খাতায় কলমে চিকিৎসকের সংখ্যা দু’শোরও বেশি। অথচ বাস্তবে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগীরা তাঁদের দেখা পান না। অভিযোগ, সপ্তাহে, দু-তিন দিন কাজ করেই হাজিরা খাতায় সব দিনের সই করছেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও তাঁরা দিনের পর দিন না আসায় আইসিইউ-ও পুরোপুরি চালু করা যায়নি বলে অভিযোগ।
রোগীদের অভিযোগ, বুধবার দুপুর হলেই মালদহ টাউন স্টেশনে কলকাতার ট্রেন ধরতে ভিড় জমান মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫০ জনের বেশি শিক্ষক চিকিৎসক। পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে একই দৃশ্য দেখা যায়। এরপর সোমবার মালদহে ফিরে হাজিরা খাতায় বাকি দিনগুলির ফাঁকা জায়গায় সই করেন শতাধিক শিক্ষক চিকিৎসক। এক বছরের বেশি সময় ধরে এ ভাবেই মালদহ মেডিক্যাল কলেজ চলছে বলে অভিযোগ।
অভিযোগ, যথেষ্ট চিকিৎসক থেকেও নিয়মিত ডিউটি না করায় জরুরি বিভাগে ডিউটির জন্য চিকিৎসক জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে। চিকিৎসকের ‘অভাবে’ চালু করা যায়নি আইসিইউ। কোনও রকমে তিনটি বেড চলছে। ফাঁকা পড়ে রয়েছে ৯টি বেড। সমস্যার কথা স্বীকার করে হাসপাতালের সুপার মহম্মদ রসিদ বলেন, “শিক্ষক চিকিৎসকেরা ঠিকমতো ডিউটি না করায় প্রচণ্ড অসুবিধার মুখে পড়তে হচ্ছে। রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষকে সব জানিয়েছি।” তবে হাজির না হয়ে কী ভাবে ওই শিক্ষক-চিকিৎসকেরা পুরো মাসের বেতন পাচ্ছেন সে সুপার কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি।
২০১২ সালে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়। বর্তমানে শিক্ষক চিকিৎসকের সংখ্যা ২১৪ জন। তবে কার্যক্ষেত্রে তাঁদের দেখা মেলেনা। সম্প্রতি হাসপাতালে গিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। তবে তাতেও পরিস্থিতির বদল হয়নি। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “আমি জানি বহু শিক্ষক চিকিৎসক দিনের পর দিন কাজে না এসে পুরো মাসের বেতন তুলছেন। আমি সমস্ত চিকিৎসকদের সর্তক করেছি। অধ্যক্ষ ও সুপারকে বলেছি যাঁরা কাজে না এসে পুরো মাসের বেতন নিচ্ছেন তাদের তালিকা করুন। যদি চিকিৎসকেরা কাজ না করে কলকাতায় বসে থাকেন তবে তাঁদের বেতন কাটা হবে।
বৃহস্পতিবার দুপুর সওয়া ১২টা নাগাদ মালদহ টাউন স্টেশনে দেখা গেল কলকাতামুখী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরতে অপেক্ষা করছেন জনা ৩৫ চিকিৎসক। টিকিট পরীক্ষকেরা জানান, প্রতি সপ্তাহেই বুধ ও বৃহস্পতিবার গড়ে ৫০-৬০ জন চিকিৎসক কলকাতা ফেরেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের টিকিট পরীক্ষক অশোক দেবের অভিযোগ, চিকিৎসকেরা সাধারণ টিকিট কেটে সংরক্ষিত কামরায় উঠে আসন দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করেন। কিন্তু কোনও চিকিৎসকই টিকিট সংরক্ষণ করে ট্রেনে ওঠেন না। মালদহ টাউন স্টেশনের চিফ রিজার্ভেশন সুপারভাইজার মনোরঞ্জন মিস্ত্রি বলেন, “চিকিৎসক উল্লেখ করে টিকিট সংরক্ষণ করলে বোঝা যাবে কে কবে যাচ্ছেন। যে কয়েকজন চিকিৎসক টিকিট সংরক্ষণ করে যাতায়াত করেন, তাঁরাও নিজেদের চিকিৎসক পরিচয় উল্লেখ করেন না।” তবে চিকিৎসকেরা অবশ্য জানান, যে ক’দিন তাঁরা হাসপাতালে থাকেন, তার মধ্যেই সব কাজ সম্পূর্ণ করে তবে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসকের কথায়, “মালদহে থাকার জন্য তো চিকিৎসকদের যথাযথ আবাসনই তৈরি হয়নি। বাধ্য হয়েই আমাদের কলকাতা যেতে হয়।”
চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির জেরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। কালিয়াচকের সাদিকুল ইসলাম বলেন, “মাসখানের আগে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আইসিইউ বাবাকে ভর্তি করাতে এসেছিলাম। কিন্তু চিকিৎসকেরা বললেন, আইসিইউতে দেখার কোন চিকিৎসক নেই। বাবাকে অন্য কোথাও নিয়ে নিয়ে যান। তা হলে মেডিক্যাল কলেজ থেকে লাভ কী?” পুরাতন মালদহের গৌতম সরকার বলেন, “আমার স্ত্রীর পা ভেঙেছিল। যে চিকিৎসক অপারেশন করলেন পরদিন তাঁকে দেখতে পাইনি। একজন জুনিয়র চিকিৎসক জানান তিনি মালদহে নেই। চারদিন পর তিনি মালদহে আসবেন। চারদিন পরেও তাঁর দেখা না পেয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে নাসিংহোমে ভর্তি করাই।” কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে বারবার জানানো হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ শৈবাল মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর বক্তব্য, “অধিকাংশ শিক্ষক চিকিৎসকেরা বেশিরভাগ সময় মালদহের বাইরে থাকেন। এই নিয়ে নতুন কথা কী বা বলার আছে? যাঁরা বাইরে থাকছেন আমার ক্ষমতা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” কেবল চিকিৎসকেরাই নয়, হাউসস্টাফদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছে তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের জেলা সভাপতি তাপস চক্রবর্তীর অভিযোগ, “মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩০ জন হাউসস্টাফ রয়েছেন। অথচ তাঁরা সপ্তাহে একদিন করে ডিউটি করছে। বাকি পাঁচদিন বেআইনিভাবে বাইরে চুটিয়ে নার্সিংহোমে ও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। কোনও নজরদারি নেই।” এ ব্যাপারে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অভিমন্যু বসু বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যা বলার অধ্যক্ষ বলবেন। একই কথা বলেছেন অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান দেবব্রত বসুও।