ফিল্টার অকেজো, বিষ ঢুকছে খুদেদের শরীরে

উত্তর ২৪ পরগনার স্কুলের প্রধান শিক্ষক চিঠি লিখে জানিয়েছেন, স্কুলের ফিল্টারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। শিশুরা বাধ্য হয়ে দূষিত জল পান করছে। নদিয়ায় ফিল্টার লাগানো ৮৫ শতাংশ নলকূপের জলেও আর্সেনিক বিষ। এই সব নলকূপের জলই স্কুলের শিশুদের একমাত্র পানীয়। মালদহে পাঁচটি ব্লকে আর্সেনিকের মোকাবিলায় স্কুলের নলকূপে ফিল্টার লাগানো হয়েছিল। অধিকাংশই অকেজো। একের পর এক এমনই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে বিজ্ঞানীদের সমীক্ষায়।

Advertisement

প্রভাত ঘোষ ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

মালদহের কালিয়াচক-২ ব্লকের মোথাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।

উত্তর ২৪ পরগনার স্কুলের প্রধান শিক্ষক চিঠি লিখে জানিয়েছেন, স্কুলের ফিল্টারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। শিশুরা বাধ্য হয়ে দূষিত জল পান করছে।

Advertisement

নদিয়ায় ফিল্টার লাগানো ৮৫ শতাংশ নলকূপের জলেও আর্সেনিক বিষ। এই সব নলকূপের জলই স্কুলের শিশুদের একমাত্র পানীয়।

মালদহে পাঁচটি ব্লকে আর্সেনিকের মোকাবিলায় স্কুলের নলকূপে ফিল্টার লাগানো হয়েছিল। অধিকাংশই অকেজো।

Advertisement

একের পর এক এমনই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে বিজ্ঞানীদের সমীক্ষায়।

ভূগর্ভের জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি এ রাজ্যে প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮৩ সালে। তার পর থেকে এ পর্যন্ত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো আটটি জেলার ভূগর্ভ থেকে জল তোলা হলেই এই বিষ উঠে আসে। এর পরেই সর্বত্র নলকূপে আর্সেনিক-ফিল্টার লাগানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি সমীক্ষক-বিজ্ঞানীদের রায়, ফিল্টার লাগানো এই ‘নিরাপদ’ নলকূপগুলির বেশিরভাগই অকেজো। কারণ, ফিল্টারগুলি খারাপ।

কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’ (আইসিএমআর)-এর আর্থিক সহায়তায় কেন্দ্রেরই ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস’ (নাইসেড) মালদহের পাঁচটি আর্সেনিক প্রবণ ব্লকে একটি সমীক্ষা চালায় ২০১৩-র অক্টোবর থেকে ২০১৪-র জুলাই মাস পর্যন্ত। এই ব্লকগুলি হল কালিয়াচক ১,২ এবং ৩, ইংরেজবাজার, ও রতুয়া ২। প্রত্যেক ব্লক থেকে ৬০টি স্কুল বাছাই করে এই সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষায় মোট ১৩৭টি স্কুলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া যায়। সমীক্ষায় দেখা যায়, এর মধ্যে ৬১টি স্কুলের নলকূপে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর থেকে আর্সেনিক নিরোধক ফিল্টার লাগানো রয়েছে। তা সত্ত্বেও ৩১টি স্কুলের পানীয় জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি পেয়েছেন সমীক্ষকেরা। এই স্কুলগুলি রয়েছে মূলত কালিয়াচক ১, ২ এবং ইংরেজবাজারে। এই সব স্কুলের মধ্যে রয়েছে কালিয়াচক ২ ব্লকের লোহারামটোলা এমজিডি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রবিরামতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতাপপুর মেহের বিশ্বতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোথাবাড়ি জুনিয়র বেসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংরেজবাজারের মদনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ইত্যাদি। সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি স্কুলে গড়ে ১৫০-২০০ শিশু পড়ে। আর্সেনিকের আওতায় সব পড়ুয়াই।

সমীক্ষকদলের দুই বিজ্ঞানী কমলেশ সরকার এবং সুমন কানুনগোর তৈরি এই রিপোর্টটি কিন্তু গত বছর জুলাই মাসেই জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর ও স্কুল শিক্ষা দফতরে জমা পড়েছিল। তার পর এই ছ’মাসে পরিস্থিতি কি কিছুটা বদলেছে?

কালিয়াচকের মোথাবাড়ি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অতুল ঘোষ বলেন, “পুরো ব্লকটাই আর্সেনিক প্রবণ। এই জলই পান করতে হয় সবাইকে। কী করব?” মালদহের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দিলীপ মণ্ডলের সাফ কথা, “ওই সব ব্লকে আর্সেনিকের প্রকোপ আছে জানি। যে সব নলকূপে আর্সেনিক উঠছে, সেগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু বিষাক্ত নলকূপ দেখার দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য কারিগরির। জল পান করে অসুস্থ হলে আমরা শুধু চিকিৎসা করি।”

কিন্তু আর্সেনিকের আক্রমণ ‘স্লো পয়জন’-এর মতো। অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া শরীরে ফুটে ওঠে না। ফলে, মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার দায় যে দফতরের হাতে, তারা কেন আগাম সাবধানতার দায়িত্ব পালন করে বিষ নলকূপগুলির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে না? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এড়িয়েই যান। মালদহের জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদীও একই ভাবে ‘খোঁজখবর নিয়ে দেখব’ বলে দায়িত্ব সেরেছেন।

একই চিত্র উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায়। সেখানে হোসেনপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’-এ সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে তাঁরা জেনেছেন, পুরনো নলকূপটি থেকে আর্সেনিক উঠছে। তাঁর দাবি, নতুন করে গভীর নলকূপ বসানো হোক। তেহট্ট ব্লকে স্কুলগুলোর নলকূপের অর্ধেকই আর্সেনিক দূষিত। এ নিয়ে স্টাডিজের প্রাক্তন প্রধান দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “দুই জেলার যে ক’টি গভীর নলকূপ রয়েছে, তার অধিকাংশই আর্সেনিক ভরা।”

উত্তর চব্বিশ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্যের বক্তব্য, “নলকূপগুলি তৈরি করে জেলাপরিষদ। নতুন যে সব নলকূপ বসানোর অনুমতি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোতে যাতে ফিল্টার লাগানোর ব্যবস্থা করা যায়, তা বলা হয়েছে।” কিন্তু বাম আমলে যে সব নলকূপে ফিল্টার লাগানো (যেগুলি এখন অকেজো) হয়েছিল, সেগুলির কী হবে? আধিকারিকের জবাব, “ওগুলো দেখি কি করতে পারি। আগে নতুনগুলো লাগানো হোক।” কিন্তু এই জেলার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার নির্ঝর শূরের বক্তব্য, “আর্সেনিক ফিল্টার অকেজো হয়ে গিয়েছে, এমন কোনও রিপোর্ট তো আমরা পাইনি।”

জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই সব সমীক্ষা মানতেই রাজি নন। একমাত্র তাঁর দফতরের নিজস্ব পরীক্ষা ছাড়া বাকি সব মূল্যহীন বলে জানান তিনি। মন্ত্রীর বক্তব্য, “আমাদের নিজেদের সমীক্ষা ছাড়া বাকি সবই আমার কাছে বেসরকারি সমীক্ষা।”

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থার সমীক্ষা ‘বেসরকারি’ হয় কী করে? তিনি বলেন, “আমরা আর্সেনিক দূর করার দায়িত্ব ভাল ভাবেই পালন করছি। তাই অন্য কারও রিপোর্ট মানবো না।” তবে মালদ হ ও অন্য জেলাগুলিতে নলকূপের ফিল্টার খারাপ কি না, তা জানা এবং অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দফতরকে নির্দেশ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।

(তথ্য সহায়তা: অভিজিৎ সাহা, অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement