সি-আর্ম মেশিন ছিল। কিন্তু কমপ্যাটিবল টেবিল না থাকায় কোমরে হাড়ের জয়েন্টের জটিল অস্ত্রোপচার এত দিন হচ্ছিল না বাঁকুড়া মেডিক্যালে। তবে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি সম্পন্ন কিছু বিশেষ অস্ত্রোপচার হচ্ছিল।
এ বার সেই সি-আর্ম মেশিনও খারাপ হয়ে পড়েছে। প্রায় তিনমাস ধরে শরীরের নীচের অংশের হাড় ভাঙার ঘটনায় একটু জটিল অস্ত্রোপচার তাই বন্ধ। সেই সব রোগীদের তাই বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু রোগীরাই বা যাবেন কোথায়?
বাঁকুড়ার কাছাকাছি দু’টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বলতে একটি বর্ধমানে, অন্যটি মেদিনীপুরে। এর মধ্যে মেদিনীপুরেও কয়েক মাস ধরে সি-আর্ম মেশিন খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে বলে বাঁকুড়া মেডিক্যাল সূত্রে খবর। অন্য দিকে, একই অবস্থা বর্ধমানেও। বর্ধমান মেডিক্যালের সুপার উৎপল রায় বলেন, “প্রায় দেড়মাস ধরে হাসপাতালের সি-আর্ম মেশিনের পিকচার টিউব খারাপ হয়ে রয়েছে।” তবে দ্রুত মেরামতির কাজ হয়ে যাবে বলেই তিনি আশাবাদী। এই পরিস্থিতিতে হাড়ের জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য কলকাতা ছাড়া গতি নেই বাঁকুড়াবাসীর।
কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়া একদিকে যেমন ব্যয় সাপেক্ষ, অন্য দিকে তেমন দূরত্বের জন্য পথে রোগীর দুর্ভোগ বরাদ্দ। একই ভাবে অন্যান্য বিভাগেরও কয়েকটি মেশিন মাঝে মধ্যেই বিগড়ে যাওয়ায় চিন্তা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, সি-আর্ম মেশিন প্রায় তিনমাস ধরে খারাপ হয়ে রয়েছে। মেশিনে ছবি উঠছে না। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর শরীরের ভিতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবস্থানের একটানা ছবি তুলতে থাকে সি-আর্ম মেশিন। ফলে অস্ত্রোপচার হয় নিখুঁত। ঝুঁকিও থাকে কম। এই যন্ত্র না থাকায় হাড়ে নানা যন্ত্রাংশ বসানোর সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার হচ্ছে না।
এত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সারানোর উদ্যোগ নেয়নি কেন?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, এর পিছনে রয়েছে সেই লাল ফিতের ফাঁস। এই নিয়মের গেরোতেই সারানো যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন হাসপাতাল সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু। তিনি বলেন, “নিয়ম মতো যে দামে হাসপাতালের যন্ত্র কেনা হয়েছে, সেই দামের ২০ শতাংশের বেশি টাকা যন্ত্র সারাতে খরচ করা যাবে না। আমাদের সি-আর্ম মেশিনটি সারাতে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ টাকায়। তাই সারানোর খরচ ৫০ শতাংশ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে গিয়েছি।” মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা স্বাস্থ্য ভবনকে জানিয়ে পরামর্শ চেয়েছে।
সারানো না গেলেও নতুন কেনা যাচ্ছে না কেন? এই বিষয়ে কোনও সদুত্তর নেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। সূত্রের খবর, ৫ লক্ষ টাকা বেশি মূল্যের কোনও যন্ত্র কিনতে গেলে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অনুমতি নিয়ে টেন্ডার ডাকতে হয়। তারপর বরাদ্দ অর্থ থেকে কিনতে হয় যন্ত্র। কিন্তু রাজ্যে পালা বদলের পর থেকে বড় যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। বাঁকুড়া মেডিক্যালের নানা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র প্রায় অকেজ হয়ে পড়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ডায়ালিসিস মেশিন। এই হাসপাতালে ছ’টি ডায়ালিসিস মেশিন রয়েছে, যা বহু পুরনো। প্রায় সময়েই সেই মেশিনগুলি বিগড়ে যায়। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন করে কাজ করা চিকিৎসকদের মতে, অবিলম্বে ওই মেশিনগুলি পাল্টে নতুন মেশিন বসানো দরকার। এ ছাড়াও ‘ইকোকার্ডিওগ্রাফি’ মেশিন, চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য ‘ফেকো’ মেশিন, অর্থপেডিক্স-এর পাশাপাশি কার্ডিওলজি বিভাগের জন্যও সি-আর্ম মেশিন, স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগের জন্য নিজস্ব একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন একান্তই দরকার।
গত তিন বছরে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে প্রায় ৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি চেয়েছে বাঁকুড়া মেডিক্যাল। অথচ স্বাস্থ্য দফতর অর্থ বরাদ্দ করেনি বলে জানাচ্ছেন বাঁকুড়া মেডিক্যালের এক আধিকারিক। হাসপাতাল সুপার পঞ্চানন কুণ্ডু এ নিয়ে প্রথমে মন্তব্যই করতে চাননি। পরে তাঁর মাপা উত্তর, “হাসপাতালের যা প্রয়োজন তা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে জানানো হয়েছে। টেন্ডার করার জন্য অনুমতি পেলে বা অর্থ বরাদ্দ হলেই যন্ত্র কেনা হবে।”
বাঁকুড়া জেলা পরিষদের প্রাক্তন স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ সিপিএম নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “একের পর এক ক্লাবকে কোটি কোটি টাকা বিলোচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একের পর নিত্য নতুন নামে রাজ্যজুড়ে মেলা করা হচ্ছে, নতুন নতুন পুরস্কার খুঁজে টাকা তুলে দিচ্ছেন বুদ্ধিজীবীদের। অথচ হাসপাতালগুলোতে যন্ত্র কেনার জন্য টাকা দিতে পারছে না এই সরকার।”
একই ভাবে রাজ্য সরকারকে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি তথা বাঁকুড়ার চিকিৎসক সুভাষ সরকার। তিনি বলেন, “মুখে উন্নয়নের মিথ্যা বুলি আওড়ে মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে। এই রাজ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি ধুঁকছে, সে দিকে কারও নজর নেই। আমি কেন্দ্রকে এই বিষয়ে রিপোর্ট দেব।” সম্প্রতি সি-আর্ম মেশিন সারানোর দাবিতে জেলা বিজেপি মেডিক্যাল কলেজে স্মারকলিপি দিয়েছে।
জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা বিধায়ক অরূপ খাঁর অবশ্য দাবি, “গোটা রাজ্যজুড়েই উন্নয়নের জোয়ার বইছে। কিন্তু একদিনেই তো সব কাজ হয়ে যেতে পারে না। পরিবর্তনের পরে বাঁকুড়া মেডিক্যালে একাধিক উন্নয়ন হয়েছে। যা সমস্যা রয়েছে সেগুলিও দ্রুত মিটে যাবে।”
জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার আশ্বাস, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক রাজ্যের কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘আপগ্রেডেশন’-র জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তাতে হাসপাতালের পুরনো মেশিন বদলে নতুন কেনা হবে।
কিন্তু যতদিন না সেই কাজ হচ্ছে, ততদিন খুঁড়িয়েই চলতে হবে বাঁকুড়া মেডিক্যালকে।