কনজাংটিভাইটিস

চোখ রাঙানির দাওয়াই ঘিরে তর্ক

চোখ লাল মানেই যেন ট্র্যাফিকের লাল সিগন্যাল! সব বন্ধ। স্কুল-কলেজের পাট নেই, অফিসে গেলে সহকর্মীরা দূরে দূরে, আমোদ-অনুষ্ঠান, লোক-লৌকিকতার তো প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী, বাড়ির লোকের হৃৎকম্প শুরু। কার আবার ছোঁয়াচ লাগে! কনজাংটিভাইটিস বা ‘জয় বাংলা’র কবলে পড়ে অচ্ছুৎ হয়ে থাকার বিড়ম্বনা নতুন নয়। তবে আগে মেয়াদ থাকত বড়জোর দিন সাতেক। চোখের অস্বস্তি ছাড়া অন্য বিশেষ উপসর্গের বালাই ছিল না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:১৫
Share:

চোখ লাল মানেই যেন ট্র্যাফিকের লাল সিগন্যাল! সব বন্ধ। স্কুল-কলেজের পাট নেই, অফিসে গেলে সহকর্মীরা দূরে দূরে, আমোদ-অনুষ্ঠান, লোক-লৌকিকতার তো প্রশ্নই ওঠে না। এমনকী, বাড়ির লোকের হৃৎকম্প শুরু। কার আবার ছোঁয়াচ লাগে!

Advertisement

কনজাংটিভাইটিস বা ‘জয় বাংলা’র কবলে পড়ে অচ্ছুৎ হয়ে থাকার বিড়ম্বনা নতুন নয়। তবে আগে মেয়াদ থাকত বড়জোর দিন সাতেক। চোখের অস্বস্তি ছাড়া অন্য বিশেষ উপসর্গের বালাই ছিল না। আর রোগটা ছড়াত বছরের মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু ইদানীং বছরভর ঘুরে-ফিরে আসছে ওই সংক্রমণ, সঙ্গে থাকছে জ্বর, গলা ব্যথা, গ্ল্যান্ড ফোলা, সর্দি-কাশিও। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের মিউটেশন হয়েছে। জিনের কাঠামো বদলে গিয়ে তার পরাক্রম বেড়েছে। উপরন্তু দূষণ বা অত্যধিক ওষুধ খাওয়ার মতো বিবিধ কারণে মানুষের শরীরও হয়ে পড়েছে বেশি মাত্রায় সংক্রমণপ্রবণ।

সেই সুযোগে কনজাংটিভাইটিস এখন রীতিমতো আগ্রাসী। এক বার ধরলে দু’-তিন সপ্তাহের আগে পুরোপুরি মুক্তির আশা থাকছে না। এবং রোগের চিকিৎসা নিয়ে বিতর্কের আঁচে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো। কী রকম? বিতর্কের মূলে স্টেরয়েড। ডাক্তারদের একাংশের মতে, বুনো ওল খেলে যেমন বাঘা তেঁতুল ছাড়া গতি থাকে না, তেমন এই দাপুটে কনজাংটিভাইটিসকে বাগে আনতে স্টেরয়েডই হল মোক্ষম দাওয়াই। আবার অন্য অংশের দাবি, স্টেরয়েডে কাজ তো হয়ই না, উল্টে তা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। চক্ষু চিকিৎসক ভাস্কর রায়চৌধুরী যেমন বলছেন, “এ বার কনজাংটিভাইটিস স্টেরয়েড ছাড়া সারছেই না! কর্নিয়ারও বেশি ক্ষতি হচ্ছে।” অন্য দিকে চিকিৎসক সমর বসাকের সাফ কথা, “এখানে স্টেরয়েড দেওয়া বৃথা। বরং তাতে পরে ক্ষতির আশঙ্কা। কনজাংটিভাইটিসের চিকিৎসার কোনও শর্টকাট নেই।”

Advertisement

চিকিৎসক মহলে এ হেন মতের দ্বন্দ্ব দেখে রোগীদের মনে প্রশ্নচিহ্ন। তাঁরাও দেখছেন, একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় থেকে লাল চোখের যে অসুখটির সঙ্গে বঙ্গবাসীর পরিচয় (যার সুবাদে ‘জয় বাংলা’ নাম), তার চরিত্র বেবাক বদলে গিয়েছে! আগে পরামর্শ ছিল, চোখে বারবার জলের ঝাপটা দিন। এখন গোড়াতেই ডাক্তারদের হুঁশিয়ারি, জল একেবারে নয়। আগে ‘জয় বাংলা’ হানা দিত মূলত বর্ষাকালে। এখন তাপমাত্রা আচমকা খুব বেশি বেড়ে বা কমে গেলেই তার ভাইরাস সক্রিয় হয়ে উঠছে। ঋতু নির্বিশেষে।

বস্তুত আবহাওয়ার চেনা ছকের পরিবর্তনকে রোগের চরিত্র বদলের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের দাবি, বায়ু দূষণ, এসি ঘরে বেশি সময় কাটানো, ভিড় রাস্তায়, গাড়িতে বেশিক্ষণ থাকা, যখন-তখন চোখে হাত দেওয়ার মতো প্রবণতাও কনজাংটিভাইটিস ডেকে আনছে। চক্ষু-চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য: আগে কনজাংটিভাইটিস মানে ছিল চোখ লাল, জল পড়া, জ্বালা, পিচুটি। ওষুধ দেওয়া হোক না-হোক, সারতে লাগত এক সপ্তাহ। এখন পিচুটির সমস্যা কমলেও চোখের পাতা অনেকটা ফুলে থাকছে। সঙ্গে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা। কাজকর্ম ছেড়ে টানা বাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে। “কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে না-থাকলে এ অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাথমিক ভাবে স্টেরয়েড দেওয়াই যায়। তাতে দ্রুত সংক্রমণ সারিয়ে কাজে যোগদান সম্ভব। পরিবার ও সমাজের আর্থিক ক্ষতি কম হবে।” বলছেন শৌভিকবাবু।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন চিকিৎসকদের মতামতের উল্লেখ করেছেন অনেকে। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ অপথ্যালমোলজি-র পর্যবেক্ষণ, কনজাংটিভাইটিসের জেরে দৃষ্টিশক্তিতে স্থায়ী ক্ষতির নজির কম। কিন্তু আক্রান্তের অস্বস্তি বা কষ্টের মাত্রা যথেষ্ট। পাশাপাশি কাজের দিনও বিস্তর নষ্ট হয়। তাই দ্রুত আরোগ্যের স্বার্থে মার্কিন চিকিৎসকেরা স্টেরয়েড ব্যবহারে জোর দিয়েছেন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের একাধিক নিবন্ধেও তা-ই বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, স্টেরয়েড মানেই খুব কড়া ডোজ নয়। তা ছাড়া স্টেরয়েড বহু ধরনের। তা প্রয়োগের নির্দিষ্ট মাত্রা বা প্রোটোকল আগাম নির্ধারণ করা কঠিন। রোগীর অবস্থা বুঝে ডাক্তারকেই ডোজ ঠিক করতে হবে। তবে শিশু ও বয়স্কদের স্টেরয়েড দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলেও স্টেয়রেডে বিপদ রয়েছে। চক্ষু-চিকিৎসক অজয় পালের কথায়, “ভাইরাল কনজাংটিভাইটিসে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে শুরু করা হয়। চব্বিশ ঘণ্টায় উন্নতি না-হলে খুব কম ডোজে স্টেরয়েড। রোগীর অস্বস্তি কমে। রোগটাও তাড়াতাড়ি সারে।”

অজয়বাবুর দাবি, এটাই কনজাংটিভাইটিসের ‘স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট।’ যদিও চক্ষু-চিকিৎসকদের অন্য অংশ তা মানতে নারাজ। ওঁদের বক্তব্য: রোগ নিজের নিয়মে সারবে। স্টেরয়েড প্রয়োগ করে নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কনজাংটিভাইটিসের কোনও বয়সের রোগীকেই এঁরা স্টেরয়েড দেওয়ার পক্ষপাতী নন। রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি-র অধ্যাপক হিমাদ্রি দত্তের কথায়, “কনজাংটিভাইটিস মূলত ভাইরাল। সাধারণত কোনও ট্রিটমেন্ট নেই। আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই অন্য সংক্রমণ ঠেকাতে। সঙ্গে লুব্রিক্যান্ট ড্রপ।” ন্যাশনাল মেডিক্যালের চক্ষু বিভাগের প্রধান জ্যোতির্ময় দত্তের অভিমত, “দ্রুত আরোগ্যের তাগিদে স্টেরয়েড দিলে কর্নিয়ার ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরা প্রেসক্রাইব করি না।” চিকিৎসক অলোকেশ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, কনজাংটিভাইটিসে গরম সেঁক আর ড্রপই যথেষ্ট। “বিশেষ পরিস্থিতিতে স্টেরয়েড যদি দিতেই হয়, তখন রোগীর উপরে নিয়মিত নজরদারি একান্ত জরুরি।” বলছেন তিনি।

অর্থাৎ, মতামতের পাল্লা দু’দিকেই ভারী। চিকিৎসার পন্থা ঘিরে এই দ্বৈরথের মাঝে কনজাংটিভাইটিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নতুন চেহারায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement