সতর্কবার্তা এসেছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে। তদন্তে নেমে কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে এ রাজ্যের তিন আইপিএস অফিসারের যোগসূত্রের সন্ধান পেল সিআইডি। এ ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিবের দফতরে জমা দিয়েছে তারা।
কিডনি প্রতিস্থাপন আইন অনুযায়ী, পারিবারিক সম্পর্ক নেই এমন কোনও ব্যক্তি কাউকে কিডনি দিতে পারেন না। এবং এ জন্য টাকার লেনদেনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন ঘিরে চক্রের রমরমা এ রাজ্যে দীর্ঘদিনের। দারিদ্র ও কর্মহীনতার সুযোগ নিয়ে দালালরা গ্রামবাংলার বহু মানুষকে কিডনি বিক্রি করতে রাজি করায়। তার পর প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মচারীর মদতে জাল করা হয় আবাসিক শংসাপত্র। ২০১২ সালে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের জারি করা নির্দেশ অনুসারে কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে যে শংসাপত্র একান্ত আবশ্যিক। এখানেই লেখা থাকে কিডনিদাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্কের কথা। এই শংসাপত্র ছাড়া কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল কিডনি প্রতিস্থাপন করে না।
নবান্ন সূত্রে খবর, গত ২২ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যসচিব জাভেদ ওসমানি ফ্যাক্স মারফত রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে একটি চিঠি পাঠান। তাতে বলা হয়, কিডনি প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার ভার যাদের হাতে, সেই স্থানীয় প্রশাসনিক কমিটি অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক ভাবে কাজ করছে না বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে অভিযোগ এসেছে। সেই অভিযোগের তদন্ত করতে নেমে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু বাসিন্দা পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ একটি হাসপাতালে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করাচ্ছেন। দাতারা সকলেই পশ্চিমবঙ্গের। প্রশ্ন হল, একটি রাজ্য থেকে এত কিডনি-দাতা পাওয়া যাচ্ছে কী ভাবে? আর তাঁদের সবার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের পারিবারিক সম্পর্ক থাকাটাও সন্দেহজনক।
এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তদন্তে নামে সিআইডি। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা জানান, তদন্ত প্রাথমিক স্তরে থাকলেও এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এটা বলাই যায় যে, বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও উত্তরবঙ্গে এই পাচার চক্র সক্রিয়। কলকাতার বেশ কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে সেই চক্রের যোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের তিন জন প্রথম সারির আইপিএস অফিসারের সঙ্গে এ রকমই একটি হাসপাতালের মালিকের সম্পর্ক থাকার কথা জানা গিয়েছে। কিডনি চক্রের কাজে যাতে ব্যাঘাত না-ঘটে, সে জন্য এই অফিসারেরা প্রভাব খাটাতেন বলে সিআইডি গোয়েন্দাদের ধারণা।
সিআইডি-র পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ সরকারের ফ্যাক্স-বার্তার ভিত্তিতে তদন্ত করেছেন এ রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবও। সেই বিভাগীয় তদন্তে কলকাতার লাগোয়া একটি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে দফতরের একটি সূত্রের দাবি।
কিডনি পাচার নিয়ে সিআইডি-র তদন্ত অবশ্য নতুন নয়। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কিডনি বিক্রির একটি মামলায় তদন্ত করছে তারা। সেই মামলায় কিডনি-দাতার পরিবার জোর করে কিডনি নেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছিল। তদন্ত এখনও শেষ না-হলেও এক চিকিৎসক ও একটি নার্সিংহোমের নাম ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে।
এ ছাড়া, ছত্তীসগঢ় হাইকোর্টের নির্দেশে কিডনি পাচার চক্র নিয়ে তদন্ত করছে সিবিআই-ও। দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন শহরে কিডনি-দাতাদের বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। যথেষ্ট কর্মংসস্থান না-হলে সমাজে অপরাধ বাড়ে বলে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন। গোয়েন্দাদের অনেকেই মনে করছেন, কিডনি বিক্রির রমরমাও একই কারণে। এক দিকে ১০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দাম পেয়েই কিডনি বেচে দিচ্ছেন গরিব মানুষরা। অন্য দিকে, তাকে ঘিরে গড়ে উঠছে অপরাধচক্র।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জেও দীর্ঘদিন ধরে কিডনি বিক্রির চক্র সক্রিয় থাকার কথা জানা গিয়েছে এর আগে। রায়গঞ্জে বিন্দোল পঞ্চায়েতের অধীন জালিপাড়া এলাকার ১০ জনেরও বেশি বাসিন্দা কিডনি বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ।
এই কিডনি বিক্রির ঘটনাগুলি ঘটেছে ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে। প্রশাসন সূত্রের দাবি, টাকার লোভ দেখিয়ে স্থানীয় দালালরা এ কাজ করাচ্ছে। যেমন, বিন্দোল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল রজ্জাক ১৯৯২ সালে মুম্বইয়ে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেছিল। এর পর এলাকায় ফিরে সে স্থানীয় কয়েক জনের কিডনি বিক্রি করানোর ব্যবস্থা করে। ১৯৯৬ সালে পুলিশ আব্দুল রজ্জাককে গ্রেফতার করে। বর্তমানে সে জামিনে মুক্ত।
বিন্দোল গ্রামেরই শেখ কুদ্দুস স্থানীয় কয়েক জনকে মোটা টাকার টোপ দিয়ে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কিডনি বিক্রি করিয়েছে বলে অভিযোগ। কয়েক মাস আগে শেখ কুদ্দুস ও তার দুই সহযোগীকে পুলিশ রায়গঞ্জ ও কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে।
আব্দুল রজ্জাক, কুদ্দুসের মতো দালালরা ধরা পড়লেও এই চক্রের পিছনে আরও অনেক বড় মাপের মাথা আছে বলেই গোয়েন্দাদের অভিযোগ। তাঁদের আঙুল এ বার আইপিএস অফিসারদের দিকেও। শেষ পর্যন্ত তদন্তের জল কোথায় গড়ায়, সেটাই দেখার।