কী ভাবে সংক্রমণ বা সেপসিস-এর নিয়ন্ত্রণ করে সদ্যোজাতদের মৃত্যু আটকানো যায়, সে ব্যাপারে রাজ্যের মধ্যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগ। কিন্তু সময়মতো টাকা না-মেলায় বিভাগ জীবাণুমুক্ত রাখার সেই প্রক্রিয়াই থমকে যেতে বসেছে। যে সব কর্মী জীবাণুমুক্তকরণের কাজ করতেন, টাকার অভাবে বেতন দিতে না-পারায় তাঁদের ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে। ফলে নিওনেটোলজির চিকিৎসকেরাই স্বীকার করছেন, যেখান থেকে সব চেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ায়, সেই চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, শিশুদের ন্যাপি, বিছানার চাদর, মায়েদের অ্যাপ্রন এবং চিকিৎসকদের অ্যাপ্রন নিয়ম করে জীবাণুমুক্ত করা যাচ্ছে না। গত পাঁচ মাস ধরে এই অবস্থা চলছে।
অথচ, গত বছরের জুন থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে এসএসকেএমের এই বিভাগই সেপসিস নিয়ন্ত্রণ করে নবজাতকদের মৃত্যু আটকাতে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (এনআরএইচএম)-এর ৫২ লক্ষ টাকায় সেখানে বিভাগীয় বিশেষ ‘স্টেরাইল সাপ্লাই সিস্টেম’ চালু করা হয়েছিল। নিওনেটোলজি বিভাগে পাঁচ জন সহায়ক নিযুক্ত হন। অটোক্লেভ মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ারের মতো কিছু যন্ত্রপাতিও কেনা হয়। বিভাগের সমস্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাধ্যতামূলক ভাবে বার-বার দু’হাতের কনুই পর্যন্ত সাবান দিয়ে ধোয়ার নিয়ম চালু হয়। পাঁচ জন সহায়কের দায়িত্ব হয় চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, জামাকাপড়, ন্যাপি, অ্যাপ্রন সব ভাল ভাবে অটোক্লেভ করে জীবাণুমুক্ত করা, ওয়াশিং মেশিনে কাচা, যন্ত্রের মাধ্যমে তা শুকোনো।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাই জানিয়েছেন, প্রতি বছর রাজ্যে যত নবজাতকের মৃত্যু হয়, তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ৭৫ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হল ব্যাকটেরিয়াঘটিত সেপসিস। নিওনেটোলজির চিকিৎসক শ্যামল সর্দার পরিসংখ্যান দিয়ে জানান, ২০১২ সালে এসএসকেএমে যেখানে সেপসিসে নবজাতক মৃত্যুর হার ছিল ৩৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা হয়েছে ২৫ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ১৯ শতাংশ। ঠিক যখন এই প্রকল্পকে গোটা রাজ্যের সমস্ত সরকারি হাসপাতালের কাছে ‘মডেল’ হিসেবে তুলে ধরার তোড়জোড় চলছে, তখনই এই জীবাণুমুক্ত করার কাজে ধাক্কা লাগে। কারণ জুলাই মাসের পর থেকে এই কাজের জন্য টাকা আসা বন্ধ রয়েছে।
এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, টাকার অভাবে প্রকল্পে জড়িত পাঁচ জন কর্মীর বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকেদের অভিযোগ, এত দিন মায়েদের বাইরের শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরে বাচ্চাকে কোলে নিতে দেওয়া হত না। তাঁদের কাচা অ্যাপ্রন পরানো হত। এখন অ্যাপ্রন কাচার লোক নেই, ফলে মায়েরা বাইরের জামাই পরছেন। জীবাণুমুক্তকরণের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের তত্ত্বাবধানে এত দিন বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ওয়ার্ড মোছা, ঝাঁট দেওয়া, বেসিন পরিষ্কার করার কাজ করতেন সাফাইকর্মীরা। সে সবও বন্ধ।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য টাকা আসছে না স্বাস্থ্য দফতর থেকে?
স্বাস্থ্য দফতরে এই বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জলি চৌধুরীর বক্তব্য, “টাকা নিয়ে আমরা বসে রয়েছি। কিন্তু এসএসকেএম গত এক বছরে এই প্রকল্পে কী ভাবে টাকা খরচ হয়েছে, তার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ না দিলে নতুন করে টাকা ছাড়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য দফতর এসএসকেএমকে চিঠি দিয়ে বসে রয়েছে।” আর এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র জানিয়েছেন, তাঁরা ভীষণ ভাবে চাইছেন এত ভাল প্রকল্প আবার চালু করতে। কিন্তু অসুবিধা অন্য জায়গায়। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “বিশেষ একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে প্রকল্পে বাধা দিতে চাইছেন। তারা তথ্য জানার আইনে গুচ্ছ-গুচ্ছ চিঠি দিয়ে প্রকল্প নিয়ে অনেক হিসেব চাইছেন। সেই সব কাগজ জোগাড় করে উত্তর দিতে গিয়ে আর ইউটিলাইজেশন রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে না।”