আর জি করের পরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কাতরাচ্ছে সন্তান। বাবা ডাক্তারকে ডাকতে গিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন, ‘কাল সকালে ভিজিটিং আওয়ারে আসুন।’ ওয়ার্ডে ফিরে বাবা দেখছেন, কানে হেডফোন গুঁজে নার্স গল্পে মত্ত। অসহায় ভাবে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ছুটছেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য সেই ছোটা থেমে যায়। কারণ, ততক্ষণে তাঁর সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সুবিচার চেয়েছেন এক বাবা। জানতে চেয়েছেন, “এটাই কি সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার একমাত্র সত্য?”
সপ্তাহ দুই আগে দমদমের বেদিয়াপাড়ার বাসিন্দা, ১৭ বছরের সুদীপ রাহার মৃত্যুর প্রতিকার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সুদীপের বাবা প্রদীপবাবু। তাঁর অভিযোগ ছিল, ইমার্জেন্সির ডাক্তার তাঁর ছেলেকে ছুঁয়েই দেখেননি। মুখ থেকে গ্যাঁজলা ওঠার পরে চিকিৎসা শুরু হয়। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায় সুদীপ। ওই ঘটনার তদন্তে তৈরি হওয়া দু’টি কমিটিই তাদের রিপোর্টে হাসপাতালের সহমর্মিতার অভাবের কথা স্বীকার করেছিল। কিন্তু তা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে শুক্রবার পৌঁছনো আর একটি চিঠি আবার তা সামনে এনে দিল।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও ওই রোগীর পরিবারের বিরুদ্ধে পাল্টা অভব্যতার অভিযোগ এনেছেন। তাঁদের বক্তব্য, পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সারা রাত রোগীর বাড়ির লোকের হাজির থাকার কথা নয়। তাঁরা হাজির থেকে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় নানা অসুবিধা সৃষ্টি করেছেন। ডাক্তারদের ধাক্কাধাক্কিও করেছেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের বাসিন্দা আব্দুস সালাম শেখের ছেলে গত ২৪ অগস্ট পুকুরে পড়ে গিয়েছিল। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে ন্যাশনাল মেডিক্যালে নিয়ে আসেন তার পরিবারের লোকেরা। অভিযোগ, শিশুটির অবস্থার উত্তরোত্তর অবনতি হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু, হাসপাতালের কর্মী পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাঁর কাছে শিশুটির সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে আব্দুস সালাম অভিযোগ করেছেন, “ছেলেকে স্যালাইন দেওয়ার জন্য হাতে চ্যানেল করার প্রয়োজন ছিল। জুনিয়র নার্স কানে হেডফোন লাগিয়ে চ্যানেল করতে এলেন। বারবার সূচ ফোটাচ্ছিলেন তিনি। কিছুতেই চ্যানেল করা যাচ্ছিল না। আমার একরত্তি ছেলের হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। অক্সিজেন জারে জল ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমার স্ত্রী সে কথা বলায় নার্স তাঁকে বললেন, নিজে জল ঢেলে নিন।”
এখানেই শেষ নয়। তিনি জানিয়েছেন, মাঝরাতে তাঁর সন্তান যখন আক্ষরিক অর্থেই খাবি খাচ্ছে, তখনও পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কোনও ডাক্তার ছিলেন না। ডাক্তারের ঘরে গিয়ে তাঁকে ডাকাডাকি করায় তিনি প্রচণ্ড রেগে যান এবং কেন তাঁর ঘুম ভাঙানো হল, তার কৈফিয়ত চান। আব্দুস সালামের অভিযোগ, “ওই মহিলা ডাক্তার আমাকে বলেন, পরের দিন ভিজিটিং আওয়ারে এসে ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে যেন কথা বলি। আমার ছেলে অবশ্য সেই সুযোগ দেয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।” ঘটনার পরেই বেনিয়াপুকুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তিনি।
আর শুক্রবার নবান্ন ও স্বাস্থ্য ভবনে পৌঁছয় তাঁর অভিযোগ। ন্যাশনালের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “ভর্তির সময়েই শিশুটির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। যা যা করা সম্ভব, আমরা করেছি। কিন্তু তাতে রোগীর পরিবারের লোককে সন্তুষ্ট করা যায়নি। ওঁরা খুবই অভদ্র আচরণ করেছেন। ডাক্তারদের ধাক্কা মেরেছেন।” এই ঘটনায় এখনও কোনও তদন্তই শুরু হয়নি। বরং গোড়া থেকেই সুপার ডাক্তার ও নার্সদের ক্লিনচিট দিয়েছেন। কেন হাসপাতালের নার্সের বিরুদ্ধে হেডফোন গুঁজে ডিউটি করার এবং রাতের ডিউটিতে থাকা ডাক্তারকে বারবার ডাকা সত্ত্বেও না পাওয়ার অভিযোগ উঠবে?
সুপারের উত্তর, “এমন কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রয়োজনে পুলিশ তদন্ত করে দেখুক।”