দায় এড়ানোর যুক্তিজালে বন্দি হয়ে অথৈ জলে

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনও অসহায়কে অন্যত্র ‘রেফার’ করা হলে তাঁকে সেখানে পাঠানোর দায়িত্ব কার, সেই প্রশ্ন ঘিরে টানাপড়েন ফের সামনে এল। এ বার ঘটনার কেন্দ্রে বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভর্তি এক দৃষ্টিহীন প্রৌঢ়া, অচলাবস্থার সুরাহা না-হওয়ায় যিনি কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে রয়েছেন ওই হাসপাতালের শয্যায়।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

অনুজা দেববর্মণ

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনও অসহায়কে অন্যত্র ‘রেফার’ করা হলে তাঁকে সেখানে পাঠানোর দায়িত্ব কার, সেই প্রশ্ন ঘিরে টানাপড়েন ফের সামনে এল। এ বার ঘটনার কেন্দ্রে বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভর্তি এক দৃষ্টিহীন প্রৌঢ়া, অচলাবস্থার সুরাহা না-হওয়ায় যিনি কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে রয়েছেন ওই হাসপাতালের শয্যায়।

Advertisement

স্বাস্থ্য দফতরের খবর: আড়িয়াদহের বাসিন্দা অনুজা দেববর্মণ নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই মহিলা গত ৫ জুলাই বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ডাক্তাররা তাঁকে পরীক্ষা করে এসএসকেএমে ‘রেফার’ করে দেন। তার পরে প্রায় পঁচিশ দিন পেরিয়ে গেলেও অনুজাদেবীর ঠাঁইবদল হয়নি। চিকিৎসাও বন্ধ। রেফার করা সত্ত্বেও ওঁকে এসএসকেএমে না-পাঠিয়ে এ ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে কেন?

হাসপাতালের সুপার উত্তম মজুমদারের যুক্তি: ৫ জুলাই স্থানীয় ব্লাইন্ড স্কুলের কয়েক জন অনুজাদেবীকে ভর্তি করে গিয়েছিলেন। তাঁর দাদা গৌতম দেববর্মণ হাসপাতালে ভর্তির কাগজে সই করে দেন। আর তাঁর দেখা নেই। উত্তমবাবুর কথায়, “রোগীর দাদাকে ফোন করা হয়েছিল। ওঁর দাবি, তিনি সই করেননি, তাঁর সই নকল করা হয়েছে। এ-ও জানিয়েছেন, বোনের কোনও দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়।”

Advertisement

এমতাবস্থায় বাড়ির লোক না-থাকলে কী ভাবে ওঁর চিকিৎসা হবে, সুপার সেই প্রশ্ন তুলছেন। বলছেন, “সব দায় হাসপাতালের ঘাড়ে চাপালে তো মুশকিল! এসএসকেএমে বেড না-ও পাওয়া যেতে পারে। তখন কি হাসপাতালের কর্মীরা ওঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন? অপারেশন করতে হলে কে দায়িত্ব নেবেন?” রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য সুপারের বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। তাঁর ব্যাখ্যা, “বাড়ির লোককে যদি একান্তই না-পাওয়া যায়, রোগীর প্রাণসংশয়ের উপক্রম হলে তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকেই করতে হবে।” তা হলে অনুজাদেবীর ক্ষেত্রে করা হচ্ছে না কেন?

স্বাস্থ্য-অধিকর্তার দাবি, “ওঁর কোনও এক পরিজন সই করে ভর্তি করেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী সেই পরিজনের লিখিত অনুমতি নিয়েই রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর কথা। অথচ এখন তিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন না। হাসপাতালমুখোই হচ্ছেন না। এ বার পুলিশ দিয়ে আত্মীয়দের ডেকে পাঠিয়ে কাজটা করতে হবে। সময় তো লাগবেই!” পঁচিশ দিনেও পুলিশ ডাকা গেল না কেন জানতে চাইলে হাসপাতাল সুপারের দাবি, পর্ণশ্রী থানা মারফত অনুজাদেবীর দাদাকে আসতে বলা হয়েছিল। তা-ও আসেননি। “পুলিশ তো আর ওঁকে ধরে আনতে পারে না! জুলুম হয়ে যাবে।” মন্তব্য উত্তমবাবুর।

অগত্যা না-ঘরকা না-ঘাটকা হয়ে রয়েছেন অনুজাদেবী। হাসপাতালে তাঁকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। শুধু দু’বেলা খাওয়া জুটছে। এ হেন পরিস্থিতিতে গুরুতর অসুস্থ কোনও রোগী মারা গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী ভাবে দায় এড়াবেন?

সুপারের অভিমত, হাসপাতালের কিছু করার নেই। ওঁর সাফ কথা, “আমরা তো সরকারি ভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, মহিলার চিকিৎসা আমাদের হাসপাতালে হবে না! মারা গেলে কর্পোরেশনের হাতে মৃতদেহ দিয়ে দেব। তারা বাহাত্তর ঘণ্টা রেখে সৎকার করে দেবে।” এমনটা হামেশাই হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

তার মানে সরকার শুধুই দর্শক হয়ে থাকবে? পুরো ঘটনাক্রমে রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে যারপরনাই বিস্মিত। তিনি কিন্তু পরিষ্কার জানাচ্ছেন, এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালের হাত ঝেড়ে ফেলার কোনও অবকাশ নেই। “সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও সেখানকার ডাক্তারেরা যদি মনে করেন যে, উন্নততর চিকিৎসার স্বার্থে রোগীকে অন্যত্র রেফার করতে হবে, সে ক্ষেত্রে বাড়ির লোক দায়িত্ব না-নিলেও সরকারি হাসপাতালই রোগীকে রেফারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করবে। গাড়ি দেবে, সঙ্গে লোকও দেবে।” বলছেন সচিব। তাঁর বক্তব্য, “হাসপাতালে থাকা রোগী কখনওই বিনা চিকিৎসায় মরতে পারেন না।”

কর্তারা আশ্বাস দিলেও অনুজাদেবীর মৃতপ্রায় দশা। বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে থাকা প্রৌঢ়া জানালেন, তিনি বিএ পাশ। “জন্মান্ধ নই। ঊনত্রিশ বছর বয়সে জটিল রোগে আচমকা দৃষ্টি চলে যায়। তার আগে বুকের একটা ভাল্ভ খারাপ হয়ে যাওয়ায় অপারেশন হয়েছিল। তাই আর বিয়ে করিনি।” বলেন তিনি। আয় বলতে ফিক্সড ডিপোজিটের সামান্য সুদ আর প্রতিবন্ধী-ভাতা। মায়ের দেওয়া সোনার হার বিক্রি করে দৃষ্টিহীনদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বৃত্তিমূলক কাজের তালিম নিতে। সেখানেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। তাঁর অভিযোগ, আড়িয়াদহের পৈতৃক বাড়ির পাশের ঘরে দাদা-বৌদি থাকলেও সম্পর্ক রাখেন না।

উল্লেখ্য, অনুজাদেবীর সেই দাদা গৌতমবাবুই হাসপাতালে ভর্তির ফর্মে সই করেছিলেন বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। যদিও গৌতমবাবু তা মানতে নারাজ। বোনের কথা তুলতেই তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “আপনি-ই দায়িত্ব নিন! বড় বড় কথা বলবেন না। আমাকে কী করতে হবে, শেখাবেন না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement