হোটেল স্টাকপুল, প্যারিস। উনিশ শতকের মধ্যভাগ। এক সান্ধ্য আসর। সাদা পোশাক পরা লোকজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল। সে আলোয় সাজানো হোটেলের রাস্তা। ফুলে-ফুলে সেজে উঠেছে হোটেলের রুম, বলরুমে রুপোর কাজ করা পর্দা, অতিথিদের জন্য রাখা কাশ্মীরি শাল, রত্ন উপহার...খাওয়াদাওয়ার আয়োজন না বলাই ভাল।
১৪ মার্চ, ১৮৪৬। লন্ডনের ১২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৯ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট ‘তন্বী সাপ্তাহিক’ পত্রিকা ‘কোর্ট জার্নাল’ পার্টির বিষয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করল। ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ লুইয়ের সুহৃদ, পার্টির আয়োজক ভারতীয় রাজাটি তখন অলক্ষ্যে হয়তো হাসছিলেন, বিদেশিদের ‘হ্যাংলাপনা’ দেখে। প্রতিবেদনে খানিক অতিরঞ্জন থাকলেও বৈভবে অমন পার্টি আমাদের এই রাজাটি কিন্তু প্রায়ই দিয়ে থাকেন, দেশে-বিদেশে। ইনিই আমাদের ইটালীয় অপেরার প্রশিক্ষিত শিল্পী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
তবে শুধু বৈভবের ছটা নয়, বরং বৈভবের নির্মাণ-নেপথ্যের উদ্যম, ব্যক্তি-চরিত্রের দ্বান্দ্বিক প্রকৃতি, সমাজ ও পরিবার জীবন, ধর্ম-যাপন, এমন নানা টুকরো উপাদানের প্রিজ়মে দ্বারকানাথ— এই মানুষটির খোঁজ করা জরুরি।
কথা শুরু
এই সন্ধানের প্রয়োজনেই প্রবেশ করা যাক ঠাকুরবাড়িতে, জোড়াসাঁকোয়। এ বাড়িতেই থাকেন রামলোচন ঠাকুর। মুর্শিদাবাদ থেকে আসা শ্রেষ্ঠ বাইজি, সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীরা ইংরেজের নব-রাজধানী কলকাতার চিৎপুরে বাস জমিয়েছেন। এঁদের শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক রামলোচন। কিন্তু স্ত্রী অলকাসুন্দরীর মনে ভারী দুঃখ। তাঁর কোল যে শূন্য। কন্যাটি শৈশবেই মারা গিয়েছে। দিদির দুঃখ জানতেন বোন মেনকা। তিনি আবার রামলোচনের ভাই রামমণির প্রথমা স্ত্রী-ও। এই দম্পতিরই সন্তান দ্বারকানাথ। জন্মের (১৭৯৪) পরেই ছেলেটিকে দিদির হাতে অর্পণ করে বোন বললেন, ‘একে তুমি পোষ্যপুত্র নাও।’
মৌলবি, পণ্ডিতদের কাছে পাঠ শুরু দ্বারকানাথের। কিন্তু বাবা রামলোচন বুঝলেন, নতুন সময় আসন্ন। ইংরেজি শিক্ষা জরুরি। ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন চিৎপুর রোডে শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে। ছাত্র হিসেবে খুব নামডাক হল দ্বারকানাথের, এমনটা নয়। কিন্তু শিক্ষার মূলমন্ত্রটা তখনই সংগ্রহ করে নিলেন। ক্রমে ১৬ বছর বয়সে পেলেন গুরুদায়িত্ব— বাবা রামলোচনের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় জমিদারিতে অভিষেক। সে জমিদারির পরিসর তখন বিরাহিমপুর পরগনা, পাণ্ডুয়া, বালিয়া মহাল এবং কলকাতার খানকতক বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
ইতিমধ্যে সানাই বাজল ঠাকুরবাড়িতে। সতেরোর দ্বারকানাথের সঙ্গে ন’বছরের কন্যা দিগম্বরী রায়ের বিয়ে হল। এই দম্পতির এক কন্যা, চার পুত্র। কিন্তু দাম্পত্য-প্রসঙ্গ পরে। কারণ, এই সময়পর্ব থেকেই দেখা যাচ্ছে উদ্যমী পুরুষ, জমিদার-শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথের জন্ম হচ্ছে।
কর্মই মন্ত্র
মধ্য উচ্চতার, জাঁদরেল গোঁফওয়ালা তরুণ জমিদার দ্বারকানাথ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বুঝলেন, জমিদারি সামলাতে হলে অত্যন্ত জটিল রাজস্ব আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। ছুটলেন ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসনের কাছে। ধীরে ধীরে শিখলেন নানা আদালতের সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া, আইনের প্রয়োগ, হিন্দু-মুসলিম বিধান-সহ নানা খুঁটিনাটি বিষয়। উইলিয়াম এডাম এবং ম্যাকিনটোস অ্যান্ড কোম্পানির জেমস কলডার, জেজি গর্ডনের সান্নিধ্যে ইংরেজি ভাষায় দখলটিও পোক্ত হল।
পাশাপাশি আইনজ্ঞ হিসেবেও পরিচিতি তৈরি হচ্ছে। জমিদারি সংক্রান্ত মামলায় পরামর্শ নিতে বাবু দ্বারকানাথের দরবারে প্রায়ই হত্যে দিতে দেখা যায় কাশিমবাজারের কুমার হরিনাথ রায়, যশোহরের রাজা বরদাকান্ত রায়, এমনকি ত্রিপুরার মহারাজাকেও। এ সব ‘পরামর্শ’ বিনামূল্যে নয়, বরং মোটা টাকা দিয়ে পেতে হয়। সেই সঙ্গে, ফারসি, আরবিতে লেখা জমিজমার কাগজ নির্ভুল ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য ‘ফি’ নেন বাবু দ্বারকানাথ। এ সব করেই আয় দাঁড়াল প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
সঙ্গে সুদে টাকা খাটানো, কোনও জমিদারি নিলামে উঠলে তা কিনে নেওয়া, এ সব তো চললই। জমিদারি সামলাতে ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রয়োগেও নজির তৈরি করলেন দ্বারকানাথ। কিন্তু একবার বিরাহিমপুরের প্রজারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমিদারের নায়েব, গোমস্তাদের নামে বিস্তর অভিযোগ জানালেন। অন্য পক্ষের বক্তব্য না শুনেই প্রজাদের পক্ষে রায় দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। এ দিকে দ্বারকানাথ ততক্ষণে গোপনে জেনে নিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটের নানা কুকীর্তির খবর। গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। প্রথম-প্রথম বেশ তড়পালেন ম্যাজিস্ট্রেট। সব শুনে বেশ কঠিন গলায় দ্বারকানাথ এ বার তাঁর ‘খবর’গুলি পরপর বলতে শুরু করলেন এবং সঙ্গে এ-ও জানালেন তাঁকে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের হাতে দেওয়া হবে। মুহূর্তে মেজাজ বদল ম্যাজিস্ট্রেটের!
জমিদারি সামলাতে বিশেষ দড় দ্বারকানাথের নায়েব-গোমস্তার পরিসর থেকে ‘প্রফেশনাল’ লোকজনের উপরেই বেশি ভরসা। তাই সাহজাদপুর ও বিরাহিমপুরে মোটা মাইনে দিয়ে নিয়োগ করলেন বিদেশি ম্যানেজার। পাশাপাশি নিজের বিস্তীর্ণ জমিতে নীলচাষ, রেশম কুঠি স্থাপন, এ সবও চলতে থাকল সমান ভাবে। এই সূত্রেই ধীরে ধীরে কৃষি অর্থনীতি থেকে শিল্পের দিকে ঝোঁক বাড়ে বাবুমশাইয়ের।
এই শিল্প-সূত্রটি কিন্তু গাঁথা হয় দ্বারকানাথের জনসংযোগের উপরে ভিত্তি করেই। এই সংযোগের সূত্রপাত, আইন-পরামর্শদাতা হিসেবে। সেই সময়ে কিছু মক্কেলের প্রতি বিশেষ নজর ছিল দ্বারকানাথের। এই ‘বিশেষ মক্কেল’রা ইউরোপীয়, পার্সি সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এঁদের সূত্রেই ইংরেজ শাসকের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ধীরে ধীরে প্রবেশ। এক দিকে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকল জমিদারি। অন্য দিকে জনসংযোগও দৃঢ় হতে শুরু করল। এই সংযোগ স্থাপনের জন্যই কালক্রমে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে সেরেস্তাদার এবং পরে আবগারি, লবণ ও আফিম বোর্ডের দেওয়ানের দায়িত্ব অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেন দ্বারকানাথ।
তত দিনে সমুদ্র-বাণিজ্য কী প্রকার, তা পরখ করা হয়ে গিয়েছে দ্বারকানাথের। ১৮২১-এ জন লানড্রিন স্যান্ডার্স নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদারিত্বে ‘রেজ়লিউশন’ জাহাজে বুয়েনস এয়ার্সে পাঠালেন মৌরি, জায়ফল আর আখের রস থেকে তৈরি রাম! কয়েক বছরের মধ্যেই দ্বারকানাথ বুঝলেন, আর্থিক নিরাপত্তার খাতিরেই ‘পাবলিক ব্যাঙ্ক’ থাকাটা এ দেশে শিল্পোদ্যোগীদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। তাই ১৮২৮-এ ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক তৈরির সময়ে দেখা গেল, ব্যাঙ্কের মূলধনের অনেকটাই এসেছে ঘুরপথে দ্বারকানাথের আত্মীয়, পরিচিতদের নামে কেনা শেয়ার থেকে। শুধু তা-ই নয়, বিশেষ প্রভাবের জোরেই হয়তো ব্যাঙ্কের সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন দ্বারকানাথের বন্ধু উইলিয়াম কার এবং কোষাধ্যক্ষ নিকটাত্মীয় রমানাথ ঠাকুর। এই আর্থিক নিরাপত্তার পথটি দ্বারকানাথ যে আগে থেকেই খুঁজছিলেন, তা বোঝা যায় ১৮২২-এ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ‘ওরিয়েন্টাল লাইফ এস্যুরেন্স সোসাইটি’ নামে বিমা সংস্থা তৈরির কাজটি থেকে।
এই কাজগুলির জন্যই উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের গোড়ায় মন্দার বাজারে যখন দেশি-বিদেশি নানা কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল, দ্বারকানাথ অত্যন্ত সমৃদ্ধির সঙ্গেই টিকে রইলেন। এমনকি বন্ধু কারকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন, ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। এই প্রতিষ্ঠানকে অভিনন্দন জানালেন স্বয়ং বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। বললেন, ‘দেশীয় ভদ্রলোকদের মধ্যে আপনিই প্রথম কলকাতায় ইউরোপীয় আদর্শে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন।’
এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত কাঁচা রেশম, রেশমের থান, নীল, চিনি, রাম, চামড়া, কাঠ, সোডা প্রভৃতি বিদেশে রফতানি করতে শুরু করল। বেশির ভাগ পণ্যই উৎপাদিত হয় বাবুর জমিদারিতে। ব্যবসা বাড়লে বড় ও ছোট জঙ্গিপুর, সাহজাদপুর, বিরাহিমপুরের মতো জমিদারিগুলিতে নীলের উৎপাদনও বাড়ল। কোম্পানি ব্যবসা বাড়াতে কিনে নিল জঙ্গিপুর ও কুমারখালির রেশম কুঠিও। জনশ্রুতি, ভারতে প্রথম চিন থেকে রেশম আমদানি করে এই কোম্পানিই। পণ্য আমদানি-রফতানির বেশির ভাগটাই চলে জাহাজে। এই জাহাজ ও জলপথের প্রতি দ্বারকানাথের একটু বিশেষ দুর্বলতাও রয়েছে। কোম্পানি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই খিদিরপুরে দুই সাহেবের সঙ্গে যৌথ ভাবে ‘ওয়াটারউইচ’ নামে একটি জাহাজ তৈরি করান দ্বারকানাথ। পাশাপাশি, চিনের সঙ্গে আফিমের কারবার এবং অন্তর্দেশীয় ব্যবসার জন্যও সাগরে এগিয়ে চলে তাঁর বেশ কয়েকটি জাহাজ। জাহাজ পার্সি ব্যবসায়ী রুস্তমজি কাওয়াসজিরও রয়েছে। জাহাজগুলির গতি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে কলকাতাবাসীও। এর এক চমৎকার বর্ণনাও মেলে—
কলকাতার লোকজন বাজি ধরেছেন, ক্যান্টন থেকে কোন জাহাজ সবচেয়ে দ্রুত কলকাতা পৌঁছবে, তা নিয়ে। দেখা গেল, ২৫ দিনের মাথায় খিদিরপুর ডকের অদূরে ‘ওয়াটারউইচ’-এর সগৌরব উপস্থিতি। জয় হল দ্বারকানাথের।
ব্যবসার সুবিধের জন্য জাহাজকে দ্রুত হুগলি নদীর মুখ পর্যন্ত টেনে আনার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়, ভাবলেন দ্বারকানাথ। ফের নতুন ব্যবসা শুরু, জাহাজ টানার। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন, ‘ক্যালকাটা স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন’। কলকাতা জুড়ে আর্থিক মন্দার কালে ম্যাকিনটোস কোম্পানির হাল খারাপ হলে তাদের স্টিমার ‘ফর্বস’ কিনে নিলেন তিনি। এই ব্যবসায় সাফল্যের কারণেই হয়তো একটি স্টিমারের নামকরণও করা হয় ‘দ্বারকানাথ’।
কিন্তু দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বোধহয়, ‘আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি’র কাছ থেকে বর্তমান পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়ি এলাকায় ৭০ হাজার টাকা মূল্যে কয়লা খনি কেনা। নিজের আমদানি-রফতানির ব্যবসা, দেশ জুড়ে প্রভাববৃদ্ধির সহায়ক হল এই জ্বালানি। পরে ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’-ও তৈরি করেন দ্বারকানাথ।
এ দিকে যা আদি ‘ব্যবসা’, অর্থাৎ জমিদারি, সেখানেও বিন্দুমাত্র ঢিলে দেন না দ্বারকানাথ। জমিদারিকে তিনি কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা ধরা পড়ে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ১৮ বছর পরে প্রকাশিত এক তথ্যে। ঠাকুর পরিবারকে সম্মিলিত ভাবে জমিদারি থেকে মাসে এক লক্ষ টাকা খাজনা দিতে হয়। তা-ও ১৮৬৪-তে! এই তথ্যের দিকে আঙুল দিয়ে ‘বেঙ্গল হরকরা’র মন্তব্য, ‘...কোম্পানী দাবি করেন যে ঠাকুরবাবুদের মালিকানাভুক্ত জমির পরিমাণ হবে বর্ধমান-রাজের মালিকানার ঠিক নীচে!’
আসলে জীবনকে খুব বড় করে দেখতে চেয়েছিলেন দ্বারকানাথ। তা দেখতে গিয়ে ঠোক্করও যে খেতে হয়নি, তা-ও নয়। দ্বারকানাথ চান কলকাতা-সহ ভারতের নানা বন্দরের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দরের সহজ যাতায়াত। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রস্তাবিত পথটি ছিল, বাষ্পচালিত জাহাজ ভারত থেকে সুয়েজ বন্দর পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে স্থলপথে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর পর্যন্ত। তার পরে ফের জলপথে ইংল্যান্ড। এ নিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনাও প্রস্তুত করেন দ্বারকানাথেরা। কিন্তু কলকাতা এবং ইংল্যান্ডের বণিকদের মধ্যে রেষারেষির কারণে এই পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু ব্যবসার জন্য পরিবহণকে সুগম হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে ‘গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানি’র কলকাতা থেকে রাজমহল অবধি রেল-যোগের চেষ্টায় আগ্রহ প্রকাশ করে দ্বারকানাথের কোম্পানি। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের।
তবে দ্বারকানাথের এই যে বিপুল শিল্পোদ্যোগ, তাকে জাতির নিরিখে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এ প্রসঙ্গে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা দ্বারকানাথের উদাহরণ টেনে লিখল, ‘‘অলস ও অজ্ঞান বলে হিন্দুদের যে-বদনাম আছে— এই ভাবে তা বিদূরিত হতে পারে।’’
বিদেশে প্রিন্স
‘জ্ঞানান্বেষণ’ কথিত ‘আলস্য’ যে সম্পূর্ণ রূপেই দ্বারকানাথ ত্যাগ করতে পেরেছিলেন, তা বোঝা যায় বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা দেখে। নিজস্ব জাহাজ ‘ইন্ডিয়া’য় চড়ে দ্বারকানাথ পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে (৯, মতান্তরে ১০ জানুয়ারি, ১৮৪২)। পরেও আর একবার বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি।
প্রথমবারের যাত্রার সঙ্গী ভাগ্নে চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত সচিব পরমানন্দ মৈত্র, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ম্যাকগাওনান, তিন জন পরিচারক ও একজন বাবুর্চি। সুয়েজে পৌঁছনোর পরে ‘ইন্ডিয়া’ ফিরে আসে স্বদেশে। দ্বারকানাথ পৌঁছন ইজিপ্ট। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ফের জলপথ। ইটালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, ভেনিস প্রভৃতি ছুঁয়ে ১৬ জুন পৌঁছলেন লন্ডনে।
এই যাত্রা পর্বের দু’-একটি ছোট ঘটনায় শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথের মেজাজটির খোঁজ পাওয়া যেতে পারে...
ঘটনা এক: ঘটনাস্থল রোম। সেখানে এক কলেজের অধ্যক্ষের সূত্রে দ্বারকানাথের আলাপ হল পোপের সঙ্গে। কিন্তু স্বভাববশত পাগড়িটি খুললেন না দ্বারকানাথ। এ জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। কিন্তু এ-ও জানালেন, তাঁর স্বদেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পাগড়ি পরে যাওয়াটাই রীতি।
ঘটনা দুই: রোমের কলোসিয়াম দেখে দ্বারকানাথ যেন শুনতে পেলেন প্রাচীন রঙ্গভূমে হাজার-হাজার মানুষের চিৎকার, আর্তনাদের অনুরণন।
ঘটনা তিন: আলেকজান্দ্রিয়ার ফারোস উপদ্বীপে পাশার নতুন প্রাসাদ দেখে খানিক ঈর্ষান্বিত শৌখিন দ্বারকানাথ। ভাবলেন, এই প্রাসাদটিকে কলকাতায় তাঁর সাধের বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারলে বেশ হত!
পথের এমনই নানা সঞ্চয় নিয়ে দ্বারকানাথ উঠলেন লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে। এ শহরে আসার দু’দিনের মধ্যেই মহারানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল দ্বারকানাথের। সৌজন্যে ‘বোর্ড অব ট্রেড’-এর প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজ়েরাল্ড। মহারানির মনে হল, এই ব্রাহ্মণ চমৎকার ইংরেজি বলেন এবং সর্বোপরি ‘ভারী বুদ্ধিমান ও আগ্রহ-উদ্দীপক লোক’।
এই ‘উদ্দীপনা’র সঙ্গেই ইংল্যান্ডে এসে দ্বারকানাথ দেখলেন, প্রযুক্তির জয়যাত্রা। আসলে, যন্ত্র দেখতে ভারী ভালবাসেন এই মানুষটি। তাই কখনও যান শেফিল্ডে, ইস্পাত কারখানা পরিদর্শনে, কখনও বা নিউকাসলের কয়লাখনিতে।
কিন্তু এ সব ‘উদ্যমে’র মধ্যেই লন্ডনের মেয়রের ভোজসভায়, ইংরেজ শাসনের গুণগান করে দ্বারকানাথের এক বক্তব্য ভারী গোলমাল তৈরি করল ভারতে। ‘লন্ডন মেল’-এ তা প্রকাশিতও হল। এই বক্তব্যের ফলে তিনি পরিচিত হলেন ‘ব্রিটিশের তাঁবেদার’ হিসেবে। যদিও এ আসলে প্রশস্তির ছলে ইংরেজকে পরিহাস করা। এই শাসনযন্ত্র সম্পর্কে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’-এ প্রকাশিত পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে দ্বারকানাথের মনোভাবটি প্রকাশিত হয়। গ্লাসগো শহরে কর্মহীন বেকারদের আন্দোলন দেখে তাই লিখছেন, ‘‘বর্তমানে এ দেশে প্রায় তিন লাখ লোকের কাজকর্ম নেই। ... ভারতের ক্ষুৎপীড়িত হিল-কুলিদের নিয়ে এরা যতই বাগবিস্তার করুক না কেন, এ দেশে দুঃখদুর্দশা কিছু কম নয়।’’ কে জানে, হয়তো এই দুর্দশার বর্ণনা যাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে বারবার, সেই লেখক চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে সখ্যের কারণে ইংল্যান্ডের মনটিকেও বুঝতে পারলেন দ্বারকানাথ!
বিদেশে থেকেও প্রিয় স্বদেশকে ভোলেন না দ্বারকানাথ। এটা বোঝা যায়, তাঁর চরিত্র গঠনের অন্যতম কারিগর রাজা রামমোহন রায়ের স্মৃতির প্রতি নিষ্ঠা দেখে। রামমোহন তখন শায়িত ব্রিস্টলে মিস কাসলের বাড়ি লাগোয়া এক এলাকায়। জীর্ণ সমাধিক্ষেত্র। মূলত দ্বারকানাথের উদ্যোগেই আর্নোজ ভেল-এ রামমোহনের সমাধিক্ষেত্র স্থানান্তরিত হয়, যা তিনি কলকাতা থেকে সংকল্প করে এসেছিলেন। ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন ফুটে ওঠে সুদৃশ্য সমাধিক্ষেত্রে।
বাঁ দিকে, কেনসল গ্রিনে দ্বারকানাথের সমাধিক্ষেত্র। ডান দিকে, দ্বারকানাথের বংশমর্যাদার প্রতীক
ধর্মে-অধর্মে
আসলে এই রামমোহনকে কেন্দ্র করেই দ্বারকানাথের জীবনে একটি পর্বের নির্মাণ ঘটেছিল। কিন্তু তিনি এর জন্য ‘কুলাচার’ ত্যাগ করেননি। এ ক্ষেত্রে দ্বারকানাথ এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র।
এডাম সাহেব ও রামমোহনের একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ২,৫০০ টাকা দান, ব্রাহ্মসমাজের বাড়ি নির্মাণে অর্থ সাহায্য, সতীদাহ বন্ধের আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা প্রভৃতি তাঁর রামমোহন অনুরাগের পরিচয় দেয়। রামমোহনকেও কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেন দ্বারকানাথ। এর অন্যতম, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা বাংলায় করার প্রস্তাব নাকি তিনিই দেন। এর আগেই অবশ্য রাজা রাধাকান্ত দেব মাতৃভাষার উন্নতির উদ্দেশে ‘গৌড়ীয় সমাজ’ স্থাপন করতে চাইলে, তাতেও পাশে থাকলেন দ্বারকানাথ।
এই রামমোহন-অনুরাগই হয়তো দ্বারকানাথের খাদ্যাভ্যাসেও বদল আনে। ভাই রমানাথের স্ত্রীর বয়ান থেকে জানা যায়, দুই ভাইয়ের জন্য বাড়ির এক কোণে মাংস রান্না হত মাটির পাত্রে। প্রথম-প্রথম খানিক অস্বস্তি হলেও পরে তা বিশেষ উপাদেয় ঠেকে দ্বারকানাথের কাছে। পাশাপাশি, মদ্যাভ্যাসও তৈরি হয় দ্বারকানাথের। রামমোহন বাড়ি আসছেন শুনে পুজো ছেড়েও উঠে যান বাবামশাই, জানান ছেলে দেবেন্দ্রনাথ। এই মানসিকতার কারণেই হয়তো কালাপানি পেরোনোর শাস্ত্রীয় বিধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন ঠাকুরবাবু। তাই কখনও পুরুতদের বলেন, ‘‘প্রায়শ্চিত্ত আমি করব না, আপনারা কী করতে চান করতে পারেন।’’ কখনও বা প্যারিসে অবস্থান করার সময়ে বলেন, ‘‘আমি তো এ দেশে আছি, দেশে বহু ব্রাহ্মণ আমার অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে— সে-ই তো যথেষ্ট প্রায়শ্চিত্ত।’’
কিন্তু এর পরেও স্বকীয়তার কারণেই কুলত্যাগী নন দ্বারকানাথ। বাড়িতে দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। আবার রামমোহনের সভায় সকলে দরবারি পোশাকে হাজির হলেও বাবু দ্বারকানাথ ঢোকেন বাঙালি ধুতি-চাদর গায়ে দিয়ে। তা দেখে রামমোহন কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট। কিঞ্চিৎ নারীসঙ্গেও অভ্যস্ত দ্বারকানাথের হয়তো তখন জবাব, দিনভর অফিসের পরে এই পোশাকেই ‘‘...বেশি আরাম। ...পরমেশ্বরের পূজায় যেতে হলে দীনহীনের মতো সামান্য পরিচ্ছদেই যাওয়া উচিত।’’
ইউরোপীয়দের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কখনও কখনও তাঁদের অতিক্রম করতে গিয়ে দ্বারকানাথ হয়তো ভোগ-বিলাসের চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যান। আজও যার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে বেলগাছিয়া ভিলা। স্মৃতিরা লেগে রয় রূপচাঁদ পক্ষীর ছড়ায়, ‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয়/ ছুরি কাঁটার ঝনঝনি/ খানা খাওয়ার কত মজা,/ আমরা তার কি জানি?/ মদের কত গুণাগুণ/ আমরা তার কি জানি?/ জানেন ঠাকুর কোম্পানী।’ কিন্তু দিনে এক গ্লাস শেরি পানে অভ্যস্ত দ্বারকানাথকে কোনও ভাবেই নেশাসক্ত বলা যায় না। তিনি কলকাতার মদ্য ক্রেতাদের অন্যতম হলেও, এ বিষয়ে তাঁর যে বিপুল উদ্যম ছিল, তা-ও ঠিক নয়। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাক্ষ্য, ‘‘আমি তাঁকে বিলক্ষণ জানি— এ সব নিন্দুকের কথা।’’ তবে মদ ব্যবসায় স্বদেশির অধিকার সুনিশ্চিত করতে বিশ্বনাথ লাহাকে এ কারবারে নামান দ্বারকানাথ।
তবে এ সব আদবকায়দা মা অলকাসুন্দরী, স্ত্রী দিগম্বরী এবং সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তান দেবেন্দ্রনাথ বোধহয় ভাল ভাবে নেননি। কিন্তু নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব অলকাসুন্দরীর অন্দরমহলে হয়তো যুগের হাওয়া খানিকটা লাগল। তিনি তাই ছেলের জীবনযাত্রায় বাধা হননি। তাঁর শুধু একটাই দাবি, বিদেশিদের সঙ্গে ছেলে এক টেবিলে বসে গো-মাংস বা অন্য কোনও আহার না করেন। অল্পবিস্তর পানে ছাড় থাকল। মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত কোনও দিন আদেশের অন্যথা করেননি দ্বারকানাথ। শোনা যায়, শেষ বয়সে মদও পরিহার করেন। আসলে অলকাসুন্দরী দ্বারকানাথের জীবনে ঠিক কতটা জায়গা জুড়ে, তা বোঝা গেল মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে।
১৮৩৮-এর ‘এশিয়াটিক জার্নাল’ জানাচ্ছে, ঠাকুরবাড়ির কাঙালি বিদায়ে অন্তত ‘৫০ হাজার মানুষ’ জড়ো হয়েছিল! ব্রাহ্মণদের জন্য আট আনা, অন্য সকলের জন্য চার আনা করে অকাতরে বিলিয়ে দিলেন দ্বারকানাথ। এমনকি, যে ব্রাহ্মণটি রোজ ভোরে অলকাসুন্দরীর ঘুম ভাঙাতেন, তাঁর জন্যও ব্যবস্থা করে দিলেন দ্বারকানাথ। শোনা যায়, অলকাসুন্দরীর মৃত্যুর পরে ব্রাহ্মণের কাছে দ্বারকানাথ জানতে চান, বাকি জীবনটা ভাল ভাবে কাটাতে তাঁর কী প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ বলেন, ‘বাবুমশাই এক দিনে যা রোজগার করেন, তাতেই আমার জীবন কেটে যাবে।’ সঙ্গে সঙ্গে সে দিন যত টাকা রোজগার করবেন, তা-ই ব্রাহ্মণকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন দ্বারকানাথ।
কিন্তু স্ত্রী দিগম্বরী অন্য ধাতুর। তাঁর অন্দরমহলে কার্যত ব্রাত্য দ্বারকানাথ আর তাঁর জীবনবোধ। নিত্য সময় সেখানে চলে ধর্মের আচার-বিচার। ব্রাহ্মণেরা বিধান দিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে সহবাস ধর্মে সইবে না। স্বামীকে এ সব অনাচার থেকে মুক্ত করতে স্ত্রী তিন দিন নিরম্বু উপবাস পর্যন্ত করলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ না হওয়ায় দিগম্বরীও একটা সময়ের পরে খুব প্রয়োজন না পড়লে স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন না। নিতান্তই বলতে হলে, সাত ঘড়া গঙ্গাজল দিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে নেন।
এক শীতে এই স্নানের জন্যই নাকি দিগম্বরীর জ্বরবিকার হল। স্ত্রীর চিকিৎসার ত্রুটি রাখলেন না দ্বারকানাথ। কিন্তু লাভ হয়নি। ১৮৩৯-এর জানুয়ারিতে দিগম্বরীর মৃত্যু হল। ঠিক এক দিন আগে তেরো বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই দম্পতির চতুর্থ সন্তান ভূপেন্দ্রনাথেরও।
ছেলেদের কথা উঠলেই দেবেন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ ওঠে। কিন্তু রামমোহনের স্কুলে শিক্ষিত, ঠাকুমা-মায়ের ধর্মীয় আবহাওয়ায় বড় হওয়া দেবেন্দ্রনাথ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাত্ম জগতের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এ সব দেখে নিজের বাণিজ্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সম্পর্কে সংশয়ী হয়ে উঠলেন দ্বারকানাথও। বেলগাছিয়া ভিলায় যখন প্রমোদ চলছে, দেবেন্দ্রনাথ তখন ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র কাজে ব্যস্ত! পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের প্রতি বিশেষ অধ্যাত্ম-আকর্ষণ অনুভব করেন দেবেন্দ্রনাথ। এ সব দেখেশুনে দ্বারকানাথ খানিকটা যেন অসন্তুষ্ট। বলেন, ‘‘একে তো ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপারে ওঁর মাথাটা তেমন খেলে না, এখন ব্যবসাবাণিজ্য একেবারে মাথায় উঠেছে— সারা দিন কেবল ব্রহ্ম ব্রহ্ম।’’ মূলত ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে দ্বারকানাথের এই সংশয়, অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর উইল সম্পাদনার কাজেও।
জনের জন্য
আসলে দেবেন্দ্রনাথ চান সমাজধর্মকে সংস্কার করতে। দ্বারকানাথের জীবনের উদ্দেশ্য একেবারেই তা নয়। এই সূত্রেই তিনি আলাদা রামমোহন বা দেবেন্দ্রনাথের থেকে। কিন্তু তা বলে তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য আর প্রশস্ত মনটি নিয়ে মানবিকতার পাশে দাঁড়াননি এমনও নয়। সমাজের পাশে, যা কিছু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক, সে সবের সঙ্গে দ্বারকানাথ বারবারই থেকেছেন। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় সম্ভবত দশ হাজার টাকা বা তারও বেশি দান করেন তিনি। আবার দ্বিতীয় বার ইংল্যান্ড যাত্রার সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের নিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা আধুনিক শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠবেন এই আশা থেকে। ভোলানাথ বসু, সূর্যকান্ত চক্রবর্তী, দ্বারকানাথ দাস বসু, গোপালচন্দ্র শীল, চার ছাত্রই সেই আশাপূরণ করেছিলেন ভাল ভাবেই।
ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসেও দ্বারকানাথ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ‘বেঙ্গল হরকরা’র স্বত্বাধিকারী, চার ভাষায় প্রকাশিত ‘বেঙ্গল হেরল্ড’-এর অন্যতম অংশীদার তিনি। এই আগ্রহের কারণেই দেখা যায়, লন্ডনে গিয়ে তিনি ‘টাইমস’ পত্রিকার ছাপাখানা দেখছেন অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে। পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়েও বেশ সচেতন দ্বারকানাথ। প্রেস অর্ডিন্যান্সের আওতায় পড়ল রামমোহনের ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এবং ‘মিরাত-উল-আখবার’। রামমোহন এর বিরুদ্ধে ইংরেজের দরবারে আপিল করলে, তাতে প্রথম সইটি করলেন এই দ্বারকানাথই।
দ্বারকানাথ দেশের স্বাধীনতা কতটা চেয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। হয়তো চাননি সেই সময়ের বিচারে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ব্যক্তির স্বাধীনতার দিকে তাঁর নজর ছিল বারবার, নিজস্ব কায়দাতেই। এ কারণেই তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। দু’টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়—
এক জেলার জজসাহেব কলকাতায় এক লক্ষ টাকা দেনা করে বসে আছেন। তা শোধ করার সাধ্য নেই। অথচ স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে ফিরতে হবে স্বদেশে। কিন্তু পাওনাদারেরা রীতিমতো শাসাচ্ছে। জজ সাহায্য চাইলেন দ্বারকানাথের কাছে। খোঁজখবর করে দ্বারকানাথ সব ঋণ শোধ করে দিলেন। গেলেনও জজ সাহেবের কাছে। জজ সাহেব নিজের অবস্থার কথা বলতে উদ্যত হতেই তাঁকে থামিয়ে হাতে গুঁজে দিলেন তাঁর বন্ধক রাখা জমিজমার কাগজপত্র। জজ সাহেব দ্বারকানাথকে ‘মুচলেকা-খত’ দিতে চাইলেন। নিলেন না দ্বারকানাথ। বললেন, ‘‘সায়েব যদি বিলেতে গিয়ে মারা যান তবে এ-মুচলেকা কোনো কাজে লাগবে না...। আর যদি সায়েব বেঁচেবর্তে বিলেতে ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসেন, তাহলে তো টাকাটা নিশ্চয় তিনি ফেরৎ দিয়ে যাবেন।’’
এমন ঔদার্যের পরিচয় পেলেন অক্টারলোনি নামে কোম্পানির তরুণ এক সেনা অফিসারও। কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন, ভারতে এসে প্রচুর টাকা রোজগার করে দেশে ফিরে বিয়ে করবেন প্রেমিকাকে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। শেষে একদিন বন্ধুদের পরামর্শে হাজির হলেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের বাড়িতে, দ্বারকানাথের কাছে। কাঠের বেঞ্চে বসে তখন দ্বারকানাথ কাগজ পড়ছেন। দ্বারকানাথের নাম শুনলেও অফিসারটি তাঁকে চেনেন না। কিন্তু সব শুনে দ্বারকানাথ কাগজের সাদা অংশ ছিঁড়ে ইংরেজিতে লিখে দিলেন, দশ হাজার টাকা যেন দেওয়া হয়। তরুণটি ভাবলেন, রসিকতা। এক বেয়ারাকে ডেকে তরুণকে নীচে ক্যাশিয়ারের ঘরে নিয়ে যেতে বললেন দ্বারকানাথ। সেখানে ‘কারেন্সি নোট’ মিলল। কৃতজ্ঞ, হতভম্ব অফিসার দ্বারকানাথের কাছে ধারের জন্য ‘প্রমিসরি নোট’ লিখে দিতে চাইলেন। কিন্তু দ্বারকানাথ বললেন, ‘...তোমার কাছে হাতচিঠা নেবার দরকার নেই।’
তবুও অনন্ত...
১ অগস্ট, ১৮৪৬। লন্ডন। বজ্র-বিদ্যুৎ, শিলাবৃষ্টিতে লন্ডনকে যেন তছনছ করে দিতে চাইছে। ঠিক সেই সময়ে সন্ধ্যা সওয়া ৬টা নাগাদ অলবেমার্ল স্ট্রিটের সেন্ট জর্জেস হোটেলে প্রয়াত হলেন দ্বারকানাথ। বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রগুলি এই মহাপ্রাণের মৃত্যু-সংবাদ পরিবেশন করল। অনেকের মতে, এই মৃত্যুর কারণ হতে পারে কম্পজ্বর, ম্যালেরিয়া। কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর শরীরে জ্বর ছাড়া আর কোনও শারীরিক গোলমাল সে ভাবে ছিল না। এই সময়পর্বে দ্বারকানাথ বারাবার বলতেন, ‘আমি তৃপ্ত’।
তিনি হয়তো তৃপ্তি নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেন মনে হয়েছিল, প্রপিতামহের মৃত্যু হয়েছিল, ‘একটা কেমন যেন রহস্যময় পরিবেশে’! দ্বারকানাথ চরিত্রই যে রহস্যের!
ছবি: ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর:
বিস্মৃত পথিকৃৎ’: কৃষ্ণ কৃপালনী, অনুবাদ, ক্ষিতীশ রায়।
তথ্যঋণ: ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর: বিস্মৃত পথিকৃৎ’: কৃষ্ণ কৃপালনী, অনুবাদ ক্ষিতীশ রায়, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’: ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মেমোয়ার অব দ্বারকানাথ টেগোর’: কিশোরীচাঁদ মিত্র, ‘পার্টনার ইন এম্পায়ার: দ্বারকানাথ টেগোর অ্যান্ড দ্য এজ অফ এন্টারপ্রাইজ ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’: ব্লেয়ার বি. ক্লিং প্রভৃতি।