শয্যা না পেয়ে এ ভাবেই রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। —নিজস্ব চিত্র।
বাগদার নলডুগারি এলাকার বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের অজিত সরকার সোমবার দুপুরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছিলেন। হাসপাতালে এসে দেখলেন, পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে কোনও বেড ফাঁকা নেই। অগত্যা তাঁকে ওই ওয়ার্ডের মেঝেতেই শোয়ানো হল। সেখানেই তাঁর চিকিৎসা চলছে।
বনগাঁর শিমুলতলার বাসিন্দা সুরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় টাইফয়েড নিয়ে সোমবার হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। তিনিও বেড না পেয়ে মেঝেতে রয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টা নাগাদ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন। স্যালাইন চলছে। বললেন, “গতকাল থেকে এখনও বেড পাইনি। অসুস্থ শরীরে শক্ত মেঝেতে শুয়ে আছি। নীচ থেকে ঠান্ডা উঠছে। কী আর করব! চিকিৎসা তো করাতে হবে।” মেঝেতে শুয়ে ফ্যানের হাওয়াও পান না বলে জানালেন সুরেন্দ্রবাবু।
এই অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র এই দু’জনের নয়। বনগাঁ মহকুমার দূর-দূরান্ত থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা বহু মানুষ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা জানালেন একই অভিজ্ঞতার কথা।
পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের পাশাপাশি মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডেরও একই চিত্র।
গোপালনগরের আকাইপুরের বাসিন্দা মিতা বিশ্বাস জ্বর নিয়ে মহিলা ওয়ার্ডে বেড না পেয়ে মেঝেতে রয়েছেন। বললেন, “বেড না পেয়েই এ ভাবে থাকতে বাধ্য হয়েছি। উপায় তো নেই। একে গায়ে জ্বর, তার উপরে নীচ দিয়ে ঠান্ডা উঠছে।”
হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, মেঝেতে শুয়ে থাকা রোগীদের পাশ কাটিয়েই যাতায়াত করছেন নার্স, চিকিৎসক, আয়ারা। ভিজিটিং আওয়ারে যখন রোগীর বাড়ির লোকজন আসেন, তখন সংকীর্ণ ওয়ার্ডে তাঁদের বসা বা দাঁড়ানোর জায়গাই হয় না। তার উপরে মেঝেতে রোগীরা শুয়ে থাকায় সমস্যা হয় দু’তরফেই। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ পায়ের চাপও খান। বাড়ির লোকেরা বসে রোগীর সঙ্গে ঠিক মতো কথাও বলতে পারেন না। রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দের বক্তব্য, “সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নূন্যতম একটা শয্যা পাবেন, এই আশা তো করাই যায়। কিন্তু বহু বার হাসপাতাল কতৃর্পক্ষকে জানিয়েও সুরাহা হয়নি।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা জানেন না তা নয়। কিন্তু তাদের করণীয়ই বা কী আছে?
বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, মহকুমার প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। রোগীর চাপ থাকে খুবই বেশি। পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে সরকারি ভাবে শয্যার অনুমোদন আছে ২৫টি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা নিজেদের মতো বাড়িয়ে ৩৮টি করছেন। কিন্তু রোজ গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ৮০-৯০ জন। শয্যা রাখারও আর জায়গা নেই ওয়ার্ডে। মহিলা ওয়ার্ডেরও একই পরিস্থিতি। ৩৫টি শয্যা রয়েছে এখানে। কিন্তু রোগী ভর্তি থাকেন শ’খানেক। এখানেও ওয়ার্ডের মধ্যে আর শয্যা বাড়ানোর জায়গা নেই।
ওয়ার্ড দু’টির সম্প্রসারণ ছাড়া সমস্যা মেটানো সম্ভব নয় বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে। চিকিসৎকেরা জানিয়েছেন, মেঝেতে রোগী থাকলে বসে চিকিৎসা করতে সমস্যায় পড়তে হয়। পরিস্থিতি যে জটিল, সে কথা মেনে নিয়েছেন হাসপাতাল সুপার গয়ারাম নস্কর। তিনি বলেন, ‘‘সমস্যা মেটাতে ২০১২ সালে ওয়ার্ড দু’টি সম্প্রসারণ করতে চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে ৭০ লক্ষ টাকার পরিকল্পনা করে পাঠানো হয়েছিল। যা এখনও অনুমোদন হয়নি। ওয়ার্ড দু’টি সম্প্রসারণ হলে বেড বাড়ানো যাবে।’’ আশার কথা শুনিয়েছেন বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তথা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, “ওয়ার্ড দু’টি সম্প্রসারণের জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয়কুমার আচার্য জানিয়েছি। বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল চত্বরেই একটি তিনশো শয্যার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। ইতিমধ্যেই এলাকা দেখে সমীক্ষার কাজ হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর অনুমোদনও দিয়েছে।” বিধায়ক জানান, ওই হাসপাতালটি তৈরি হলে মেঝেতে থাকার সমস্যাও মিটে যাবে। তা ছাড়া, হাসপাতালের ওই ওয়ার্ড দু’টি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের শয্যা বাড়ানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, নতুন তিনশো বেডের হাসপাতালটি পিপিপি মডেলে হওয়ার কথা। বর্তমানে হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা তিনশো। প্রস্তাবিত হাসপাতালটি তৈরি হলে মহকুমার মানুষ উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন বলে আশা করাই যায়। সে দিকেই তাকিয়ে মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।