হাসপাতালে ঢুকলে এ বার সবই ফ্রি

মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াই শুনে আশঙ্কায় স্বাস্থ্যভবন

পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল এবং ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পেয়িং বেড তুলে দিল রাজ্য সরকার। এমনকী, জেলা স্তর পর্যন্ত সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে কেবিন বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটও মিলবে নিখরচায়। ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের জন্যও পয়সা লাগবে না। বুধবার এসএসকেএম হাসপাতালের এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এ হেন ঘোষণা শোনার পরেই অবশ্য তার বাস্তবতা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল এবং ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পেয়িং বেড তুলে দিল রাজ্য সরকার। এমনকী, জেলা স্তর পর্যন্ত সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে কেবিন বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটও মিলবে নিখরচায়। ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের জন্যও পয়সা লাগবে না। বুধবার এসএসকেএম হাসপাতালের এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে এ হেন ঘোষণা শোনার পরেই অবশ্য তার বাস্তবতা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে একাধিক প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এই মহলের আশঙ্কা, নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রাখার প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

Advertisement

অন্য দিকে স্বাস্থ্যভবনের একাংশ বলছেন, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের কাছ থেকে আরও বেশি অনুদান আদায়ের উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধাম্ত। ওঁদের ব্যাখ্যা: গ্রামীণ স্তরে নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন খাতে রাজ্যগুলোকে অনুদান দিয়ে থাকে। যত বেশি লোককে নিখরচায় পরিষেবার আওতায় আনা যাবে, রাজ্য তত বেশি অনুদান পাবে। তাই জেলাস্তরে সরকারি চিকিৎসা বিনামূল্যে হলে রাজ্যের ঘাড়ে বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপবে না বলেই স্বাস্থ্য-কর্তাদের এই অংশের দাবি।

কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কোথায়? স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল টেস্ট, প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসোনোগ্রাফি ইত্যাদির জন্য বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে পিপিপি মডেলের কেন্দ্র খুলিয়েছে সরকার। সংস্থাগুলি সরকারি হাসপাতালের জমিতে তৈরি ওই সব ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ রোগীদের থেকে বাজারদরের তুলনায় কম টাকা নেয়। “এখন যদি ওই চুক্তি বজায় রেখে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক রোগীদের নিখরচায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দিতে হয়, তা হলে সঙ্কট দেখা দিতে বাধ্য।’’ মন্তব্য এক কর্তার। ওঁদের মতে, সে ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা যে টাকাটা রোগীদের থেকে আদায় করছিল, তার পুরোটা সরকারকে মেটাতে হবে।

Advertisement

সেই অঙ্কটা কত হতে পারে, তা নিয়ে স্বাস্থ্যভবনে ইতিমধ্যে হিসেব-নিকেশ শুরু হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেকের বক্তব্য, জেলা হাসপাতালে রোগীকল্যাণ সমিতির আয়ের অন্যতম উৎস হল কেবিন-ভাড়ার টাকা। ওঁদের প্রশ্ন, কেবিন ফ্রি হয়ে গেলে সমিতির খাতে টাকা জমা হবে কোথা থেকে? দৃষ্টান্ত হিসেবে কলকাতার এমআর বাঙুর হাসপাতালের প্রসঙ্গ তুলে ওঁরা জানাচ্ছেন, ওখানে বার্ন ইউনিটের এসি কেবিনের ভাড়া ধার্য হয়েছিল চারশো টাকা। এ দিকে বাঙুর জেলা হাসপাতালও বটে। সেখানে কেবিন নিখরচায় দিতে হলে হাসপাতালের তহবিলে টাকা কী ভাবে জমবে, তা নিয়ে সংশয় যথেষ্ট। পাশাপাশি ধন্ধ, জেলা হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখার দরকার পড়লে কী হবে?

ভেন্টিলেটর-ও ফ্রি’তে মিলবে কি না, সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় এ দিন স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা পরে বলেন, “আমরাও ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না। কী ভাবে কী হবে, আমাদের মাথায় ঢুকছে না।”

সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে পেয়িং ও ফ্রি দু’ধরনের শয্যা থাকে। ফ্রি বেডের রোগীকেও ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ বহন করতে হয়। “বেডের ভাড়া যতই কম হোক, ওষুধ কিনতে গিয়ে রোগী সর্বস্বান্ত হয়ে যান। সেই পরিস্থিতি থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত।” এ দিন ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে একমাত্র এসএসকেএমেই এ যাবৎ ঘোষিত ‘ফ্রি’ বেড ছিল না। শনিবার রোগীকল্যাণ সমিতির বৈঠকে ওখানেও সাতশো শয্যা ‘ফ্রি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

এবং এই সিদ্ধান্ত ঘিরেও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। “যাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা রয়েছে, তাঁরাও কেন নিখরচায় চিকিৎসার সুবিধা পাবেন?” প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্যভবনের অন্দরে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেকে বলছেন, এমনিতেই রাজ্যে জেলাস্তরে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর হাল সঙ্গিন। নতুন সিদ্ধান্তে অবস্থা আরও ঘোরালো হবে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জেলায় জেলায় ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার যৌক্তিকতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ মিললে ন্যায্য মূল্যের দোকানের অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়ে।

বস্তুত এত সব সমস্যার সমাধান ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে এমন ঘোষণা করলেন, স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেকে তা বুঝে উঠতে পারছেন না। সরকারের কী বক্তব্য? স্বাস্থ্যভবন-সূত্রের ‘সরকারি’ ব্যাখ্যা: জেলার হাসপাতালে বেড চার্জ মকুব করাতে হলে গরিব রোগীকে বিস্তর ঝক্কি পোহাতে হয়। জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে শংসাপত্র জোগাড় করতে নাজেহাল হতে হয়। সমস্ত শয্যা ফ্রি হয়ে আর জটিলতা থাকবে না। উপরন্তু ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ না-লাগলে চিকিৎসা নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তাও থাকবে না বলে সরকার আশাবাদী। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “২০১৩-র জানুয়ারিতে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের ওষুধ ফ্রি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তাই ওষুধ খাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা (২০১০-১১) থেকে বাড়িয়ে করা হয় চারশো কোটির বেশি। এ বার জেলা স্তর পর্যন্ত সব কিছুই ফ্রি করে দেওয়ায় ৭৬ শতাংশের বেশি মানুষ সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা করিয়ে তাঁদের যাবতীয় দুশ্চিন্তা লাঘব করতে পারবেন।”

এ দিন এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন এবং ইউরোলজি ও নেফ্রোলজি বিভাগের নতুন আউটডোর কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। একই মঞ্চ থেকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই স্ক্যান এবং এমআর বাঙুরে ডিজিট্যাল এক্স-রে’র সূচনা হয়। মুখ্যমন্ত্রী এসে হাজির হয়েছিলেন অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের ২৫ মিনিট আগেই, যখন এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারও ভরেনি। পুলিশ ও পূর্ত-কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। শেষমেশ ডাক্তার-নার্সদের পাশাপাশি রোগীর বাড়ির লোকজনকেও ডেকে এনে শ্রোতার আসন ভরানো হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর আগাম হাজিরা তাঁদের যে ঘোর বিড়ম্বনায় ফেলেছে, অনুষ্ঠান শেষে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেন হাসপাতালের কর্তারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement