এক প্রবীণের আত্মবিলাপ

বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘অন্য থিয়েটার’-এর নতুন নাটক ‘নটী কিরণশশী’ অনেকটা যেন এমনই। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় আদরের মেয়ে বুলা যে দিন মারা যায়, সে দিনও প্রভাদেবী মঞ্চে উঠেছিলেন। বাধ্য হয়ে নয়, থিয়েটারকে ভালবেসে। প্রভা ছিলেন শিশির ভাদুড়ির হাতে গড়া।গিরিশ-প্রিয়া তিনকড়ি দাসী উইল করে তাঁর দুটি বাড়ি দান করেছিলেন বড়বাজারের একটি হাসপাতালকে।এর সম্পূর্ণ অন্য চিত্রও আছে। এক কালের গ্ল্যামার-কুইন কুসুমকুমারী যেমন। শেষজীবনে ভিক্ষে করে পেট চালিয়েছেন।আর বাংলা নাটমঞ্চে বিনোদিনীর বঞ্চনা, তাঁর ক্ষোভ, তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর উদ্‌যাপন তো বহু চর্চিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share:

সে দিনের মহলায় সেঁজুতি-শ্যামল, ছবি: কুন্তল নারায়ণ চৌধুরী

আদরের মেয়ে বুলা যে দিন মারা যায়, সে দিনও প্রভাদেবী মঞ্চে উঠেছিলেন। বাধ্য হয়ে নয়, থিয়েটারকে ভালবেসে। প্রভা ছিলেন শিশির ভাদুড়ির হাতে গড়া।

Advertisement

গিরিশ-প্রিয়া তিনকড়ি দাসী উইল করে তাঁর দুটি বাড়ি দান করেছিলেন বড়বাজারের একটি হাসপাতালকে।

এর সম্পূর্ণ অন্য চিত্রও আছে। এক কালের গ্ল্যামার-কুইন কুসুমকুমারী যেমন। শেষজীবনে ভিক্ষে করে পেট চালিয়েছেন।

Advertisement

আর বাংলা নাটমঞ্চে বিনোদিনীর বঞ্চনা, তাঁর ক্ষোভ, তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর উদ্‌যাপন তো বহু চর্চিত।

এমন আরও আছেন গোলাপসুন্দরী, সুশীলবালা, হরিসুন্দরী থেকে নরীসুন্দরী, চারুশীলা।

প্রত্যেকটি জীবনের গায়েই লেগে আছে এক দিকে ত্যাগ, তিতিক্ষা, সহশীলতা, অন্য দিকে প্রেম, মমতা, মায়া, শ্রদ্ধার অসংখ্য জলছবি।

কিন্তু নটী কিরণশশীর জীবন কোথায় যেন তারও ‘এক্সটেনশন’। বর্ধিত রূপ। সে যেন আরও তীক্ষ্ণভাবে নির্দেশ করে সামাজিক কাঠামোকে।

থিয়েটারি গণ্ডি ছাড়িয়ে কিরণের চিৎকার, আর্তনাদ, কান্না, ঘৃণা, ক্ষোভ যেন ঘরে ঘরে ঢুকে আজন্মকাল ধরে বয়ে চলা নর এবং নারীর ‘দাস-প্রভু’ সদৃশ সম্পর্কর ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়। তাকে সজোরে থাপ্পড় কষায়।

বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘অন্য থিয়েটার’ নাট্যদলের নতুন নাটক তাঁকে নিয়েই। ‘নটী কিরণশশী’। প্রথম শো ১০ এপ্রিল, রবীন্দ্রসদন, সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

কিরণ (সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়) কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। তবে তাঁর কাহিনি যে ইতিহাসের বাইরে, তাও নয়। বরং কিরণের জীবন, মঞ্চ ও মঞ্চের বাইরে অসংখ্য নারীজীবনের যোগফল।

নাটকটির অনুপ্রেরণা বিমল করের গল্প ‘পিঙ্গলার প্রেম’। কিন্তু নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের এ-নাটকে গল্পকারের ভাবটুকুই যা রয়েছে, কাহিনিটি ছড়িয়েছে আরও বিস্তৃত স্তরে। চরিত্রের ধাঁচাও তাতে বদলে বদলে গেছে।

কিরণশশী ছ’মাসের পুত্রকে ফেলে স্বামীঘর ছেড়ে পরপুরুষের সঙ্গে চলে আসা এক অভিনেত্রী।

তাঁর বাঁধা-বাবু ভুবন চৌধুরী (শ্যামল চক্রবর্তী)। ভুবন নাট্যকার। অভিনেতা।

নাটকের মুখড়াতেই শোনা যায়, কিরণশশী নাকি এ বার থিয়েটার ছেড়ে দেবেন। সিনেমা করবেন।

তার আগে তাঁকে তিন রাত্তির থিয়েটারের জন্য বায়না করতে এসেছে মনোহরপুর-এর একটি ক্লাব।

কম্বিনেশন নাইট। কিরণকে অভিনয় করতে হবে ক্লাবের শখের অভিনেতার সঙ্গে। রফা হয় তিনটি নাটক। তিনটিরই নাট্যকার ভুবন চৌধুরী।

মনোহরপুরে কিরণশশীর যাওয়া, সে-পাড়ায় গিয়ে এলাকার সুদর্শন নায়ক মৃগাঙ্কর (প্রতীক দত্ত) সঙ্গে তাঁর থিয়েটারের প্রস্তুতি-পর্ব, তাঁর অভিনয়— এ সবের মধ্যে দিয়েই নাটকটি গড়ায়।

যার কোটরে বাসা বাঁধে কিরণ-মৃগাঙ্কের প্রণয়। আর শাখাপ্রশাখায় বয়ে যায় গাঁ-ঘরের জীবন।

