এক ক্যানসার রোগীর রেডিওথেরাপি চলছিল। ক্যানসার-আক্রান্ত কোষগুলিকে মারতে মাত্র মিনিট দু’য়েক ওই রোগীর শরীরে তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রবেশ করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখা গেল, রশ্মি বেরোতেই থাকছে। রিমোট কন্ট্রোলে যন্ত্রটি বন্ধ করার কথা। অথচ, একাধিক বার সুইচ টিপলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। সকলেই হতবাক। ডাক্তার, নার্স, ফিজিসিস্টরা ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। খবর দেওয়া হল যন্ত্র সরবরাহকারী সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারদের। তাঁরা জানালেন, তৎক্ষণাৎ কিছু করা সম্ভব নয়। তা হলে উপায়? শেষ পর্যন্ত ওই বিভাগের এক মহিলা ফিজিসিস্ট রেডিয়েশনের ঘরে ঢুকে বহু চেষ্টাচরিত্র করে নিজের হাতেই যন্ত্রটি বন্ধ করলেন। ততক্ষণে অবশ্য তাঁর শরীরে ওই অতি তেজস্ক্রিয় রশ্মি অনেকটাই প্রবেশ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যার ফল হতে পারে মারাত্মক।
ঘটনাস্থল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ। এ রাজ্যে ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, বুধবার সকালের এই একটি ঘটনাতেই তা বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। এনআরএসে তো বটেই, অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজেও এ নিয়ে জোর শোরগোল চলছে। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই বলছেন, সরকারি অবহেলায় পরিকাঠামোর ঘাটতিই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। যে যন্ত্রে প্রতিদিন বড়জোর শ’দেড়েক রেডিয়েশন এক্সপোজার হওয়ার কথা, সেখানে কখনও কখনও হচ্ছে আড়াইশো-তিনশো। অতি-ব্যবহারের জেরে যন্ত্র কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। অতিরিক্ত সংখ্যক রোগীকে রেডিয়েশন দিতে হওয়ায় চিকিৎসার মানের সঙ্গেও আপস করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলির ক্যানসার বিভাগে ত্রাহি মধুসূদন রব।
এনআরএসের ফিজিসিস্ট যে ভাবে ঝুঁকি নিয়ে রেডিয়েশনের ঘরে ঢুকে যন্ত্রটি বন্ধ করেছেন, তার প্রশংসা করেন সকলেই। তিনি নিজে বিষয়টিকে ‘পেশাগত ঝুঁকি’ বলে বর্ণনা করলেও তাঁর সতীর্থেরা মেনে নিয়েছেন, এমন একটা কাজ করে অন্যদের সমস্যা থেকে বাঁচালেও নিজে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢুকেছেন তিনি।
আচমকা ওই রেডিয়েশন শরীরে প্রবেশ করার পরে এ বার কী করবেন ওই ফিজিসিস্ট? এনআরএসের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অমিতাভ রায় বলেন, “অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ডকে গোটা বিষয়টি জানানো হচ্ছে। তারা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় মেপে দেখবে ঠিক কতটা রশ্মি ওঁর শরীরে ঢুকেছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।” বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ক্যানসারের ওই রেডিয়েশন সাধারণ, সুস্থ কোষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এর জেরে সাময়িক এবং স্থায়ী একাধিক বড়সড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় রয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করছে কতটা রশ্মি ঢুকেছে, তার উপরে। বিকল যন্ত্রকে বাগে আনতে বুধবার ওই ফিজিসিস্টকে যে মাসুল দিতে হল, তাতে সেই ঘটনার পরিণামের কথা ভেবে খুবই আতঙ্কিত তাঁরা।
অমিতাভবাবু বলেন, “১৫০-এর বেশি রেডিয়েশন এক্সপোজার হওয়ার কথাই নয়। এখানে গড়ে ২৩০-২৪০ হয়। কখনও কখনও তারও বেশি। বুধবার আমাদের ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেটা অবশ্য দ্রুত ঠিক করা গেছে।” তাঁর বক্তব্য, “বছরে পাঁচ হাজার নতুন ক্যানসার রোগী শুধু এই হাসপাতালেই আসেন। কাউকেই তো আর চিকিৎসা না করে ছেড়ে দিতে পারি না।
রাজ্যে ক্যানসার চিকিৎসার সরকারি পরিকাঠামো এই মুহূর্তে বেহাল। ক্যানসার রোগীদের রেডিয়েশন দেওয়ার জন্য কোবাল্ট যন্ত্র বহু মাস ধরে খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে এসএসকেএম হাসপাতালে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দু’টি যন্ত্রের একটি ধুঁকছে। ফলে এনআরএস এবং আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে রোগীর ভিড় বাড়ছে। এনআরএসে যেহেতু রেডিওথেরাপি বিভাগে পে-ক্লিনিক রয়েছে, তাই রোগীর ভিড় এমনিতেই বেশি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত সেখানে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। এক চিকিৎসকের কথায়, “হু হু করে ক্যানসার রোগী বাড়ছে। সাধারণ মানুষের সরকারি হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই। অথচ ওই বিপুল সংখ্যক রোগীকে পরিষেবা দেওয়ার মতো ব্যবস্থাই নেই রাজ্যে। সরকারি তরফে ক্যানসার চিকিৎসা ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ে যে সব দাবি করা হয়, তা আদতে কথার কথা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।”
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, সীমিত পরিকাঠামোয় এত রোগীকে পরিষেবা দিতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা যথাযথ মান বজায় রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, “যে কোনও ক্যানসার রোগীরই দ্রুত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু এত চাপ যে রেডিয়েশন-এর তারিখ পেতে তিন-চার মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। অত দিন কি রোগী বিনা চিকিৎসায় থাকবেন? এই কারণেই এমন বহু ক্ষেত্রে যেখানে কেমোথেরাপি তখন না দিলেও চলে, সেখানেও আমরা কেমোথেরাপি নিতে বলি। অন্তত চিকিৎসা প্রক্রিয়াটা শুরু হল এবং রোগী বা তাঁরা বাড়ির লোকেরা খানিকটা মানসিক স্বস্তি পেলেন।”
যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে ২০২০ সালের মধ্যে মহামারীর আকার নেবে ক্যানসার, সেখানে এই রোগের চিকিৎসাকে ঘিরে এমন উদাসীনতা কেন? কেন এখনও পর্যন্ত সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগ খোলা হয়নি, কেন বহু জায়গাতেই রেডিয়েশনের যন্ত্র খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে, সেই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর অবশ্য স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।
রেডিয়েশনে ক্ষতি
তাত্ক্ষণিক
পরবর্তী সময়ে
• চর্মরোগ
• অতিরিক্ত ক্লান্তি
• বমি, পেট খারাপ
• মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ
• হার্টের সমস্যা
• ফুসফুসের সমস্যা
• বন্ধ্যত্বের সমস্যা
• এমনকী ক্যানসারও