মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ দূত-সহ রাজ্য স্বাস্থ্যদফতরের বার কয়েক পরিদর্শন, প্রচুর প্রতিশ্রুতি, পরিকল্পনা সবই সার। আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালের পরিষেবা-সংক্রান্ত সঙ্কট ক্রমশ ঘোরাল হচ্ছে। একদিকে অস্ত্রোপচার বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-সহ নানা স্তরে কর্মীর অভাব, অন্য দিকে দালাল এবং আয়াদের দৌরাত্ম্য-সহ অবাঞ্ছিত বহু ঘটনায় রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়েরা তিতিবিরক্ত। হাসপাতালের সুপার নির্মাল্য রায় বলেন, “নানা অব্যবস্থা ও অভাব মেটাতে একাধিকবার জেলা এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে দরবার করেছি। তাঁরা দেখেও যাচ্ছেন। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তনিমা মণ্ডল বলেন, “আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালের অনেক অভাবই মিটে গেছে, চিকিৎসক দেওয়া হয়েছে। প্যাথলজিস্ট দেওয়া হয়েছে। জিডিএ এবং সাফাইকর্মীর অভাবও থাকবে না। হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিষেবা নিয়ে কোনও অসুবিধা থাকবে না।” তবে স্বাস্থ্য দফতরের এই ব্যবস্থা যে নেহাতই অপ্রতুল, তা মেনে নিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এত বড় হাসপাতালে উপযুক্ত সংখ্যক কর্মী না থাকলে যথাযথ পরিষেবা দেওয়া দুষ্কর। এ দিকে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল মহকুমা বাদেও বর্ধমান, বাঁকুড়া, দুই মেদিনীপুর এবং হাওড়া জেলার সংলগ্ন গ্রামগুলির বহু মানুষ। হাসপাতাল সূত্রের খবর, মহকুমা হাসপাতালটিতে অনুমোদিত মোট শয্যা সংখ্যা ২৬২। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে রোগীর চাপ থাকে প্রায় চারশোর বেশি। মেঝেতে, বারান্দা, করিডোরে কম্বল পেতে শুয়ে থাকতে হয় তাঁদের।
হাসপাতালে ‘নেই’-এর তালিকাটা দীর্ঘ। চিকিৎসক ছাড়াও জেনারেল ডিউটি অ্যাসিট্যান্ট তথা গ্রুপ-ডি স্বাস্থ্য কর্মীদের অনুমোদিত ৯২টি পদে আছেন মাত্র ১৮ জন। জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার ১২ জন থাকার কথা। আছেন মাত্র ৩ জন। উল্টো চিত্রও আছে। যেখানে প্রসূতি বিভাগের জন্য চিকিৎসকের পদ ২টি, সেখানে চিকিৎসক পাঠানো হয়েছে ৫ জন। কী ভাবে তা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে হাসপাতালের কর্মীদেরই একাংশের মধ্যে। এ ছাড়াও আছে দালালদের দৌরাত্ম্য। আয়াদের দুর্ব্যবহার, ব্লাড ব্যাঙ্কে অধিকাংশ সময় রক্ত মজুত না থাকাও দীর্ঘ দিনের সমস্যা।
ঘটনাবহুল আরামবাগ মহকুমায় প্রতিদিন গড়ে অস্ত্রোপচার বিভাগে রোগী ভর্তি হন ৪০-৫০ জন। কিন্তু এক জন মাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকায় জটিল অস্ত্রোপ্রচারগুলির ক্ষেত্রে ফেরত পাঠানো হয় বেশির ভাগ রোগীকেই। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে বহির্বিভাগ এবং অন্তর্বিভাগ মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০০-১২০ জন রোগীর রক্ত-মল-মূত্রের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় টেকনিসিয়ান নেই। থাকার কথা পাঁচ জন টেকনিসিয়ান। আছেন মাত্র দু’জন। স্বভাবতই পরীক্ষার ফলাফল পেতে ১০-২০ দিন সময় লেগে যায়।
এ নিয়ে টেকনিসিয়ানদের সঙ্গে রোগীর আত্মীয়-স্বজনের হাতাহাতি হওয়ারও নজির আছে। টেকনিসিয়ানের অভাবেই মহকুমা হাসপাতাল স্তরে যে সব পরীক্ষা হওয়ার কথা তা-ও সবগুলি হয় না। যেমন টাইফয়েড, রক্তের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা পরীক্ষা প্রভৃতি। সুপার বলেন, “আমরা টেকনিসিয়ানও চেয়ে আসছি কয়েক বছর ধরে। টেকনিসিয়ান পেলে সমস্ত রকম পরীক্ষাই সম্ভব।”
একে কর্মী সংখ্যা কম, তার উপরে তাঁদের যথা সময়ে হাজিরা নিয়েও জেরবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বহির্বিভাগে চিকিৎসকেরা দেরিতে আসেন বলে অভিযোগ। এমনকী রোগী দেখতে দেখতেই নিজের চেম্বারে চলে যাওয়ার বহু অভিযোগ আছে। গত ১৪ ডিসেম্বর আচমকাই আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে ঢুকে এ রকম নানান অসঙ্গতি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন রাজ্য বিধানসভার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজি। তাঁর চোখে পড়ে, চিকিৎসকের সংখ্যা ৩৫ জন হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালে উপস্থিত আছেন মাত্র ৬ জন। নার্সের সংখ্যা ১০৭ জনের মধ্যে উপস্থিতি অর্ধেক। নভেম্বর মাসে চিকিৎসকদের হাজিরা খাতার অনেকগুলি পাতা ছেঁড়া মেলে। সে সময়ে হাসপাতাল সুপারকে ধমক দিয়ে নির্মলবাবু বলেছিলেন, “মনে রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজে এই হাসপাতালের উপরে নজর দিয়েছেন। হাসপাতালটাকে এ রকম পচা-গলা কঙ্কালসার বানিয়ে রেখেছেন?” হাজিরা খাতার পাতা ছেঁড়া নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। নির্মলবাবু সে সময়ে প্রতিশ্রুতি দেন, আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে জানুয়ারি মাস নাগাদ বেশ কিছু চিকিৎসক পাঠানো হবে। ১০টি ডায়ালিসিস যন্ত্র-সহ বেশ কিছু আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম দেওয়া হবে। মর্গ সংস্কার হবে। রোগী সহায়তা কেন্দ্র এবং রাতে রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের থাকার জায়গাও করা হবে। সে সব প্রতিশ্রুতির কিছুই এখনও কার্যকর হয়নি।
জানুয়ারির ১৯ তারিখ আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল খুঁটিয়ে পরিদর্শন করেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথি। নানান অসুবিধা এবং অসঙ্গতি দীর্ঘ সময় ধরে খতিয়ে দেখেন তিনি। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হবে বলে সে সময়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
• জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার ১২ জন থাকার কথা। আছেন মাত্র ৩ জন।
• থাকার কথা পাঁচ জন টেকনিসিয়ান। আছেন মাত্র দু’জন।
• এ ছাড়াও আছে দালালদের দৌরাত্ম্য। আয়াদের দুর্ব্যবহার, ব্লাড ব্যাঙ্কে অধিকাংশ সময় রক্ত মজুত না থাকাও দীর্ঘ দিনের সমস্যা।
নানা অব্যবস্থা ও অভাব মেটাতে একাধিকবার জেলা এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে দরবার করেছি। তাঁরা দেখেও যাচ্ছেন। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।
নির্মাল্য রায়, হাসপাতালের সুপার