সাক্ষী হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এক আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের তখন-এখন নেই। ওই শতকের পারেও যা, এই শতকের পারেও তা। ঈশ্বর গুপ্তের সাক্ষ্যের দ্বন্দ্বটি গত শতকের সত্তরের দশকের। পাকিস্তান অভিযোগ করল, ‘ভারত ফারাক্কায় খাল কাটার ফলে পূর্ববঙ্গের পদ্মা-নদীতে জল নেই’। গুরুতর অভিযোগ। তো সেই সময়ের জনপ্রিয় গণমাধ্যম রেডিয়োয় ‘খবর’ হল। ১৯৭০ সালের ২৩ এপ্রিল আকাশবাণীর রাত ১০টার ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় উপস্থাপক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। পাকিস্তানের অভিযোগ যে মিথ্যে তা প্রমাণে ভারত সরকার একটি ভ্রমণ কাহিনিকে নথি হিসেবে পেশ করল। বইটির নাম, ‘ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র’। লেখক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। বইয়ের অংশবিশেষ দেখিয়ে ভারত দাবি করল, পদ্মা আজ (১৯৭০) শুকিয়ে যায়নি। ঈশ্বর গুপ্ত ১২৬১ বঙ্গাব্দেই পদ্মা পারাপারের সময়ে নদীর দুরবস্থা দেখেছিলেন।
মৃত্যুর শতাধিক বছর পরে দেশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করেছিলেন ‘গুপ্ত কবি’। কী ভাবে তিনি সাক্ষী হলেন? তার একটা গল্প আছে। এই সাক্ষ্যদানের মাত্র বছর সাতেক আগে তিনি নিজেই উজ্জ্বল উদ্ধার হয়েছিলেন। ঘুরতে ভালবাসতেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুর্গাপুজোর পরে জলপথে পাড়ি দিতেন বিভিন্ন জায়গায়। সেই সব ভ্রমণকথা শুধু সফরনামা ছিল না। ছিল ইতিহাস, প্রকৃতি আর জীবনচরিতের মিশেল। যেখানে যেতেন, লোকজনের সঙ্গে ভাব জমাতেন। উচ্চবিত্ত থেকে নদীর পারে ক্রীড়ারত শিশু, সকলেই ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। তখন তিনি বেশ নামী। উচ্চবিত্তরা পরিচয় পেয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সমাদর করতেন। আর নদীর পারে খেলা করা শিশুদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের বাড়িতে হাজির হতেন স্বয়ং। ছেলেপুলেদের বাড়িতে কোনও আনাজ ফলে থাকলে চেয়ে নিতেন। লাউ, কুমড়ো, যা-ই হোক না কেন, দ্বিধাহীন ভাবে চাইতেন। আবার ছোট ছোট ছেলেদের কাছে ডেকে গানও শুনতেন। ১২৬১ সালে অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র পর্যন্ত ‘গুপ্ত কবি’ উত্তর ও পূর্ববঙ্গ সফর করেছিলেন জলপথেই। সেই ভ্রমণকথা প্রকাশিত হত ‘সংবাদ প্রভাকর’এ। লেখাগুলি হয়তো হারিয়েই যেত। কিন্তু অধ্যাপক মোহনলাল মিত্র লেখাগুলি উদ্ধার করে ১৯৬৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এই বই বছর সাতেক পরে ভারতের সঙ্কটমোচন করে।
সফরের সময়ে যিনি পথে ও পথের প্রান্তে জীবন খোঁজেন, তিনি জীবনরসিক নিশ্চয়ই। সেই রসের সন্ধান তিনি দিয়েছেন জীবনভর। লোক হাসাতে পারতেন ঈশ্বর গুপ্ত। কথায়, বক্তৃতায়, লেখায়। ছোটবেলা থেকেই সম্ভবত এই হাসির অস্ত্রে শান দিতে দিতে এগিয়েছেন। অন্তত দু’টি ঘটনা তাঁর সেই গুণেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রথম ঘটনার সময়ে তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়া থেকে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মামার বাড়িতে এসেছেন তখন। এসে পড়লেন অসুখে। কলকাতা নিয়ে তখন তাঁর বিরক্তি ছিল। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মশা-মাছির উপদ্রব। তাতেই নাকি তিতিবিরক্ত হয়ে বছর তিনেকের ঈশ্বর আবৃত্তি করতে থাকেন, ‘রেতে মশা দিনে মাছি/এই তাড়য়ে কলকেতায় আছি’। তিন বছরের মস্তিষ্কই প্রবাদের মতো পঙ্ক্তির জন্ম দিয়েছিল।
দ্বিতীয় ঘটনার সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের বয়স পাঁচ বছর। ডাকাবুকো ছিলেন সেই বয়সেই। কালীপুজোর দিনে কোথাও একটা নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। রাস্তায় ঘোর অন্ধকারে তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ে কোনও একজন ঈশ্বরের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তর দেন, ‘আমি ঈশ্বর’। ঘাড়ে পড়া ব্যক্তির দ্বিতীয় প্রশ্ন, একলা এই অমাবস্যার অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে এইটুকু বাচ্চা? ঈশ্বরের জবাব, ‘ঠাকুর মশায়ের বাড়ী লুচি আনিতে’। এই যে হাজির-জবাব, সব পরিস্থিতি পেষণে রস নিষ্কাষণ— এ তাঁর সৃষ্টিতে প্রচুর মেলে। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায়, ‘ইয়ার্কি’র প্রবণতা। তিনি রস বিনা একদণ্ড থাকতে পারতেন না। সে সোমরসই হোক বা কাব্যরস। হ্যাঁ, গুপ্তকবির পানদোষ ছিল। শোনা যায়, সুরাপান করলেই নাকি তাঁর কাব্যপ্রতিভা প্রগলভ হত। সুরাসক্তির কথা নিজেই স্বীকার করেছেন এক কবিতায়, ‘পাত্র হোয়ে পাত্র পেয়ে ঢোলে মারি কাটি/ঝোলমাখা মাছ নিয়া চাটি দিয়া চাটি’।
‘ইয়ার্কি’র এই প্রবণতাই কি ‘গুপ্ত কবি’কে ‘পাষণ্ড পীড়ন’ পত্রিকা প্রকাশে মনে খোঁচা দিচ্ছিল? তার আগে কিন্তু সম্পাদক এবং সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র অনেক ভারী ভারী কাজ করে ফেলেছেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ তখন প্রতিষ্ঠিত কাগজ। প্রতিষ্ঠিত বললে কম বলা হবে। এখনকার ভাষায় ‘ভাইরাল’। প্রভাকরের জনপ্রিয়তার বর্ণনা দিয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রভাকর পড়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ তখন পাগল হয়ে উঠেছিলেন। ‘প্রভাকর বাহির হইলে বিক্রেতাগণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া ঐ সকল কবিতা পাঠ করিত’ এবং নিমেষের মধ্যে কাগজ বিক্রি হয়ে যেত। জনপ্রিয় কবির ভক্তকুল তৈরি হয়েছিল। কবিতার জগতে নতুন পা ফেলা সারস্বতেরা জেনে বা না জেনে ঈশ্বর গুপ্তের ‘ছাঁচে’ ঢেলে কবিতা লিখতেন। ‘বঙ্গ-সাহিত্যে এক নবযুগের’ সূচনা করে ফেলেছিলেন তিনি। তৈরি হয়েছিল তাঁর অনুসারী ‘কবি-সম্প্রদায়’। জেলা শহরের এক প্রায় লেখাপড়া না জানা তরুণ কলকাতার বিদ্বজ্জনসভায় নিজের প্রতিভায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। হয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ।
কাঁচরাপাড়ায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের স্মরণে
তবুও তিনি ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশ করলেন। কিন্তু ‘পাষণ্ড পীড়ন’ ভদ্রসমাজের কাছে হয়ে দাঁড়াল উৎপীড়ন। বাঙালি ভদ্রজনের কান, গাল লাল করে দিল। করতে চেয়েছিলেন ব্যঙ্গ পত্রিকা। লক্ষ্য ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের রসাল জবাব দেওয়া। কিন্তু পত্রিকা হয়ে দাঁড়াল গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকার বিরুদ্ধে ‘লড়াই ক্ষ্যাপা’। গৌরীশঙ্কর মানে গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যের সঙ্গে কিন্তু এক সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের বন্ধুত্ব ছিল। গৌরীশঙ্কর ‘সংবাদ প্রভাকর’কে সাহায্য করতেন। গৌরীশঙ্করেরও একটি পত্রিকা ছিল ‘সংবাদ ভাস্কর’। কিন্তু ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশের পরে যে শব্দযুদ্ধ শুরু হল, তার অশালীন আওয়াজে সাহিত্য সংসারে কান পাতা দায় হল। সেই সময়ে কবির লড়াইয়ের আসর বসত উৎসবে, অনুষ্ঠানে। আর সেই লড়াই অনেক সময়েই হয়ে উঠত আদিরসের জমাটি আসর। সেই আসরই যেন উঠে এল ছাপা পত্রিকার পাতায়।
দুই পত্রিকা এবং তাদের কবির লড়াইকে বঙ্কিমচন্দ্র বা শিবনাথ শাস্ত্রী কেউই স্বীকৃতি দেননি। ১২৫৪ সালে ‘পাষণ্ড পীড়ন’ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের কারণ? সীতানাথ ঘোষ নামে এক ব্যক্তি ‘পাষণ্ড পীড়ন’-এর মাস্ট হেড চুরি করে নিয়ে পালান। পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে শিবনাথ শাস্ত্রী ‘সুখের বিষয়’ বলেছেন। আর বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা, ‘দুই পত্রের অশ্লীলতায় জ্বালাতন’ হয়ে জেমস লং সাহেব অশ্লীলতা আটকাতে আইনের দরকার বলে প্রচার করতে থাকেন। এবং সফল হন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এত ‘কদর্য’ কবির লড়াইয়ের পরেও দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্কে সৌজন্যের অভাব হয়নি। গৌরীশঙ্কর গুরুতর অসুস্থ হলে ঈশ্বর গুপ্ত তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর সময়ে গৌরীশঙ্কর ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। তিনি দেখতে যেতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ ভাস্কর’এ লিখেছিলেন, সুস্থ হলে ‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদকের ‘মৃত্যুশোক’ নিজে লিখবেন।
পরবর্তী কালের একটি ঘটনা। ব্যঙ্গ পত্রিকার শলাকার ধার সংক্রান্ত কাহিনি। কিছুটা মিল রয়েছে গুপ্ত-গুড়গুড়ে সংবাদের সঙ্গে। মিল না থাকলেও রসাস্বাদনে বাধা নেই... অধিকন্তু ন দোষায়। এক সময়ে সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’র সমালোচনায় বহু বিদ্বজ্জন বিদ্ধ হয়েছিলেন। ছাড় পাননি জীবনানন্দ দাশ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে ‘শনিবারের চিঠি’ অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট ছিল না। ঘটনাটির সাক্ষী শিবনারায়ণ রায়। সজনীকান্ত তখন অসুস্থ। একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন শিবনারায়ণ রায়। বাকিটা তাঁর জবানিতেই শোনা যাক, ‘সজনীকান্ত হঠাৎ আমার হাতদুটি চেপে বললেন, শুনেছি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আপনার বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক আছে। যৌবনে শনিবারের চিঠিতে তাঁকে এবং আরও অনেককে বিস্তর আঘাত করেছি। অনেকেই আমাকে ক্ষমা করেছেন। আমার এখন যাবার সময় হয়েছে। আপনি কি তাঁকে দেখা হলে বলবেন আমি তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’। শিবনারায়ণ রায় সজনীকান্তের অনুরোধ যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুনে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্য, ‘বুড়ো...ঢং দেখে বাঁচি না। মরার আগে হরিনাম’। ওই শূন্যস্থানে ছিল সাংঘাতিক এক শব্দ-বোমা। যার আওয়াজে শিবনারায়ণ রায়ও চমকিত হয়েছিলেন।
‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদনা এবং ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশের বৈপরীত্য গুপ্ত কবির জীবন জুড়ে। ছোটবেলায় অত্যন্ত উদ্ধত ও অবাধ্য ছিলেন। যা খুশি তা-ই করতেন। ইচ্ছে হলে পাঠশালায় যেতেন। না হলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। তিনি কী রকম অবাধ্য ছিলেন? তা হলে তাঁর বাবার বিয়ের ঘটনাটা বলা যেতে পারে। ঈশ্বর গুপ্তের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। মায়ের মৃত্যু হল। কিছু দিনের মধ্যেই বাবা হরিনারায়ণ আবার বিয়ে করলেন। কিন্তু বিয়ে করার পরে বাড়ি না এসে শ্বশুরবাড়ি থেকে সোজা কাজে চলে গেলেন। নববধূ একা এলেন কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে। গুপ্ত কবির সৎ ঠাকুমা নববধূকে বরণ করে নিচ্ছিলেন। হ্যাঁ, তাঁর ঠাকুরদারও দু’টি বিয়ে। প্রথম পক্ষ তখন প্রয়াত। কিন্তু সৎ মাকে দেখে রেগে গেলেন বালক ঈশ্বর। সৎ মায়ের দিকে একগাছা রুল ছুড়ে মারলেন। তবে সেই রুল বিমাতার গায়ে লাগেনি। গিয়ে গেঁথে এক কলাগাছে।
তার পরের ঘটনা আরও সাংঘাতিক এবং অবমাননাকর। রুল ছোড়ায় সফল না হয়ে একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু পরিত্রাণ পাননি। জেঠামশাই দরজা ভেঙে ঈশ্বরচন্দ্রকে জুতো পেটা করেন। কিন্তু তাতেও উদ্ধত ঈশ্বরকে বশে আনা যায়নি। ঠাকুরদা সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন মা হারা ছোট ছেলেটিকে। বলেছিলেন, ‘তোদের মা নেই। মা হল। তোদের দেখবে।’ ঈশ্বর ঠাকুরদার মুখের উপরে বলে দিল, ‘হাঁ! তুমি আর একটা বিয়ে করে যেমন বাবাকে দেখছ, বাবা আমাদের তেমনই দেখবেন’। সময়ের সঙ্গে বিস্তর বদল হয়েছিল এই উদ্ধত ঈশ্বরচন্দ্রের। প্রায় প্রথাগত শিক্ষাহীন এক তরুণ কলকাতার বুধমণ্ডলীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তখন। সেই সময়ের ঈশ্বর গুপ্ত পুরো অন্য মানুষ। সদাহাস্যময়। আর মুখ খুললেই ইঙ্গিতপূর্ণ রসকথা। ছেলে-বুড়ো সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। শত্রুরাও নাকি তাঁর ব্যবহারে
‘মুগ্ধ হইত’।
ছোটবেলায় পাঠশালাবিমুখ হওয়ায় পড়াশোনাও খুব বেশি এগোয়নি। কিন্তু তখন থেকেই মুখে মুখে কবিতা বানাতে পারতেন। বাল্যকালের সেই মুখে মুখে কবিতা রচনার অভ্যেস আর রসকথার প্রবাহ মিলেমিশেই বোধহয় তৈরি করেছিল তাঁর হাসি-মজার কবিতাগুলি। গুপ্ত কবি কাব্যরস যন্ত্রে কী নিষ্কাষণ করেননি? যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিলেন ‘পাঁটা’। বেরিয়ে এল নির্যাস, ‘রসভরা রসময় রসের ছাগল।/তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল’। দীর্ঘ কবিতা। সেই পাঁঠা-প্রেমাবলির এক জায়গায় লেখা, ‘মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?/যত চুসী তত খুসী হাড়ে হাড়ে রস’। কাব্যযন্ত্রে ঢুকল ‘এণ্ডাওয়ালা তপ্স্যামাছ’। বেরিয়ে এল স্ফূর্তি, ‘প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।/ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিক কাঁচা’। বা ‘ভেজে খাই ঝোলে দিই কিংবা দিই ঝালে।/উদর পবিত্র হয় দিবামাত্র গালে’। কবিতায় বর্ণনা করেছেন ‘প্রণয়ের প্রথম চুম্বন’এর রসাস্বাদন! সে কেমন? ‘রসনায় রসবারি খরস্রোতে বয়/শিহরে সর্ব্বাঙ্গ ভঙ্গ দেয় লজ্জাভয়’। চুম্বনের ফল? কিংবা চুম্বনের আকর্ষণের বিপদ? ‘মুনীনাঞ্চ মতিভ্রম এই স্থলে ঘটে।/নতুবা অযুক্তি হেন কি কারণ ঘটে’। এ সবই বঙ্কিম কথিত, ‘ইয়ার্কি’র ফল।
আসলে জীবনটাকেই তিনি ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। সমাজকেও। সেই ভাবনা লেখাতেও স্পষ্ট করে গিয়েছেন। তাঁর মতে, দেশখানা বড়ই রঙ্গে ভরা। শুধু একে অপরকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা। কাষ্ঠ হাসি, মিছা কান্নায় কার্যসিদ্ধির চেষ্টা।
জীবনের মতো রচনাতেও কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের বৈপরীত্য আছে। তাঁর সৃষ্টিমালায় কিন্তু একজন গুপ্ত কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক ঈশ্বরচন্দ্র সেখানে ছড়িয়ে রয়েছেন। একদল তাঁর কবিতার উদাহরণ দেখিয়ে বলতেই পারেন, ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশদের স্তাবক। তাই তিনি ইংল্যান্ডেশ্বরীর স্তুতিতে লিখেছিলেন, ‘তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু/ শিখিনি শিং বাঁকানো/কেবল খাবো খোল বিচালি ঘাস’। কিছু দিন আগেই আমাদের দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব জেগেছিল। পুলওয়ামা-বালাকোট পর্বে। বাগযুদ্ধ চলছিল শাসক বনাম বিরোধী দলের। মানবিকতা, ভাবাদর্শ বনাম আনুগত্য এবং ‘দেশভক্তি’র। যুদ্ধের সময় সমাজের অগ্রগণ্যদের মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র মতামত জানিয়েছিলেন কবিতায়। কিন্তু তাতে শাসক ইংরেজের প্রতি আনুগত্যই প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ নিয়ে তাঁর মত, ‘পেটে খেলে পিঠে সয় এই বাক্য ধর।/রাজার সাহায্য হেতু রণসজ্জা পর’। সিপাই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা নানাসাহেবকেও একটি কবিতায় ব্যঙ্গ করেছিলেন, ‘আগেতে দেখেছ ঘুঘু, শেষে দেখ ফাঁদ’।
কিন্তু এই ঈশ্বর গুপ্তই তো সরকারি চাকরিতে দেশি ও বিলিতি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিয়ে সরকারি নীতির তুলোধনা করেন। কড়া সম্পাদকীয় লেখেন। তাঁর সময়ে কর্মদক্ষ দেশীয় কর্মী পেতেন একশো টাকা। আর ইংরেজরা এক হাজার টাকা। শুধু তা-ই নয়, কাজের ভুল হলে শাস্তির মাত্রাতেও ছিল বৈষম্য। একই রকম ভুলের জন্য ইংরেজ কর্মীদের এক টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু এদেশীয় কর্মী হলে তাঁর শাস্তি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি। ‘গুপ্ত কবি’ দেশের মানুষকে ভালবাসতেন না? তা হলে কেন ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর পাতায় ফি বছর দামোদর নদের বন্যায় বাসিন্দাদের কষ্ট নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন? দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। তাই সরকারকে প্রস্তাব দেবেন, কৃষিবিদ্যা শিক্ষার বিদ্যালয় গড়ে তোলার!
কিছু বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের গোঁড়ামি ছিল। বিশেষ করে মহিলাদের বিষয়ে। বিদ্যাসাগর এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘বিধবা-বিবাহ’ কবিতায় তাঁর কিছু পঙ্ক্তি ব্যঙ্গের মাত্রা ছাড়িয়ে অশালীনতার দিকে ঢলেছে। স্ত্রী শিক্ষা বিষয়েও তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী। তাই লেখেন, ‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল/ ব্রত ধর্ম কোর্তো সবে।/একা বেথুন এসে শেষ করেছে/ আর কি তাদের তেমন পাবে?/যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে/কেতাব হাতে নিচ্চে যবে/তখন এ বি শিখে/বিবি সেজে/বিলাতী বোল কবেই কবে’। ব্যক্তিজীবনেও স্ত্রীর প্রতি রূঢ় ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। পনেরো বছর বয়সে গুপ্তিপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ে দুর্গামণির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে কোনও দিন কথা বলতেন না। কারণ দুর্গামণি কুৎসিত। হাবাগোবা। তবে এর পিছনে নাকি প্রণয়ঘটিত কাহিনিও ছিল। ‘গুপ্ত কবি’ নাকি কাঁচরাপাড়ার কোনও ধনী পরিবারের অপরূপাতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা ছেলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেননি। দুর্গামণির সঙ্গে বিয়ে দেন। আর দুর্গামণি হন তাঁর অবহেলার শিকার।
ঈশ্বর গুপ্তকে এমন অনেক দিক দিয়ে বিচার করা যায়। তারই একটি হল তাঁর দেখার চোখ। বাংলা সাংবাদিকতার শুরুর সময়েই তিনি এমন কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন, যা নিয়ে আজও কথায় লাঠালাঠি চলে। এই দু’টি পঙ্ক্তি, ‘শুনে জিনিসের দর গায়ে আসে জ্বর/ছুটে যাই ঘর বাড়ী ফেলে’। আজই কোনও কবি লিখেছেন বললে কি ভুল হবে? বাজারের অগ্নিমূল্য তো এখন রোজকারের খবর। আর ধর্ম নিয়ে টানাপড়েন? কিছু বলার অপেক্ষা রাখে! শাসকের কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাত থাকবে না, এটা ধর্মান্ধ ছাড়া সকলেরই দাবি। ১৮৫৩ সালে সেই দাবিই তুলেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। এক লেখায় জানিয়েছিলেন, রাজকোষের অর্থ
দিয়ে ‘পাদ্রীদের প্রতিপালন’ অত্যন্ত অন্যায় কাজ।
ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির ‘বুলি’ আর মাতৃভাষা বাংলার দ্বন্দ্ব এখনও শোনা যায়। ঈশ্বর গুপ্তের সময়েও শোনা যেত। তাই নতুন প্রজন্মকে তাঁর কটাক্ষ, ‘যত কালের যুবো যেন সুবো/ইংরেজী কয় বাঁকা ভাবে’। শুধু কি তাই? বাঙালি নব প্রজন্ম বিলাতি কায়দায় রপ্ত হবে, ‘সব কাঁটা চামচে ধোরবে শেষে/পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে?’ দেশি বনাম বিলিতি টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। বাঙালির অনুকরণ প্রবণতা শ্লেষের খোরাক হয়েছে বারবার। ঈশ্বর গুপ্তেরই শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র পরে লিখবেন বিখ্যাত ‘বাবু’ চরিত। উনিশ শতকে বাবু কারা? যাদের ‘চর্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপার-নির্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু’ তারা বাবু। আর
কারা বাবু? ‘যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা তিনিই বাবু’। আবার মুজতবা আলীর ‘ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপকথন’ পড়ুন। সেই হাতে খাওয়া বনাম কাঁটা-চামচ। তবে অন্য আঙ্গিকে। আলী সাহেবের রম্যরচনাটি দু’টি চরিত্রের কথোপকথন। একজন বিদেশি আর অন্যজন ভারতীয়। বিদেশিকে ভারতীয় বলছেন, ‘ভারতবর্ষ তোমাদের পাল্লায় পড়িয়া দিন দিন এমনি অসভ্য হইয়া পড়িতেছে যে, ভারতীয়রাও ছুরি কাঁটা ধরিতে শিখিবার চেষ্টা করিতেছে’। ব্যঙ্গের সলতে জ্বালিয়েছিলেন গুপ্ত কবি। তা কিন্তু আজও জ্বলছে।
ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গদর্শী চোখ বা মন তখনই ধরে ফেলেছিল, দুর্গাপুজো লড়াকু বাঙালির আর এক রণক্ষেত্র। তাই বোধহয় তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমরা মাথা কুটাকুটি করিয়া দুর্গোৎসব কর’। এখনও প্রতি শারদীয়ায় ‘হাজার হাতের দুর্গা’, পঞ্চাশ ফুটের প্রতিমার বিজ্ঞাপন কি সেই মাথা ‘কুটাকুটি’র পরম্পরা?
ঈশ্বর গুপ্তের ভাবনা আর এক বিষয়ে কালজয়ী। আগে ঘটনাটি বলা যাক। ১২৫৭ সাল। নববর্ষে তিনি নতুন একটি অনুষ্ঠান শুরু করলেন। নিজের ‘যন্ত্রালয়’-এ ওই দিন একটি সভার আয়োজন করলেন। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ সভা হত। সেই সভায় কলকাতা এবং জেলার সম্ভ্রান্ত মানুষ, বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানালেন। কী হত সেই সভায়? ঈশ্বরচন্দ্র প্রবন্ধ, কবিতা পড়তেন। পরের দিকে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা ভাল লিখতেন, তাঁদের লেখা সভায় পাঠ করার সুযোগ দিতেন। যাঁর লেখা ভাল হত তাঁকে নগদ পুরস্কার দিতেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্ব। সভাশেষে আমন্ত্রিত চার-পাঁচশো লোকের মহাভোজের আয়োজন থাকত।
কলকাতার বইপাড়ায় নববর্ষ পালন হয়। সাহিত্যপাঠ, ভোজনও পালনীয় রীতি সেখানে। এই রীতির ভগীরথ কি ‘গুপ্ত কবি’!
ঋণ:
ঈশ্বর গুপ্ত রচনাবলী প্রথম খণ্ড— সম্পাদক শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও হরিবন্ধু মুখটী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাসংগ্রহ—ভূমিকা’, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নির্বাচিত রচনাবলী’— সম্পাদনা বাঁধন সেনগুপ্ত, ঈশ্বর গুপ্ত পাঠাগার, ঈশ্বর গুপ্ত পরিষদ ও কল্যাণী পুরসভার ‘কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত— দ্বি-শত বার্ষিক জন্মজয়ন্তী-২০১২ স্মরণিকা’, ‘কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর (দ্বিতীয় পর্ব)’।