তাতে যেমন পিরিতের মৃত্যু হয়, স্বপ্নেরও ইতি ঘটে। তির তির করে বয়ে চলা ছলাৎ-ছলাৎ স্রোত হঠাৎ যেন দামাল ঢেউয়ের গ্রাসে তলিয়ে যায়।

ভুবন তাঁর এত দিনের কেনা ‘বাঁদি’ কিরণকে পিছলে যেতে দেখে। তার ক্রুঢ় চাল, সর্বগ্রাসী ক্ষুধা হায়নার মতো তাঁকে হিংস্র করে তোলে।

ভুবনের কলমের আঁচড়ে পালার গতি, চলন, কাহিনি ধাওয়া করে ফেরে কিরণের ফেলে আসা জীবনকে। প্রকাশ্যে তাঁকে বিবস্ত্র করতে করতে খ্যাপাটে উল্লাসে তাণ্ডব নৃত্য চালায় তাঁর ‘বাবু’।

কিরণকে প্রাণ দিয়ে গড়ছেন সেঁজুতি। কিরণের লাস্য, কিরণের কামনা, কিরণের ফুৎকার, কিরণের কাতরতা— সবখানে সেঁজুতির যত্নের ছাপটি স্পষ্ট। তার সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিচ্ছে শ্যামলের ‘ভুবন’। গ্রাম্য-সারল্যে ডুবে থাকা মৃগাঙ্কও বড় মায়াময় প্রতীকের অভিনয়ে।

তিরিশ-চল্লিশ দশকের এ-কাহিনির চলনকে বইতে গিয়ে এ-নাটকের আবহসঙ্গীতটি (মুরারী রায়চৌধুরী) যেন হুবহু মাখামাখি সেই সময়কালে।

টাইটেল মিউজিক খানিকটা অপেরা স্টাইলের হলেও কোথায় যেন তার টিউনটা একটু হলেও আলাদা।

যাত্রাধর্মী সুরটাকে বুকে নিয়ে সে যেন থিয়েট্রিকাল অর্কেস্ট্রা হয়ে বাজে। আর তার সুর প্রথম থেকেই শরীরের পাকদণ্ডি বেয়ে পেশি পেশিতে হানাদারি আক্রমণ চালায়। মুহূর্তে অবশ ভাব এনে দেয় প্রতিটি প্রত্যঙ্গে।

একের পর এক গান বাজে। তার চলাচলে কোথায় যেন সায়গল-কাননদেবী-জগন্ময় মিত্ররা লুকিয়ে থাকেন।

অসংখ্য মিশ্র রাগে মোড়া গানের তরঙ্গ—খাম্বাজ, গৌরসারং, কাফি-টোডি, বিলাসখানি-টোডি...!

শুধু সুরে নয়, গানের কলি, তার শব্দে, তার গড়নে যেন জেগে ওঠে সময়। তার মায়া।

মঞ্চভাবনাটিতে রঙ্গালয়ের আদল একশোভাগ। কিন্তু সে-রঙ্গালয় বুঝিবা শুধু নাটমঞ্চের নয়, হয়ে ওঠে জীবনের।

এ পার থেকে ওপারে ঝুলতে থাকা লাল-হলুদ-সবুজ কাপড়ের ফালি, তার নীচে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া ত্রিস্তর পাটাতন। তার বাঁ ধারে সিঁড়ি।

এ পাশে কোথাও চিক, তো ওপাশে কোথাও জাফরি। মাঝে মাঝে কতগুলো খুঁটি রাখা। তার গা বেয়ে নামে নানান মোটিফ, মুখোশ। গোটা চত্বর জুড়ে পালা আর জীবন যেন গলাগলি করে দাঁড়িয়ে।

প্রায় দু’বছর বাদে নির্দেশনায় বিভাস চক্রবর্তী। ২০১৪ সালে সেই ‘ছোট ছোট বাড়ি’ নাটকটির পরে।

বিভাস বললেই চোখের সামনে যে থিয়েটারগুলো ভেসে ওঠা— ‘চাকভাঙা মধু’, ‘শোয়াইক গেল যুদ্ধে’, ‘রাজরক্ত’, নিদেন ‘অদ্ভুত আঁধার’ বা ‘হচ্ছেটা কী’— সেই টিপিক্যাল ঘরানা থেকে এ-নাটক কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা।

বরং বিভাসের এ থিয়েটার খানিক হলেও তাঁর ‘মাধবমালঞ্চী কইন্যা’র সঙ্গে মেলে।

তার চেয়ে বড় কথা, এ নাটকে চোরাস্রোতে কেবলই যেন ভেসে বেড়ায় নির্দেশকের এক ধরনের পীড়া।

যেখানে জুড়ে থাকে শিলেটে তাঁর ফেলে আসা ছেলেবেলা, শ্যামবাজারের বাড়িতে থাকা, তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংসর্গ, হাতিবাগানে থিয়েটার পাড়ার রমরমা সময়গুলো কী অনুরোধের আসরে মায়াধরা সেই সব হারানো দুপুর।

প্রতি মুহূর্তে এ নাটকের সাবটেক্সট্-এ যেন ছায়া হয়ে ভাসতে থাকে পিছলে যাওয়া সময়ের গদ্য, হারিয়ে যাওয়া ভাবালুতার বিলাপ, ছন্নছাড়া দিনকালে বাধ্য হয়ে বাঁচতে থাকার শোক।

এ নাটক তাই কখনও’বা হয়ে যায় আশি ছুঁতে চলা এক প্রবীণের আত্মচারিতা। হয়তো’বা আত্মদর্শনও। যার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চ ছাড়িয়ে, তার বাইরেও!

‘নটী কিরণশশী’ যেখানে উপলক্ষ মাত্র!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement