পরিস্থিতি যে ভয়াবহ, তা এর আগেও একাধিক বার নানা ঘটনায় সামনে এসেছে। কিন্তু এ বার তা আরও প্রকট হল কেন্দ্রীয় সরকারেরই এক সমীক্ষায়। যাতে জানা গিয়েছে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিয়ে গত পাঁচ বছরে এ দেশে প্রায় ন’হাজার মানুষ এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০১৪ সালের শেষ ছ’মাসে এই সংখ্যাটা ৭০০ ছাড়িয়েছে। যাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ এ রাজ্যেরও বাসিন্দা। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে কেন্দ্র।
ন্যাশনাল এড্স কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)-ও এই তথ্য স্বীকার করে নিয়েছে। ভারতীয় ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালেও। রক্ত সুরক্ষা খাতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক বহু বছর ধরেই আর্থিক সহায়তা করছে ন্যাকো-কে। ন্যাকো-র এক কর্তার কথায়, “এই মুহূর্তে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপে না গিয়ে সমস্যা সমাধানের কথাটা ভাবা উচিত। ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে না পারলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”
বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কনসালট্যান্ট, চিকিৎসক কুণাল সাহা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে ন্যাকো এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ককে চিঠি দিয়েছেন। কুণালবাবুর বক্তব্য, “বেশ কিছু বছর ধরেই বিশ্ব ব্যাঙ্ক ন্যাকোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। এ দেশে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক দায়িত্ব ন্যাকো-রই। তারা যদি সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তা হলে ওই সহায়তার অর্থ কী? তিনি বলেন, “বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক পরিদর্শন করে দেখেছি, সেখানে কার্যত কোনও নিয়মই মানা হয় না। যথাযথ পদ্ধতি তো দূরের কথা, বহু ক্ষেত্রেই কোনও পরীক্ষা না করেই রক্ত ব্যবহার হয়। এর পরিণতি তো এমন মারাত্মক হবেই।”
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, রক্ত সুরক্ষা নিয়ে আদৌ কতটা সচেতন আমাদের রাজ্য? যে ভাবে পরিকাঠামো ছাড়াই একের পর এক ব্লাড ব্যাঙ্ককে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও বিপন্ন হচ্ছে না তো?
থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই রোগীরাই সব চেয়ে বেশি রক্ত সংক্রমণের শিকার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব হেমাটোলজি অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন-এর চিকিৎসক মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলেন, “থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়া রোগীদের অনেককেই মাসে দু’তিন বার রক্ত নিতে হয়। তাই তাঁদের সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। দিনের পর দিন যখন দেখছি বাচ্চাগুলো সংক্রমণের শিকার হচ্ছে, তখন অসহায় লাগে। বাবা-মায়েদের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারি না।”
কেন হয় এমন সংক্রমণ? চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এইচআইভি সংক্রমণ যদি উইন্ডো পিরিয়ডে থাকে, তা হলে তা কোনও পরীক্ষাতেই ধরা পড়ে না। কিন্তু এর চেয়েও বড় কারণ একটা রয়েছে। আর তা হল, এখানে এলাইজা পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা হয়। সেই পদ্ধতিতে ১০০ শতাংশ ঠিক রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়। আর যে ধরনের পরীক্ষায় তা পাওয়া সম্ভব, সেটা ব্যয়সাপেক্ষ। তাই এখানে তা করা হয় না। শুধু এইচআইভি নয়, হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণও আকছার হচ্ছে রক্ত থেকেই।
রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী অপূর্ব ঘোষের ব্যাখ্যা, “এখন এক ইউনিট রক্ত বিভাজন করে অনেকের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। ফলে এক জনের দূষিত রক্ত থেকে একাধিক জনের শরীরে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে। তাই রক্তদাতা নিরাপদ হলে তবেই রক্ত নিরাপদ হবে। একটা সময়ে রক্তবিক্রেতাদের উপরে রক্ত সংগ্রহ নির্ভর করত। এখন রক্তদান আন্দোলন জোরদার হওয়ায় সেটা কমেছে। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা ঠিকঠাক না হওয়ায় মূল সমস্যার জায়গাটা মেটানো যাচ্ছে না।”
এ থেকে মুক্তির উপায় কী? চিকিৎসকেরা একবাক্যে জানিয়েছেন, যত দিন না সঠিক পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে, তত দিন এ থেকে মুক্তির কোনও আশা নেই।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তনই একমাত্র কারণ নয়। এ সব ছাড়াও যে পরিকাঠামো প্রয়োজন সেটাও বহু ক্ষেত্রেই থাকে না। সরকারি বা বেসরকারি কোনও ব্যাঙ্কেই নিয়মিত সরকারি পরিদর্শনের ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ব্লাড ব্যাঙ্কেই কর্মীর অভাব, কর্মী থাকলেও তাঁদের প্রশিক্ষণ নেই। যন্ত্র অকেজো হয়েই পড়ে থাকে। ব্লাড ব্যাগ থাকে না। কিট থাকে না। এমনকী সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কেও বহু ক্ষেত্রে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয় বলে অভিযোগ।
কেন সেই সব পরিস্থিতি না পাল্টেই ব্লাড ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে? গত মাসে আরও ১৪টি ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলার অনুমোদন দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। পরিষেবার মান নিশ্চিত না করে এ ভাবে অনুমোদন দেওয়ায় পরিস্থিতি কি আরও বেশি খারাপ হচ্ছে না? স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, সঠিক সময়ে রক্ত না পেয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। ব্লাড ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়ানো তাই খুবই জরুরি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে বলে এই জরুরি কাজ থেকে পিছিয়ে আসা যায় না।