উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে এমসিআই পরিদর্শক দলের এক সদস্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
ছুটিতে থাকা কয়েকজন চিকিত্সককে বিমানে উড়িয়ে এনেও পরিদর্শকদের মন গলাতে পারলেন না উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার আগাম নোটিশ ছাড়াই মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার তিন প্রতিনিধি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরিদর্শনে যান। সকাল ৯টায় কলেজের রেকর্ড রুম, অস্ত্রোপচার ঘর, জরুরি বিভাগ পরিদর্শন সেরে অধ্যক্ষের ঘরের পাশে সভা কক্ষে ঢোকেন প্রতিনিধিরা। চেয়ে পাঠান কলেজের সব বিভাগের শিক্ষক চিকিত্সকদের হাজিরা খাতা। দেখা যায় কলেজের প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষক চিকিত্সক কলেজে অনুপস্থিত।
বিষয়টি আশঙ্কা করে তড়িঘড়ি কলকাতায় ছুটিতে থাকা চিকিত্সকদের একাংশকে বিমানে শিলিগুড়িতে উড়িয়ে আনা হয়। কলেজ সূত্রের খবর, তাতে কোনও ফল মেলেনি। এমসিআইয়ের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দেন, সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত যে কজন শিক্ষক-চিকিত্সক হাজিরা খাতায় সই করেছেন শুধুমাত্র তাঁদের উপস্থিতিই গোনা হবে। হাজিরা খাতা দেখে, সেই সব চিকিত্সককেই সশরীরে উপস্থিত হওয়ার জন্য ডেকে পাঠান পরিদর্শকরা। অনেকে পরে পৌঁছন। তবে মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, দেরিতে আসা বা ছুটি বাতিল করে ফিরে আসা শিক্ষক চিকিত্সকদের সঙ্গেও দেখা করেছেন পরিদর্শনকারীরা।
মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সমীর ঘোষ রায় অবশ্য শিক্ষক চিকিত্সকদের অনুপস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, “পরিদর্শন হয়েছে। সব চিকিত্সকের কথাই শুনেছেন এমসিআই-এর প্রতিনিধিরা। আচমকা পরিদর্শন হওয়াতে কিছু সমস্যা হয়েছে।”
এমসিআই-এর আগের পরিদর্শনেও মেডিক্যাল কলেজের ১৫ শতাংশ শিক্ষক চিকিত্সক অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। এমসিআইয়ের মাপকাঠি অনুযায়ী, যে কোনও দিন ৫ শতাংশ শিক্ষক-চিকিত্সকের অনুপস্থিত থাকাকে সাধারণ বলে ধরা হয়। অনুপস্থিতির হার এর থেকে বেশি হলে পরিষেবায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে কাউন্সিলের তরফে ধরা হয়। এ দিন প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষক চিকিত্সকের অনুপস্থিতি স্বাভাবিকের হার থেকে অনেকটাই বেশি। কলেজের বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে ২৫০ জন শিক্ষক চিকিত্সক রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সে কারণেই মেডিক্যাল কলেজের বাড়তি আসনের অনুমোদন নিয়ে সংশয় অব্যাহত রইল বলে মনে করা হচ্ছে।
মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন পরিদর্শনকারী দলে ছিলেন গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক বিভাগের অধ্যাপক ঋতুরাজ চালিয়া, জওহরলাল নেহেরু মেডিক্যাল কলেজের শরীরবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রাজীব ঘোলাটি এবং গুজরাতের ভদোদরা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি ওষুধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ কে সাকসেনা। এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে যান বলে জানা গিয়েছে। এর আগেও এমসিআই পরিদর্শনে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। সে সময়েই বাড়তি আসন নিয়ে সংশয়ের শুরু বলে জানা গিয়েছে।
বছর দু’য়েক আগে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ ডাক্তারিতে ভর্তির আসনসংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ করে। সে সময় এমসিআই অতিরিক্ত ৫০ আসনের জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষক চিকিত্সকের সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়। ২০১৪ সালে দু’দফায় এমসিআই প্রতিনিধিরা মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শন করেন। শেষ পরিদর্শন হয়েছিল গত বছরের নভেম্বর মাসে। সে হিসেবে অন্তত ৬ মাসের আগে ফের পরিদর্শন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই বিভিন্ন মহল ভেবে রেখেছিল। সে কারণেই এ দিনের আচমকা পরিদর্শনে বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃপক্ষ গুছিয়ে নিতে পারেননি বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে গত জানুয়ারি মাসে কলেজ কর্তৃপক্ষ এমসিআইকে চিঠি পাঠিয়ে পরিকাঠামো তৈরির জন্য আরও কিছু সময় চেয়ে নিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
অভিযোগ, বর্তমানে আড়াইশো জন শিক্ষক চিকিত্সক থাকার কথা বলা হলেও, অনেকেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে অন্য মেডিক্যাল কলেজ বা হাসাপাতালের দায়িত্বেও রয়েছেন। সে কারণেই এ দিন এমসিআই পরিদর্শনের সময়ে অনুপস্থিতির হার বেশি দেখা গিয়েছে বলে মেডিক্যাল কলেজেরই একাংশ চিকিত্সকদের অভিযোগ। কলেজের এক প্রবীণ চিকিত্সকের কথায়, “পরিকাঠামো সংক্রান্ত ঘাটতির থেকেও বড় হল শিক্ষক চিকিত্সকদের অস্বাভাবিক অনুপস্থিতি। দু’বার পরিদর্শনে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়েছে। এমসিআই যদি মনে করে, শিক্ষক চিকিত্সককের উপস্থিতিতে পরিষেবা এবং পাঠক্রমের ঘাটতি রয়েছে, তবে যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ রয়েছে।”
এদিকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা মেডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান গৌতম দেব বলেন, “মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামোর উন্নতিতে রাজ্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত ৩৪ বছরে রাজ্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিত্সক পায়নি। এটা একটা বড় খামতি। তাই পরিকাঠামো বাড়াতে কিছু সময় তো লাগবেই।”