘মলি, রেডি?’’ মলিনাকে নিউ থিয়েটার্সে সকলে ‘মলি’ নামেই ডাকতেন। হঠাৎ হেমচন্দ্র দেখেন, মলিনা সেটের এক ধারে মেকআপ ম্যানের কাছ থেকে লুকিয়ে গ্লিসারিনের শিশি নিচ্ছেন। হেমচন্দ্র ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, “মলি, তুই শরৎবাবুর এই সিনে গ্লিসারিন দিয়ে চোখের জল আনছিস? ছি, ছি, ছি!” গ্লিসারিনের শিশিটা কেড়ে ফ্লোরে ছুড়ে দিয়ে হেমচন্দ্র বললেন, “আই ওয়ান্ট রিয়াল টিয়ার্স!” মলিনা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমায় একটু সময় দিন।”
মিনিট দশেক। ফ্লোরে ফিরে এসে মলিনা বললেন, “হেমদা, টেক করুন।” হেমচন্দ্র বললেন, “অ্যাকশন!”
তুলসীতলা। বিন্দু চলে গেল। বড়বৌ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে দাঁড়িয়ে, তাঁর দু’চোখে জল টলটল করছে। কাট! হেমচন্দ্র মলিনাকে কাছে টেনে কপালে চুমু খেলেন। মলিনা তাঁকে প্রণাম করতে গিয়ে পায়ে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন।
সাড়ে চুয়াত্তর
উত্তম যুগের শুরুতেই, ১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল এম পি প্রোডাকসন্স-এর একটি ছবি, যার দৌলতে বঙ্গজীবনে কার্যত অমরত্ব প্রাপ্ত হবেন মলিনা, যদিও সে দিন তা বোঝা যায়নি। পরিচালক নির্মল দে। ছবির শুরুতে নামপত্রে মলিনা এবং তুলসী চক্রবর্তীর নাম বড় করে, উত্তম-সুচিত্রার নাম ছোট। পোস্টারেও তা-ই। উত্তম-সুচিত্রা তখন নবাগত, এই প্রথম তাঁরা জুটি বাঁধছেন। মলিনা-তুলসী সেই তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাঁদের সঙ্গে নবদ্বীপ হালদার, ভানু, জহর, হরিধন, শ্যাম লাহা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মাদেবী মায় গায়ক শ্যামল, মানবেন্দ্র, ধনঞ্জয়, দ্বিজেন মিলিয়ে সে এক হইহই-রইরই কাণ্ড! ছবির গপ্পো তথা চলনে কমেডির ঠাস-বুনট, প্রেমের আয়োজন সেখানে ধরতাই মাত্র। এই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির গল্প বিজন ভট্টাচার্যের লেখা— যাঁকে আমরা গণনাট্য সঙ্ঘ, ‘নবান্ন’ নাটক বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণ-রেখা’ দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য মেজাজে চিনি। বাংলা তথা ভারতীয় ছবিতে ‘পথের পাঁচালী’ নামক বিপ্লব ঘটতে তখনও দু’বছর বাকি।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির একটি দৃশ্যে মলিনা দেবী ও তুলসী চক্রবর্তী
শরৎচন্দ্রীয় আবেগের পাশাপাশি কিন্তু কমেডির ঝিলিকও মলিনার অন্যতম অস্ত্র ছিল চিরকাল। বাংলা ছবিতে স্নেহে বিগলিত মা-মাসির, গোলগাল নিটোল আবেগের আইকন তিনি, কিন্তু তাঁর অভিনয়ের পরিধি অনেক বড়। ‘নিষ্কৃতি’, ‘ছোট বৌ’, ‘মেজো বৌ’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’, ‘সাত পাকে বাঁধা’র পাশেই নানা মাত্রার অভিনয়ে তাঁকে দেখছি ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘একটি রাত’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ বা ‘ছায়াসূর্য’ ছবিতে। তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে ভক্তিমূলক ছবি আর নাটকে পাকা ঠাঁই করে নিয়েছেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। যার ফসল ১৯৫৫ সালে কালীপ্রসাদ ঘোষের ‘রানী রাসমণি’। নামভূমিকায় মলিনা, রামকৃষ্ণ গুরুদাস। এর পর ভক্তিমূলক থিয়েটার টানা দু’দশক করে গেলেও পর্দায় মলিনা কিন্তু কখনও ভক্তির ছাঁচে আটকে থাকেননি।
সিনেমায় মলিনার অন্যতম সেরা কাজ বলে গণ্য হয় ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফুলু ঠাকুরমা’, কিন্তু সে ছবি দেখার কোনও উপায় সম্ভবত আজ আর নেই। তার আগের বছরেই তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’ ছবিতে অভিনয় করেন মলিনা। তরুণবাবুর কথায়, “খুব উঁচু দরের অভিনেত্রী ছিলেন উনি, বিশেষ করে ঘরোয়া চরিত্রে। চলচ্চিত্রে অভিনয় অনেক সময়েই পরিচালকের উপরে নির্ভর করে। ঠিক সুযোগ পেলে উনি কী করতে পারতেন তার প্রমাণ আছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে।” মানুষটা কেমন ছিলেন? তরুণবাবুর মনে পড়ে, “ডেকচি-ডেকচি খাবার বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে গিয়ে গোটা ইউনিটকে খাওয়াতেন। অনুভাদি (গুপ্ত), মলিনাদিরা এ রকমটা করতেন। এই প্রজন্মে এমন মানুষ খুব কমই দেখা যাবে।”
সত্যি থিয়েটার
যে রঙ্গমঞ্চ মলিনাকে গোড়ায় ব্যবহার করছিল প্রধানত নাচিয়ে হিসেবে, পর্দায় খ্যাতির সুবাদে সেই মঞ্চই অভিনয়ের দরজা খুলে দিচ্ছিল। প্রচুর প্রস্তাব আসছিল, যদিও তিনি তা নিচ্ছিলেন না। কিন্তু ১৯৪৩ সালে এমন একটা প্রস্তাব এল যা আর ফেরানো গেল না— শিশির ভাদুড়ীর শ্রীরঙ্গমে (পরে বিশ্বরূপা) শরৎচন্দ্রের ‘বিপ্রদাস’ নাটকে বন্দনা। বিপুল প্রশংসা পেলেন। এর পর সেখানেই বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা হালকা রসের নাটক ‘তাইতো’। কিন্তু শ্রীরঙ্গমের দিন ফুরিয়ে আসছিল। এই সময়ে কলকাতা পুলিশের ইনস্পেক্টর রাম চৌধুরী দক্ষিণ কলকাতায় ‘কালিকা থিয়েটার’ পত্তন করে মঞ্চস্থ করলেন শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’। মলিনা তাতে ভবানী। পরের বছর, ১৯৪৫-এ ‘মেজদিদি’ নাটকে তিনি নামভূমিকায়। ১৯৪৮ সালের ১৯ নভেম্বর কালিকা থিয়েটারেই মঞ্চস্থ হল শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন নিয়ে তারক মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘যুগদেবতা’। মলিনা রাসমণি, শ্রীরামকৃষ্ণ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শকের ঢল নামল। এক নতুন অধ্যায়ের বীজ পোঁতা হয়ে গেল অলক্ষে। ১৯৫১ সালে মলিনা অভিনয় করলেন বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘ছাব্বিশে জানুয়ারি’ নাটকে। পরের বছর জলু বড়ালের নির্দেশনায় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নাটকে নামভূমিকায় এবং প্রচুর সুখ্যাতি। এর পরে রেডিয়ো নাটকেও কাজ করেছেন নিয়মিত। সেই পর্বে ‘রাধারাণী’ নাটকে রাধারাণীর মায়ের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় প্রাচীনদের স্মৃতিতে অমলিন।
গিরিশ সংসদ তাঁকে ‘নাট্যাধিরাজ্ঞী’ উপাধি দিয়েছে, ১৯৭৬ সালে পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির সম্মান। ঠিক তার আগের বছর, জীবনের প্রায় শেষলগ্নে রঙ্গনায় গণেশ মুখোপাধ্যায় রচিত- পরিচালিত ‘নটনটী’ নাটকে তিনি গঙ্গামণি, নটী বিনোদিনীর মা। সাড়া ফেলা সেই কাজই শেষ। আর শরীরে দেয়নি।
এবং গুরুদাস
তবে মঞ্চে মলিনার সবচেয়ে বড় কাজ বোধহয় ১৯৫৪ সালে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘এম জি এন্টারপ্রাইজ’ নামে নাটকের দল তৈরি করা। মলিনা আর গুরুদাস, এই দুই নামের আদ্যক্ষর নিয়েই ‘এমজি’। তাঁদের প্রথম দু’টি নাটক— ‘ঠাকুর রামকৃষ্ণ’ ও ‘রানী রাসমণি’। পরে হল ‘যুগদেবতা’ও। এই সব নাটকেই গুরুদাস ঠাকুর, মলিনা রাসমণি এবং অভিনেতা-পরিচালক শিশির মিত্র মথুর। এ ছাড়া পুরাণ বা ইতিহাসাশ্রয়ী নানা পালা। পরের দুই দশকে অম্তত বিশ হাজার শো তাঁরা করেছেন বাংলার শহরে-গাঁয়ে, বাংলার বাইরেও।
১৯৪৭ সনে, স্বাধীনতার বছরেই ভবানীপুরে মিত্র ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকের গলিতে একতলা বাড়ি কিনে আড়ে-বহরে বাড়িয়ে সেখানে উঠে এসেছিলেন মলিনারা। ছাদ থকে গঙ্গা দেখা যেত, সেটাই এ বাড়ি পছন্দের বড় কারণ। সেই ১৩ নম্বর বলরাম বসু ঘাট রোডেই খোলা হল সংস্থার অফিস। অকৃতদার গুরুদাস পরে পাকাপাকিই সেখানে থাকতে শুরু করেন। জলুবাবু কখনও সেখানে থাকতেন, কখনও অন্য বাড়িতে। এই পর্বেই ক্রমশ কালীসাধকদের ভূমিকায় একচ্ছত্র হয়ে ওঠেন গুরুদাস এবং তা তাঁর রোজকার জীবনেও প্রভাব ফেলত।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও জলু বড়ালের মাঝে মলিনা।
ক দিন মলিনা আর গুরুদাস বসে আছেন। মলিনার হঠাৎ চোখে পড়ল, শ্রীরামকৃষ্ণের হাতের মুদ্রার আদলে গুরুদাসের আঙুলগুলো বেঁকে যাচ্ছে। মলিনা বলে উঠলেন, “ও গুরুদাস, তুমি এ কী করছ!” তাতেই তাঁর সংবিৎ ফিরল। গুরুদাস বললেন, “না না, এমনিই ভাবছিলাম।” —মলিনা নিজেই মাধবীকে বলেছেন এই গল্প।
মলিনার মৃত্যুর পরে তাঁর বড় জামাই সমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ওরফে ননীবাবুর নামের আদ্যক্ষর জুড়ে ‘এনএমজি এন্টারপ্রাইজ’ করে কিছু দিন চালানো হয়েছিল। কিন্তু বেশি দিন আর চলেনি। গুরুদাস আরও কিছু দিন টুকটাক ছবির কাজ আর যাত্রায় অভিনয় চালিয়ে যান। তার পর হঠাৎ এক দিন অন্তর্ধান, আর তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পথের সাথী
যাটের দশকের মাঝামাঝি কানন দেবী, মলিনা দেবী, নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবী, সুনন্দা দেবী, মঞ্জু দে, আরও অনেক অভিনেত্রী মিলে গড়েছিলেন ‘মহিলা শিল্পী মহল’। উদ্দেশ্য, বয়স্ক দুঃস্থ অভিনেত্রীদের সাহায্য করা। টাকা তুলতে নাটক হত। সব চরিত্রে অভিনয় করতেন মেয়েরাই। এমনই বরাত, নাটক বাছা হল ‘মিশরকুমারী’। সেই নাটক, যাতে এক দিন সখীর দলে নাচতেন মলিনা। এ বার তিনি আবনের ভূমিকায়, মাধবী নাহরিন। “যত বার নাটক হত, পাহাড়ী সান্যাল আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসতেনই। কখনও রবীন্দ্রসদন, কখনও মহাজাতি সদনে। প্রত্যেক বার হাউসফুল। পাহাড়ীদা বলতেন, ‘ঠিক আছে, আমি সিঁড়িতে বসে দেখব।’ আর হেমন্তদা উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতেন,” মনে পড়ছে মাধবীর।
আবন চরিত্রে মলিনার অভিনয় দারুণ প্রশংসা পেয়েছিল। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ যায়নি — ‘‘অহীনবাবুর আবন যে কত বার দেখেছি। আমি ওঁকে পুরোপুরি নকল করেছি। এক সময়ে খুব ইচ্ছে ছিল অহীনবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় করব। ওই নাহরিনের রোলটাই করব। সিনেমার কাজের চাপে তা আর হয়ে উঠল না।”
ঘটনাচক্রে, সে কালে বাংলা ছবির কলাকুশলীদের স্বার্থরক্ষার জন্য যে প্রধান তিনটি সংগঠন হয়েছে, প্রতিটিতেই ছিলেন মলিনা। ছবি বিশ্বাসের বাড়িতে যে দিন অভিনেতৃ সঙ্ঘের জন্ম হয়, মলিনা সেখানে উপস্থিত। আবার ১৯৬৮ সালের ধর্মঘট এবং তা নিয়ে নানা তিক্ততার জেরে উত্তমকুমার যখন অভিনেতৃ সঙ্ঘ ছেড়ে শিল্পী সংসদ গড়লেন, মলিনা রইলেন তাঁর সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে উত্তম যখন শিল্পী সংসদের ব্যানারে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ পরিচালনা করলেন, মলিনা তখন বাতের ব্যথায় অনেকটাই কাবু। কিন্তু ‘অট্টামা’র চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে চোখ ফেরানো শক্ত।
জন্ম হোক যথা তথা
মলিনমালার জন্ম, যত দূর জানা যায় ১৯১৬ সালের মার্চে, একটি সূত্রে ৭ মার্চ। অন্য এক সূত্র বলছে ১৩২৩ সনের ১৬ ফাল্গুন, অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তবে বড় মেয়ে নূপুর চট্টোপাধ্যায়ের মতে, তাঁর মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালেই। একটি সূত্রের মতে, পৈতৃক গৃহ ছিল হাওড়ায়, যদিও সেই তথ্যের গায়েও সময়ের কুয়াশা। বাবার নাম হরিপদ ঘোষ, মা সুশীলারানী। তিন বোন, এক ভাই। মলিনাই সবার বড়। ভাই রমেন ঘোষ চলচ্চিত্র সম্পাদনার কাজ করতেন। তিনিও থাকতেন এই বলরাম বসু ঘাট রোডেই। ১৯৭৯ সালে মেয়ের নামে ‘পিঙ্কি এন্টারপ্রাইজ’ গড়ে সুখেন দাসকে দিয়ে ‘সুনয়নী’ ছবি করান। উত্তমকুমার এবং শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেই ছবিতেই শকুন্তলা বড়ুয়ার আত্মপ্রকাশ।
নিজে প্রথাগত পড়াশোনার সুযোগ পাননি মলিনা, একার চেষ্টায় যতটুকু যা পেরেছেন শিখেছেন। কিন্তু তা উসুল করে নিয়েছিলেন দুই মেয়ের বেলায়। বড় মেয়ে নূপুর, তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোট রুণু। নূপুরকে পড়িয়েছেন লোরেটো, ডায়াসেশন, বিশ্বভারতী, গোখেলে। রুণুও পড়েছেন শান্তিনিকেতনে। এমজি এন্টারপ্রাইজের অসম টুরের সময়ে সারা দিন শোয়ের পর রাত দুটোয় বসে চিঠি লিখেছেন মেয়েদের। শান্তিনিকেতনের উপর দিয়ে ট্রেনে যাওয়ার সময়ে স্টেশন মাস্টারের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়ির রান্না। আজীবন ভাল ছাত্রী নূপুর অভিনয়ও করতেন। এক সময়ে ‘রানী রাসমণি’ নাটকে মলিনা করতেন রাসমণি, ছোট মেয়ে জগদম্বার রোলে নূপুর। ‘নিষ্কৃতি’তে মলিনা বড় বৌ, নূপুর ছোট বৌ। দরকারে মেয়েদের থেকে শিখতে দ্বিধা ছিল না মলিনার। রুণুর কথায়, “একটা ইংরেজি পিস ছিল ‘ফুলু ঠাকুরমা’তে । মা দিদিকে বলল, ‘নপা, এই জায়গাটা পড়ে আমায় বল।’ দিদি বলার পরে মা ঠিক করে নেয়।”
শেষ নাহি যে...
নূপুর বা রুণু কেউই আজ আর নেই। রুণুর মেয়ে রুমুলীনা বিবাহিত, থাকেন বিরাটিতে। ভবানীপুরের বাড়িতেই থাকেন নূপুরের দুই ছেলে সুপ্রতীক আর সুমন। অন্য পক্ষেও একটি সুতো রয়ে গিয়েছে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে। সুমন বলেন, “জলুদাদুর দুই স্ত্রীর মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। দিদার একটা অস্টিন গাড়ি ছিল, নম্বর ৯২২৯, তাতে চেপে আমরা ওই বাড়িতে যেতাম দিদার সঙ্গে, বিয়ে-টিয়ে সব অনুষ্ঠানেই। ও পক্ষে দাদুর তিন ছেলে। তার মধ্যে গীতা বড়ালের সঙ্গেই আমাদের জমত বেশি, এখন তত যোগাযোগ নেই।” জন্ম থেকেই একটা কিডনি ছোট ছিল মলিনার। টানা বাতের ব্যথার ওষুধ খেয়ে অন্য কিডনিরও ক্ষতি হয়েছিল। ক্যালকাটা হসপিটালে (এখন সিএমআরআই) চতুর্থ বার ডায়ালিসিসের সময়ে হার্টফেল।
১৯৭৭ সালের ১৩ অগস্ট।
সে দিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় ‘নিষ্কৃতি’ ছবির শুটিং হচ্ছে। আগে যখন ‘নিষ্কৃতি’ হয়, বড় বৌ মলিনা, ছোট বৌ সন্ধ্যরাণী। এ বার সন্ধ্যারাণী বড় বৌ, মাধবী ছোট বৌ। খবর এল, মলিনা নেই।
সুমনের মনে আছে, মলিনাকে শেষ দেখা দেখতে বাড়িতে উপচে পড়া ভিড়। সে দিনটা দেহ রেখে দেওয়া হল। পরের দিন কেওড়াতলা মহশ্মশানে সৎকার। পরের বছর মুক্তি পেল তাঁর শেষ ছবি ‘ময়না’।
অভিনয়ের বড়াই
ইস্কুলে না গেলেও নিজের মতো করে বাংলা লেখাপড়া শিখেছিলেন মলিনা। এক সময়ে ‘আমোদ’ পত্রিকায় পূর্ণিমা দাসী নামে কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন। ছদ্মনাম, যাতে অভিনেত্রী জেনে লোকে দূর-ছাই না করে।
অটোগ্রাফের খাতায় পদ্য
পারিবারিক বন্ধু শিশির মিত্র-শিপ্রা মিত্রের ছেলে, পরে ইমপ্রেসারিও সজল মিত্রের অটোগ্রাফের খাতায় মলিনা লিখে দিয়েছিলেন— ‘লিখতে কিছু বলছ আমায়/ লিখবো কি যে ভাই/ কিছু লেখার মতো নেইকো বিদ্যে/ শুধু অভিনয়ের বড়াই।’
‘শহর থেকে দূরে’ ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল, মলিনা গঙ্গায় ঝাঁপ দিচ্ছেন। গান বেজে উঠছে— ‘রাধে ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যামরায়...’ হলে মায়ের পাশে বসে কেঁদে উঠেছিলেন ছোট্ট নূপুর। মলিনা মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, ‘‘চুপ কর নপা, দেখ আমি তোর পাশে বসে।’’
আজ নপাও নেই, তাঁর মা-ও নেই। তবে মলিনা দেবী, মলিনা দেবীরা বাঙালি দর্শকের বুকের কাছটিতে আজও বসে আছেন।
ঋণ: অভিজিৎ গোস্বামী, সজল মিত্র, পশুপতি চট্টোপাধ্যায় (চিত্রভাষ পত্রিকা), দেবনারায়ণ গুপ্ত (বাংলার নটনটী), শঙ্কর ঘোষ (যে দিন গেছে চলে), রবি বসু (সাতরঙ), ছবি বিশ্বাস (কিছু স্মৃতি কিছু কথা), অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (এখন কেমন আছেন, আনন্দলোক), গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (সোনার দাগ), প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র এবং (সিনে গিল্ড, বালি’র পত্রিকা)